কৃষি পুঁজির সক্ষমতা
সোমনাথ গুহ
বামপন্থী আন্দোলনের প্রাথমিক পাঠ শুরু হত জমি দখলের লড়াই দিয়ে এবং তাতে শ্রেণি লাইন বোঝাটা আবশ্যিক ছিল। সেই শ্রেণি লাইনে কৃষি ক্ষেত্রে স্পষ্টতই পরিষ্কার একটা বিভাজন ছিল। একদিকে বিপুল সংখ্যক দুঃস্থ, নিরন্ন চাষি, বিপরীত দিকে জমিদার, মহাজন ও তাদের লেঠেল বাহিনী। আর এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতেন ভুমিহীন ও ক্ষুদ্র চাষি এবং কৃষি মজুরেরা।
আশির দশকে পাটনা এবং সন্নিহিত অঞ্চলে কৃষি মজুরদের নেতৃত্বেই গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী অগ্রণী বাহিনী গড়ে ওঠে। এঁদের আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, জমিদার ও ধনী চাষিদের দখলে থাকা উদ্বৃত্ত, খাস জমি দখল করে গরিব চাষিদের মধ্যে বণ্টন করা এবং দলিত ও পিছিয়ে পড়া জাতগুলির সামাজিক মান মর্যাদার আন্দোলন গড়ে তোলা। এই আন্দোলনে মধ্য চাষিদের অবস্থান ছিল দোদুল্যমান। এটা সমস্যা তৈরি করে, যা হয়ে ওঠে প্রায় অলঙ্ঘনীয়। সচেতন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মধ্য চাষিরা অনেক সময় আন্দোলনের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ে। এর ফলে আন্দোলন ধাক্কা খায়। আন্দোলন সম্পর্কে অভিযোগ ওঠে যে কৃষি শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে কৃষক ঐক্য গড়তে গিয়ে ব্যাপক কৃষক ঐক্যে ফাটল ধরানো হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, সমালোচনাটা তারাই করেছিল যাঁদের নিজেদের ভিন্ন কোনও আন্দোলন গড়ে তোলার বিন্দুমাত্র কোনও তাগিদ ছিল না।
এই একই সময়ে দেশের অন্তত তিনটি রাজ্যে ভিন্ন ধরনের কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের উত্থান ঘটে। তিনি ছিলেন উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানার সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী বালিয়ান খাপের সর্বেসর্বা। মহেন্দ্র সিং ছিলেন টিপিকাল ‘গেঁয়ো’ বা ‘রাস্টিক’ ভূস্বামী যিনি বিস্তীর্ণ খোলা জায়গায় খাটিয়ায় বসে হুঁকোয় সুখ টান দিতে দিতে কৃষক সমাজকে শাসন করতেন। ১৯৮৮ সালে দিল্লির বোট ক্লাবে পাঁচ লাখ কৃষক সমাবেশিত করে তিনি তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকারকে হিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মূল দাবি ছিল আখের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ ও জলের খরচ মকুব করা। পরবর্তীকালে কৃষি ঋণ মকুব এবং কৃষকদের জমির ক্ষতিপূরণের জন্য তাঁর সংগঠন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় লাগাতার আন্দোলন করেছে।
মহারাষ্ট্রের শরদ জোশি ১৯৮০ সাল নাগাদ ‘শ্বেতকারি সংগঠন’ নামে একটি কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন এক বহুমুখী মানুষ- একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ যিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রায় দশ বছর কাজ করেছেন। তিনি আখ, তুলো, পেঁয়াজের সহায়ক মূল্যের দাবিতে বহুবার আন্দোলন করেছেন। তিনি মনে করতেন যে কৃষিপণ্যের সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করার জন্য কৃষি উপকরণের দাম কীভাবে উৎপাদন মূল্যকে প্রভাবিত করছে সেটা বোঝা দরকার। তিনি স্বতন্ত্র এক কৃষক নেতা ছিলেন। উপরন্তু, নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন, ডব্লিউটিও এবং ডাঙ্কেল প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন, কারণ, তিনি মনে করতেন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানি করতে পারলে কৃষক উপকৃত হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন কৃষি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উপস্থিতি যত কম হয় তত ভালো এবং কৃষকদের উন্মুক্ত বাজার এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্পূর্ণ সুযোগ দেওয়া উচিত। কৃষি পুঁজির রূপান্তর বোঝার জন্য তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। এটা বিশেষ করে যে রাজ্যগুলিতে সবুজ বিপ্লব হয়েছে সেগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাঁর মতে, পুরনো কৃষির পরিবর্তে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি পণ্যের রফতানি ও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় কৃষক ভারতীয় পণ্য উৎপন্ন করবে, পশ্চিমি নয়। বহুজাতিকদের সাথে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা হবে। শিল্পপতিদের অনুদান প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু কৃষকদের নয়, কারণ কৃষকরা রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। তাঁর মতে একজন কৃষিজীবী শুধুমাত্র একজন কৃষক নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি। খাদ্যের প্রক্রিয়াকরণ, কৃষি পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, ব্যাপারী বা বাণিজ্যিক কৃষির ওপর তিনি জোর দেন। তিনি ‘ভারত বনাম ইন্ডিয়া’ আওয়াজ তোলেন এবং অভিযোগ করেন যে ইন্ডিয়ার অভিজাত শ্রেণি ভারতকে শোষণ করছে। এই শ্লোগানের মধ্যে সদ্য স্থগিত হয়ে যাওয়া কৃষক আন্দোলনের কর্পোরেট পুঁজি বিরোধী অনমনীয় মানসিকতার প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এই আশির দশকেই কর্নাটকের অধ্যাপক এমডি নাঞ্জুন্দাস্বামী বাঙ্গালোরে বহুজাতিক সংস্থা কেএফসি আক্রমণ করে হৈচৈ ফেলে দেন। নাঞ্জুন্দাস্বামী শরদ জোশির পুরো বিপরীত অবস্থানে ছিলেন। তিনি ডব্লিউটিও'র মুখর সমালোচক ছিলেন এবং তৃতীয় বিশ্বে বহুজাতিক সংস্থাগুলির ব্যবসা করার বিরোধী ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালে ‘কর্নাটক রাজ্য রায়ত সংঘ’ (কেআরআরএস) স্থাপিত করেন যা কৃষির কর্পোরেটিকরণ ও বহুজাতিক সংস্থার তীব্র বিরোধিতা করে। তাঁর মতে, ভারতে বহুজাতিক সংস্থার ব্যবসা করা নতুন করে উপনিবেশ স্থাপন করার শামিল। কেএফসি ছাড়াও তাঁর সমর্থকরা কার্গিল, পেপসি, ম্যাকডোনাল্ড ইত্যাদি কোম্পানির বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, মনস্যান্টোর জিএম শস্য পুড়িয়ে দেন। তিনি মনে করতেন, সবুজ বিপ্লব ভারতীয় কৃষির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, পরিবেশ ধ্বংস করেছে। সবুজ বিপ্লব চাষিকে দেনাগ্রস্ত করেছে, তাঁদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ইউরোপের মতো এখানেও কৃষকরা তাঁদের জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। আজকের বাতিল হয়ে যাওয়া কৃষি আইন কৃষকদের মধ্যে একই ধরনের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। কেআরআরএস ফসলের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি, নিখরচায় বিদ্যুৎ, সারের জন্য অনুদান ইত্যাদি দাবি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করেছে।
