Sunday, 6 February 2022

স্তব্ধ এই উপমহাদেশ!

'সঙ্গীত অনুসরণ করে লতাজীকে'

শোভনলাল চক্রবর্তী 


জীবনযুদ্ধে জয়ী মানুষ হিসেবে শুধু তাঁর নাম বলে থেমে গেলেও ভুল হবে না। এর চেয়ে বড় প্রতিকূলতাকে জয় করে, এর চেয়ে বেশি সফল হওয়া তো আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়! লতাজী'র অবস্থানে আসতে কী অসম্ভবকেই না সম্ভব করেছেন লতা মঙ্গেশকর।

বাবা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী এবং মঞ্চ অভিনেতা। নাটকের গ্রুপ ছিল তাঁর। স্ত্রী সুধামতি- চার মেয়ে লতা, মীনা, আশা, উষা আর একমাত্র ছেলে হৃদয়নাথকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু ১৯৩৪ সালে ভারতের প্রথম টকি 'আলম আরা' মুক্তি পাওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া এত ভয়াবহ হল যে ‘বলওয়ানত মানডাল’ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন দীনানাথ। হঠাৎ একরকম বেকার হয়ে পড়ায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়লেন। হতাশা ভুলতে ডুবলেন মদ্যপানে। তাতে কি আর সুদিন ফেরে!  নাটকের দল নিয়ে আজ এখানে, কাল ওখানে ঘুরে বেড়াতে হত বলে তাদের লেখাপড়া খুব ভালো করে শেখাতে পারছিলেন না। তবে গান শিখিয়েছিলেন সমস্ত আন্তরিকতা ঢেলে। বিশেষ করে বড় মেয়ে লতাকে তো তালিম দিয়েছিলেন খুব যত্ন করে। মেয়েটাকে ভালোওবাসতেন খুব। ওর নাম রাখার সময় যে কত কাণ্ড হল!

দীনানাথ নিজে ছিলেন শৌখিন জ্যোতিষী। তাই জন্মের মুহূর্তের কত কী হিসেব কষে টষে প্রথমে নাম রাখা হল হেমা। কিন্তু নিয়ম মেনে রাখলেও ওই নাম তাঁর নিজেরই বোধহয় খুব একটা পছন্দ হত না। তাই আদর করে সব সময় ডাকতেন, ‘হৃদিয়া’। পরে অবশ্য হেমা বা হৃদিয়া— কোনও নামই টেকেনি। পরিবারের অন্যদের মুখে মুখে কেন যেন ফিরতে লাগল 'লতা' নামটা; এক সময় পরিবারের বড় মেয়ের নামই হয়ে গেল লতা মঙ্গেশকার। 

১৯৩৪ থেকে হতাশা সইতে সইতে, শরীরের ওপর অত্যাচার করতে করতে দীনানাথ অবশেষে ১৯৪২ সালে সব হতাশা থেকে চিরমুক্তি পেলেন— চলে গেলেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বাবার মৃত্যুতে সমস্ত পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ল লতার কাঁধে। বয়স তখন মাত্র ১২। এ বয়সে কী করা যায়! গান ছাড়া তেমন কিছু জানাও নেই। আর শুধু গান দিয়ে খুব ভালো কিছু করারও জো নেই, কণ্ঠ তো তখন একেবারেই কচি, ফিল্ম বা অন্য কোথাও তা খুব বেশি কাজে আসবে না। বাধ্য হয়েই ছোট্ট লতা নামল অভিনয়ে। শুরুটা মারাঠি ছবি দিয়ে। বাবার মৃত্যুর অষ্টম দিনেই মেকআপ নিয়ে কিশোরীটিকে যেতে হল ‘প্যাহলি মঙ্গলাগাওর’ ছবির শুটিংয়ে। মুম্বাই চলচ্চিত্রের এক সময়ের নামকরা অভিনেত্রী নন্দার বাবা ভিনায়েক রাও-এর এ ছবিতে অবশ্য গানও গাইতে হয়েছে তাকে। সেই শুরু। জীবদ্দশায় বাবা নাকি প্রায়ই একে-ওকে বলতেন, ‘দেখো, আমার বড় মেয়ে একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।’ সেই মেয়ের প্রথম প্লেব্যাক 'কিত্তি হাসাল' নামের এক মারাঠি ছবিতে। একে একে আটটি ছবিতে অভিনয় করা হল। ১৯৪৩ সালে প্রথম হিন্দি গানও গাওয়া হয়ে গেল মারাঠি ছবি 'গজবহু'তে। তার গাওয়া ‘মাতা এক সপুত কি দুনিয়া বদল দে তু’ গানটা ভিনায়েক রাও'এর এত ভালো লাগল যে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে সাইন করিয়ে নিলেন লতাকে। বেতন ধরা হল ৬০ রুপি। 

