বুদ্ধিজীবীর স্বপ্নবিলাস!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
(আনন্দবাজার পত্রিকায় গত ১ অক্টোবর ২০২১'এ প্রকাশিত সুগত মারজিৎ'এর নিবন্ধের জবাবে সমালোচনামূলক এই লেখাটি চিঠির আকারে গত ২ অক্টোবর সকালে ইমেলে আনন্দবাজার দফতরে পাঠানো হয়। আজও চিঠিটি প্রকাশ না পাওয়ায় সেই পুরনো সংশয়ই দৃঢ়বদ্ধ হল যে আনন্দবাজার আছে আনন্দবাজারেই। তারা বিরুদ্ধ-সমালোচনা ও মতামতকে বরাবরই উপেক্ষা ও ঘৃণা করে। সে যাক গে, অপেক্ষার সুযোগ নিয়ে লেখাটিকে কতকটা পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে এখানে প্রকাশ করা হল।)
‘আজ-কালের গল্প, পরশুর নয়’ নিবন্ধে (আনন্দবাজার, ১/১০) সুগত মারজিৎ আক্ষেপ করেছেন যে, বুদ্ধিজীবীদের কথা আমজনতা শুনতে চাইছেন না। তাঁর মতে, জনতা যেন অনেক বেশি স্বার্থগন্ধ লালায়িত; কোথায় কোন রাজনৈতিক নেতা কোন মন ভোলানো কথা বললেন বা জনমোহিনী প্রকল্পের কিছু তোড়া মুখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হল- সেদিকেই তাঁদের মন। মোদ্দা কথায়, নিজ সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে বৃহৎ করে কিছু ভাবার চেষ্টা করা, এতে যেন তাঁদের (আমজনতা) বড্ড বেশি অনীহা। পড়ে ভালো লাগল যে তিনি এ বিষয়ে তাঁর হতাশার কথা অকুন্ঠ চিত্তে ব্যক্ত করেছেন।
প্রশ্ন হল, বুদ্ধিজীবীদের কথা কে কবে শুনেছেন? তার চেয়েও আরও বড় কথাটি হল, বুদ্ধিজীবী কে বা কারা? প্রথমত, স্পষ্ট করে নেওয়া যাক, বাংলা বাজারে ‘বুদ্ধিজীবী’ বর্গটির জনপ্রিয় চল কবে থেকে!
এই শতকের প্রথম দশকে মূলত বাংলা টিভি সংবাদ চ্যানেলের আলোচনার আসর থেকে এই শব্দটির ধীরে ধীরে জনপ্রিয় উদ্ভব। বিশেষ বিশেষ বিষয়ের ওপর আলোচনার আসরে বিষয়-বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে শব্দবন্ধটি মিডিয়াকুল দ্বারা বার বার বর্ষিত হওয়ার ফলে সমাজে এর একটি অস্তিত্ব-গ্রাহ্যতা তৈরি হয়। বিশেষত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে শব্দবন্ধটি সকলের নজর কাড়ে। এখন অবশ্য টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও মিডিয়ার আনুকূল্যে ‘বুদ্ধিজীবী’ পদবাচ্য। দ্বিতীয়ত, এর আগেও ‘বুদ্ধিজীবী’ বর্গের একটা হাল্কা ব্যবহার ছিল এবং কোনও কোনও সময়ে লেখক-শিল্পী-অভিনেতা-বুদ্ধিজীবীদের সমাজের নানান ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মধ্যে তার কিছু পরিচয় আমরা পেয়েছি। যেমন, সত্তর দশকে বন্দীমুক্তি আন্দোলনের মিছিলে ও অন্যান্য নানান ঘটনাবলীতে তাঁদের স্বাক্ষর-সম্বলিত ইশতেহারে আমরা তাঁদের আংশিক অংশগ্রহণ দেখেছি। কিন্তু তা সব সময়েই ছিল এক বৃহৎ গণ-রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের নানা মাপের সহায়ক-ধর্মী অংশগ্রহণে পুষ্ট। এমনটা কখনও হয়নি যে তাঁরা কোনও মত বা পথের দিশারী হয়ে জনসাধারণকে পথ দেখিয়েছেন। সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিতেও একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, জনপ্রিয় অভিনেতাকে শ্রমিক আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমিতে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে সংহতি জ্ঞাপনের চেষ্টা, যা নায়কের আপত্তিতে শেষমেশ দানা বাঁধেনি।
