পালটা ন্যারেটিভ গড়া শুরু হয়েছে
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
'কেন প্রতিটি বড় নির্বাচনের আগে ধর্মীয়ভাবে মেরুকরণের ইস্যু সব সময়ই বাড়তে থাকে? কাকতালীয় বা সুবিধাজনক। চিন্তা করুন। শুভরাত্রি, শুভরাত্রি।' এই ট্যুইটটি করেছেন সাংবাদিক রাজদীপ দেশাই। হ্যাঁ, গত ২০-২৫ বছর দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ভোটের আগে নানা সাইজের ধর্মীয় উস্কানি চলে। কখনও কখনও তা বড় ধরনের সহিংসতার জন্ম দেয়। এ নিয়ে চর্চা না করেও বলা যায়, ধর্মকে মূল অক্ষ করে যারা রাজনীতি করে, তারা বরাবর এটা করে আসছে এবং ভবিষ্যতে করবেও।
যেমন, এখন এসেছে স্কুল-কলেজে ছাত্রীরা হিজাব পরবে কেন? যেন নতুন কিছু! এই 'সমস্যাগুলি' আমাদের উপমহাদেশের সমাজে সত্যিকার অর্থে বিদ্যমান এবং আমাদের দেশে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ভোটারদের মেরুকরণের চেষ্টা করার আগে বিজেপি তাদের তাসটা ওপেন করে। আমরা বেশির ভাগ মানুষ অধিকাংশ সময়ে এ নিয়ে মাথা ঘামাই না। এই সমস্যাগুলি সর্বদাই ছিল এবং সাধারণত চোরাস্রোত হিসাবে বিদ্যমান আছে, কেয়ার করি না। কিন্তু বিচলিত হই যখন বিজেপি এটিকে স্পটলাইটে টেনে আনে। ইতিহাস চেতনার অভাব, বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, বোঝার অভাব এবং বিপুল অজ্ঞতার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা এই 'ইস্যু'গুলিকে আশ্রয় করে। আর এভাবেই বিজেপি প্রতিদিন বিভাজন ও শাসন করে এবং তাদের শোষণ করে। আমার কথা হল, রাজদীপের মতো বর্ষীয়ান ও প্রাজ্ঞ সাংবাদিকরা কখনই মূলধারার মিডিয়াতে এই বিষয়গুলিকে তেমন করে অ্যাড্রেস করেননি। অন্যদিকে, গোদি মিডিয়া প্রথম থেকেই এগুলোকে পুঁজি করে মতাদর্শ তৈরির নামে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সাহায্য করে আসছে। আমরা যে সমাজে বাস করি, তার স্পন্দন যদি বুঝতে না পারি তবে হিজাব নিয়ে এই সমস্যার নাগাল আমরা পাব না। কিছু নীতিকথার শিকার হয়ে ক্ষতবিক্ষত হব।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি হিজাব, ঘোমটা, বোরখা বা যে কোনও পর্দার বিরোধী। পর্দাকে আমার মানবতা-বিরোধী বলেই মনে হয়। বহু উদারচেতা মানুষ এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কিন্তু রাজনীতির থেকে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখা এই উপমহাদেশে আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই ভোট এলেই শুরু হয়ে যায় নানান ফিকির।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিজাব বাতিলের দাবিতে পথে নামে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই ইসলাম বিরোধিতার তবু একটা মানে বোঝা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বিরক্তকর হচ্ছে ভদ্রবিত্তের মানুষজনরা যখন এইসব কাজকে যুক্তিগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেন। সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদ চেনা যায়। সমস্যা হয় তথাকথিত প্রগতিশীল ছুপা হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে। সম্প্রীতির শত্রু হিসেবে তাঁরা অনেক বেশি বিপজ্জনক। এদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইসলামফোবিয়া সব সময় সক্রিয়। নইলে শাঁখা-পলা-সিঁদুর-পৈতেও তো সামন্ততান্ত্রিক ধর্মীয় শৃঙ্খল। সেগুলোর বিরোধিতা করেন না কেন? আসলে সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবলে দেখবেন, সংখ্যাগুরুর কোনও কিছুতেই এঁদের তেমন করে আপত্তি থাকে না। এঁরা বেশ গলা তুলে বলেন, স্কুল-কলেজে কেন বোরখা পরে যাবে। ওরা ওদের ব্যক্তিগত পরিসরে হিজাব নিয়ে থাকুক। এই একচোখো বিজ্ঞরা কিন্তু একবারও বলেন না, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কেন একটি বিশেষ ধর্মের বসন অঙ্গে ধারণ করে সাংবিধানিক পদে বসে সব সরকারি কাজ করেন? এই বাস্তুঘুঘুরা একবারও তো বলেন না, প্রধানমন্ত্রী কেন সরকারি অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ ধর্মের পোশাক গায়ে চড়িয়ে হাজির হন। এই তো সরস্বতী পুজোর দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হায়দরাবাদে 'স্ট্যাচু অফ ইকোয়ালিটি'র আবরণ উন্মোচন করতে গিয়ে ধর্মীয় পোশাকে আনখশির মুড়ে সরকারি অনুষ্ঠান করলেন। তার বেলা!