দু' বছর পর ভিনায়েক তার ইউনিট নিয়ে চলে যান মুম্বাই। নতুন উদ্যমে শুরু হয় কাজ। ১৯৪৭ সালে প্রথম হিন্দি ছবিতে গান গাওয়া হল লতার (ছবি: আপ কি সেবা মে, গান: পা লাগু কার জোরি)। সে বছর বেতন ৬০ থেকে বেড়ে হল ৩৫০ রুপি। যেন সুসময়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। হঠাৎ মারা গেলেন ভিনায়েক রাও (১৯৪৭)। লতার মাথার ওপর যেন আবার ছাদ ধসে পড়ল! তারপরও মুষড়ে পড়েননি। মুম্বাই আসার পর বেশ কিছুদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছেন উস্তাদ আমানত আলী ভিণ্ডিবাজারওয়ালার কাছে। ভিনায়েক মারা যাওয়ার পর আমানত আলীর বন্ধু, সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু উপকার করতে গিয়ে গুলাম হায়দার পড়লেন অস্বস্তিতে। বড় আশা করে শশধর মুখার্জির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু লতার কণ্ঠ শুনে শশধর মুখার্জি বললেন, ‘একে এনেছেন কেন? এর কণ্ঠ কোনও নায়িকার সঙ্গেই মিলবে না। আর যা-ই বলুন, এই মেয়ের যা কণ্ঠ তা দিয়ে প্লেব্যাক হবে না।’ আর কেউ হলে হয়তো হতাশায় ভেঙে পড়ত। রাজকুমারী দুবে, আমীরবাঈ কর্ণাটকি, শামসাদ বেগম, নূরজাহান, জোহরাবাঈ আম্বালেওয়ালি, গীতা দত্ত বা সুরাইয়ার মতো ভারি কণ্ঠ তো তার নয়! অথচ তখন সেরকম কণ্ঠেরই জমজমাট বাজার। সে হিসেবে ১৭/১৮ বছর বয়সী একটা মেয়ের যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আর কী আশা থাকে! আশার কথাটা গুলাম হায়দারের মুখেই শুনেছিলেন লতা। ভদ্রলোক সেদিন জোর গলায় সবাইকে বলেছিলেন, ‘আমি বলছি, এই মেয়ে কিছুদিনের মধ্যে নূরজাহানকেও ম্লান করে দেবে, প্রযোজক-পরিচালকরা তখন ওর পেছনেই ছুটবে।’

সেখানেই গল্পের শেষ নয়। সেদিন গুলাম হায়দারের সঙ্গে বেরিয়েছেন লতা। গোরেগাঁও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গুলাম হায়দার শশধর মুখার্জিকে শোনানো সেই গান আবার শুনতে চাইলেন লতার কাছে। মাত্র ৯ বছর বয়সে যে মেয়ে রাগ খাম্বাবতি আর দুটো মারাঠি গান গেয়ে শোলাপুরের হাজার খানেক শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিল, তার আর যা-ই থাক-না-থাক, গানে কোনও ভয় নেই। তখন বৃষ্টি নেমেছে। ট্রেনও এসে গেছে। ট্রেনে উঠেই গান ধরলেন লতা; ট্রেনের হুইসেল, ঝিকঝিক শব্দ, যাত্রী-ফেরিওয়ালাদের চেঁচামেচি— এসবের মাঝেই। সিগারেটের টিনে তাল ঠুকতে ঠুকতে গান শুনলেন গুলাম হায়দার। মুখে কিছু বললেন না। ট্রেন থেকে নামিয়ে লতাকে সোজা নিয়ে গেলেন মালাদ-এর বোম্বে টকিজ স্টুডিয়োতে। কী আশ্চর্য, সেখানে লতা প্রশংসিত এবং 'মজবুর' ছবিতে গাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ!

