Wednesday, 23 February 2022

আনিস হত্যা ও তারপর

ছাত্র আন্দোলন পথ দেখাবে?

শান্তনু ভট্টাচার্য

 

১৮ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তরতাজা যুবক আনিস খানের নির্মম হত্যার পর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল ঘটনাবহুল। ওই দিন বেলা ১২'টায় হাওড়ার পানিয়ারায় হাওড়া গ্রামীণ এলাকার এসপি'র কাছে ডেপুটেশন দিতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েকশো ছাত্র, অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী, সামাজিক আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্ট ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কর্মীরা। আনিস হত্যার তদন্ত ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে ডেপুটেশন চলাকালীন এসপি'র ঘরে 'এবিপি আনন্দ'এর সম্প্রচার চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী ওই লাইভ সম্প্রচারে জানালেন, 'আনিসের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর তদন্তে আমরা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম তৈরি করছি। তদন্তে চিন্হিত দোষী ব্যক্তি, তিনি যেই হোন না কেন, কাউকে রেয়াত করা হবে না। আমরা নিরপেক্ষ ভাবে এই তদন্ত করব। আনিস আমাদেরই ফেভারিট, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।' এই সম্প্রচারের পর এসপি সাহেবের আলাদা ভাবে কিছু বলার ছিল না। ডেপুটেশন শেষ, কিন্তু কর্মসূচি জারি থাকল। 

একই দিনে কলকাতায় বেলা ৪'টের সময় 'স্টুডেন্টস এগেন্স্ট ফ্যাসিজম'এর তরফে আয়োজিত নাগরিক মিছিলে বিভিন্ন পেশার মানুষ সমবেত হন। মিছিলের কলেবর ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। পোস্টার, ফ্লেক্সে সুসজ্জিত মিছিলের একটাই আহ্বান- 'জাস্টিস ফর আনিস খান।' লেনিন মূর্তির পাদদেশ থেকে শুরু হওয়া ওই মিছিল শেষ হয় মহাজাতি সদনে সংক্ষিপ্ত সভার মধ্যে দিয়ে। 
 
পাশাপাশি, পার্ক সার্কাসে আলিয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শনিবার থেকেই লাগাতার ধর্না, বিক্ষোভ চলছে। ছাত্রদের উচ্চকিত জিজ্ঞাসা- কেন ৭২-ঘন্টা পরেও আনিস হত্যাকারীরা অধরা! এর দায় তো পুলিশমন্ত্রীর উপরেই বর্তায়। অনুরূপ দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের আঁতুড়ঘর প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার থেকেই চলেছে লাগাতার পথসভা, পথ অবরোধের কর্মসূচি।

এবার গন্তব্য আরও ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে আমতা থানার সারদা গ্রামের খানপুর, যেখানে আনিসের বাড়িকে এক গভীর  শূন্যতা গ্রাস করেছে। সারদা গ্রামে আনিসের বাড়ির চারপাশে  লোকে লোকারণ্য। সংবাদমাধ্যমের ভিড়। একজন জানালেন, ওই সাংবাদিকদের লাগাতার পুলিশি জেরার মতো প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বাড়ির লোকেরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে আছে শাকের আঁটির মতো ক্যামেরা মোবাইলের লাগাতার ফ্ল্যাশ। ভিড়ের মধ্যে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কয়েকজনকে দেখা গেল। ওই দিন সকালে এসএফআই ও ডিওয়াইএফআই'এর আমতা থানা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ছিল। গার্ড রেল ছুঁড়ে ফেলে, বাঁশের ব্যারিকেড ভেঙে বেশ কিছুক্ষণ চলে ওই বিক্ষোভ। তার জেরেই হয়তো ওই পুলিশ বাহিনীর গ্রামে আসা। 
 
ইতিমধ্যেই ওই বাড়িতে এসেছিলেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী পুলক রায়, সঙ্গে জনৈক কৌস্তুভ রায়। পুলক রায় এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ বার্তাবাহক হিসেবে। তিনি আনিসের পিতা সালেম খানের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলে বাইরে এসে জানান মুখ্যমন্ত্রী সালেম খানকে নবান্নে যেতে বলেছেন। আমি তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছি। পরিবারের সকলের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত সালেম খান নবান্নে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফেরার পথে পুলক রায়কে গ্রামের মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। উল্লিখিত কৌস্তুভ রায় আগের দিন সালেম খানের কাছে এক বা একাধিক চাকরির প্রস্তাব দেন। পরিবার থেকে তাঁকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় যে আনিস হত্যার নিরপেক্ষ বিচার ও খুনিদের যথাযোগ্য শাস্তি ছাড়া তাঁরা আর কিছুই চান না। 
 
কিছুটা দেরিতে হলেও আনিসের মোবাইল ফোনের সন্ধান পান সালেম খানের পরিবারের লোকজন। তবে তা হাতছাড়া করতে নারাজ আনিসের বড় ভাই। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান যে পুলিশের উপর তাঁর কোনও আস্থা নেই। হয়তো ওই মোবাইল ঘেঁটে, তথ্য বিকৃত করে আনিসকে অন্য কোনও কেসে ফাঁসিয়ে দেবে পুলিশ। এর মধ্যেই তার চরিত্রে কালিমা লেপন করার চেষ্টা চলছে পুলিশের দিক থেকে। যদি হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, অথবা সিবিআই তদন্ত করতে আসে, তবেই ওই মোবাইল তাদের হাতে জমা দেওয়া হবে। 'আনিস আমাদেরই লোক' টিভি চ্যানেলে প্রচারিত মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য সরাসরি খারিজ করে দেন আনিসের বড় ভাই। আইএসএফ বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকী বলেন, আনিস তাঁদের সেকুলার ফ্রন্টেরই সদস্য ছিলেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে তিনি জোটের কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচার করেন।
 
এই হত্যাকাণ্ডে তৃণমূল যোগাযোগের অভিযোগটা উঠল কেন? ঘটনা হল, ২০২১ সালের ২২ মে আনিসের উদ্যোগে এলাকায় একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয় যা স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং গা-জোয়ারিতে বানচাল হয়ে যায়। আনিসকে অপদস্থ করা এবং প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। আনিসের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল যে তার জন্যেই নাকি ওই অঞ্চলে তৃণমূল প্রার্থী তুলনামূলকভাবে কম ভোট পেয়েছেন। পারিপার্শ্বিক এইসব রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কথা মাথায় রেখে আনিস পুলিশ প্রশাসনের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখেন এবং  ওই চিঠিতে কয়েকজন তৃণমূলের নেতার নাম উল্লেখ করেন যাদের কাছ থেকে তিনি বিপদের আশঙ্কা করছেন। ফলে, তাঁকে বাড়িছাড়া হয়ে থাকতে হয় বেশ কিছু দিন। যথারীতি পুলিশের কাছে ওই চিঠি কোনও গুরুত্ব পায়নি। শনিবারই ছাত্রদের তরফে দাবি উঠেছিল আনিসের ওই চিঠিকেই এফআইআর হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করুক পুলিশ। রবিবার সংবাদপত্রে একটা ছোট খবর প্রকাশিত হলে জানা গেল যে ওই গ্রামের তৃণমূলের মাথারা সবাই গা ঢাকা দিয়েছে।
 
২১ ফেব্রুয়ারি সোনারপুরের এক যুবক তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখলেন, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে হাওড়া গ্রামীণ এলাকার এসপি সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারবেন না, কারণ, সোনারপুরের তৃণমূল বিধায়িকা সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী। এই পোস্টের জন্যে সেই যুবককে সোনারপুর থানার ওসি তুলে নিয়ে যান আর জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখেন। পরে বিক্ষোভের মুখে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পর পর বেশ কিছু পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন থানার বিরুদ্ধে, যেগুলো সবই সাধারণের 'ভিন্ন মতের' সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করছে, যা গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়। 
    
২২ ফেব্রুয়ারি সারদা গ্রামে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো সিট তার কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই আমতা থানার  নিচুতলার পুলিশকর্মীদের তিনজনকে সাসপেন্ড করা হয়। আনিসের পরিবার ও গ্রামবাসীরা সিবিআই তদন্তের কথা বলে আসছেন গত শনিবার থেকে। তাঁদের মূল অভিযোগটাই ছিল আমতা থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। ঘটনা হল, গভীর রাতে পুলিশের পোশাকে চারজন দুষ্কৃতী পেশাদারি কায়দায় আনিসকে খুন করে চলে যাওয়ার পর থানায় খবর দেওয়া সত্ত্বেও আনিসের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকে শনিবার বেলা ৯'টা পর্যন্ত। পরিবারের অজান্তে বেআইনি ভাবে পুলিশি অতি সক্রিয়তায় ময়না তদন্ত করে জানানো হয় যে আনিসের পাকস্থলীতে অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছে। তাই পরিবারের আশঙ্কা, একটা নির্মম খুনের ঘটনা হয়তো পুলিশের লেখা চিত্রনাট্যে নিছক আত্মহত্যার গল্পে পরিণত হবে।  শুক্রবারের ওই ঘটনার পর এক ধরনের ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন আনিসের পরিবার। তদন্তে সিট'কেও কোনও সহযোগিতা করবেন না বলে জানাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। 

২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পার্ক সার্কাস থেকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মহাকরণ অভিযানের ডাক দেন। পুলিশ এই অভিযানের সক্রিয় বিরোধিতা করে। শিয়ালদহ, মৌলালি, কলেজ স্ট্রিট সর্বত্রই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে টিয়ার-গ্যাস শেল, জলকামান ইত্যাদি মজুত ছিল। কিন্তু পুলিশ অন্যান্য দিনের তুলনায় সংযত ছিল। মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা পুরোটাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।  বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আনুমানিক ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে লালবাজার থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর, পার্ক সার্কাসে নিয়মিত অবরোধ চলছে, আন্দোলনের ঢল নামছে সর্বত্র। শোনা যাচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট ও পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে পুনরায় আনিসের ময়না তদন্ত হবে।
 
আনিস হত্যা ও উত্তাল ছাত্রসমাজ সম্ভবত এ রাজ্যে এক নতুন পথের দিশা দেখাতে চাইছে। আমাদের সম্মুখ পানে তাকিয়ে থাকার সময় এখন।

Tuesday, 22 February 2022

শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রা?

প্রাথমিক শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ!

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

 


সারা দেশে হৈ চৈ পড়ে গেছে- এই রাজ্যের মা-মাটি-মানুষের সরকার নাকি প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রটিকে তুলে দিচ্ছে বেসরকারি হাতে। গেল গেল রবও উঠেছে। যদিও এক বড়সড় পদাধিকারী আমলা বলেছেন যে অভিযোগটি সত্য নয়, স্বাক্ষরহীন তারিখবিহীন এমন আদেশনামা (যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে) সরকারি আদেশনামা হতেই পারে না। তিনি ঠিকই বলেছেন, তবে খসড়া তো এমনই হয়, নাকি? খসড়ার বাজার বা ক্রিকেটিয় ভাষায় 'পিচ পরিদর্শন' বলব নাকি? আমার এক বন্ধু জানিয়েছে, এমন উদ্যোগ দেশে নতুন নয়; সে বলেছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক সরকার নাকি ইতোমধ্যে এমন অবিশ্বাস্য ব্যবস্থা নিয়েছে। কেন বলছি অবিশ্বাস্য?