অবশ্য, সংহতি জ্ঞাপনের উদ্যোগে ‘বুদ্ধিজীবী’দের সামিল করার প্রচেষ্টা বহু পুরনোকালের। যেমন, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথও পথে নেমেছিলেন এবং গান বেঁধেছিলেন (যদিও তাঁকে কেউ কখনও ‘বুদ্ধিজীবী’ বলেননি)। কিন্তু যদি মনে করা হয়, অতএব, এনারা রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের নেতাদের মতো জনসাধারণের অগ্রণী হয়ে সমাজ পরিবর্তন বা সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টায় জড়িয়ে পড়বেন (দু-একজন ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন), তাহলে তা বাতুলতা। সুগতবাবু’র নিবন্ধটি পড়ে মনে হবে যে তিনি বোধহয় বুদ্ধিজীবীদের এমন এক নেতৃত্বের আসনে দেখতে চাইছেন যেখানে তাঁদের মত নিয়ে আলোড়ন তৈরি হবে বা আমজনতা ভাববেন; সে ক্ষেত্রে তো তাঁদের বাস্তব অনুশীলনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন উঠবে। কারণ, আমজনতা বুঝে নিতে চাইবেন তাঁদের পাশে কে বা কারা আছেন। কিন্তু তাঁরা তা থাকেন না। তাই আমজনতার কাছে তাঁদের গ্রাহ্যতা পাওয়ার কোনও প্রশ্নও ওঠে না। তবে সরকার পরিচালনায় কিছু কিছু নীতি গ্রহণের প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই ভূমিকা থাকে আর তা তাঁদের পেশাদারি দায়িত্ব থেকেই।
এর অর্থে আমি বলতে চাইছি, অধ্যাপক হন কি গবেষক, চলচ্চিত্র পরিচালক অথবা লেখক, অভিনেতা কিংবা নাট্যকর্মী- এঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ও বহু ক্ষেত্রেই অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেই ভূমিকার যাথার্থ্য ও সীমাবদ্ধতা- দুইই উপলব্ধিতে রাখা প্রয়োজন (বুদ্ধিজীবী ও আমজনতা দু' তরফেই)। স্বীকার করে নেওয়া ভালো, বুদ্ধিজীবী ও আমজনতার মধ্যে সংযোগের এক গভীর সমস্যা রয়েছে; তা হয়তো অনতিক্রম্য কিন্তু সব সময় দুর্ভেদ্য নয়। তপস্যার অধিকারে হাত দিয়েছিলেন বলে সে কালে শম্বুকের গলা কাটা গিয়েছিল; কিন্তু পুঁজিবাদ যেহেতু বাজার থেকেই আহরণের নিয়ম জানে, তাই তপস্বী শম্বুকদের আজ মনোরঞ্জন ব্যাপারী হয়ে ওঠায় কোথাও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। অস্যার্থ, 'কেউ কারও নয় গো মা'।
বলার কথা এই, আমজনতা রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের নিরিখেই তাঁদের পছন্দের শীর্ষ নেতানেত্রীদের অনুগামী হন, যারা যথেষ্ট বুদ্ধি, চিন্তা ও প্রজ্ঞার ধারক। প্রাক-স্বাধীনতা কালে, স্বয়ং গান্ধীজী অথবা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কি একাধারে জনপ্রিয় নেতা ও চিন্তার দিশারী ছিলেন না? স্বাধীনতা-উত্তরকালে জয়প্রকাশ নারায়ণ কিংবা শঙ্কর গুহ নিয়োগীকে কি আমরা একই সাথে চিন্তাবিদ ও জননেতা বলতে পারি না?
মনে হয়, সুগতবাবু একাডেমিক জগতের অধ্যাপক ও গবেষকদেরই শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী হিসেবে ঠাওর করতে চেয়েছেন যাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা বৃহত্তর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবেন! কারণ, প্রত্যক্ষ বাস্তব অনুশীলন বিনা জনগণের অগ্রভাগে স্থান পাওয়াটা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন এবং সে হেতু তাঁদের এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠাটাও কতকটা অবাস্তব। তাই বুঝতে হবে, পেশাগত গবেষক এবং জনতার মধ্যে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করা রাজনীতিক-গবেষক- এই দুইয়ের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। রাজনীতির পরিসর যতই কলুষিত হোক না কেন, যেহেতু আমজনতাকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির অনুশীলনের মধ্য দিয়েই জীবনধারণ করতে হয়, তাই তাঁর কাছে রাজনৈতিক নেতা যেমন কাছের মানুষ আবার দূরেরও। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সব সময়েই অনেকটা দূরের জন।
বিষয়টি আরও কিছুটা মোড় পেয়েছে গত পাঁচ-দশ বছরে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে এক আমূল পরিবর্তনের ফলে। কলিম খান দু' দশক আগেই বলে গিয়েছেন, জ্ঞানের জগৎ কথাটি অসম্পূর্ণ, আসলে আমাদের ভাবতে হবে জগতের জ্ঞান নিয়ে। যখনই বলব জ্ঞানের জগৎ, তখন জ্ঞান এক সীমায়িত পরিসরে প্রাক-নির্ধারিত উপায়ে অবস্থিত; সেই জ্ঞান নানাবিধ ক্ষমতার প্রকোষ্ঠ থেকে জাত। কিন্তু যখন 'জগতের জ্ঞানের' কথা ভাবব, তখন তা অসীম, অনন্ত ও শৃঙ্খল-মুক্ত। রাজার দরবার, কুক্ষিগত মিডিয়া ও একাডেমিকস'এর প্রান্তর থেকে জ্ঞানবীক্ষার যে স্ফুরণ এতদিন মানবসমাজকে চালনা করেছে, তা আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্মে ও গিগ অর্থনীতির উদয়ে এক লাগামছাড়া ঠিকানা পেয়েছে। তাই হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটির জঞ্জালের সাথে সাথে নানাবিধ দমিত সদর্থক-চিন্তাগুলিও আজ দিনের আলোয় দৃশ্যমান ও বহুজনে স্পর্শমান, যে চিন্তার প্রকরণগুলিকে মিশেল ফুকো বলেছিলেন, 'সাবজুগেটেড নলেজ'। এইখানেই ক্ষমতাশীলদের ভয় ও হতাশা।
যেমন, বহু পণ্ডিতজনকে যখন জিজ্ঞেস করেছি, রামকৃষ্ণদেব কথিত 'ব্রহ্ম কখনও এঁটো হয় না' কথাটির অর্থ কী, তাঁদের 'রায় ও মার্টিন'এ এর কোনও উত্তর নেই, অতএব, তাঁরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন। আশার কথা এই যে, চাইলে কোনও বক্তব্যই আজ আর মানুষের দুয়ারে পৌঁছয় না- তেমনটি বিশেষ বলা যাবে না।
লেখাটা দারুণ হয়েছে। আবাপ এমন লেখা ছাপবেন এমন আশা না করাই ভাল। সুগতবাবু বরাবরই কিছু ভুল্ভাল বক্তব্য রাখেন, এটাও তাই। আমি যতদূর বুঝতে পারি উনি ওনেক বিষয়ে জ্ঞানী হলেও মৌলিকভাবে কিছুটা অবামমনস্ক তাই সুযোগ পেলেই বাম কালচার টাকেই আক্রমণ করে ফেলেন। তার পুরস্কার উনি অবশ্য ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। এই লেখার মধ্যেও এমন একটা ইঙ্গিত আছে। কারণ সচরাচর বুদ্ধিজীবী বলতে একটা সময় মূলত বামমতাদর্শের মানুষদেরই বোঝাতো। তখন বামপন্থীরা পড়াশোনা করতেন বলে সমাজের অগ্রগণ্য হিসেবে গ্রহণীয় হতেন। এখন জমানা বদলালেও বাম মতাদর্শের একটা সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক মাত্রা আছে। মারজিত বাবুরা এটাকে আজও টেরা চোখে দেখতে পছন্দ করেন।
ReplyDelete