আসলে, সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় পোশাক পরে মাথা ঢেকে ঘুরলে দোষ নেই, নজর যত হিজাবে! বাংলা কথা, আজ যা হচ্ছে, যে ভাবে কর্নাটকে হিংস্র ইভটিজিং হল, এর জন্য প্রধানত দায়ী হিন্দু লেফট লিবারাল মধ্যবিত্ত। এতই যদি দম থাকে তবে শাঁখা-পলা-সিঁদুর পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি কার্যালয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন করে দেখাক। তারপর হিজাব, বোরখা, ফুঃ খারাপ কি না, সেই ডিসকোর্স করা যাবে। এই তথাকথিত লিবারালরা ভুলে যান, কোনও একপক্ষ নিয়ে বক্কাবাজি করলে জিতে যায় মৌলবাদ, জিতে যায় বোরখা, জিতে যায় ঘোমটা-সহ সবরকম পর্দা প্রথা। আর চাপা পড়ে যায় এর মধ্যে গেঁথে থাকা রাজনীতিটা।
পুঁজির প্রাথমিক বিকাশের কালে সমুদ্র অভিযানের নামে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন চার্চের প্রতিনিধিরা। শুরু করেছিল ধর্মের প্রচার। পিছন পিছন এসেছিল পুঁজিতন্ত্রের প্রতিভূরা ও তাদের রাজনীতি। তাই হিজাব নিয়ে কর্নাটকের ঘটমান বর্তমানকে রাজনীতির বাইরে আমি দেখতে নারাজ। দক্ষিণের এই রাজ্যে পুরভোটে কংগ্রেসের কাছে একেবারে গোহারান হারার পরেই বিজেপি বুঝে গিয়েছিল, ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে জরুরি একটা মেরুকরণ। চাই একটা হিন্দু-মুসলিম তর্ক। তাই ঘোমটার দেশে নামানো হয়েছে হিজাব বিতর্ক। ৫ রাজ্যে ভোটে এই মেরুকরণ কতটা কাজ করবে তার হিসেব বোধহয় গৈরিক শিবির করে নিয়েছে। তবে সেই হিসেব কতটা মিলবে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে। মেরুকরণের খেলা খেলতে খেলতে তিন-তিনবার দিল্লির মসনদ দখল করতে পেরেছে বলে বিজেপি নেতৃত্ব ভাবছে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোকে ময়দানে নামিয়ে দিলে আড়াআড়ি মেরুকরণ সম্ভব হবে। তবে সবদিক থেকে দেখে মনে হচ্ছে এবার হিসেবটা সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়নি।
মুশকান নামে ওই ইসলামি ছাত্রীকে ঘিরে ধরে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দেওয়ার ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে। যদি ওই বীরপুঙ্গবরা ভেবে থাকে শুধু ইসলামিরাই ওই ভিডিও দেখেছে, তাহলে বলব তারা ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানে না বহুত্ববাদ। এখনও ভারতীয় সেই আত্মাকে চেনে না, যা লালিত হয়েছে ভক্তি আন্দোলনের জাইলেম-ফ্লোয়েমে গত হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। তাদের জানিয়ে রাখি, ওই ভিডিওটা দেখেছেন সব শ্রেণির, সব বয়সের মহিলারা। দেখেছেন এবং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন আসলে বিজেপি মহিলাদের কী চোখে দেখে। জানা যাচ্ছে, এক মহিলা কী পোশাক পরে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, সেটা কিছু রাস্তার গুণ্ডা ঠিক করে দেবে! একজন মহিলা হিজাব পরবে না জিনস পরবে, কুর্তা-পাজামা পরবে না হট প্যান্ট পরবে, তা ঠিক করে দেবে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান তোলা বিজেপির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী!