হুসেইন লাল ভগতরাম, অনিল বিশ্বাস, নওশাদ এবং খেমচান্দ প্রকাশ— ভারতীয় সঙ্গীতের এমন চার দিকপালের সামনে গুনে গুনে ৩২ বার একটা গান গাইলেন, রেকর্ডিং হল তারপর। সেই যে পায়ের নিচে শক্ত একটুখানি মাটি পেলেন আর ফিরে তাকাতে হয়নি লতা মঙ্গেশকরকে। বাবার মৃতদেহের পাশেই যে ভাইটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিল তার চিকিৎসা সহ সংসারের যাবতীয় খরচ কোত্থেকে আসবে তা নিয়ে আর তেমন করে ভাবতে হয়নি কখনও। তবে ভাববেন না যে, ১৯৪৮ সালে 'মজবুর' ছবির ‘দিল মেরা তোড়া’ গানটি দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসার পর খুব সহজেই কোটি মানুষের মনে ঠাঁই করে উপমহাদেশের সঙ্গীতের অলিখিত মহারাণী হয়ে গেছেন লতা মঙ্গেশকর। বড় বন্ধুর পথ পেরিয়ে এসেছেন, এ পথে বন্ধু পেয়েছেন নিশ্চয়ই, তবে সদা-ছিদ্রান্বেষী সমালোচকও পেয়েছেন অনেক। কারণে-অকারণে সমালোচনা হয়েছে। হেমন্তের সঙ্গে একই মাইক্রোফোনে গাইতে গেলে যখন বাক্সের ওপর না দাঁড়ালে চলত না, সেই ছোট্টটি থাকার সময় থেকেই সইতে হয়েছে নানান সমালোচনা।

কণ্ঠ সমাদৃত হওয়ার পর কিছুদিন চলেছে হিন্দি আর উর্দু উচ্চারণ নিয়ে বিদ্রূপ। প্রথম সাক্ষাতে লতাকে ‘মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নতুন শিল্পী, মারাঠি মেয়ে, বেশ ভালো গায়’ এভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর দিলীপ কুমারও বলে ফেলেছিলেন, ‘ইনকা এক প্রোবলেম হোতা হ্যায়, ইনকে গানেমে ডাল-ভাতকি বু আতি হ্যায়।’ বিদ্রূপটাকে শুধু গায়ে মাখেননি, একেবারে মনে গেঁথে নিয়েছিলেন লতা। কয়েকদিনের মধ্যেই উর্দু শেখা শুরু করেন মৌলভী শফির কাছে। বাকিটা ইতিহাস। দিলীপজী প্রকাশ্যে বহুবার ‘বহেন লতা’র গানের প্রশংসা করেছেন তারপর এবং লতাও প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস, আমি কোনওদিন দিলীপজীর হয়ে কণ্ঠ দিতে পারলাম না!’ সাদা শাড়িতে মোড়ানো, আটপৌরে ভারতীয় নারীর অবয়ব নিয়ে সঙ্গীত ভুবন শাসন করে যাওয়া ভদ্রমহিলার পরিশীলিত কৌতুকবোধের পরিচয় ঠিকঠাক পেয়েছেন তো!

খ্যাতির শিখরে উঠলেও লতাজীর জীবনে দুঃখ অনেক। ছোটবেলা থেকেই কেএল সায়গলের ভক্ত। সেটা প্রথমত বাবার কারণেই। বাবা সায়গলকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, গান গাওয়ার প্রশ্ন উঠলেই বলতেন, 'সায়গলের ওই গানটা ধরত।' লতা নিজেও রেডিওতে খুব মন দিয়ে শুনতেন সায়গলের গান। বড় সাধ ছিল, একদিন বড় শিল্পী হবেন, সায়গলের পাশে দাঁড়িয়ে ডুয়েট গাইবেন। তো নিজের আয়ে প্রথম রেডিওটা কিনলেন লতা। চালিয়ে দিয়ে ভাবছেন বহুদিন পর একটু শান্তিতে বসে সায়গলজীর গান শুনবেন। একটু পরেই শুরু হল খবর। প্রথম খবর— কুন্দন লাল সায়গল আর বেঁচে নেই! সেই কষ্ট সইতে পারেননি লতা। কাঁদতে কাঁদতে ‘অপয়া’ রেডিওটাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন দোকানে। 