এই কারণে তা অবিশ্বাস্য যে, এমন কিছু করার অর্থ শিক্ষা অধিকার আইনের পরিপন্থী। সে আইন মতো ৬-১৪ বয়সগুচ্ছের সকলের জন্য শিক্ষা মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা করে দিতে বাধ্য। সে কথা তো আজকের নয়। সংবিধানের Directive Principle'এ তেমন দায়িত্বের কথা বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রও মেনেছিল বা মানতে বাধ্য হয়েছিল, তবে তা মৌলিক অধিকার বলে গণ্য হয়নি, এই যা। গণ্য হল এই সেদিন আদালতের গুঁতোয়। সরকার মানল, তবে কৌশলে তারা বয়সটা বদলে করল ৬-১৪, যা আগে ছিল ০-৬। তা শিশু যে, তার বয়স হোক ০ বা ৬, সে কী বোঝে শিক্ষার, সে চায় তার খেলার সংসারে থাকতে।

এমন শিশুকে শিক্ষা দিতেই হবে? তার শিক্ষার আয়োজন করতে হবে সরকারি বিদ্যালয়েই? বেসরকারি বিদ্যালয়ে তেমন ব্যবস্থা করা যাবে না এমন কথা তো আইনে বলা নেই। কেউ বলতেই পারেন, আইনে তো অনেক কথাই বলা থাকে না। তাতে কী? ও নিয়ে তর্ক থাক (আমি যে আইন বুঝি না)। মূল প্রশ্ন- বেসরকারি ব্যবস্থা কি পারবে তেমন আয়োজন করতে, এমন আয়োজন যাতে প্রতিটি শিশু পাবে নিখরচায় সুশিক্ষা?   

একটা গল্প বলি। গল্প হলেও সত্যি গোছের নয়, এ এক প্রকৃত ঘটনা-নির্ভর গল্প। আমার অভিজ্ঞতা। সেবার শিশু অধিকার আয়োগের শীর্ষ পদে থাকার সুবাদে বারাসাতে গিয়েছি ওই জেলার শিক্ষার হাল বুঝতে। জেলার পরিদর্শক মহাশয়কে প্রশ্ন করি, বেসরকারি স্কুল ব্যবস্থায় ১৫ শতাংশ ছাত্র ভর্তি হতে পারে সরকারি বিধি মেনে, জানেন? ঘাড় নাড়লেন– তিনি জানেন। কিন্তু তিনি জানেন না এর সুযোগ কোনও দরিদ্র পরিবারের সন্তান পেয়েছে কিনা! তিনি দুঁদে রাজনীতিবিদদের মতো উল্টে আমাকেই বললেন, 'কেউ না চাইলে আমি কী করতে পারি?'  

আমি তো রাজনীতির লোক নই, আমাকে মানতেই হল! যদিও বললাম, লোকে না জানলে আর চাইবে কেমন করে? লোককে জানান।

- সে দায়িত্ব আমার না।

সে দায়িত্ব যে কার তা বোঝা গেল না। যেমন বোঝা যায় না, কেন প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সরকার জাতীয় গড় উৎপাদনের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করে না। একজন আমাকে বোঝাতে বসলেন। তিনি বললেন, কেউ চায় নাকি? বহুদিন আগে পড়া ছিল টলস্টয়, জানতাম রাষ্ট্র চায় না সুশিক্ষা পাক সকলে, কিন্তু রাষ্ট্র সকলের শিক্ষার দায়ও অস্বীকার করে না।

-                   - তা হলে শিশুরা যে শিক্ষা পাচ্ছে তা সুশিক্ষা নয়?

তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন জন গলব্রেথের কথা। স্পষ্ট হল শিক্ষার উদ্দেশ্য। তা যে নিছক ব্রান্ড রেকগনিশন নয়, আরও কিছু, আরও অনেক কিছু। কিছুটা স্পষ্ট হল। রাষ্ট্র চায় না সুশিক্ষা পাক সকলে, কিন্তু রাষ্ট্র সকলের শিক্ষার দায়ও অস্বীকার করে না! কথাটা আরও স্পষ্ট বোঝা যায় যখন দেখি দেশ জুড়ে অশিক্ষিতদের ভীড়।

আর নিখরচার শিক্ষা? পাগল হয়েছেন? তিনি বললেন। আরও বললেন, রঙ্গনাথ মিশ্রের হতাশার কথা (গত শতাব্দীর শেষ দশকে মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি সব রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন করেছিলেন যেন তারা তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে বলে যে তারা শিক্ষাখাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ চায়; কোনও দল রাজি হয়নি)। তবে যে ওরা মাঠে-ময়দানে বক্তৃতায় ৬ শতাংশ বরাদ্দ দাবি করে? মাঠে-ময়দানে! সংসদের ভেতরে কাউকে কখনও এমন দাবি তুলতে শুনেছেন? শোনেননি? শুনবেনও না। শিক্ষাখাতে বাড়তি খরচ মানে তো অন্য খাতে খরচ কমানো। এমন কথা বললে উন্নয়ন বা দেশপ্রেমে ঘাটতি আছে বলে মনে হতে পারে।

একবার তো সদ্যপ্রয়াত সাংসদ রাহুল বাজাজ বলেছিলেন যে যেহেতু তাঁরাই শিক্ষান্তে চাকরির ব্যবস্থা করেন তাই শিক্ষা কেমন হবে তা তাঁদের ঠিক করতে দেওয়া হোক। বিড়লা-কুমারমঙ্গলম কমিটি সে সুপারিশ গ্রহণও করে। তবে সরকার মানেনি এই যা। সেদিন মানেনি মানে এমন নয় যে সরকার পরে মানবে না। 

রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি বলে যাচ্ছেন, শিক্ষা বেসরকারিকরণের খবরটা ঠিক নয়। সদ্য ত্রিপুরা ফেরত মন্ত্রী মহোদয় কিছু বলছেন না, তিনি কিছুতেই কিছু বলেন না, হুকুম নেই, তাঁর নেত্রী বলেননি যে কিছু বলতে! দলও বলেনি। তাই কিছু না বলে চুপচাপ সিপাহীজোলায় স্যুটিং করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবা ঢের ভালো নয় কী? বা পূর্বসুরীদের কারও কারও মতো শান্তিনিকেতনে বাড়ি! এর জন্য যদি কেউ আমাকে হেড ক্লার্ক বলে তো বলুক– আমি মুখ খুলছি না। কতজন চাকরি না পেয়েও হল্লা করছে রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায়, কোর্টে– করুক, আমি কিছু বলছি না, একবার কিছু বলে দলকে, মন্ত্রীসভার সহকর্মীদের বিপদে ফেলেছি আর নয়। (প্রাক্তন একজন এখন ফের দলের কর্তা হয়েছেন!)

তবে, এমন তারিখবিহীন স্বাক্ষরবিহীন প্রস্তাব দিল কে? রাজ্য সরকারকে তা নিয়ে ভাবতেই হবে। রাজীব গান্ধির মতো ‘হামে শোচনা হ্যায়’ বলে আর পার পাবার উপায় নেই। বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে ঝুলি থেকে। নাকি একটা কমিটি গড়ে দিলে হবে? এমন লোকজনকে নিয়ে কমিটি যে বা যারা কদাচ আমলাদিগের নিন্দা করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না, তায় কোনও মন্ত্রীকর্তার নিন্দা! তারা প্রশ্ন করে না এত টাকা খরচ হল (নাই বা হল তা ৬ শতাংশ, সব মিলিয়ে যা হল তাও কম কী?), তবু কেন দেশটা আজও পূর্ণ স্বাক্ষর হল না। দায় কার? স্কুল শিক্ষকদের? স্কুল শিক্ষকরা তো কর্তা নয়, তোমরাই কর্তা।

এসব প্রশ্ন করবে না এমন লোকজন চাই! বাপ রে বাপ! ‘সেই সাপ জ্যান্ত … ’

নয়া (বা জাতীয়) শিক্ষানীতিতেও যে PPP মডেলের কথা বলা হয়েছে! তাতে যে ভয় বাড়ে। দেশ সেবা করবেন শিল্পপতিরা! তারা ব্যবসা করবেন বিনা লাভে! ঘোড়ায় হাসব! আরও একটা বাংলা প্রবাদ তো জানি- শেয়ালকে ভাঙ্গা বেড়া দেখাতে নেই! উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এমন বেড়া দেখিয়েছিল বামফ্রন্ট আর মনমোহন সরকারের শিক্ষামন্ত্রীরা। তো, তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কিঞ্চিৎ কম ছিল বলেই বোধহয় তারা p–র মানে philanthropic'ও হতে পারে ভাবেনি। তবে মোদ্দা জিনিসটা বুঝতে ভুল হয়নি। প্রাইভেট নানা কিসিমের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গণ ম’ ম’ করত্যাছে গো কত্তা। স্কুল শিক্ষায় কেবল খরচ! নিখরচায় বিদ্যাদান। হয় না। প্রাথমিক শিক্ষাকোষের টাকাতেও না। অবশ্য সে টাকার কতটা যে রাজ্য পায় কে জানে? শিক্ষার দায় শিক্ষকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে তো। কিন্তু টাকা ঢালতেই হবে যে স্কুল শিক্ষায়। নইলে ওরা খাবে কী? ওরা কে? রাজ্যের শিশুরা? নাকি শিক্ষকরা? বোকা কারে কয়? স্কুল শিক্ষকদের কথা ভাবলে চলে! চাই নতুন গন্ধ, নতুন ফন্দি, নতুন বর্ণ।

নিখরচায় বিদ্যা লাভ হয় না, সবাইকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যায় না– সাহস করে কথাটা বলুন না। ঘোমটার আড়াল কেন? শিক্ষা অধিকার আইন, ২০০৯? তা বদলের সুপারিশ তো ছিলই। তাও এল বলে।       

 

Friday, 18 February 2022

পৌরসভার নির্বাচন

'জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না...'

