'জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না...'
সোমনাথ গুহ
চারটি পুরসভার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সবুজ ঝড়ে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি বিধ্বস্ত। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল প্রত্যাশা জাগিয়ে তারপর মুখ থুবড়ে পড়ার পর বিজেপির অবস্থা এখন রীতিমতো শোচনীয়। নিশ্চিত জয়ের লোভে যে সব নেতা-কর্মীরা পিলপিল করে দলে এসে ভিড়ে ছিল, তারা আবার পুরনো দলে ফিরে গেছে। নেতাদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি ও প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে দলটির অবস্থা এখন রীতিমতো ছন্নছাড়া। বাম ও কংগ্রেস পূর্বাবস্থাতেই আছে, এই দশ মাসে তাদের কাজকর্মে কোনও বিশেষ উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। বিপুল জনাদেশ নিয়ে পুনরায় তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে জনদরদি হয়ে উঠেছে এমনটাও নয়। বরং, বারবার গণআন্দোলনের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, আন্দোলনের কর্মীদের পুলিশ নৃশংস ভাবে আক্রমণ করেছে, কিন্তু বিরোধীদের দিশাহীনতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা এবং অতিমারি জনিত বিধিনিষেধের কারণে নানা ইস্যু থাকা সত্ত্বেও সেগুলো নিয়ে শাসক-বিরোধী কোনও বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। কোনও শক্তিশালী বিকল্পের অভাবে এই পুর নির্বাচনে তৃণমূলের জয় নিশ্চিতই ছিল, প্রশ্নটা ছিল জয়ের ব্যবধান কতটা হবে।
ফলাফল বেরনোর পর বোঝা গেল যে সবুজ ঝড় নয়, চারটি পুরসভায় সবুজ সুনামি বয়ে গেছে। চন্দননগরে ৩২টি আসনের মধ্যে বিরোধী দল (সিপিএম) মাত্র একটি আসন পেয়েছে। শিলিগুড়ির ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে ৪৭টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ৩৭টি, বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস যথাক্রমে পেয়েছে ৫, ৪ ও ১টি আসন। এই পুরসভা বাম-কংগ্রেসের দখলে ছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ, গত বিধানসভা ভোটে শিলিগুড়ি আসনে বিজেপির শঙ্কর ঘোষ ৩৫,৫৮৬ ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। তিনি শহরের ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৭টিতে এগিয়ে ছিলেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি এই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, যদিও সামান্য ব্যবধানে। বিজেপির এই উলটপুরাণ বিস্ময়কর।
শিলিগুড়ির ভোটপর্বের পর কিন্তু বিজেপি ও সিপিএম উভয়েই বিবৃতি দিয়েছিল যে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অশোক ভট্টাচার্য আক্ষেপ করেছেন, বিজেপি থেকে যে ভোটটা তাঁদের দিকে ফিরে আসবে ভেবেছিলেন সেটা তৃণমূলের বাক্সে চলে গেছে; বিজেপির এক নেতা স্বীকার করেছেন যে রাজ্য সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পগুলির তাঁরা মোকাবিলা করতে পারেননি। সুতরাং, ভোটে কারচুপি হয়ে থাকলেও তা সামান্যই হয়েছে। তাহলে বিজেপির এই ভরাডুবি কেন? সকলের মনে আছে নিশ্চয়ই যে বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের দু-তিন মাস পরেই বিজেপির দুই সাংসদ জন বার্লা এবং নিশীথ প্রামাণিক উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার দাবিতে সরব হয়েছিলেন। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বিজেপি সেই দাবিকে সমর্থন করেনি, কিন্তু উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত- এই ধুয়ো তুলে তা সরাসরি নাকচও করেনি। এটা পরিষ্কার যে, উত্তরবাংলার মানুষ এই দাবিকে ভালো ভাবে নেননি; বিজেপিকে প্রত্যাখান করে তাঁরা তাঁদের মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বিধাননগর ও আসানসোলের গল্প কিন্তু অন্য। বিজেপি দুটি পুরসভাতেই পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছে। সিপিএম বহু ওয়ার্ডে একই দাবি করেছে। উভয় দলেরই অভিমত, দুটি পুরসভাতেই ব্যাপক কারচুপি, ছাপ্পা ভোট, জোরজুলুম হয়েছে; মোটমাট ভোট লুঠ হয়েছে। বিধাননগরে বিজেপি ও সিপিএম কোনও আসন পায়নি। ৪১টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ও নির্দল একটি করে আসন পেয়েছে। আসানসোলে তৃণমূল ১০৬টি আসনের মধ্যে ৯১টি পেয়েছে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস এবং অন্যান্যরা যথাক্রমে ৭, ২, ৩ ও ৩টি করে আসন পেয়েছে।