২০২২'এর এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তাহলে বিজেপির এটাই বীজমন্ত্র! এটাই আরএসএস'এর পুরুষতন্ত্র, যা বিজেপি অনুসরণ করে। গোটা পৃথিবীর কাছে এই বার্তাই পাঠাচ্ছে বিজেপি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঘৃণা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। ধর্মের নামে হাজার হাজার বছর ধরে নির্মাণ করা ঘৃণা বা দ্বেষের একটা কাউন্টার-হেজিমনি তৈরি হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। মুশকানকে উত্যক্ত করা ভাইরাল ভিডিওটি কিন্তু সেই কাউন্টার-ঘৃণা বা দ্বেষ তৈরি করছে, যা বর্ষাবে পুরুষোত্তম রামের নামে জয়ধ্বনি করা এই লুম্পেন সংস্কৃতির ওপরে। মুশকান দেখিয়ে দিয়েছে ভারত নামক দেশটি কোনও বিশেষ একটি ধর্মের দেশ নয়, এই দেশে সবার সমান অধিকার। তোমাকে সালাম মুশকান। ধর্মের রাজনীতির হাত ধরেই পালটা ন্যারেটিভ গড়া শুরু হয়েছে। তাই নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই ট্যুইট করেছেন, ‘হিজাব পরে মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা ভয়ঙ্কর ঘটনা।’ এরপরই ভারতের রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা, ‘মুসলিম মহিলাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা এবার বন্ধ করুন আপনারা।’
কী বলবেন কর্নাটকের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই? কী বলেন প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? আসলে কিছু বলার নেই। কেননা, একুশে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের সময় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'দিদিই...ও দিদিইইই' করে যে অশ্লীলতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন, তার পরে আর তাঁদের বানরসেনাকে দমন করার কোনও ক্ষমতাই নেই। তবে স্মরণ করিয়ে দিই, এগারো মাস আগে বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অসম্মান করার জবাব ইভিএমে ট্রানস্লেটেড হয়েছে। সেই যে মুখ লুকিয়ে পালিয়েছেন মোশারা, আর বাংলায় ভিড়তে পারছেন না। এবার মুশকানকে হেনস্থা ও অপমান করেও রেহাই পাবেন না মোদীর ভক্তের দল। পুরুষোত্তম রামের নামে 'জয় শ্রীরাম'এর মতো পবিত্র শব্দবন্ধ মেয়েদের উত্যক্ত করার হাতিয়ার হয়ে গেলে সীতারা দলবদ্ধভাবে জবাব দেবেন ইভিএমে।
সীতা রামের হাতেই লাঞ্চিত তারপরও জয় শ্রীরাম পবিত্র শব্দবন্ধ? সাহস থাকলে সরাসরি ধর্মের বিরোধিতা করুন যদি সত্যিই বিজেপিকে হারাতে চান।
ReplyDeleteএকদম ঠিক বলেছেন। সংখ্যালঘুদের সব কিছুই ঘৃণ্য আর সংখ্যাগুরুর সব কিছুই পূজ্য। এ জিনিস সভ্য মানুষ মানতে পারেনা। কর্ণাটকে ছাত্র সংগঠন ডি এস ও পথে নেমে আওয়াজ তুলেছে এই নষ্টামির বিরুদ্ধে
ReplyDelete