সোমনাথ গুহ

 

চারটি পুরসভার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সবুজ ঝড়ে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি বিধ্বস্ত। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল প্রত্যাশা জাগিয়ে তারপর মুখ থুবড়ে পড়ার পর বিজেপির অবস্থা এখন রীতিমতো শোচনীয়। নিশ্চিত জয়ের লোভে যে সব নেতা-কর্মীরা পিলপিল করে দলে এসে ভিড়ে ছিল, তারা আবার পুরনো দলে ফিরে গেছে। নেতাদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি ও প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে দলটির অবস্থা এখন রীতিমতো ছন্নছাড়া। বাম ও কংগ্রেস পূর্বাবস্থাতেই আছে, এই দশ মাসে তাদের কাজকর্মে কোনও বিশেষ উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। বিপুল জনাদেশ নিয়ে পুনরায় তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে জনদরদি হয়ে উঠেছে এমনটাও নয়। বরং, বারবার গণআন্দোলনের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, আন্দোলনের কর্মীদের পুলিশ নৃশংস ভাবে আক্রমণ করেছে, কিন্তু বিরোধীদের দিশাহীনতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা এবং অতিমারি জনিত বিধিনিষেধের কারণে নানা ইস্যু থাকা সত্ত্বেও সেগুলো নিয়ে শাসক-বিরোধী কোনও বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। কোনও শক্তিশালী বিকল্পের অভাবে এই পুর নির্বাচনে তৃণমূলের জয় নিশ্চিতই ছিল, প্রশ্নটা ছিল জয়ের ব্যবধান কতটা হবে। 

ফলাফল বেরনোর পর বোঝা গেল যে সবুজ ঝড় নয়, চারটি পুরসভায় সবুজ সুনামি বয়ে গেছে। চন্দননগরে ৩২টি আসনের মধ্যে বিরোধী দল (সিপিএম) মাত্র একটি আসন পেয়েছে। শিলিগুড়ির ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে ৪৭টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ৩৭টি, বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস যথাক্রমে পেয়েছে ৫, ৪ ও ১টি আসন। এই পুরসভা বাম-কংগ্রেসের দখলে ছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ, গত বিধানসভা ভোটে শিলিগুড়ি আসনে বিজেপির শঙ্কর ঘোষ ৩৫,৫৮৬ ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। তিনি শহরের ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৭টিতে এগিয়ে ছিলেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি এই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, যদিও সামান্য ব্যবধানে। বিজেপির এই উলটপুরাণ বিস্ময়কর। 

শিলিগুড়ির ভোটপর্বের পর কিন্তু বিজেপি ও সিপিএম উভয়েই বিবৃতি দিয়েছিল যে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অশোক ভট্টাচার্য আক্ষেপ করেছেন, বিজেপি থেকে যে ভোটটা তাঁদের দিকে ফিরে আসবে ভেবেছিলেন সেটা তৃণমূলের বাক্সে চলে গেছে; বিজেপির এক নেতা স্বীকার করেছেন যে রাজ্য সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পগুলির তাঁরা মোকাবিলা করতে পারেননি। সুতরাং, ভোটে কারচুপি হয়ে থাকলেও তা সামান্যই হয়েছে। তাহলে বিজেপির এই ভরাডুবি কেন? সকলের মনে আছে নিশ্চয়ই যে বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের দু-তিন মাস পরেই  বিজেপির দুই সাংসদ জন বার্লা এবং নিশীথ প্রামাণিক উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার দাবিতে সরব হয়েছিলেন। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বিজেপি সেই দাবিকে সমর্থন করেনি, কিন্তু উত্তরবঙ্গ বঞ্চিত- এই ধুয়ো তুলে তা সরাসরি নাকচও করেনি। এটা পরিষ্কার যে, উত্তরবাংলার মানুষ এই দাবিকে ভালো ভাবে নেননি; বিজেপিকে প্রত্যাখান করে তাঁরা তাঁদের মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছেন। 

বিধাননগর ও আসানসোলের গল্প কিন্তু অন্য। বিজেপি দুটি পুরসভাতেই পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছে। সিপিএম বহু ওয়ার্ডে একই দাবি করেছে। উভয় দলেরই অভিমত, দুটি পুরসভাতেই ব্যাপক কারচুপি, ছাপ্পা ভোট, জোরজুলুম হয়েছে; মোটমাট ভোট লুঠ হয়েছে। বিধাননগরে বিজেপি ও সিপিএম কোনও আসন পায়নি। ৪১টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ও নির্দল একটি করে আসন পেয়েছে। আসানসোলে তৃণমূল ১০৬টি আসনের মধ্যে ৯১টি পেয়েছে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস এবং অন্যান্যরা যথাক্রমে ৭, ২, ৩ ও ৩টি করে আসন পেয়েছে।

শাসক দলের এই বিপুল জয়ের কারণ কি শুধুই ভোট লুঠ ও সন্ত্রাস? এটা আজ মেনে নেওয়ার দরকার আছে যে, গত দু' বছরে শাসক দল একের পর এক যে সব জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছে তা জনগণকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। বহু মানুষ, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ দরিদ্র ও প্রান্তিক, তাঁরা এইসব প্রকল্প দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। বিরোধী দলগুলি এই প্রকল্পগুলিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সেগুলিকে দান-খয়রাতির রাজনীতি বলে কটাক্ষ করেছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে অলক্ষ্মীর ভাণ্ডার বলে ব্যঙ্গ করেছে, যা মানুষকে তাদের প্রতি আরও বিরূপ করে তুলেছে। 

ঘটনা হচ্ছে, এই প্রকল্পগুলির প্রভাবের কারণে তৃণমূলের জয় এমনিতেই নিশ্চিত ছিল, হয়তো তারা দশটা আসন কম পেত কিংবা বিভিন্ন আসনে জয়ের ব্যবধান কম হত। তাতে তো তাদের এই জয় কালিমালিপ্ত হত না, তাদের ভাবমূর্তি আরও পরিচ্ছন্ন হত। গা-জোয়ারি নির্বাচন করার ফল যে কী হতে পারে সে অভিজ্ঞতা তো বাংলার শাসক দলের রয়েছে। বিরোধী-শূন্য পঞ্চায়েত করার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বিপুল সংখ্যক বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন পেশ করতে দেওয়া হয়নি। এর পরিণামে বাম ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপিতে শিফট করে গিয়েছিল, যার ফলস্বরূপ বিজেপি ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন জিতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল; দীর্ঘ দেড় বছর শাসকের মসনদ টলমল হয়ে গিয়েছিল। তৃণমূল কি সেই অভিজ্ঞতা থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি? 

আগামী ২৭ তারিখ তো আরও ১০৮টি পুরসভায় ভোট। সেখানেও তো জোরজুলুম, বিরোধী প্রার্থীকে চমকানো ধমকানো চলছে। ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪টি পুরসভা শাসক দল কব্জা করে নিয়েছে-দিনহাটা, বজবজ, সাঁইথিয়া, সিউড়ি। শোনা যাচ্ছে বোলপুরে বিজেপি কোনও প্রার্থীই দিতে পারেনি; কয়েকটি ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী রয়েছে, তাঁরাও ভোটের দিন অবধি টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। বোঝাই যাচ্ছে, বীরভূম জেলায় চার বছর আগের মতো উন্নয়ন এখনও খড়্গ হাতে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাননীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সেই চিরাচরিত যুক্তি দিচ্ছেন- বিরোধী দল যদি প্রার্থী না দিতে পারে তাতে আমরা কী করব! এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য! যে দলের ১৮টি সাংসদ রয়েছে তারা পুরসভায় প্রার্থীই দিতে পারছে না; যে দল ব্রিগেডে বড় সভা করতে পারে তারা প্রার্থী দিতে পারছে না। 

এবার কিন্তু তৃণমূল দলের ভিতর থেকেই এর বিরোধিতা হচ্ছে। তরুণ নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য বলেছেন যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ ব্যাপারটা মানুষ ভালো ভাবে নেয় না। ২০১৮ সালে এটা করার ফলে পরিণাম যে ভালো হয়নি সেটা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমনও বলেছেন যে বিরোধী দলগুলি যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করার দাবি করে তাহলে সেটা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত, কারণ, তাহলে কেউ আমাদের দিকে আঙুল তুলে দায়ী করতে পারবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, নেতৃত্ব তাঁর এই বিবৃতিকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। দেবাংশুর বক্তব্য কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এটা অশনি সংকেত হলেও হতে পারে। দলের তরুণ অংশ ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ দাবি তুলছে, দলের ওয়েবসাইটে দলনেত্রীর অনুমোদন ছাড়াই অন্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব কীসের ইঙ্গিত? দলে কি দ্বিতীয় কোনও ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে উঠছে? যাই হোক সেটা অন্য গল্প। 

বিভিন্ন পার্টিতে এখন একটা অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব কাজ করছে! বিজেপি কেন্দ্রে কংগ্রেস-মুক্ত ভারত চাইছে, তৃণমূল এখানে বিরোধী-মুক্ত বাংলা চাইছে। এটা একটা ভয়, আতঙ্ক- এই বুঝি আমার ক্ষমতা চলে গেল। এছাড়া এখানে পয়সার গল্প আছে। একটা পুরসভায় একচ্ছত্র আধিপত্য থাকা মানে প্রচুর সরকারি অনুদান আমার ঝুলিতে চলে এল। এই যে লাখো বেকার যুবক অহোরাত্রি খাটছে, বুথ জ্যাম করছে, ছাপ্পা মারছে, বিরোধীদের মারধোর করছে, অপহরণ করছে, বাড়ি গিয়ে চমকাচ্ছে- এঁদের হাতে রাখার জন্য পয়সা খরচ আছে না, সেটা আসবে কোথা থেকে! এর জন্যই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চাই; পরের নির্বাচনে কী হবে তা পরে ভাবা যাবে।


Thursday, 10 February 2022

মুশকান দেখিয়ে দিয়েছেন...

পালটা ন্যারেটিভ গড়া শুরু হয়েছে

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 


'কেন প্রতিটি বড় নির্বাচনের আগে ধর্মীয়ভাবে মেরুকরণের ইস্যু সব সময়ই বাড়তে থাকে? কাকতালীয় বা সুবিধাজনক। চিন্তা করুন। শুভরাত্রি, শুভরাত্রি।' এই ট্যুইটটি করেছেন সাংবাদিক রাজদীপ দেশাই। হ্যাঁ, গত ২০-২৫ বছর দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ভোটের আগে নানা সাইজের ধর্মীয় উস্কানি চলে। কখনও কখনও তা বড় ধরনের সহিংসতার জন্ম দেয়। এ নিয়ে চর্চা না করেও বলা যায়, ধর্মকে মূল অক্ষ করে যারা রাজনীতি করে, তারা বরাবর এটা করে আসছে এবং ভবিষ্যতে করবেও। 

যেমন, এখন এসেছে স্কুল-কলেজে ছাত্রীরা হিজাব পরবে কেন? যেন নতুন কিছু! এই 'সমস্যাগুলি' আমাদের উপমহাদেশের সমাজে সত্যিকার অর্থে বিদ্যমান এবং আমাদের দেশে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ভোটারদের মেরুকরণের চেষ্টা করার আগে বিজেপি তাদের তাসটা ওপেন করে। আমরা বেশির ভাগ মানুষ অধিকাংশ সময়ে এ নিয়ে মাথা ঘামাই না। এই সমস্যাগুলি সর্বদাই ছিল এবং সাধারণত চোরাস্রোত হিসাবে বিদ্যমান আছে, কেয়ার করি না। কিন্তু বিচলিত হই যখন বিজেপি এটিকে স্পটলাইটে টেনে আনে। ইতিহাস চেতনার অভাব, বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, বোঝার অভাব এবং বিপুল অজ্ঞতার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা এই 'ইস্যু'গুলিকে আশ্রয় করে। আর এভাবেই বিজেপি প্রতিদিন বিভাজন ও শাসন করে এবং তাদের শোষণ করে। আমার কথা হল, রাজদীপের মতো বর্ষীয়ান ও প্রাজ্ঞ সাংবাদিকরা কখনই মূলধারার মিডিয়াতে এই বিষয়গুলিকে তেমন করে অ্যাড্রেস করেননি। অন্যদিকে, গোদি মিডিয়া প্রথম থেকেই এগুলোকে পুঁজি করে মতাদর্শ তৈরির নামে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সাহায্য করে আসছে। আমরা যে সমাজে বাস করি, তার স্পন্দন যদি বুঝতে না পারি তবে হিজাব নিয়ে এই সমস্যার নাগাল আমরা পাব না। কিছু নীতিকথার শিকার হয়ে ক্ষতবিক্ষত হব। 