শাসক দলের এই বিপুল জয়ের কারণ কি শুধুই ভোট লুঠ ও সন্ত্রাস? এটা আজ মেনে নেওয়ার দরকার আছে যে, গত দু' বছরে শাসক দল একের পর এক যে সব জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছে তা জনগণকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। বহু মানুষ, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ দরিদ্র ও প্রান্তিক, তাঁরা এইসব প্রকল্প দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। বিরোধী দলগুলি এই প্রকল্পগুলিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সেগুলিকে দান-খয়রাতির রাজনীতি বলে কটাক্ষ করেছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে অলক্ষ্মীর ভাণ্ডার বলে ব্যঙ্গ করেছে, যা মানুষকে তাদের প্রতি আরও বিরূপ করে তুলেছে।
ঘটনা হচ্ছে, এই প্রকল্পগুলির প্রভাবের কারণে তৃণমূলের জয় এমনিতেই নিশ্চিত ছিল, হয়তো তারা দশটা আসন কম পেত কিংবা বিভিন্ন আসনে জয়ের ব্যবধান কম হত। তাতে তো তাদের এই জয় কালিমালিপ্ত হত না, তাদের ভাবমূর্তি আরও পরিচ্ছন্ন হত। গা-জোয়ারি নির্বাচন করার ফল যে কী হতে পারে সে অভিজ্ঞতা তো বাংলার শাসক দলের রয়েছে। বিরোধী-শূন্য পঞ্চায়েত করার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বিপুল সংখ্যক বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন পেশ করতে দেওয়া হয়নি। এর পরিণামে বাম ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপিতে শিফট করে গিয়েছিল, যার ফলস্বরূপ বিজেপি ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন জিতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল; দীর্ঘ দেড় বছর শাসকের মসনদ টলমল হয়ে গিয়েছিল। তৃণমূল কি সেই অভিজ্ঞতা থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি?
আগামী ২৭ তারিখ তো আরও ১০৮টি পুরসভায় ভোট। সেখানেও তো জোরজুলুম, বিরোধী প্রার্থীকে চমকানো ধমকানো চলছে। ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪টি পুরসভা শাসক দল কব্জা করে নিয়েছে-দিনহাটা, বজবজ, সাঁইথিয়া, সিউড়ি। শোনা যাচ্ছে বোলপুরে বিজেপি কোনও প্রার্থীই দিতে পারেনি; কয়েকটি ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী রয়েছে, তাঁরাও ভোটের দিন অবধি টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। বোঝাই যাচ্ছে, বীরভূম জেলায় চার বছর আগের মতো উন্নয়ন এখনও খড়্গ হাতে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাননীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সেই চিরাচরিত যুক্তি দিচ্ছেন- বিরোধী দল যদি প্রার্থী না দিতে পারে তাতে আমরা কী করব! এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য! যে দলের ১৮টি সাংসদ রয়েছে তারা পুরসভায় প্রার্থীই দিতে পারছে না; যে দল ব্রিগেডে বড় সভা করতে পারে তারা প্রার্থী দিতে পারছে না।
এবার কিন্তু তৃণমূল দলের ভিতর থেকেই এর বিরোধিতা হচ্ছে। তরুণ নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য বলেছেন যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ ব্যাপারটা মানুষ ভালো ভাবে নেয় না। ২০১৮ সালে এটা করার ফলে পরিণাম যে ভালো হয়নি সেটা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমনও বলেছেন যে বিরোধী দলগুলি যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করার দাবি করে তাহলে সেটা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত, কারণ, তাহলে কেউ আমাদের দিকে আঙুল তুলে দায়ী করতে পারবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, নেতৃত্ব তাঁর এই বিবৃতিকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। দেবাংশুর বক্তব্য কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এটা অশনি সংকেত হলেও হতে পারে। দলের তরুণ অংশ ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ দাবি তুলছে, দলের ওয়েবসাইটে দলনেত্রীর অনুমোদন ছাড়াই অন্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব কীসের ইঙ্গিত? দলে কি দ্বিতীয় কোনও ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে উঠছে? যাই হোক সেটা অন্য গল্প।
বিভিন্ন পার্টিতে এখন একটা অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব কাজ করছে! বিজেপি কেন্দ্রে কংগ্রেস-মুক্ত ভারত চাইছে, তৃণমূল এখানে বিরোধী-মুক্ত বাংলা চাইছে। এটা একটা ভয়, আতঙ্ক- এই বুঝি আমার ক্ষমতা চলে গেল। এছাড়া এখানে পয়সার গল্প আছে। একটা পুরসভায় একচ্ছত্র আধিপত্য থাকা মানে প্রচুর সরকারি অনুদান আমার ঝুলিতে চলে এল। এই যে লাখো বেকার যুবক অহোরাত্রি খাটছে, বুথ জ্যাম করছে, ছাপ্পা মারছে, বিরোধীদের মারধোর করছে, অপহরণ করছে, বাড়ি গিয়ে চমকাচ্ছে- এঁদের হাতে রাখার জন্য পয়সা খরচ আছে না, সেটা আসবে কোথা থেকে! এর জন্যই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাই; পরের নির্বাচনে কী হবে তা পরে ভাবা যাবে।
খুব যথাৎথ বিশ্লেষন।
ReplyDelete