Thursday, 9 December 2021

প্রকৃতি পরিবর্তনের রূপ

কেন 'জাওয়াদ' পরিণত হল নির্বিষ নিম্নচাপে?

শোভনলাল চক্রবর্তী


পৃথিবীর বুকে এখন একদল নতুন প্রজাতির মানুষ তৈরি হয়েছেন যাঁদের বলে নেটিজেন। এনারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমস্ত খবর সংগ্রহ করেন ও প্রচার করেন। এর মধ্যে থাকে প্রচুর ভুয়ো খবর, যার সত্য-মিথ্যা কেউ যাচাই করে দেখেন না। তেমনই সব নেটিজেনরা 'জাওয়াদ' ঝড় নিয়ে সমাজমাধ্যমে ঝড় তুলেছেন। নেটিজেনদের যেন খানিকটা মন খারাপ, কারণ 'জাওয়াদ' তাঁদের হতাশ করল। অনেক নেটিজেন ক্যামেরা রেডি করে বসেছিলেন সমাজমাধ্যমে ঝড়ের প্রথম ছবি দেবেন বলে। অনেকে নিষেধ না মেনে হাজির হয়েছিলেন সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলে, ঝড়ের সময় 'লাইভ' হবেন বলে। সে সব শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল না, কারণ ঝড় পরিণত হল নিম্নচাপে। 

এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এর পরেই নেটিজেনরা শুরু করলেন- কেন ঝড় তার শক্তি হারাল, সেই কারণ নির্ণয় করার। আর তাতে যে সব চমকপ্রদ ব্যাখ্যা উঠে এল, তা নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে কাঁড়ি কাঁড়ি মিম। যে ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে তা হল এই যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বেড়ে যাওয়া সমুদ্রের উষ্ণতা। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে নেটিজেনরা ভাবছেন, এটা ভালো। সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বেড়েছে, এ তথ্যও সঠিক। কিন্তু 'জাওয়াদ' কেন ধাপে ধাপে শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণাবর্ত থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে ফুঁসতে থাকা অবস্থা থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরিণত হল নির্বিষ নিম্নচাপে, তা ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের। তাঁদের মতে, এর কারণ গভীর চিন্তার। তাঁরা দেখেছেন, সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি নয়, বরং 'জাওয়াদ'এর ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। দক্ষিণবঙ্গ যে বড়সড় দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেল, তার কারণ প্রধান কারণ উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের শীতলতা। 'জাওয়াদ' তৈরি হয়েছিল থাইল্যান্ড উপকূলে। এই ঘূর্ণাবর্তকে ইন্ধন জুগিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত করেছিল ভারত মহাসাগরের সমুদ্রতলের অতিরিক্ত তাপমাত্রা। কয়েকশো কিলোমিটার আসার পর সেই তাপমাত্রাই কেড়ে নিল ঘূর্ণিঝড়ের সব তেজ। কোনও ঘূর্ণিঝড় শেষ পর্যন্ত কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে, তা নির্ভর করে বাতাসের অভিমুখের উপরে। 'জাওয়াদ'কে সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় বারো কিলোমিটার উপরে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা যে ভাবে ঠেলেছে, তাতে শেষ পর্যন্ত সেটি বাংলার খুব কাছ দিয়েই গেল। যদিও তখন তার আর শক্তি প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সব শক্তি শেষ হলে কী হবে, নিম্নচাপ হওয়ায় ডিসেম্বর মাসের বৈশিষ্ট্য বিরোধী অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে। 

পশ্চিমবঙ্গের ঘূর্ণিঝড় প্রবণ মাস হল অক্টোবর আর নভেম্বর। ডিসেম্বর মাসে এখানে ঘূর্ণিঝড় হয় না। গত ৪০ বছরে ডিসেম্বর মাসে বাংলায় ঘূর্ণিঝড়ের নজির মাত্র একটি। ১৯৮১ সালের ৯ ডিসেম্বর থ্রি বি নামের ওই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার। প্রাণহানি হয়েছিল অন্তত ২০০ জনের, বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন ১০ লক্ষ মানুষ। সে কথা মাথায় রেখে ঝড়ের মুখ বাংলার দিকে ফিরতে রীতিমতো চিন্তায় পড়েছিলেন প্রশাসনিক কর্তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের ইন্ধনে তৈরি ঘূর্ণিঝড়কে শান্ত করে দিল সমুদ্রই। বিজ্ঞানীদের মতে, ঘূর্ণিঝড় তৈরি হতে সমুদ্রতলের উষ্ণতা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। যেখানে 'জাওয়াদ' তৈরি হয়েছিল সেখানে সমুদ্রতলের উষ্ণতা ছিল ২৮-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। ফলে, জলীয় বাষ্পের জোগান পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি 'জাওয়াদ'এর। কিন্তু এরপর বাতাসের দিক অনুযায়ী সরতে সরতে 'জাওয়াদ' এমন জায়গায় এসে হাজির হয়, যেখানে সমুদ্রতলের উষ্ণতা কম। ফলে, জলীয় বাষ্পের ঘাটতি ঘটায় নির্বিষ হয়ে পড়ে সে। এই ঘটনা ঘটে ওড়িশায় ঢোকার আগে পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে। ফলে, ওড়িশা সীমানা পার করে বাংলায় ঢোকার সময় সেটি নিছকই নিম্নচাপ। কিন্তু তবুও বছরের শুষ্কতম মাসে, অর্থাৎ ডিসেম্বরে যে বৃষ্টি হল, তার জন্য দায়ী নিম্নচাপ। 

অসময়ের এই বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লেন কৃষিজীবীরা। ধান আগেই কেটে নেওয়ার ফলে কিছুটা রক্ষা পেলেও, ক্ষতি হয়েছে সবজি, ফুল এবং আলু চাষের। মাঠে থাকা সরষে গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ক্ষতি হয়েছে পটল, ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষের। নিম্নচাপ এবং অমাবস্যার কোটালের জোড়া ফলায় জলোচ্ছ্বাসের জেরে বাঁধ ভেঙ্গে জল ঢুকে পড়েছে বহু সমুদ্র তীরবর্তী চাষের জমিতে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেমন সমুদ্রতলের উষ্ণতা বৃদ্ধি তৈরি করবে জোরালো ঘূর্ণিঝড়ের, তেমনই আবার 'ঠাণ্ডা সমুদ্র' ঘটাতে পারে এই ধরনের অসময়ের নিম্নচাপ। ভারতের সমুদ্র উপকূলে এই ধরনের 'ঠাণ্ডা সমুদ্রে'র ঘটনা প্রথম ঘটল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, যেমনটা আমরা ভূগোলে পড়ে থাকি, সমুদ্রতলের উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটলে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমুদ্রে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে জলপ্রবাহ দেখা যায়। ফলে, ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপ বেশ কিছুটা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতলের উষ্ণতা বৃদ্ধি স্বাভাবিক জলস্রোতকে ব্যাহত করছে। ফলে, এক সমুদ্রে যখন উষ্ণতা অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে, তখন অন্য সমুদ্রে তার তুলনায় উষ্ণতার হ্রাস হচ্ছে। এই ঘটনা বিজ্ঞানীরা ইতিপূর্বে লক্ষ করলেও একটি ঘূর্ণিঝড়ের উপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে, তা প্রথম দেখিয়ে দিল 'জাওয়াদ'। ভবিষ্যতে অসময়ের আরও নিম্নচাপের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

লেখা শুরু করেছিলাম নেটিজেনদের কথা দিয়ে, শেষ করা যাক তাঁদের কথা দিয়েই। একজন নেটিজেন পরামর্শ দিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরকে মনস্তাত্ত্বিকের কাছে নিয়ে যেতে, এত ঘনঘন ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার লক্ষণ ভালো নয়! আসলে কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকের কাছে এক্ষুনি যাওয়ার কথা তাঁদের যারা জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে বসে থেকে, যেন কিছুই হয়নি ভাব করে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রকৃতি কিন্তু বারবার তার পরিবর্তনের রূপ তুলে ধরছে মানুষের সামনে, কিন্তু মানুষের কোনও হেলদোল নেই। আর কী কী হলে মানুষের হুঁশ ফিরবে সেটা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।


No comments:

Post a Comment