ব্যক্তিগত ভাবে আমি হিজাব, ঘোমটা, বোরখা বা যে কোনও পর্দার বিরোধী। পর্দাকে আমার মানবতা-বিরোধী বলেই মনে হয়। বহু উদারচেতা মানুষ এই অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কিন্তু রাজনীতির থেকে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখা এই উপমহাদেশে আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই ভোট এলেই শুরু হয়ে যায় নানান ফিকির।

কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিজাব বাতিলের দাবিতে পথে নামে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই ইসলাম বিরোধিতার তবু একটা মানে বোঝা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বিরক্তকর হচ্ছে ভদ্রবিত্তের মানুষজনরা যখন এইসব কাজকে যুক্তিগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেন। সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদ চেনা যায়। সমস্যা হয় তথাকথিত প্রগতিশীল ছুপা হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে। সম্প্রীতির শত্রু হিসেবে তাঁরা অনেক বেশি বিপজ্জনক। এদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইসলামফোবিয়া সব সময় সক্রিয়। নইলে শাঁখা-পলা-সিঁদুর-পৈতেও তো সামন্ততান্ত্রিক ধর্মীয় শৃঙ্খল। সেগুলোর বিরোধিতা করেন না কেন? আসলে সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবলে দেখবেন, সংখ্যাগুরুর কোনও কিছুতেই এঁদের তেমন করে আপত্তি থাকে না। এঁরা বেশ গলা তুলে বলেন, স্কুল-কলেজে কেন বোরখা পরে যাবে। ওরা ওদের ব্যক্তিগত পরিসরে হিজাব নিয়ে থাকুক। এই একচোখো বিজ্ঞরা কিন্তু একবারও বলেন না, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কেন একটি বিশেষ ধর্মের বসন অঙ্গে ধারণ করে সাংবিধানিক পদে বসে সব সরকারি কাজ করেন? এই বাস্তুঘুঘুরা একবারও তো বলেন না, প্রধানমন্ত্রী কেন সরকারি অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ ধর্মের পোশাক গায়ে চড়িয়ে হাজির হন। এই তো সরস্বতী পুজোর দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হায়দরাবাদে 'স্ট্যাচু অফ ইকোয়ালিটি'র আবরণ উন্মোচন করতে গিয়ে ধর্মীয় পোশাকে আনখশির মুড়ে সরকারি অনুষ্ঠান করলেন। তার বেলা! 

আসলে, সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় পোশাক পরে মাথা ঢেকে ঘুরলে দোষ নেই, নজর যত হিজাবে! বাংলা কথা, আজ যা হচ্ছে, যে ভাবে কর্নাটকে হিংস্র ইভটিজিং হল, এর জন্য প্রধানত দায়ী হিন্দু লেফট লিবারাল মধ্যবিত্ত। এতই যদি দম থাকে তবে শাঁখা-পলা-সিঁদুর পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি কার্যালয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন করে দেখাক। তারপর হিজাব, বোরখা, ফুঃ খারাপ কি না, সেই ডিসকোর্স করা যাবে। এই তথাকথিত লিবারালরা ভুলে যান, কোনও একপক্ষ নিয়ে বক্কাবাজি করলে জিতে যায় মৌলবাদ, জিতে যায় বোরখা, জিতে যায় ঘোমটা-সহ সবরকম পর্দা প্রথা। আর চাপা পড়ে যায় এর মধ্যে গেঁথে থাকা রাজনীতিটা। 

পুঁজির প্রাথমিক বিকাশের কালে সমুদ্র অভিযানের নামে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন চার্চের প্রতিনিধিরা। শুরু করেছিল ধর্মের প্রচার। পিছন পিছন এসেছিল পুঁজিতন্ত্রের প্রতিভূরা ও তাদের রাজনীতি। তাই হিজাব নিয়ে কর্নাটকের ঘটমান বর্তমানকে রাজনীতির বাইরে আমি দেখতে নারাজ। দক্ষিণের এই রাজ্যে পুরভোটে কংগ্রেসের কাছে একেবারে গোহারান হারার পরেই বিজেপি বুঝে গিয়েছিল, ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে জরুরি একটা মেরুকরণ। চাই একটা হিন্দু-মুসলিম তর্ক। তাই ঘোমটার দেশে নামানো হয়েছে হিজাব বিতর্ক। ৫ রাজ্যে ভোটে এই মেরুকরণ কতটা কাজ করবে তার হিসেব বোধহয় গৈরিক শিবির করে নিয়েছে। তবে সেই হিসেব কতটা মিলবে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে। মেরুকরণের খেলা খেলতে খেলতে তিন-তিনবার দিল্লির মসনদ দখল করতে পেরেছে বলে বিজেপি নেতৃত্ব ভাবছে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোকে ময়দানে নামিয়ে দিলে আড়াআড়ি মেরুকরণ সম্ভব হবে। তবে সবদিক থেকে দেখে মনে হচ্ছে এবার হিসেবটা সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়নি।

মুশকান নামে ওই ইসলামি ছাত্রীকে ঘিরে ধরে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দেওয়ার ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে। যদি ওই বীরপুঙ্গবরা ভেবে থাকে শুধু ইসলামিরাই ওই ভিডিও দেখেছে, তাহলে বলব তারা ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানে না বহুত্ববাদ। এখনও ভারতীয় সেই আত্মাকে চেনে না, যা লালিত হয়েছে ভক্তি আন্দোলনের জাইলেম-ফ্লোয়েমে গত হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। তাদের জানিয়ে রাখি, ওই ভিডিওটা দেখেছেন সব শ্রেণির, সব বয়সের মহিলারা। দেখেছেন এবং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন আসলে বিজেপি মহিলাদের কী চোখে দেখে। জানা যাচ্ছে, এক মহিলা কী পোশাক পরে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, সেটা কিছু রাস্তার গুণ্ডা ঠিক করে দেবে! একজন মহিলা হিজাব পরবে না জিনস পরবে, কুর্তা-পাজামা পরবে না হট প্যান্ট পরবে, তা ঠিক করে দেবে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান তোলা বিজেপির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী! 

২০২২'এর এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে তাহলে বিজেপির এটাই বীজমন্ত্র! এটাই আরএসএস'এর পুরুষতন্ত্র, যা বিজেপি অনুসরণ করে। গোটা পৃথিবীর কাছে এই বার্তাই পাঠাচ্ছে বিজেপি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঘৃণা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। ধর্মের নামে হাজার হাজার বছর ধরে নির্মাণ করা ঘৃণা বা দ্বেষের একটা কাউন্টার-হেজিমনি তৈরি হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। মুশকানকে উত্যক্ত করা ভাইরাল ভিডিওটি কিন্তু সেই কাউন্টার-ঘৃণা বা দ্বেষ তৈরি করছে, যা বর্ষাবে পুরুষোত্তম রামের নামে জয়ধ্বনি করা এই লুম্পেন সংস্কৃতির ওপরে। মুশকান দেখিয়ে দিয়েছে ভারত নামক দেশটি কোনও বিশেষ একটি ধর্মের দেশ নয়, এই দেশে সবার সমান অধিকার। তোমাকে সালাম মুশকান। ধর্মের রাজনীতির হাত ধরেই পালটা ন্যারেটিভ গড়া শুরু হয়েছে। তাই নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই ট্যুইট করেছেন, ‘হিজাব পরে মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা ভয়ঙ্কর ঘটনা।’ এরপরই ভারতের রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা, ‘মুসলিম মহিলাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা এবার বন্ধ করুন আপনারা।’ 

কী বলবেন কর্নাটকের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই? কী বলেন প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? আসলে কিছু বলার নেই। কেননা, একুশে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের সময় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'দিদিই...ও দিদিইইই' করে যে অশ্লীলতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন, তার পরে আর তাঁদের বানরসেনাকে দমন করার কোনও ক্ষমতাই নেই। তবে স্মরণ করিয়ে দিই, এগারো মাস আগে বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অসম্মান করার জবাব ইভিএমে ট্রানস্লেটেড হয়েছে। সেই যে মুখ লুকিয়ে পালিয়েছেন মোশারা, আর বাংলায় ভিড়তে পারছেন না। এবার মুশকানকে হেনস্থা ও অপমান করেও রেহাই পাবেন না মোদীর ভক্তের দল। পুরুষোত্তম রামের নামে 'জয় শ্রীরাম'এর মতো পবিত্র শব্দবন্ধ মেয়েদের উত্যক্ত করার হাতিয়ার হয়ে গেলে সীতারা দলবদ্ধভাবে জবাব দেবেন ইভিএমে।


Wednesday, 9 February 2022

বাঙালিত্বের কথা

কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে যুক্তিশীলতা গড়ে তোলা যাবে কী?

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে খুঁটি করে সম্প্রতি বড়বাজারের মাড়ওয়ারি ও বিহারীদের (ব্যবহৃত শব্দদ্বয় হল ‘মেড়ো’ ও ‘গুটকাখোর’) বিরুদ্ধে এক অংশের বাঙালি উচ্চকিত হয়ে নাকি স্বজাতির কাজের ও জীবনযাপনের অধিকারগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।  অন্তত এমনই একটা ভাবের প্রচার ফেসবুক-টেসবুকে অহরহ দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, বন্ধনাবদ্ধ শব্দ দুটির চৌহদ্দিই স্পষ্ট করে দেয় আসলে কাদের বিরুদ্ধে এই সোচ্চার অবস্থান। কেননা, দক্ষিণাবর্তের কিংবা পশ্চিমাপথের ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এইরকম নামের (বিদ্বেষ নয়, ‘পাঁইয়্যা’ কিংবা ‘গুজ্জু’ সম্বোধনে যে ব্যঙ্গ প্রচ্ছন্ন তা অন্য আলোচনার বিষয়) প্রচলন ও প্রয়োগ সচরাচর কর্ণগোচর হয় না; কেন হয় না, তা বলাই বাহুল্য।

সুতরাং, কারা উদ্দিষ্ট তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে যে-প্রশ্নটা সবচেয়ে জরুরি হয়ে ওঠে তা হল, কাদের উদ্দেশ্যে? তথাকথিত আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে বিচার করলে বাঙালি (হিন্দু-মুসলমান উভয়ই) মূলত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত– ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। ধনী শ্রেণির বাঙালি, যাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলের ওপরে নির্ভরশীল নয়, তাদের স্বজাতিপ্রীতি-টীতি নিয়ে ভাবার সবিশেষ সময় নেই। বাকিরা নিজেদের রোজগারের বিষয়টিকে টিকিয়ে রাখার জন্যই মাঝে-সাঝে এ-ব্যাপারে মাথা ঘামাতে কার্যত বাধ্য হন। দরিদ্র শ্রেণির বাঙালি, যাদেরকে সাধারণত 'অধিকাংশ বাঙালি' শব্দবন্ধের মধ্যে ধরাই হয় না, অর্থাৎ, চাষি-মজুর-জেলে-তাঁতি-মিস্ত্রি-কারিগর-কুমোর-সব্জি বিক্রেতা-রিক্সাচালক প্রমুখ শ্রেণির মানুষজনের দাবিদাওয়া খুব সামান্যই। তাঁরা শুধুমাত্র দু-বেলা পেট ভরে ভাত, মাথার ওপরে ছাদ আর সন্তানদের শিক্ষা ও বৃদ্ধ বাপ-মায়ের চিকিৎসা কোনওরকমে জুটিয়ে ফেলতে পারলেই যথেষ্ট বলে ঠাউরান। দরিদ্র স্তরে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তই হল সহাবস্থান ও সহযোগিতা। শহুরে বস্তি কিংবা গ্রামেগঞ্জে গেলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে একে অপরের ওপরে কীভাবে নির্ভর করে দিন-গুজরান করে থাকেন এঁরা। এখানেও জাত্যাভিমান বা জাতি-গৌরবের মতো চিন্তাগুলি কলকে পায় না। 

বাকি থাকল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাঙালি। এ দেশের এই শ্রেণির বাঙালিই দেশভাগের পরে বাঙালদের ওপরে হেব্বি চটেছিল কেননা অভিযোগ ছিল, এরাই সব চাকরি-বাকরি কাজ-বাজ খেয়ে ফেলছে। সম্প্রতি আবার এরাই (এইবারে ঘটি-বাঙাল উভয়েই) হিন্দুস্তানিদের ওপরে খচেছে সম্ভবত একই কারণে।

সময় ও অর্থনীতির মানদণ্ড যে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, তা মেনে নেওয়া মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে একটু কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা, এতদিন এরা দশটা-পাঁচটার চাকরি ও কয়েকটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স করে ধনী শ্রেণিতে ওঠার বাসনা বুকে নিয়ে ঘুরত আর ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে পড়িয়ে হয় তাদের এখানেই (পার্টি-টার্টি ধরে) চাকরি জুটিয়ে দিত, নয়তো বিদেশে পাঠিয়ে পাড়াপড়শির সামনে বুক ঠুকে বেড়াত। শেষে বৃদ্ধ বয়সে বলত, বৌমা বদ আর ছেলে দেখে না। কিন্তু এখন তারা ক্রমশ দেখছে যে, দশটা-পাঁচটার চাকরি বলে আর কিছু নেই (পার্টি ধরলেও নেই), লাইফ-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আজ বাদে কাল টিকবে কিনা নিশ্চয়তা নেই, তাদের সময়ের ভালো স্কুলের বদলে এখন যে-সব স্কুল চালু হয়েছে সেখানে পড়ানোর খরচ আকাশছোঁয়া, যদিও বা কোনওরকমে সেখান থেকেও সন্তানদের পড়ানো হয় তারপরেও তারা আদৌ কাজ-বাজ পাবে কিনা ঠিক নেই, পেলেও কদিন টিকবে জানা নেই– এমতাবস্থায় এতকাল যে নিরাপত্তার জীবনে মোটামুটি মধ্যবিত্ত বাঙালি নিশ্চিন্ত ছিল সেই স্থান আজ আর থাকছে না। অর্থাৎ, চিরাচরিত অর্থনীতির বদলে সময় এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর গিগ-অর্থনীতিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে একমাত্র ভরসা- হয় পুঁজির জোর নয় গায়ে-গতরে খাটুনির জোর। আর এই দুইই আছে তথাকথিত বিদ্রূপবাণে জর্জরিত বড়বাজারি ‘মেড়ো’ আর বিহারের ‘গুটখাখোর’দের। ফলে, তারাই মোটামুটি কর্মক্ষেত্রের জায়গাগুলি দখল করছে। বাঙালি এখানে তার মধ্যবিত্ততাসুলভ আত্মসম্মানের জন্য হয় কাজ পাচ্ছে না, আর পেলেও থেকে যেতে হচ্ছে এদেরই কর্মচারী হয়ে। এইখানেই জমা হচ্ছে ঈর্ষা ও হতাশাজনিত যত উষ্মা যা প্রকাশ পাচ্ছে অন্য অজুহাতে। তার রূপ কিছুটা রণংদেহী। অর্থাৎ, ব্যাপারখানা এইরকম যে, ‘মুষ্ঠি থাকতে মুখে কেন’ অথবা ‘ভাতে না পারি হাতে মারব’ গোছের। এর সঙ্গে অনেকে মহারাষ্ট্রের শিবসেনার উত্থানকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আমার মতে সেটা সঠিক নয়। কেননা জাতিসত্তার চেতনার ওপরে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে আরোপ করার প্রয়াস এখনও এখানে অমিল, অন্তত বহিরঙ্গে।

তাই বলে, হিন্দি ভাষা ও হিন্দিভাষীদের অন্যায় আগ্রাসন নেই– এ কথা কি বলা যায়? কিছুতেই বলা যায় না। তা আছে এবং চরম ভাবেই আছে। এ কথা তো সত্য যে, যে কোনও জাতিই তাদের মাতৃভূমির পরিবেশ বিদেশ-বিভুঁয়ে গিয়ে সৃষ্টি করতে চায়। ইংরেজরাও এক কালে কলকাতাকে কেন্দ্র করে তাইই করেছিল, বাঙালিও আমেরিকায় গিয়ে একই কাজ করেছে, এখানে উত্তরাপথের মানুষজনও সেই কাজই করছে। ফলে, সেকালেও যেমন ইংরেজের বিরুদ্ধে বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণি জাতিচেতনার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, এ কালেও তেমনই বাঙালিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য করা প্রচেষ্টাগুলি প্রশ্নাতীত। ফলে, যা হচ্ছে তা অবশ্যই একটা আশার আলো। এর ফলে স্বদেশেই খোয়া যাওয়া বহু অধিকারকে বাঙালি নতুন করে ফিরে পাবে। কিন্তু একইসঙ্গে একটা মৃদু ভয়ের কালো মেঘও ক্রমশ কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। কথায় বলে, জাতিবৈরিতা ছাড়া জাতিপ্রেম জাগরিত হয় না। এখন বৈরিতাই প্রধান উদ্দিষ্ট হয়ে উঠে যদি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠার বদলে জাতি-মৌলবাদের সঞ্চার হয়, তবে তা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলার পক্ষে সুখবর হবে না।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, প্রাক্‌-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি জীবনের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রাক্‌-স্বাধীনতা কালের তথাকথিত ‘বাবু’ ও ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির শিক্ষা-রুচি-বোধ-চেতনা-যাপন-আদর্শ কিছুই আর স্বাধীনতা-উত্তরকালে টিকে থাকেনি। থাকার কথাও নয়, কেননা চল্লিশের দশক থেকে জাপানি বোমা, মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গা, নকশালবাড়ি ইত্যাদি সমস্ত কিছু মিলে বাঙালির জীবনের খাতকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে বইয়ে দিয়েছে। সুতরাং, কী ছিল আর কী হল– সে আলোচনা এখানে অর্থহীন। কিন্তু কী এমন জিনিস যা সে কালে বাঙালিকে নিজের ঐতিহ্য সন্ধানে মগ্ন রেখে একদিকে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটিয়েছিল আর অন্যদিকে তারই অনুবর্তনে রাষ্ট্রিক অধিকার লাভের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বিপ্লবীয়ানার আদর্শবাদকেও পুষ্টি জুগিয়েছিল– সেটাকেই খুঁজে বের করতে হবে। তবেই একুশ শতকের এইসব প্রচেষ্টাগুলি সফল হবে। নইলে মারদাঙ্গা, ঝগড়া-ঝামেলা ইত্যাদি করে শুধুমাত্র গায়ের জোরের আশ্রয় গ্রহণ করলে তা একদিন এক বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেবে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাঙালির সমাজ জীবনে কী কী সমস্যা দেখা দিয়েছিল তা বোঝা জরুরি। ‘বাবু’ ও ‘ভদ্র’ শ্রেণির বদলে এই সময়ে উঠে এসেছিল এক স্বার্থান্বেষী মধ্যবিত্ত বাঙালি যারা শুধুমাত্র পয়সাটাকেই জীবনের সব মনে করত। আমলা থেকে অধ্যাপক, জমির কারবারি থেকে কথাসাহিত্যিক, ব্যবসায়ী থেকে ফাটকাবাজ, রাজনেতা থেকে প্রাইভেট টিউটর বা ডাক্তার– সর্বস্তরে কেবল অর্থই প্রাধান্য লাভ করছিল। এতটাই যে তার জন্য যা-খুশি করাটা কোনও ব্যাপার ছিল না। পাশাপাশি ছিল স্বজাতির সৃষ্টিশীলতার প্রতি অবহেলা-উপেক্ষা। ফলে, ধীরে-ধীরে ঘুষখোর-মাফিয়া-মাস্তান থেকে পাঠবিমুখ অধ্যাপক-শিক্ষার্থী, কর্মস্থলে ল্যাদ খাওয়া ডেলি প্যাসেঞ্জার, মালিকের সঙ্গে বসে মদ খাওয়া ইউনিয়ন নেতা ইত্যাদি নানা চরিত্রের রমরমা বেড়েছিল। এই মানসিক ও চরিত্রগত দৈন্যের শূন্যস্থানটিকেই বাইরের লোকজন এসে দখল করেছিল। ক্রমে দৈহিক শ্রমের জায়গাগুলি থেকে বাঙালি কাজ হারাতে থাকল আর মেধাবী বাঙালি মনোযোগী হল অন্য রাজ্যে বা বিদেশে গিয়ে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে। এখন যে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে রাস্তাঘাটে দেখা যায়, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, আলাপ-আচরণ, চর্চা-চর্যা প্রায় সম্পূর্ণতই এক আশ্চর্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোঁজামিলে পরিপূর্ণ। বিনোদনের দুনিয়ায় এরা কেবলই সত্যজিৎ ও সৌরভকে নিয়ে বুক পিটিয়ে বেড়ায়, কেউ নোবেল পেলে কেন পেল তা না ভেবেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দেয় আর একইসঙ্গে তীব্রতর উপেক্ষা ছুঁড়ে দেয় এখানকার প্রকৃত অর্থে কাজ করে যাওয়া বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, নাট্যশিল্পী, লোকসংস্কৃতির কৃষ্টিকার থেকে অন্যান্য মননশীলদের দিকে, বিদ্রূপ করে ‘আঁতেল নাকি’ বলে, আর দরিদ্র-অসহায়দের কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবে না। নিজেরাই নিজেদের বলে ‘কাঁকড়ার জাত’।

তবুও এখন যে আলোর উৎস দেখা যাচ্ছে তার সম্ভাবনা কিন্তু সামান্য নয়। বরং উনিশ শতকের বাঙালির উত্থানের থেকে অনেক বেশি বৃহত্তর বাঙালির স্বার্থ এইখানে জড়িয়ে আছে। এখনই যদি একটা সফল উত্থান ঘটানো যায় তবে তা বাঙালির জাতীয় জীবনের পক্ষে দৃঢ় পদক্ষেপ হবে। তাই এখানে কেবলমাত্র গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করলে হবে না, সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিকল্প সংস্কৃতির উদ্ভাসনের পরিবেশ সৃষ্টির প্রতিও মনোযোগী হতে হবে। আশীষ লাহিড়ী তাঁর ‘এই পঙ্ক-কালচারের হেজিমনি ভাঙুন’ নিবন্ধে লিখেছেন, 'যদি প্রতিনিয়ত আমরা প্রমাণ করতে পারি যে নিছক প্রকরণগত দিক থেকেও আমরা এই মুৎসুদ্দি বিকার-সংস্কৃতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, সুরটা আমরা ঠিকঠাক লাগাতে শিখি, সম্-টা আমরা ঠিকঠাক জায়গাতে ফেলি, শুধু কারাওকে আর সিন্থেসাইজরের ভরসায় গান না গাই– তাহলে সমাজের ওপর তার একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।' আর সেই বিকল্প সত্তার উদবর্তন না করা গেলে হিন্দি ভাষা ও হিন্দিভাষীদের এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করা কিছুতেই যাবে না। 

ফলে, যাঁরা এখন এইসব আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁদেরকে নিজেদের চরিত্র ও মনন গঠনের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে। ‘আত্মমর্যাদার সঙ্গে সৌজন্যবোধ, সুরুচির সঙ্গে সংযম, স্বাধীনচিত্ততার সঙ্গে নিয়মানুগত্য, কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে যুক্তিশীলতা’– উনিশ শতকে এই জিনিসটাই বাঙালিকে উচ্চতম অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল, তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে এনে দিয়েছিল উচ্চাসন–  একমাত্র এগুলিকে পুনর্জীবন দিলে তবেই বাঙালির জাতিচৈতন্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেওয়া যাবে। নইলে ফেসবুক ভরে যাবে ঝাণ্ডায় আর আরেক হাল্লা রাজার সেনা তৈরি হবে– এর বেশি কিচ্ছুটি নয়। এটাই শুরুর কথা...     


Sunday, 6 February 2022

স্তব্ধ এই উপমহাদেশ!

'সঙ্গীত অনুসরণ করে লতাজীকে'

শোভনলাল চক্রবর্তী 


জীবনযুদ্ধে জয়ী মানুষ হিসেবে শুধু তাঁর নাম বলে থেমে গেলেও ভুল হবে না। এর চেয়ে বড় প্রতিকূলতাকে জয় করে, এর চেয়ে বেশি সফল হওয়া তো আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়! লতাজী'র অবস্থানে আসতে কী অসম্ভবকেই না সম্ভব করেছেন লতা মঙ্গেশকর।

বাবা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী এবং মঞ্চ অভিনেতা। নাটকের গ্রুপ ছিল তাঁর। স্ত্রী সুধামতি- চার মেয়ে লতা, মীনা, আশা, উষা আর একমাত্র ছেলে হৃদয়নাথকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু ১৯৩৪ সালে ভারতের প্রথম টকি 'আলম আরা' মুক্তি পাওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া এত ভয়াবহ হল যে ‘বলওয়ানত মানডাল’ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন দীনানাথ। হঠাৎ একরকম বেকার হয়ে পড়ায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়লেন। হতাশা ভুলতে ডুবলেন মদ্যপানে। তাতে কি আর সুদিন ফেরে!  নাটকের দল নিয়ে আজ এখানে, কাল ওখানে ঘুরে বেড়াতে হত বলে তাদের লেখাপড়া খুব ভালো করে শেখাতে পারছিলেন না। তবে গান শিখিয়েছিলেন সমস্ত আন্তরিকতা ঢেলে। বিশেষ করে বড় মেয়ে লতাকে তো তালিম দিয়েছিলেন খুব যত্ন করে। মেয়েটাকে ভালোওবাসতেন খুব। ওর নাম রাখার সময় যে কত কাণ্ড হল!

দীনানাথ নিজে ছিলেন শৌখিন জ্যোতিষী। তাই জন্মের মুহূর্তের কত কী হিসেব কষে টষে প্রথমে নাম রাখা হল হেমা। কিন্তু নিয়ম মেনে রাখলেও ওই নাম তাঁর নিজেরই বোধহয় খুব একটা পছন্দ হত না। তাই আদর করে সব সময় ডাকতেন, ‘হৃদিয়া’। পরে অবশ্য হেমা বা হৃদিয়া— কোনও নামই টেকেনি। পরিবারের অন্যদের মুখে মুখে কেন যেন ফিরতে লাগল 'লতা' নামটা; এক সময় পরিবারের বড় মেয়ের নামই হয়ে গেল লতা মঙ্গেশকার। 

১৯৩৪ থেকে হতাশা সইতে সইতে, শরীরের ওপর অত্যাচার করতে করতে দীনানাথ অবশেষে ১৯৪২ সালে সব হতাশা থেকে চিরমুক্তি পেলেন— চলে গেলেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বাবার মৃত্যুতে সমস্ত পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ল লতার কাঁধে। বয়স তখন মাত্র ১২। এ বয়সে কী করা যায়! গান ছাড়া তেমন কিছু জানাও নেই। আর শুধু গান দিয়ে খুব ভালো কিছু করারও জো নেই, কণ্ঠ তো তখন একেবারেই কচি, ফিল্ম বা অন্য কোথাও তা খুব বেশি কাজে আসবে না। বাধ্য হয়েই ছোট্ট লতা নামল অভিনয়ে। শুরুটা মারাঠি ছবি দিয়ে। বাবার মৃত্যুর অষ্টম দিনেই মেকআপ নিয়ে কিশোরীটিকে যেতে হল ‘প্যাহলি মঙ্গলাগাওর’ ছবির শুটিংয়ে। মুম্বাই চলচ্চিত্রের এক সময়ের নামকরা অভিনেত্রী নন্দার বাবা ভিনায়েক রাও-এর এ ছবিতে অবশ্য গানও গাইতে হয়েছে তাকে। সেই শুরু। জীবদ্দশায় বাবা নাকি প্রায়ই একে-ওকে বলতেন, ‘দেখো, আমার বড় মেয়ে একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।’ সেই মেয়ের প্রথম প্লেব্যাক 'কিত্তি হাসাল' নামের এক মারাঠি ছবিতে। একে একে আটটি ছবিতে অভিনয় করা হল। ১৯৪৩ সালে প্রথম হিন্দি গানও গাওয়া হয়ে গেল মারাঠি ছবি 'গজবহু'তে। তার গাওয়া ‘মাতা এক সপুত কি দুনিয়া বদল দে তু’ গানটা ভিনায়েক রাও'এর এত ভালো লাগল যে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে সাইন করিয়ে নিলেন লতাকে। বেতন ধরা হল ৬০ রুপি। 

দু' বছর পর ভিনায়েক তার ইউনিট নিয়ে চলে যান মুম্বাই। নতুন উদ্যমে শুরু হয় কাজ। ১৯৪৭ সালে প্রথম হিন্দি ছবিতে গান গাওয়া হল লতার (ছবি: আপ কি সেবা মে, গান: পা লাগু কার জোরি)। সে বছর বেতন ৬০ থেকে বেড়ে হল ৩৫০ রুপি। যেন সুসময়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। হঠাৎ মারা গেলেন ভিনায়েক রাও (১৯৪৭)। লতার মাথার ওপর যেন আবার ছাদ ধসে পড়ল! তারপরও মুষড়ে পড়েননি। মুম্বাই আসার পর বেশ কিছুদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছেন উস্তাদ আমানত আলী ভিণ্ডিবাজারওয়ালার কাছে। ভিনায়েক মারা যাওয়ার পর আমানত আলীর বন্ধু, সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু উপকার করতে গিয়ে গুলাম হায়দার পড়লেন অস্বস্তিতে। বড় আশা করে শশধর মুখার্জির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু লতার কণ্ঠ শুনে শশধর মুখার্জি বললেন, ‘একে এনেছেন কেন? এর কণ্ঠ কোনও নায়িকার সঙ্গেই মিলবে না। আর যা-ই বলুন, এই মেয়ের যা কণ্ঠ তা দিয়ে প্লেব্যাক হবে না।’ আর কেউ হলে হয়তো হতাশায় ভেঙে পড়ত। রাজকুমারী দুবে, আমীরবাঈ কর্ণাটকি, শামসাদ বেগম, নূরজাহান, জোহরাবাঈ আম্বালেওয়ালি, গীতা দত্ত বা সুরাইয়ার মতো ভারি কণ্ঠ তো তার নয়! অথচ তখন সেরকম কণ্ঠেরই জমজমাট বাজার। সে হিসেবে ১৭/১৮ বছর বয়সী একটা মেয়ের যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আর কী আশা থাকে! আশার কথাটা গুলাম হায়দারের মুখেই শুনেছিলেন লতা। ভদ্রলোক সেদিন জোর গলায় সবাইকে বলেছিলেন, ‘আমি বলছি, এই মেয়ে কিছুদিনের মধ্যে নূরজাহানকেও ম্লান করে দেবে, প্রযোজক-পরিচালকরা তখন ওর পেছনেই ছুটবে।’

সেখানেই গল্পের শেষ নয়। সেদিন গুলাম হায়দারের সঙ্গে বেরিয়েছেন লতা। গোরেগাঁও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গুলাম হায়দার শশধর মুখার্জিকে শোনানো সেই গান আবার শুনতে চাইলেন লতার কাছে। মাত্র ৯ বছর বয়সে যে মেয়ে রাগ খাম্বাবতি আর দুটো মারাঠি গান গেয়ে শোলাপুরের হাজার খানেক শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিল, তার আর যা-ই থাক-না-থাক, গানে কোনও ভয় নেই। তখন বৃষ্টি নেমেছে। ট্রেনও এসে গেছে। ট্রেনে উঠেই গান ধরলেন লতা; ট্রেনের হুইসেল, ঝিকঝিক শব্দ, যাত্রী-ফেরিওয়ালাদের চেঁচামেচি— এসবের মাঝেই। সিগারেটের টিনে তাল ঠুকতে ঠুকতে গান শুনলেন গুলাম হায়দার। মুখে কিছু বললেন না। ট্রেন থেকে নামিয়ে লতাকে সোজা নিয়ে গেলেন মালাদ-এর বোম্বে টকিজ স্টুডিয়োতে। কী আশ্চর্য, সেখানে লতা প্রশংসিত এবং 'মজবুর' ছবিতে গাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ!

হুসেইন লাল ভগতরাম, অনিল বিশ্বাস, নওশাদ এবং খেমচান্দ প্রকাশ— ভারতীয় সঙ্গীতের এমন চার দিকপালের সামনে গুনে গুনে ৩২ বার একটা গান গাইলেন, রেকর্ডিং হল তারপর। সেই যে পায়ের নিচে শক্ত একটুখানি মাটি পেলেন আর ফিরে তাকাতে হয়নি লতা মঙ্গেশকরকে। বাবার মৃতদেহের পাশেই যে ভাইটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিল তার চিকিৎসা সহ সংসারের যাবতীয় খরচ কোত্থেকে আসবে তা নিয়ে আর তেমন করে ভাবতে হয়নি কখনও। তবে ভাববেন না যে, ১৯৪৮ সালে 'মজবুর' ছবির ‘দিল মেরা তোড়া’ গানটি দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসার পর খুব সহজেই কোটি মানুষের মনে ঠাঁই করে উপমহাদেশের সঙ্গীতের অলিখিত মহারাণী হয়ে গেছেন লতা মঙ্গেশকর। বড় বন্ধুর পথ পেরিয়ে এসেছেন, এ পথে বন্ধু পেয়েছেন নিশ্চয়ই, তবে সদা-ছিদ্রান্বেষী সমালোচকও পেয়েছেন অনেক। কারণে-অকারণে সমালোচনা হয়েছে। হেমন্তের সঙ্গে একই মাইক্রোফোনে গাইতে গেলে যখন বাক্সের ওপর না দাঁড়ালে চলত না, সেই ছোট্টটি থাকার সময় থেকেই সইতে হয়েছে নানান সমালোচনা।

কণ্ঠ সমাদৃত হওয়ার পর কিছুদিন চলেছে হিন্দি আর উর্দু উচ্চারণ নিয়ে বিদ্রূপ। প্রথম সাক্ষাতে লতাকে ‘মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নতুন শিল্পী, মারাঠি মেয়ে, বেশ ভালো গায়’ এভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর দিলীপ কুমারও বলে ফেলেছিলেন, ‘ইনকা এক প্রোবলেম হোতা হ্যায়, ইনকে গানেমে ডাল-ভাতকি বু আতি হ্যায়।’ বিদ্রূপটাকে শুধু গায়ে মাখেননি, একেবারে মনে গেঁথে নিয়েছিলেন লতা। কয়েকদিনের মধ্যেই উর্দু শেখা শুরু করেন মৌলভী শফির কাছে। বাকিটা ইতিহাস। দিলীপজী প্রকাশ্যে বহুবার ‘বহেন লতা’র গানের প্রশংসা করেছেন তারপর এবং লতাও প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস, আমি কোনওদিন দিলীপজীর হয়ে কণ্ঠ দিতে পারলাম না!’ সাদা শাড়িতে মোড়ানো, আটপৌরে ভারতীয় নারীর অবয়ব নিয়ে সঙ্গীত ভুবন শাসন করে যাওয়া ভদ্রমহিলার পরিশীলিত কৌতুকবোধের পরিচয় ঠিকঠাক পেয়েছেন তো!

খ্যাতির শিখরে উঠলেও লতাজীর জীবনে দুঃখ অনেক। ছোটবেলা থেকেই কেএল সায়গলের ভক্ত। সেটা প্রথমত বাবার কারণেই। বাবা সায়গলকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, গান গাওয়ার প্রশ্ন উঠলেই বলতেন, 'সায়গলের ওই গানটা ধরত।' লতা নিজেও রেডিওতে খুব মন দিয়ে শুনতেন সায়গলের গান। বড় সাধ ছিল, একদিন বড় শিল্পী হবেন, সায়গলের পাশে দাঁড়িয়ে ডুয়েট গাইবেন। তো নিজের আয়ে প্রথম রেডিওটা কিনলেন লতা। চালিয়ে দিয়ে ভাবছেন বহুদিন পর একটু শান্তিতে বসে সায়গলজীর গান শুনবেন। একটু পরেই শুরু হল খবর। প্রথম খবর— কুন্দন লাল সায়গল আর বেঁচে নেই! সেই কষ্ট সইতে পারেননি লতা। কাঁদতে কাঁদতে ‘অপয়া’ রেডিওটাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন দোকানে। 

হতে পারে চিরকুমারী থেকে যাওয়াও বড় একটা দুঃখ। কেন বিয়ে করলেন না? জবাবে লতাজী সব সময়ই বলে থাকেন, ‘গান গাইতে গাইতে আর সংসারের কথা ভাবতে ভাবতে বিয়ে করার সময়টা পেলাম কই!’ সঙ্গীতে কম-বেশি নাম কামানো তিন বোন আশা, উষা আর মীনা এবং ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরকে এ অবধি নিয়ে আসতে গিয়ে লতাজীকে যে বলতে গেলে প্রাণাতিপাত করতে হয়েছে তাতে আর সন্দেহ কী! পরিবারের জন্য তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষার খবর তো সবাই জানেন। তবে অনেকেই যা জানেন না তা হল, নিজের বিখ্যাত সেই বাংলা গানের মতো সত্যি সত্যিই ‘প্রেম একবার এসেছিল’ এবং নীরবে নয়, জানিয়ে-শুনিয়েই এসেছিল লতাজীর জীবনে। প্রেমিক দুঙ্গারপুরের রাজপুত্র, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি, নির্বাচক রাজ সিং দুঙ্গারপুর। রাজ-পরিবার রাজ'কে সাধারণ ঘরের কোনও মেয়েকে বিয়ে করার অনুমতি দেয়নি। পরিবারের অমতে লতাকে তাই বিয়ে করেননি, তবে আজীবন ভালোবেসে গেছেন এক সময় রাজস্থানের হয়ে ৮৬টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার। এমনও হয়েছে, রাজ সিং দুঙ্গারপুর গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। পথে কোনও কাজে হয়তো থেমেছেন। গাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে খুব পরিচিত এক খালি গলার গান। মুগ্ধ, কৌতূহলী মানুষ এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘কে গান গাইছেন?’ স্বামী হতে না পারলেও, ভীরু তো নন, গর্বিত প্রেমিকের মতোই রাজ সিং দুঙ্গারপুর বলতেন, ‘তাঁকে আপনারা ভালো করেই চেনেন, তিনি আর কেউ নন, আপনাদেরই লতা মঙ্গেশকর।’  চিরবিদায় নিয়েছেন রাজ। লতাজী নিশ্চয়ই জীবনের আর সব দুঃখের মতো এ দুঃখও সয়ে চলেছেন অগোচরে!

কী পেয়েছেন, কী পাননি— এসবের হিসেব অনেক সাক্ষাৎকারেই চাওয়া হয়েছে। জবাব সব সময়ই এক এবং অভিন্ন- না পাওয়ার কোনও যন্ত্রণা, বড় কোনও আক্ষেপ তাঁর নেই। বাবা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা দেখে যেতে পারেননি, অকালে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন হৃদরোগে। বড় এই দুঃখ কিছুটা লাঘব করতে লতাজী পুনেতে বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল।

জীবনে অনেক প্রতিকূলতা এসেছে, দ্বন্দ্ব হয়েছে রফি, শচীন দেব বর্মনের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও। সব ঠিকও হয়ে গেছে এক সময়। সব ঘটনাতেই চেনা গেছে সংগ্রামী, আপসহীন, পেশাদার শিল্পী লতা মঙ্গেশকরকে। মোহাম্মদ রফির সঙ্গে কোনও ব্যক্তিগত সংঘাত ছিল না। লতা চেয়েছিলেন গানের জন্য শিল্পীর শতকরা ৫০ ভাগ রয়্যালটি আদায় করে নিতে। পুরো বিষয়টিতেই ছিল সব শিল্পীর স্বার্থচিন্তা। কিন্তু সহজ-সরল, সৎ মানুষ রফি মনে করলেন, প্রযোজকের কাছ থেকে একবার টাকা নিলে গানের ওপর শিল্পীর আর কোনও অধিকার থাকে না, সুতরাং লতার পাশে থাকতে পারবেন না! ব্যস, এই ছিল দ্বন্দ্বের কারণ। 

আরেকটা বিষয় এক সময় বড় বেশি কষ্ট দিত। নিন্দুকেরা বলতেন, লতা নতুনদের বরদাস্ত করতে পারেন না, তাঁদের উন্নতির পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। প্রথম প্রথম নীরব থাকতেন। হাস্যকর কথার প্রতিবাদ করলেও তো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যায়! কিন্তু তাঁর নীরবতা নিন্দুকদের নীরব করতে পারছিল না। অবশেষে নিজেকে বঞ্চিত করেই নতুনদের জন্য সুযোগ তৈরির অনন্য নজির গড়লেন। লতা মঙ্গেশকর চিরতরে নাম প্রত্যাহার করে নিলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড থেকে।

গত প্রায় দেড় দশক ধরে লতাজী সঙ্গীত জগতে সব প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে। হিন্দি ছবিতে গান কালেভদ্রে। তবে যখন গান, সে গান হয়ে ওঠে অসাধারণ। বাকিদের সঙ্গে তফাতটা ধরতে একটুও অসুবিধে হয় না। ৮১-তে পা দিলেন, অথচ কণ্ঠ শুনে বয়স ১৮ বলেও ভ্রম হতে পারে! ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুম্বাই ছবির জগতে কী অবিশ্বাস্য কাণ্ডটাই না করে চলেছে লতাজীর কণ্ঠ। ভাবা যায়, ২০ বছর বয়সে 'মহল' ছবিতে যিনি মধুবালার জন্য গেয়েছিলেন অমর সেই গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’, ৪৪ বছর বয়সে ডিম্পল কাপাডিয়ার জন্য তিনি 'ববি' ছবিতে গাইলেন ‘হাম তুম এক কামরেমে বনধ হো’, ৬৯ বছর বয়সে একই শিল্পী 'যব পেয়ার কিসিসে হোতা হ্যায়' ছবিতে ডিম্পলের মেয়ে টুইঙ্কেল খান্নার জন্য গাইলেন ‘মদহোশ দিল কি ধড়কন’, ৭৫ বছর বয়সে 'ভীরজারা' ছবিতে প্রীতি জিনতা'র জন্য অবলীলায় গেয়ে দিলেন ‘তেরে লিয়ে হাম জিয়ে!’ এমন কণ্ঠের কী প্রশংসা হতে পারে, কী উপমা খুঁজবেন তার জন্য? কোকিলকণ্ঠী, কিন্নরকণ্ঠী— সবই তো কারও না কারও জন্য ব্যবহৃত এবং অতিব্যবহৃত। বরং লতাজী-বন্দনা শেষ করা যাক 'ভীরজারা'র পরিচালক যশ চোপড়ার কথা দিয়ে। যশ বাকি শিল্পীদের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের পার্থক্যরেখা টানতে গিয়ে বলেছেন, ‘সব শিল্পী সঙ্গীতকে অনুসরণ করে, আর সঙ্গীত অনুসরণ করে লতাকে।’ 

১৯৫৫ সাল। 'চোরি চোরি' ছবির ‘রসিক বালমা’ সেরা গানের পুরস্কার পেল। শিল্পী লতাকে বলা হল অনুষ্ঠানে গানটা গেয়ে শোনাতে। লতাজী বললেন, 'না, যেখানে শিল্পীর স্বীকৃতি নেই, সেখানে আমি গাইব না।' টনক নড়ল আয়োজকদের। ১৯৫৮ সাল থেকে প্লেব্যাক সিঙ্গারের পুরস্কারও এল 'ফিল্মফেয়ার'এ। তাঁর পেশাদারিত্ব নিয়ে কথার শেষ নেই। বিরূপ মন্তব্যও করেছেন অনেকে। রয়্যালটি নিয়ে মোহাম্মদ রফির সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর বিষয়টি তো মুম্বাই ফিল্ম ইতিহাসেরই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর বাইরেও এমন অনেক ঘটনা আছে যেগুলো তাঁর চূড়ান্ত পেশাদারিত্বেরই প্রমাণ। ১৯৬২-র একটি ঘটনা। ‘বিস সাল বাদ’ ছবির ‘ক্যাহি দ্বীপ জ্বলে ক্যাহি দিল’ গানটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। কালজয়ী সেই গান গাওয়ার সুযোগ কিন্তু লতাজী হারাতে বসেছিলেন। তখন তিনি এতটাই অসুস্থ যে ডাক্তারের মনে হয়েছিল লতাজীকে দিয়ে আর কোনওদিন গান হবে না! কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়লে কি চলে? সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত কুমার (মুখোপাধ্যায়)'কে লতাজী বললেন, ‘কয়েকটা দিন বিশ্রামের সময় দিন, গানটা ঠিকই গেয়ে দেব আমি।’ তা-ই হল। বিশ্রাম নিয়ে ফিরলেন, গাইলেন এবং জিতে নিলেন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড! 

২৭ বছর পরও ঘটেছিল প্রায় একই রকমের ঘটনা। চিকিৎসক তাঁকে কয়েক মাস বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। কিন্তু বিশ্রাম নিতে গেলে তো আর ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ ছবির গানগুলো যথাসময়ে গাওয়া হবে না। একবার শিডিউল পিছিয়ে দিলে কত ক্ষতি সেটা লতাজীর চেয়ে বেশি ক’জনই বা জানেন! তো অসুস্থতা নিয়েই রেকর্ডিংয়ের দিনে লতাজী একদম সময় মতো স্টুডিয়োতে হাজির। সে অবস্থায় ৫টি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন একই দিনে! 

সবাইকে অবাক করে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জিতে নিল ভারত। লতাজী তখন লন্ডনে। ফাইনালে কপিল দেব বাহিনীর অবিশ্বাস্যভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর দৃশ্য মাঠে বসে দেখেছেন। ঘনিষ্ঠরা জানেন, ক্রিকেট ভক্ত লতা মঙ্গেশকরের জন্য একটা বিশেষ আসনের বরাদ্দ রয়েছে লর্ডসে। যা হোক, ফাইনাল শেষে লতাজী নিজে কপিল দেবকে অনুরোধ করলেন সদলবলে তাঁর ফ্ল্যাটে চলে আসতে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা দাওয়াত কবুল করেছিলেন। লতাজী মজাদার অনেক খাবারের সঙ্গে নিজের রান্না করা গাজরের হালুয়াও খাইয়েছিলেন তাঁদের। চীন-ভারত যুদ্ধের সময় এক অনুষ্ঠানে ‘অ্যায় মেরি ওয়াতন কে লোগো’ গানটা শুনে জওহরলাল নেহরু অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের সুর এতটাই আচ্ছন্ন করে, আবেগে ভাসায় মনকে! অভিনেত্রী নার্গিস বলতেন, ‘লতার গানের দৃশ্যে অভিনয় করার সময় আমার গ্লিসারিন লাগে না, আপনা-আপনিই কান্না চলে আসে!’ আর সঙ্গীত পরিচালক সাজ্জাদ হুসাইন কী বলেছিলেন শুনবেন? বলেছিলেন, ‘লতা যখন গায়, মাইক্রোফোনের সামনে বসে অন্যরা তখন কাঁদে।’

১৯৯৯ সালের কথা। রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত করা হল লতাজীকে। কিন্তু শিল্পী মানুষ, চাইলেও রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দায়িত্বে কতটা আর জড়াতে পারেন! তার ওপর শরীরটাও তখন খুব একটা বশে ছিল না। ফলে, অধিবেশনে বলতে গেলে যাওয়াই হত না। কিন্তু সবাই এটা মেনে নেবেন কেন? প্রণব মুখার্জী, নাজমা হেপতুল্লাহ, এমনকি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ শাবানা আজমি পর্যন্ত বলতে লাগলেন, 'সম্মানের ভাগ নেবেন, অথচ নামকা ওয়াস্তে সদস্য থেকে অধিবেশনে আসবেনই না, এ কেমন কথা!' লতাজী স্বভাবসুলভ বিনম্রতায় শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। পরে জানা যায়, সক্রিয় সদস্যের ভূমিকা পালন করতে না পারায় লতা মঙ্গেশকর তাঁর জন্য দিল্লীতে বরাদ্দ করা সরকারি বাসভবনে কখনও ওঠেননি, সংসদ সদস্য হিসেবে প্রাপ্য বেতন ভাতা সহ কোনও আর্থিক সুবিধাও কোনওদিন নেননি! 

শিকাগোতে একক সঙ্গীতানুষ্ঠান। সেদিন আবার লতাজীর ৬৯তম জন্মদিন। স্বাভাবিক নিয়মেই কেক কাটা হল। হলে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষ সমস্বরে গাইতে লাগলেন, 'হ্যাপি বার্থডে টু লতাজী!' এরই মাঝে দূর থেকে লতা মঙ্গেশকরকে ‘পাঞ্জাবের গর্ব’ দাবি করে এক শিখ সর্দার বলে উঠলেন, 'তুসি কুড়ি পাঞ্জাবদি হো।' হলে নেমে এল পিনপতন নিস্তব্ধতা। একটু সময় নিয়েই জবাবটা দিলেন লতা মঙ্গেশকর, 'আমি পাঞ্জাবের, আমি গুজরাটের, আমি সারা ভারতের; শুধু তাই বা বলি কেন, আমি পাকিস্তানেরও!'


Tuesday, 1 February 2022

একটি অন্তর্ঘাতী বাজেট

‘তুমি নেই আমি নেই, কেউ নেই কেউ নেই’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


বহু দিনের অভ্যেস খানিক মন দিয়ে বাজেট শোনা। যেন, আগামী এক বছরে অর্থনীতির চলার পথটি কিঞ্চিৎ আগাম ভেসে ওঠে মনে। একেবারে কান খাড়া করে শুনি। এবারে মাঝপথে ঘুম পেল। অথচ এই অর্থমন্ত্রীর বাজেটই গত চার বছর ধরে শুনছি; কই আগে তো ঘুম পায়নি? চোখ-টোখ কচলে সবটা শোনার পর একদম শেষে কেন জানি মনটা গুন গুন করে উঠল: ‘হরি, দিন তো গেল/ সন্ধ্যা হল…’। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখলাম খুব ব্যাজার মুখ করে বসে আছেন। উত্তরপ্রদেশে হিন্দু মেরুকরণের আস্ফালন মোটে কাজে দিচ্ছে না। অতএব, অর্থমন্ত্রী কী পড়লেন আর সব শেষে কী দাঁড়াল, সম্ভবত তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী নামকরণে ওস্তাদ। কতশত নাম আমরা পেয়েছি- ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্ট্যান্ড-আপ ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্টআপ ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণের গোড়াতেই তাই আরেক নতুন নাম শোনালেন: প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি। সেটি কী? না, সাতটি ইঞ্জিনে সওয়ার হওয়া এমন এক পরিকাঠামো-পরিকল্পনা যা নাকি আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে! এতদিন ওনাদের ‘ডবল ইঞ্জিন’ শুনেছি, বছরে ২ কোটি চাকরির গুলগাপ্পাও উপভোগ করেছি, কিন্তু একেবারে সাতটি ঘোড়ায় চড়ে সপ্ত সাগর পার? মনে পড়ল সুকুমার রায়কে:

 ‘একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত।তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।’

সে যাক গে।

অর্থমন্ত্রী শুরু করলেন মহামারি আক্রান্ত মধ্যবিত্ত ও অন্যান্য দুর্বল শ্রেণিগুলিকে ভরসা ও সুবিধা জোগানোর কথা বলে। সাতকাণ্ড রামায়ণ শেষে বাজেট ভাষণে মূলত পেলাম:

        বেসরকারি বিনিয়োগকে সহায়তা দিতে সরকারি বিনিয়োগের আশ্বাস;

        ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ঘোষণা;

        SEZ’এর রকমফের;

        নীলাচল ইস্পাত নিগম, এলআইসি ও আরও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ;

        কর্পোরেট সারচার্জ ১২ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা;

        ৫জি স্পেকট্রামের নিলাম ঘোষণার প্রতিশ্রুতি;

        সরকারের মূলধন খরচকে ৩৫.৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা;

        এবং

        ব্যক্তিগত আয়করে কোনও পরিত্রাণ না দেওয়া;

        জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে কোনও ব্যয় বৃদ্ধি না করা;

মোদ্দা কথায়, করে খাও গে যাও। এমনকি কৃষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি পালনেরও কোনও ঘোষণা নেই। অর্থাৎ, ধ্বস্ত অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির কোনও পরিকল্পনা নেই, অথচ ঝাঁপি উপুড় করে কর্পোরেট ক্ষেত্রের হাতে দেশের মূল্যবান সম্পদ ও সরকারি কোষাগার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা। এমন নির্লজ্জ ও নগ্ন বাজেট স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এই প্রথম।  

অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দ্বারা ব্লকচেইন প্রযুক্তি নির্ভর ‘ডিজিটাল টাকা’ প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু ডিজিটাল সম্পদের লেনদেনের ওপর ৩০ শতাংশ কর ধার্য করেছেন। কী আশ্চর্য স্ববিরোধ! তিনি যে ব্লকচেইন প্রযুক্তির অন্তর্জগৎ’কে জানেনই না। দুর্ভাগ্য, কেউ তাঁকে এ বিষয়ে ব্রিফ করেননি। কারণ, ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি’র যে লেনদেন হয় তা যতক্ষণ না আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় টাকায় রূপান্তরিত হয়ে জমা পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নাগাল পেতে কর ব্যবস্থা অক্ষম। একমাত্র ছোট বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষ, যারা ব্লকচেইনে ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে পণ্য ক্রয় করছেন বা তার লেনদেনে নিযুক্ত, তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তা টাকায় রূপান্তরিত করে নিজেদের দৈনিক সংসার চালাতে হয়। এইসব মানুষদের অর্জিত অর্থের ওপরেই ৩০ শতাংশ করের আঘাতটা পড়বে। অর্থমন্ত্রী কি জানেন না যে গত এক-দু বছরে আমাদের দেশে ছোট বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বহু গুন বেড়ে এখন ৩ কোটির কাছাকাছি। এঁরাই এখন মূলত শেয়ার বাজারের কারিগর। অথচ, যারা আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়, বড় বিনিয়োগকারী, তাঁরা কিন্তু ৩০ শতাংশ কর এড়াতে ভারতীয় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় ক্রিপ্টোকারেন্সি’কে রূপান্তর করবেন না, বিদেশের ব্যাঙ্কে জমা করবেন যেখানে করের হার সামান্য অথবা একেবারেই নেই।

অর্থমন্ত্রী আরও একটি শব্দ চয়ন করেছেন: blended finance। এ ভারী মজার। যেখানে সরকারি অর্থ ও সম্পদ কর্পোরেটওয়ালাদের অর্থ ও সম্পদের সঙ্গে blended হয়ে এমন খিচুড়ি হবে যে ‘তুমি নেই আমি নেই, কেউ নেই কেউ নেই’, ওড়ে শুধু মোদি-শাহ আদানি-আম্বানি।

এমনিতে বাজেট নিয়ে বেশি কিছু বলার থাকে না। কারণ, তা আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব মাত্র, যা আবার সারা বছর ধরে বদলে বদলে যায়। এবারে কিছু বলতেই হল। কারণ, খুব গায়ে লেগেছে। কয়েকটি লোক দেশ দখল করছে মিথ্যা ও পেশির জোরে।

প্রতিরোধ করুন।