হতে পারে চিরকুমারী থেকে যাওয়াও বড় একটা দুঃখ। কেন বিয়ে করলেন না? জবাবে লতাজী সব সময়ই বলে থাকেন, ‘গান গাইতে গাইতে আর সংসারের কথা ভাবতে ভাবতে বিয়ে করার সময়টা পেলাম কই!’ সঙ্গীতে কম-বেশি নাম কামানো তিন বোন আশা, উষা আর মীনা এবং ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরকে এ অবধি নিয়ে আসতে গিয়ে লতাজীকে যে বলতে গেলে প্রাণাতিপাত করতে হয়েছে তাতে আর সন্দেহ কী! পরিবারের জন্য তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষার খবর তো সবাই জানেন। তবে অনেকেই যা জানেন না তা হল, নিজের বিখ্যাত সেই বাংলা গানের মতো সত্যি সত্যিই ‘প্রেম একবার এসেছিল’ এবং নীরবে নয়, জানিয়ে-শুনিয়েই এসেছিল লতাজীর জীবনে। প্রেমিক দুঙ্গারপুরের রাজপুত্র, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি, নির্বাচক রাজ সিং দুঙ্গারপুর। রাজ-পরিবার রাজ'কে সাধারণ ঘরের কোনও মেয়েকে বিয়ে করার অনুমতি দেয়নি। পরিবারের অমতে লতাকে তাই বিয়ে করেননি, তবে আজীবন ভালোবেসে গেছেন এক সময় রাজস্থানের হয়ে ৮৬টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার। এমনও হয়েছে, রাজ সিং দুঙ্গারপুর গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। পথে কোনও কাজে হয়তো থেমেছেন। গাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে খুব পরিচিত এক খালি গলার গান। মুগ্ধ, কৌতূহলী মানুষ এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘কে গান গাইছেন?’ স্বামী হতে না পারলেও, ভীরু তো নন, গর্বিত প্রেমিকের মতোই রাজ সিং দুঙ্গারপুর বলতেন, ‘তাঁকে আপনারা ভালো করেই চেনেন, তিনি আর কেউ নন, আপনাদেরই লতা মঙ্গেশকর।’  চিরবিদায় নিয়েছেন রাজ। লতাজী নিশ্চয়ই জীবনের আর সব দুঃখের মতো এ দুঃখও সয়ে চলেছেন অগোচরে!

কী পেয়েছেন, কী পাননি— এসবের হিসেব অনেক সাক্ষাৎকারেই চাওয়া হয়েছে। জবাব সব সময়ই এক এবং অভিন্ন- না পাওয়ার কোনও যন্ত্রণা, বড় কোনও আক্ষেপ তাঁর নেই। বাবা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা দেখে যেতে পারেননি, অকালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন হৃদরোগে। বড় এই দুঃখ কিছুটা লাঘব করতে লতাজী পুনেতে বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল।

জীবনে অনেক প্রতিকূলতা এসেছে, দ্বন্দ্ব হয়েছে রফি, শচীন দেব বর্মনের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও। সব ঠিকও হয়ে গেছে এক সময়। সব ঘটনাতেই চেনা গেছে সংগ্রামী, আপসহীন, পেশাদার শিল্পী লতা মঙ্গেশকরকে। মোহাম্মদ রফির সঙ্গে কোনও ব্যক্তিগত সংঘাত ছিল না। লতা চেয়েছিলেন গানের জন্য শিল্পীর শতকরা ৫০ ভাগ রয়্যালটি আদায় করে নিতে। পুরো বিষয়টিতেই ছিল সব শিল্পীর স্বার্থচিন্তা। কিন্তু সহজ-সরল, সৎ মানুষ রফি মনে করলেন, প্রযোজকের কাছ থেকে একবার টাকা নিলে গানের ওপর শিল্পীর আর কোনও অধিকার থাকে না, সুতরাং লতার পাশে থাকতে পারবেন না! ব্যস, এই ছিল দ্বন্দ্বের কারণ। 

আরেকটা বিষয় এক সময় বড় বেশি কষ্ট দিত। নিন্দুকেরা বলতেন, লতা নতুনদের বরদাস্ত করতে পারেন না, তাঁদের উন্নতির পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। প্রথম প্রথম নীরব থাকতেন। হাস্যকর কথার প্রতিবাদ করলেও তো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যায়! কিন্তু তাঁর নীরবতা নিন্দুকদের নীরব করতে পারছিল না। অবশেষে নিজেকে বঞ্চিত করেই নতুনদের জন্য সুযোগ তৈরির অনন্য নজির গড়লেন। লতা মঙ্গেশকর চিরতরে নাম প্রত্যাহার করে নিলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড থেকে।

গত প্রায় দেড় দশক ধরে লতাজী সঙ্গীত জগতে সব প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে। হিন্দি ছবিতে গান কালেভদ্রে। তবে যখন গান, সে গান হয়ে ওঠে অসাধারণ। বাকিদের সঙ্গে তফাতটা ধরতে একটুও অসুবিধে হয় না। ৮১-তে পা দিলেন, অথচ কণ্ঠ শুনে বয়স ১৮ বলেও ভ্রম হতে পারে! ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুম্বাই ছবির জগতে কী অবিশ্বাস্য কাণ্ডটাই না করে চলেছে লতাজীর কণ্ঠ। ভাবা যায়, ২০ বছর বয়সে 'মহল' ছবিতে যিনি মধুবালার জন্য গেয়েছিলেন অমর সেই গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’, ৪৪ বছর বয়সে ডিম্পল কাপাডিয়ার জন্য তিনি 'ববি' ছবিতে গাইলেন ‘হাম তুম এক কামরেমে বনধ হো’, ৬৯ বছর বয়সে একই শিল্পী 'যব পেয়ার কিসিসে হোতা হ্যায়' ছবিতে ডিম্পলের মেয়ে টুইঙ্কেল খান্নার জন্য গাইলেন ‘মদহোশ দিল কি ধড়কন’, ৭৫ বছর বয়সে 'ভীরজারা' ছবিতে প্রীতি জিনতা'র জন্য অবলীলায় গেয়ে দিলেন ‘তেরে লিয়ে হাম জিয়ে!’ এমন কণ্ঠের কী প্রশংসা হতে পারে, কী উপমা খুঁজবেন তার জন্য? কোকিলকণ্ঠী, কিন্নরকণ্ঠী— সবই তো কারও না কারও জন্য ব্যবহৃত এবং অতিব্যবহৃত। বরং লতাজী-বন্দনা শেষ করা যাক 'ভীরজারা'র পরিচালক যশ চোপড়ার কথা দিয়ে। যশ বাকি শিল্পীদের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের পার্থক্যরেখা টানতে গিয়ে বলেছেন, ‘সব শিল্পী সঙ্গীতকে অনুসরণ করে, আর সঙ্গীত অনুসরণ করে লতাকে।’ 

১৯৫৫ সাল। 'চোরি চোরি' ছবির ‘রসিক বালমা’ সেরা গানের পুরস্কার পেল। শিল্পী লতাকে বলা হল অনুষ্ঠানে গানটা গেয়ে শোনাতে। লতাজী বললেন, 'না, যেখানে শিল্পীর স্বীকৃতি নেই, সেখানে আমি গাইব না।' টনক নড়ল আয়োজকদের। ১৯৫৮ সাল থেকে প্লেব্যাক সিঙ্গারের পুরস্কারও এল 'ফিল্মফেয়ার'এ। তাঁর পেশাদারিত্ব নিয়ে কথার শেষ নেই। বিরূপ মন্তব্যও করেছেন অনেকে। রয়্যালটি নিয়ে মোহাম্মদ রফির সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর বিষয়টি তো মুম্বাই ফিল্ম ইতিহাসেরই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর বাইরেও এমন অনেক ঘটনা আছে যেগুলো তাঁর চূড়ান্ত পেশাদারিত্বেরই প্রমাণ। ১৯৬২-র একটি ঘটনা। ‘বিস সাল বাদ’ ছবির ‘ক্যাহি দ্বীপ জ্বলে ক্যাহি দিল’ গানটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। কালজয়ী সেই গান গাওয়ার সুযোগ কিন্তু লতাজী হারাতে বসেছিলেন। তখন তিনি এতটাই অসুস্থ যে ডাক্তারের মনে হয়েছিল লতাজীকে দিয়ে আর কোনওদিন গান হবে না! কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়লে কি চলে? সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত কুমার (মুখোপাধ্যায়)'কে লতাজী বললেন, ‘কয়েকটা দিন বিশ্রামের সময় দিন, গানটা ঠিকই গেয়ে দেব আমি।’ তা-ই হল। বিশ্রাম নিয়ে ফিরলেন, গাইলেন এবং জিতে নিলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড! 

