নিরন্তর জীবন-সংগ্রাম
সূর্যশেখর দাস
এক ব্যতিক্রমী ছবি 'স্যার'। মালিক অশ্বিনের সঙ্গে গৃহ পরিচারিকা রত্নার স্নিগ্ধ প্রেমের কাহিনি চমৎকার ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন পরিচালিকা রোহেনা গেরা।
অশ্বিন নিউ ইয়র্কে ছিলেন। কিন্তু ভাই অসুস্থ হওয়ায় মুম্বই ফিরে আসেন। অশ্বিন এবং তাঁর প্রেমিকা সাবিনা গ্রামের বাসিন্দা রত্নাকে গৃহ পরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু অশ্বিনের সঙ্গে সাবিনার সম্পর্ক ভেঙে যায়! ওদিকে পণ দিতে হবে না- এই আনন্দে রত্নার মা-বাবা রত্নার খুব দ্রুত বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের চার মাস পরেই রত্না বিধবা হন! তখন রত্নার বয়স মাত্র ১৯ বছর। রত্নার মতে, ওই বয়সে গ্রামের অনেক মেয়েরই জীবন কার্যত ফুরিয়ে যায়। কিন্তু উনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নন। ফ্ল্যাটে শুধু একাকী অশ্বিন, আর কেউ নেই, সমাজের আর পাঁচজন কী দুর্নাম ছড়াবে- এসব উনি গুরুত্ব দেননি। তাঁর অশ্বিন স্যারকে বরাবরই ভালো মানুষ মনে হয়েছিল। রত্না অত্যন্ত পরিশ্রমী। কাজের ফাঁকে উনি অশ্বিনের অনুমতি নিয়েই টেলরিং'এর কোর্স করতে শুরু করেন। ওঁর ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ওঁর কাজে নিষ্ঠা দেখে অশ্বিন তাঁকে সেলাই করার একটি মেশিনও কিনে দেন। অশ্বিন রত্নার সঙ্গে কখনই খারাপ ব্যবহার করতেন না। ক্রমশ তাঁরা একে অপরকে বুঝতে শুরু করেন। অশ্বিনের রত্নার প্রতি প্রেম জন্মায়। কিন্তু রত্না বুঝিয়ে দেন যে উনি হলেন একজন গৃহ পরিচারিকা এবং অশ্বিন হলেন তাঁর স্যার- এই পরিস্থিতিতে তাঁদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক তৈরি হলে সমাজ কখনই ভালো চোখে দেখবে না। অথচ এর পরেও ওঁদের মধ্যে কোনও তিক্ততা তৈরি হয় না! একটা সময়ে রত্না কাজ ছেড়ে চলে যান। অশ্বিনও নিউ ইয়র্কে ফিরে যান। ওদিকে রত্না অশ্বিনের এক বন্ধুর ফ্যাশন ডিজাইনিং'এর অফিসে কাজ পান। রত্না বুঝতে পারেন, অশ্বিনই তাঁর নাম সুপারিশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত এক অপরূপ স্নিগ্ধতার মধ্য দিয়ে ছবিটির পরিসমাপ্তি ঘটে। রত্না এবং অশ্বিনের ভূমিকায় যথাক্রমে তিলোত্তমা সোম এবং বিবেক গোম্বার অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত মহিলাদের এক বড় অংশ গৃহ পরিচারিকা হিসেবে কাজ করেন। গৃহ পরিচারিকারা অবশ্যই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। তাই এঁদের ন্যূনতম বেতন-কাঠামো নেই। মালিকপক্ষ বা নিয়োগকারী এঁদের যখন-তখন ছাঁটাই করে দেন। অনেক শিক্ষিত মালিকও ঠাণ্ডা মাথায় এঁদের প্রাপ্য বেতন থেকে বঞ্চিত করেন। পরিচারিকাদের নির্দিষ্ট ছুটির কোনও বালাই নেই। উল্টে কাজে সামান্য ভুল হলেই অনেকের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা জোটে। এঁদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বই পায় না। অনেক সময়ে গৃহ পরিচারিকারা যৌন নিগ্রহের শিকার হন। সব কিছু জেনে-বুঝেও এঁরা মুখ-বুজে সহ্য করতে বাধ্য হন। কারণ, প্রতিবাদ করলে কাজটা চলে যাবে। কাজ চলে গেলে ওঁরা খাবেন কী? অনেকের স্বামী আবার উপযুক্ত কাজ করেন না। কারওর স্বামী আবার চূড়ান্ত মদ্যপ এবং অত্যাচারী। বহু পরিচারিকাকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। সেই সূত্রে আলাদাভাবে ইলেকট্রিক বিল মেটাতে হয়। সেই সঙ্গে ডাক্তার-ওষুধপত্রের খরচ তো লেগেই রয়েছে। আবার কেউ প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক কিংবা অন্য কোনও সূত্র থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাই ঋণ শোধ করার দায় এঁদেরকেই নিতে হয়। এঁরা খুব কষ্ট করে মেয়েদের বিয়ে দেন। সেই সব মেয়েদের অনেকেই শ্বশুরবাড়িতে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে আবার বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাছাড়া মেয়ে গর্ভবতী হলে তার খাওয়া-পরা এবং চিকিৎসার খরচও বহন করতে হয়। ফলে, সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট গৃহ পরিচারিকাদের জীবন সত্যিই নরক হয়ে ওঠে। নানান দায়-দায়িত্বের বোঝা বইতে গিয়ে ওঁরা কার্যত ভারবাহী পশুতে পরিণত হন। তার ওপর এই কোভিড পরিস্থিতিতে এইসব পরিচারিকাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতি গত বছরের জুন মাসের শেষ দিকে প্রায় ৫৫০০ জন গৃহ পরিচারিকার ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ৫৬ শতাংশ গৃহ পরিচারিকা লকডাউনের জাঁতাকলে পড়ে পুরোপুরি রোজগারহীন হয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে মাত্র ৬ শতাংশ পরিচারিকা তাঁদের জীবিকা ঠিকঠাক বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। গত বছর লকডাউন উঠে যাওয়ার পর যে তাঁদের অবস্থা আবার ভালো হয়ে গিয়েছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। আবার ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইটস ইউনিয়ন (Domestic Workers Rights Union), বৃহৎ ব্যাঙ্গালোর গ্রুহকর্মীক সংঘ (Bruhat Bangalore Gruhakarmika Sangha) এবং মানেগেলাসা কার্মীকর ইউনিয়ন ( Manegelasa Kaarmikara Union) গত বছরের মে মাসে বেঙ্গালুরুর ২৪০০ জন গৃহ পরিচারক-পরিচারিকাদের ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী মালিকপক্ষ বা নিয়োগকর্তা ৮৭ শতাংশ পরিচারক-পরিচারিকাকে লকডাউনের সময় কাজে আসতে বারণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কর্মী গত বছরের এপ্রিল মাসের কোনও বেতনই পাননি! যে সব কর্মীর বয়স পঞ্চাশের বেশি তাঁদের প্রায় ৫০ শতাংশ লকডাউনের ধাক্কায় কর্মহীন হয়েছিলেন। এইসব ভুক্তভোগী কর্মীদের একটা বড় অংশ হলেন পরিচারিকা। মনে রাখতে হবে, 'ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স'দের ৭৬.২ শতাংশই হলেন মহিলা। এঁদের অনেকেই বিধবা কিংবা স্বামী থেকেও নেই। কারও সন্তান থাকলেও সে আবার তার মায়ের কোনও দায়িত্ব পালন করে না। এমতাবস্থায় কর্মহীন হলে এইসব পরিচারিকাদের পেট চলবে কী করে?
আবার গত বছরের লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক দুর্দশা আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছি। এই হতভাগ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অবশ্যই বহু গৃহ পরিচারিকা রয়েছেন। কোভিড-বিধ্বস্ত লকডাউনের সময় তাঁরা কেমন ছিলেন সেটা খুব ভালোভাবেই বোঝা গিয়েছে! করোনা-আক্রান্ত এই সময়ের বেশ কয়েক বছর আগেই নোবেল জয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলোর করা গবেষণা আমাদের জানিয়েছিল যে বহু পরিচারিকা অপুষ্টিতে ভোগেন। কোভিড-১৯'এর 'আশীর্বাদ'এ এই অপুষ্টির কালো থাবা আরও প্রসারিত এবং মারাত্মক হয়ে উঠেছে। তাই, বর্তমান সময়ে করোনার 'কামড়' খানিকটা দুর্বল হলেও তাঁদের সমস্যা মিটে যায়নি।
গৃহ পরিচারিকারা যাতে ভালো থাকেন সে ক্ষেত্রে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে- এ কথা বলতে পারলে হয়তো খুব ভালো হত! হ্যাঁ, পরিচারিকারা যাতে 'ন্যূনতম বেতন আইন'এর(১৯৮৪) আওতায় আসেন সে ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। আবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'লক্ষ্মীর ভান্ডার' প্রকল্প এঁদের আর্থিক দুরাবস্থার ক্ষতে মলম জুগিয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষে একা এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। যাঁরা পরিচারিকাদের নিয়োগ করেন তাঁদের এ ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। এটা সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে পরিচারিকারা ঠিক সময়ে বেতন এবং পুজোর 'বোনাস' পান। 'কাজের মেয়েদের' রোগ-অসুখ করলে সেটা মানবিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করতে হবে।
'স্যার' ছবিটি পরিচারিকাদের যাঁরা মালিক তাঁদের খুব মন দিয়ে দেখা উচিত। ওই সিনেমায় অশ্বিন সব সময়ই রত্নার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। অশ্বিন রত্নার বোনের বিয়ের সময় জোর করেই কিছু টাকা রত্নার হাতে গুঁজে দিয়েছেন। আবার ওঁর পরিচিত কেউ যখন রত্নাকে গাল-মন্দ করেছেন অশ্বিন কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করেছেন। এবং উনি কখনই রত্নাকে লোভনীয় 'এক টুকরো মাংস' ভাবেননি। হ্যাঁ, উনি এক দিনের জন্যও ওঁর পরিচারিকাকে বিছানার সম্পর্কে যেতে বাধ্য করেননি। এমনকি রত্না যখন বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সামাজিক বিভাজনের জন্য তাঁর সঙ্গে অশ্বিনের সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব নয়, তখনও অশ্বিন হিংস্র হয়ে ওঠেননি। সব থেকে জরুরি বিষয়টা হল, অশ্বিন রত্নাকে একজন মানুষ হিসেবে পুরোপুরি মর্যাদা দিয়েছেন।
অশ্বিনের কাছ থেকে গৃহ পরিচারিকাদের নিয়োগকর্তারা অনেক কিছু শিখতে পারেন।
ভালো লাগলো লেখাটি। স্যার ছবিটা দেখেছি।সত্যিই ভালো
ReplyDeleteবাহ্ খুব ভালো লিখেছো সূর্য !!!!! 👌🏼👌🏼👌🏼👍🏼🌹
ReplyDelete