আশির দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের একটা সারাংশ করা যেতে পারে। প্রথমত, যে রাজ্যে সবুজ বিপ্লব হয়নি, সেখানকার আন্দোলনের প্রকৃতি, যে রাজ্যে সবুজ বিপ্লব হয়েছে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি বা উদ্বৃত্ত ও খাস জমি বন্টনের জন্য আন্দোলন বিহারের অন্য জেলা বা রাজ্যে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পরেই পাঞ্জাবে দলিত ক্ষেতমজুররা যে রেল রোকো আন্দোলন করেন, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে সেখানে তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির কোনও দাবিই ছিল না। তাঁদের মূল দাবি ছিল ঋণ মকুব করা এবং বিল না দেওয়ার জন্য ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা। অসমে অখিল গগৈ'এর ‘কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি’ মূলত বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে ভুমিহীন চাষির সংখ্যা ১১.২৪ শতাংশ, এক একরের কম জমি এমন চাষির সংখ্যা ৪০.১১ শতাংশ। অথচ জমির প্রতি কৃষকের আর কি সেই আকর্ষণ আছে? থাকার কথা নয়, কারণ জমি নিয়ে কী হবে যখন চাষ আর লাভজনক নয়? একজন দরিদ্র কৃষিজীবীর মোট উপার্জনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অন্যান্য কাজ থেকে আসে। সেই কারণে যে সব রাজ্যে কৃষকের গড় জমি কম তাঁরা এমএসপি বা বিদ্যুৎ বিল মকুবের জন্য আন্দোলনে কোনও আকর্ষণ বোধ করেন না।
দ্বিতীয়ত যেটা লক্ষণীয়, উল্লিখিত তিনটি রাজ্যেই কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি ছিল এমএসপি বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, যার ফলস্বরুপ স্বামীনাথন কমিটি তৈরি হয়। সহায়ক মূল্যের দাবি সবুজ বিপ্লবের বাইরের রাজ্যেও ছড়ায়। মধ্যপ্রদেশের মতো একটি পিছিয়ে পড়া রাজ্যে ২০১৭ সালে সহায়ক মূল্যের জন্য আন্দোলনে মন্দসৌরে ছ' জন কৃষক মারা যান। এই আন্দোলন করছেন এমন কৃষকরা যাঁদের অন্তত কিছু জমি আছে, যাঁরা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন। স্বাভাবিক ভাবেই কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি জমি বা মজুরি বৃদ্ধি থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, মান্ডি ব্যবস্থার দিকে সরে গেছে; আন্দোলনের নেতৃত্বও ভুমিহীন কৃষকের থেকে মধ্য ও ধনী কৃষকের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, সবুজ বিপ্লবের কারণে গ্রামে বিপুল ব্যাংক পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। এক সময় ব্যাংক থেকে চাষির ঘরে ঘরে গিয়ে ট্র্যাক্টরের ঋণ দেওয়া হত। ট্র্যাক্টরের জন্য বেশি ঋণ দিতে পারলে ব্যাংক অফিসারদের আলাদা ইনসেন্টিভ দেওয়া হত। যেখানে সবুজ বিপ্লব হয়নি সেখানেও ঢেলে কৃষি ঋণ দেওয়া হয়েছে। উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, পোকা মারার ওষুধ, স্প্রে'র কারণে গ্রামাঞ্চল বহুজাতিক সংস্থার লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এসবের ফলে সাবেকি সামন্ততান্ত্রিক পুঁজির চরিত্রের রূপান্তর ঘটে। জমি, মহাজনী কারবারে বন্ধক থাকা পুঁজি সচল বাণিজ্যিক, ব্যাপারী পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। এই নব্য পুঁজির প্রতিনিধিরাও আর সেই লেঠেল পরিবৃত জমিদার/জোতদার নয়। এঁদের মধ্যে রাকেশ টিকায়েতের মতো সাবেকি ভূস্বামী যেমন আছেন, তেমনি আছেন দর্শন পাল সিং'এর মতো চিকিৎসক-বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ভোট বিশারদ যোগেন্দ্র যাদব, এনআরআই ব্যবসায়ী, দলিত ও মহিলা আন্দোলনের নেত্রী।
সবুজ বিপ্লবের কুফলে ভারতীয় কৃষি জর্জরিত হয়েছে আবার এই সবুজ বিপ্লবের কারণেই কৃষি পুঁজি উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং তা এতটাই যে আজ কর্পোরেট পুঁজির সাথে টক্কর দিতে সক্ষম; তার দাপটে আম্বানি-আদানিদের সমর্থন পুষ্ট রাষ্ট্রকেও পিছু হঠতে হয়। গ্রামাঞ্চলে এই পুঁজির উত্থান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে স্বস্তিদায়ক, একটি অতি প্রয়োজনীয় দখিনা বাতাস।
No comments:
Post a Comment