Friday, 3 December 2021

সঞ্জয় মজুমদার

সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এক মানুষ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এমন একটা কিছু লিখতে হতে পারে, তা তো কখনও ভাবিনি। তাই দিনকতক কিছুটা স্তব্ধ হয়ে থাকা!

দিনান্তে সমস্ত কাজ অবসানে মানুষ যেমন ঘরে ফিরে আসে, সঞ্জয় সেভাবে আর ঘরে ফেরেনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও সে তার ভাবনাকে জারি রেখেছিল। আমরা অনেকে ধরতেই পারিনি, স্মার্ট ফোনের আঙ্গুলে যখন সে অবিরাম শব্দ খোদাই করে চলেছে, তখন তার ফুসফুস ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে জীবন-সায়াহ্নের অভিমুখে। তবুও সে অদম্য। চলে যাওয়ার একদিন আগেও সে তার নিকটজন সকলকে রোজকার মতো হোয়াটস অ্যাপে খবরের কাগজের পিডিএফ সংস্করণগুলো পাঠিয়েছে। যেন কিছুক্ষণের জন্যও সে মারণরোগের স্পর্ধাকে বরদাস্ত করতে রাজী নয়।

আমার সঙ্গে তার আলাপ তো চার-পাঁচ বছরের বেশি নয়! বইমেলায় ‘একক মাত্রা’র ছোট টেবিলে যখন পাঠকের হুমড়ি খেয়ে পড়া ভীড়, তখন ঠিক তার পিছনেই তার মুখটি প্রথম দেখেছিলাম। কিছু বলতে চাইছে, ভীড় ঠেলে পত্রিকাগুলোর কাছে আসতে চাইছে। আর সেই থেকেই আলাপ। সেই আলাপ গড়ায় খানিক বন্ধুত্বে ও তার একক মাত্রা’য় যোগদানে।

শুধুমাত্র কর্মঠ বললে খুবই কম বলা হয়। প্রখর, বুদ্ধিদীপ্ত এক মানুষ, বাঙালির গৎ-বাঁধা চিন্তা থেকে বহু যোজন এগিয়ে। কর্মসূত্রে একাডেমিক জগতের মানুষ হয়েও একেবারেই ‘সবজান্তা’, ‘নিজেকে জাহির করা’ ব্যক্তি নয়। তার প্রতিটি লেখার মধ্যেই ছিল এক অনাবিল খোঁজ ও সংস্কার-মুক্ত অন্বেষণ (এই ব্লগে সঞ্জয়ের অনেকগুলো লেখা আছে, অবশ্যই পড়ে নেবেন)। শুনেছি, তার একটি গ্রন্থ প্রকাশের পথে, যা না দেখেই তার চিরবিদায়।

সকলেই জানেন, ‘একক মাত্রা’র কাজ মানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ। এখানে বাবুয়ানার কোনও জায়গা নেই। যিনি লিখছেন, পত্রিকা বানাচ্ছেন, তিনিই আবার ঘাড়ে করে পত্রিকার কপি নিয়ে জেলার মেলায় যাচ্ছেন, কিংবা ঘুরে ঘুরে গ্রাহক সংগ্রহ করছেন। ‘একক মাত্রা’য় যুক্ত হয়ে সঞ্জয় এইসব কাজে নির্দ্বিধায় ও অনায়াসে হাত পাকিয়ে নিয়েছিল। একাডেমিক অচলায়তন ও মূঢ়তা ভেঙ্গে তার কর্মক্ষেত্র (যেখানে সঞ্জয় পড়াত) মুরলীধর গার্লস কলেজে ‘একক মাত্রা’র দু’ দুটি অনুষ্ঠান করা গিয়েছিল মূলত তার সৃজনশীল উদ্যোগ ও সহকর্মীদের অদম্য উৎসাহে। শুধুমাত্র তাই নয়, আধুনিক প্রযুক্তিতে সড়গড় সঞ্জয় কোভিড-সময়ে অনলাইন সেমিনারেরও আয়োজন করে (তখনও এইসব ব্যবস্থাদির তত চল হয়নি) সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

আরও বহু কথা বলার আছে। কিন্তু অনুজ কেউ যখন এভাবে হঠাৎ করে চলে যায় (২৯ নভেম্বর ২০২১), তখন কথাগুলোও কেমন জানি গলার কাছে এসে আটকে যায়। এ হেন জনপ্রিয় ও ছাত্রদরদী শিক্ষক এবং অন্বেষক মানুষ তো আজকাল বিরল, তাই আচম্বিতে সঞ্জয়কে হারানোর শোক এই মুহূর্তে অকল্পনীয় এখনও। জীবনে কোনও কোনও মানুষের সরব-নীরব উপস্থিতির তো কোনও সীমানা হয় না!  

5 comments:

  1. খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখেছি। কিন্তু একক মাত্রার প্রোগ্রামের সময় দেখেছি দক্ষ সংগঠক ছিলেন। চিন্তা ভাবনায় নতুনত্ব ছিল। ওনার মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক।

    ReplyDelete
  2. রুদ্ধবাক হয়ে আছি এই দুঃসংবাদ শুনে থেকে

    ReplyDelete
  3. ওঁকে প্রণাম। এই লেখাটা পড়ে মন আরও ভারাক্রান্ত হলো. এটা শুধু আমার নয়, সামাজিক ক্ষতি।

    ReplyDelete
  4. যেদিন সঞ্জয়দা চলে গিয়েছেন সেদিন রাত্রিবেলায় এককমাত্রা গ্রুপে অরুণাভ এই মেসেজটা দেয়ার পর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে । যদিও সঞ্জয়দার সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপ বা পরিচয় নেই তবুও এককমাত্রার বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাকে দেখেছিলাম তো । তাছাড়া এককমাত্রার ব্লগে ওনার অনেকগুলো লেখা পড়েছি । সেগুলো আমার দুর্দান্ত লেগেছে । অত্যন্ত সহজভাবে কঠিন বিষয়গুলিকে বলতে পারতেন সঞ্জয়দা । লেখাগুলো পড়ে মনে হতো তার অগাধ জ্ঞান ছিল বিভিন্ন বিষয়ে, কিন্তু তিনি সেসবের জাহির করতেন না এবং একেবারে সকলের বোঝার সুবিধার মতো করেই সেগুলোকে আমাদের কাছে তুলে ধরতেন । পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যা খুবই কম, কমছে । তাই তার মত ভালোমানুষের এভাবে হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় অন্য অনেকের মত আমারও খুব খারাপ লেগেছে । এই যেমন এগুলো বলতে বলতে সত্যি সত্যিই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । কত কাজ তিনি করেছিলেন, কত করা বাকি ছিল কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে তার মতো একজন ভালো মানুষের চলে যাওয়ায় আপনজনদের মতোই সমাজেরও প্রচুর ক্ষতি হলো । যাইহোক, জীবন তো এভাবেই চলবে এবং আমাদের তা মেনেও নিতে হবে-- মানিয়ে নিতে হবে । সঞ্জয়দার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল । 💐😔

    ReplyDelete
  5. খুব দুঃখের কথা। এমন ভাবে চলে যাওয়া! অনন্ত বেদনা ও শোকের বিষয়। আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তাঁর পরিবারের সকল সদস্য দের জন্য, বন্ধু ও নিকট জনের জন্য সহমর্মিতা জানাই।

    ReplyDelete