২৭ বছর পরও ঘটেছিল প্রায় একই রকমের ঘটনা। চিকিৎসক তাঁকে কয়েক মাস বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। কিন্তু বিশ্রাম নিতে গেলে তো আর ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ ছবির গানগুলো যথাসময়ে গাওয়া হবে না। একবার শিডিউল পিছিয়ে দিলে কত ক্ষতি সেটা লতাজীর চেয়ে বেশি ক’জনই বা জানেন! তো অসুস্থতা নিয়েই রেকর্ডিংয়ের দিনে লতাজী একদম সময় মতো স্টুডিয়োতে হাজির। সে অবস্থায় ৫টি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন একই দিনে! 

সবাইকে অবাক করে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জিতে নিল ভারত। লতাজী তখন লন্ডনে। ফাইনালে কপিল দেব বাহিনীর অবিশ্বাস্যভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর দৃশ্য মাঠে বসে দেখেছেন। ঘনিষ্ঠরা জানেন, ক্রিকেট ভক্ত লতা মঙ্গেশকরের জন্য একটা বিশেষ আসনের বরাদ্দ রয়েছে লর্ডসে। যা হোক, ফাইনাল শেষে লতাজী নিজে কপিল দেবকে অনুরোধ করলেন সদলবলে তাঁর ফ্ল্যাটে চলে আসতে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা দাওয়াত কবুল করেছিলেন। লতাজী মজাদার অনেক খাবারের সঙ্গে নিজের রান্না করা গাজরের হালুয়াও খাইয়েছিলেন তাঁদের। চীন-ভারত যুদ্ধের সময় এক অনুষ্ঠানে ‘অ্যায় মেরি ওয়াতন কে লোগো’ গানটা শুনে জওহরলাল নেহরু অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের সুর এতটাই আচ্ছন্ন করে, আবেগে ভাসায় মনকে! অভিনেত্রী নার্গিস বলতেন, ‘লতার গানের দৃশ্যে অভিনয় করার সময় আমার গ্লিসারিন লাগে না, আপনা-আপনিই কান্না চলে আসে!’ আর সঙ্গীত পরিচালক সাজ্জাদ হুসাইন কী বলেছিলেন শুনবেন? বলেছিলেন, ‘লতা যখন গায়, মাইক্রোফোনের সামনে বসে অন্যরা তখন কাঁদে।’

১৯৯৯ সালের কথা। রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত করা হল লতাজীকে। কিন্তু শিল্পী মানুষ, চাইলেও রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দায়িত্বে কতটা আর জড়াতে পারেন! তার ওপর শরীরটাও তখন খুব একটা বশে ছিল না। ফলে, অধিবেশনে বলতে গেলে যাওয়াই হত না। কিন্তু সবাই এটা মেনে নেবেন কেন? প্রণব মুখার্জী, নাজমা হেপতুল্লাহ, এমনকি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ শাবানা আজমি পর্যন্ত বলতে লাগলেন, 'সম্মানের ভাগ নেবেন, অথচ নামকা ওয়াস্তে সদস্য থেকে অধিবেশনে আসবেনই না, এ কেমন কথা!' লতাজী স্বভাবসুলভ বিনম্রতায় শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। পরে জানা যায়, সক্রিয় সদস্যের ভূমিকা পালন করতে না পারায় লতা মঙ্গেশকর তাঁর জন্য দিল্লীতে বরাদ্দ করা সরকারি বাসভবনে কখনও ওঠেননি, সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্য বেতন ভাতা সহ কোনও আর্থিক সুবিধাও কোনওদিন নেননি! 

শিকাগোতে একক সঙ্গীতানুষ্ঠান। সেদিন আবার লতাজীর ৬৯তম জন্মদিন। স্বাভাবিক নিয়মেই কেক কাটা হল। হলে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষ সমস্বরে গাইতে লাগলেন, 'হ্যাপি বার্থডে টু লতাজী!' এরই মাঝে দূর থেকে লতা মঙ্গেশকরকে ‘পাঞ্জাবের গর্ব’ দাবি করে এক শিখ সর্দার বলে উঠলেন, 'তুসি কুড়ি পাঞ্জাবদি হো।' হলে নেমে এল পিনপতন নিস্তব্ধতা। একটু সময় নিয়েই জবাবটা দিলেন লতা মঙ্গেশকর, 'আমি পাঞ্জাবের, আমি গুজরাটের, আমি সারা ভারতের; শুধু তাই বা বলি কেন, আমি পাকিস্তানেরও!'


2 comments: