মহাবিশ্বে উড়ল টাইম মেশিন!
শোভনলাল চক্রবর্তী
মহাবিশ্বের প্রথম আলোর খোঁজে অবশেষে মহাকাশে পাড়ি জমাল জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। ২৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে ফ্রেঞ্চ গায়ানার ইউরোপিয়ান কওরু স্পেসপোর্ট থেকে উৎক্ষেপণ করা হল টেলিস্কোপটি, যেটি বহন করে নিয়ে যায় একটা আরিয়ান রকেট। মহাকাশে যৌথভাবে এ টেলিস্কোপটি পাঠাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)। আর এ মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩০ বছর! সব ঠিকঠাক থাকলে একবিংশ শতকের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক অভিযান হবে এটাই। প্রায় এক মাস ধরে মহাকাশের বিশাল শূন্যতার মধ্য দিয়ে ছোটার পরে জেমস ওয়েব লক্ষ্যে পৌঁছবে। একে বলা হয় এল২ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট। গন্তব্যে যেতে যেতে ভাঁজ খুলবে জেমস ওয়েবের বিভিন্ন অংশের। লক্ষ্যে পোঁছনোর প্রায় ছয় মাস পরে এটি কার্যকর হয়ে উঠবে পুরোপুরি। ২০৩১ সাল পর্যন্ত সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রচুর তথ্য দেবে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের। খুঁজে বেড়াবে মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সির আলো।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ টেলিস্কোপের ওজন প্রায় ৬,২০০ কেজি আর আয়নার আকার ৬.৫ মিটার। আগামী ১০ বছর টেলিস্কোপটি কার্যক্ষম থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটিই হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও এটি ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী।
১৯৯৬ সালে প্রথম এই নভোদূরবীন বানানোর পরিকল্পনা করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ১৯৯৭ সালে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করা হয় তখন। এরপর শুরু হয় ঝামেলা। বারবার পেছতে থাকে উৎক্ষেপণ। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৮ তারিখ জেমস ওয়েব উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা পিছিয়ে যায়। এরপর নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২২ ডিসেম্বর। তবে খারাপ আবহাওয়ার কারণে সে তারিখও পিছিয়ে যায়। টেলিস্কোপটি মহাবিশ্বকে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোয় অবলোকন করবে। এর মূল আয়নাটি স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো বেরিলিয়াম ধাতুর ১৮টি ষড়ভুজ আকৃতির আয়না জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ফলে, হাবলের তুলনায় অনেক দূরের আলো ও বস্তু দেখতে পারবে এটি। উল্লেখ্য, আলোর গতি সেকেন্ডে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল। দূরবর্তী কোনও নক্ষত্র থেকে যখন আলো এসে আমাদের গ্রহ পর্যন্ত পৌঁছয়, তখন আমরা আসলে সেই আলোর যাত্রা শুরুর সময়কার অবস্থা দেখতে পাই।
অর্থাৎ, এই টেলিস্কোপ যে চিত্র ধারণ করবে, তা হবে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার চিত্র। সুতরাং, এর মাধ্যমে আমরা ‘অতীতের’ ছবি দেখতে পাব বলা যায়। সেই কারণেই বিজ্ঞানীরা একে বলছেন টাইম মেশিন। ১৮৯৫ সালে ৮৪ পাতার 'টাইম মেশিন' নামে একটি বই লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ জি ওয়েলস। সেই প্রথম কেউ ভাবলেন অতীত দেখার কথা। তারপর বিজ্ঞান এক লম্বা খোঁজ লাগালো, আইনস্টাইন থেকে স্টিফেন হকিং সবাই বললেন সম্ভব, কিন্তু...! সেই 'কিন্তু'কে অতিক্রম করেছে ওয়েব।
টেলিস্কোপটি এক মাস ধরে পৃথিবী থেকে ১০ লাখ মাইল দূরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে। এ সময় পৃথিবী থেকে এটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। জেমস ওয়েবের পূর্বসূরি হাবল টেলিস্কোপটি মাত্র ৩৪০ মাইল দূর থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। প্রতি ৯০ মিনিট পর পর পৃথিবীর ছায়ার অন্তরালে চলে যায় সেটি। চাঁদে অবতরণকারী অ্যাপোলো নভোযানের একজন স্থপতির নামে নামকরণ করা হয়েছে এই টেলিস্কোপ। এটি আগের যে কোনও টেলিস্কোপের চেয়ে শতগুণ বেশি শক্তিশালী হবে। এ টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ নিয়ে উদ্বেগও ছিল। টেলিস্কোপটির যাত্রা সহজ ছিল না স্বীকার করে নাসার কর্মকর্তা বিল নেলসন বলেছেন, আমাদের এটা অনুধাবন করতে হবে যে এখনও অসংখ্য কাজ বাকি আছে এবং সেগুলো খুব যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু আমরা জানি বড় পুরস্কারে বড় ঝুঁকিও থাকে। এটির ক্ষেত্রেও তাই। আর এই কারণেই আমরা অন্বেষণে সাহস দেখাই।
ওয়েব অসাধারণ একটি মিশন। আমরা যখন বড় স্বপ্ন দেখি তখন কী অর্জন করতে পারি তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এটি। আমরা সব সময় জানতাম যে, প্রকল্পটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টা হবে। কিন্তু, যখন আপনি একটি বড় পুরস্কার চান, আপনাকে একটি বড় ঝুঁকি নিতে হবে। টেলিস্কোপটির মূল লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন বছর আগের, অর্থাৎ, বিগ ব্যাংয়ের পরপরই সৃষ্ট আদি নক্ষত্রের তথ্য অনুসন্ধান করা। এ বস্তুগুলোর মধ্যে পারমাণবিক বিক্রিয়া থেকেই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম ভারী পরমাণুগুলো সৃষ্টি হয়। যেমন কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস ও সালফার সৃষ্টির জন্য এগুলো দায়ী। এর বাইরে এ টেলিস্কোপ দিয়ে দূরবর্তী নক্ষত্রের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা যাবে। কোনও গ্রহ বাসযোগ্য কিনা বুঝতে সাহায্য করবে এ টেলিস্কোপ। মিশনের সঙ্গে যুক্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেইডি হ্যামেল বলেছেন, ‘আমরা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। একটি নতুন সীমান্ত। এটাই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সম্পর্কে আমাদের রোমাঞ্চ তৈরি করেছে।’
বসে বসে দেখা ছাড়া টেলিস্কোপের বিশেষ আর কাজ নেই। ৩০ বছর ধরে হাবলও ওই কাজই করেছিল। উপহার দিয়েছিল মহাকাশের দারুণ সব ছবি। তবে জেমস ওয়েবের চোখ আরও সূক্ষ্ম, আরও বড় আয়না। তাতে ধরা পড়তে পারে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই আদ্যিকালের ছবি। কোটি কোটি আলোকবর্ষ থেকে ছুটে আসা প্রথম দিককার নক্ষত্রের আলো শনাক্ত করার ক্ষমতাও আছে এর। অনায়াসে দেখতে পাবে দূরের গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র। আরও নিখুঁতভাবে বলতে পারবে কোন গ্রহ বাসযোগ্য, কোনটি নয়। প্রাথমিকভাবে ওয়েব মহাকাশে তাকাবে তার ইনফ্রারেড চোখ দিয়ে। মানে খালি চোখে যা দেখা যাবে না, সেটাই দেখবে অনায়াসে। চারটি যন্ত্রের সমন্বয়ে ছবি তুলবে এটি। কভারেজে থাকবে ০.৬ থেকে ২৮ মাইক্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (হাবল টেলিস্কোপের ছিল ০.৮ থেকে ২.৫ মাইক্রন)। নাসা আশা করছে, এত সূক্ষ্ম চোখে মহাকাশে নানা ধরনের বস্তু কণা ও বিল্ডিং ব্লক তৈরির রহস্য এবার ধরা পড়বেই। আর এতে করে বোঝা যাবে দূরের গ্যালাক্সিতে আদৌ অন্য কোনও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা। আর তাই সব মিলিয়ে বিজ্ঞান জগৎ আবার জমজমাট।
মহাকাশ আর সৌরজগৎ নিয়ে আমাদের জানার আগ্রহ বরাবর।এই আধুনিকতম টেলিস্কোপ হয়তো সেই প্রয়োজন অনেকটাই মেটাবে।লেখাটির মাধ্যমে আমরা সমৃদ্ধ হলাম
ReplyDeleteজেমস ওয়েব টেলিস্কোপ নিয়ে এই রকম চমৎকার একটি প্রবন্ধের খুব দরকার ছিল। মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে যারা আগ্রহী তারা উপকৃত হবেন এই লেখা পড়ে। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete