অস্ত্র কেনার চাপ?
কল্যাণ সেনগুপ্ত
আশাকরি কেউ ভোলেননি, অতীতে আমেরিকা সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের সমাবেশে ট্রাম্পের হয়ে শ্লোগান তুলেছিলেন-- 'অব কি বার ট্রাম্প সরকার'। কোনও একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে এভাবে অপর একটি রাষ্ট্রের নির্বাচন প্রার্থীর হয়ে খোলাখুলি প্রচার করা, সম্ভবত নজিরবিহীন। কিন্তু তিনি নরেন্দ্র মোদী, কোনও ছেদো যুক্তির ধার তিনি ধারেন না। তিনি তাঁর বন্ধু ট্রাম্পের জন্য প্রচার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে প্রোটোকল বা আইনি বিধিনিষেধের তিনি পরোয়া করারও প্রয়োজন মনে করেন না। যদিও এত কাণ্ডের পর ট্রাম্প কিন্তু সেই নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। আর এবার সেই ট্রাম্পই ভোটে জিতেছেন, মোদীর প্রকাশ্য ভোট প্রচার ছাড়াই।
আমেরিকা সফরে গিয়ে সেখানকার ভারতীয়দের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে যেভাবে সংকীর্ণ দলীয় প্রচার করেছেন, তাও এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সেই সমাবেশকে প্রায় দলীয় সভায় পরিণত করা এবং সেখান থেকে মোদী বন্দনায় 'হাউডি মোদী' শ্লোগান তুলে অতি সংগঠিত রূপে ও কৃত্রিম উপায়ে মোদীর জনপ্রিয়তাকে উন্নীত করার অপচেষ্টা আমরা প্রত্যেকেই জেনেছি। ওই সভায় আগত প্রায় সবাই ছিল অবৈধরূপে আমেরিকায় বসবাসকারী এবং মূলত গুজরাতবাসী সহ মোদীভক্ত ব্যবসায়ী তথা বিশেষ সাহায্য প্রত্যাশীদের ভিড়। এখন বোঝা যাচ্ছে, এদের কারণেই ট্রাম্পের প্রতি মোদীর এত ভালোবাসা; এবং এদের কারণেই মোদী একদা জিগির তুলেছিলেন যে, এইসব অনাবাসীদের মধ্যে ইচ্ছুকদের আমাদের ভোটার লিস্টে নাম তুলে অনলাইন ভোটের সুযোগ করে দিতে হবে। পরে অবশ্য এ নিয়ে আর বেশি উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি, হয়তো আইনি সাত পাঁচ ভেবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যে বলা হয় গুজরাত হচ্ছে শিল্পোন্নত ও সর্বাধিক সমৃদ্ধ ও সুখী রাজ্য, তাহলে কেন এত বেশি সংখ্যায় গুজরাতবাসী রুজি-রোজগারের আশায় আমেরিকায় গিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে মরিয়া? ঐতিহাসিক ভাবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই গুজরাতের অধিবাসীদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে এবং স্বাধীনোত্তর ভারতের অত্যধিক ক্ষমতাশালী জাতীয় নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের অকৃত্রিম সহায়তায় গুজরাতিরা ব্যবসার ক্ষেত্রে বরাবরই এগিয়ে ছিল। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসি জমানায় সফল মুখ্যমন্ত্রী রূপে চিমনভাই প্যাটেলের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অতঃপর কালের নিয়মে কংগ্রেসি জমানার শেষে বিজেপি শাসন চালু হয় এবং দলীয় নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে অবশেষে শাসন ক্ষমতা মোদীর করায়ত্ব হয়। এর আগে শুধুমাত্র দলের অন্দরমহলেই তাঁর পরিচিতি ছিল আদবানীজীর অনুগামী রূপে।
গুজরাতের দায়িত্ব পেয়েই তিনি বুঝলেন, এখানে টিকে থাকতে হলে তাঁকে আগে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাঁটাকে দুর করতে হবে এবং সে জন্য চাই একজন বিশ্বস্ত বুদ্ধিমান সহযোগী। কথায় আছে, রতনে রতন চেনে...। ফলে, অচিরেই তিনি বেছে নিলেন গুরুত্বের মাপে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা অমিত শাহকে এবং অনেকখানি তুলে এনে বানালেন তাঁর মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ধীরে ধীরে তৈরি হল সংগঠনকে পুরোপুরি কব্জা করে দখলে আনার রোডম্যাপ, যেখানে কেউ ট্যাঁ-ফু করার সুযোগ পাবে না। প্রশাসনের মধ্যেও বাছাই করা আমলাদের নিয়ে শুরু হল মোদীর নেতৃত্বকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করার অভিযান। ঘটে গেল সাবরমতি এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা, ফলে বহু হিন্দু সাধু ও ধার্মিক মানুষদের মৃত্যু এবং এরই ফলস্বরূপ এক ভয়াবহ দাঙ্গা; স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে যা অন্যতম এক অতীব কলঙ্কজনক অধ্যায়রূপেই চিহ্নিত হয়ে আছে। অবশ্য এটি দাঙ্গা না গণহত্যা, সে প্রশ্নের সহজ উত্তর আজও মেলেনি। প্রশাসন বা দলে যাঁরাই এই ঘটনার সামান্যতম বিরোধিতা করেছেন, তাঁরাই হয় জেলে গেছেন নয়তো বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন (অনেক বিচারাধীন বন্দী জামিন পাওয়ার পরপরই প্রাণ হারিয়েছেন)। এই সংক্রান্ত বিচার পদ্ধতির জন্য নির্দিষ্ট এক বিচারপতিকেও শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাতে হয়েছে বলে ভয়ঙ্কর অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছিল।
এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং বিজেপির ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু বিজেপি দলের দুই শিক্ষিত ও যোগ্য প্রার্থীদ্বয় সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলি'র মধ্যে কোনওপ্রকার সমঝোতা না হবার ফলে হঠাৎই শিকে ছিঁড়ল মোদীর ভাগ্যে, বলা যায় অপ্রত্যাশিতভাবেই। এর অন্যতম বড় কারণ, ফান্ডিং'এর নিশ্চয়তা প্রদান। ফলে, দল তাঁকেই পিএম পদপ্রার্থী বানালো এবং জাতীয় ক্ষেত্রেও আরএসএস নির্দেশিত হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় বিচারকে সামনে এনে ও নানা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয়কে সুনিশ্চিত করল।
কিন্তু এবার মোদীর ভাগ্য কিঞ্চিৎ খারাপ, তাই বন্ধু(!) ট্রাম্প ও তাঁর সরকার তাঁকে যথেষ্ট বিপদে ফেলে দিয়েছে। যে সাহস এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কলম্বিয়া দেখাতে পারল, অর্থাৎ পরিষ্কার বলে দিল, তাদের দেশের নাগরিকদের হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা থাকলে সেই বিমানকে তারা মাটিতে নামতে অনুমতি দেবে না; দেড়শো কোটি মানুষের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদীজী সেটা বলতে পারলেন না। কারণ, ট্রাম্প যদি ক্ষেপে যায় তো মোদীর 'সাড়ে সব্বোনাশ' হয়ে যাবে। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর কোনওক্রমে ম্যানেজ করে যেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর একটা আপাতত সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছেন (সম্ভবত ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি), সেখানে এক সামরিক বিমানে হাতে-পায়ে শিকল বেঁধে ভারতীয়দের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করতে গিয়ে আরও বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে তো আমন্ত্রণ জানানো যায় না!
ট্রাম্প সাহেব মোদীকে আদৌ বন্ধু ভাবেন কিনা, সেটা মোদীজী না বুঝলেও অনেকেই বোঝেন। কিন্তু ট্রাম্প এখন বিশ্বকে কড়া বার্তা দিতে বেছে নিলেন তাঁর বাধ্য 'মোদীর দেশ' ভারতকেই। রাষ্ট্রপতি-অভিষেক অনুষ্ঠানে আসার জন্য মোদীকে ফোন তো করলেনই না, তাও বা যে ফোনটা করলেন তা আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র কেনার চাপ দিয়ে। ট্রাম্প যে এভাবে বন্ধুকৃত্য সারবেন, কেউ ভেবেছিল? সবার মনে আছে, ২০১৯'এ ট্রাম্পের ভারত সফর উপলক্ষ্যে চারদিকে সাজোসাজো রব, চতুর্দিকে দারিদ্র্য ঢাকতে লাগানো হচ্ছে কাপড়ের আড়াল এবং ট্রাম্পকে খুশি করতে নানাবিধ আয়োজন। তবে তিনি আদতে খুশি হয়েছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু বারংবার দুই বন্ধুর আলিঙ্গনের ছবি আমরা সবাই দেখে ধন্য হয়েছি। ঠিক সেই সময়ের কিছু পূর্বেই বিশ্বত্রাস করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পের আতিথেয়তায় কোনওরূপ বিঘ্ন না ঘটাতে বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। ততদিনে রোগের প্রকোপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, ট্রাম্প বিদায়ের অব্যবহিত পরেই কোনওরকম সময়-সুযোগ না দিয়েই দুম করে তড়িঘড়ি লকডাউন ঘোষণা করা হল। এর ফলে বিভিন্ন প্রদেশে কর্মরত গরিব শ্রমিকরা পড়লেন চূড়ান্ত বিপাকে এবং হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘ অবর্ণনীয় কষ্ট ও অজস্র প্রাণহানির চূড়ান্ত সাক্ষী আমরা হয়েছি অসহায়ভাবে। এ হেন ট্রাম্প যদি এমন দুর্ব্যবহার করে বন্ধু(!) মোদীকে এতখানি বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দেন, তাহলে মোদীজী একে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিই বা বলবেন!
ট্রাম্প খুব ভালো ভাবেই জানেন যে, আমেরিকায় অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় অভিবাসীদের সবাইকে ফেরত পাঠালে ভারত সরকার তথা মোদী খুবই বিপদের সম্মুখীন হবেন। জমি সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে প্রায় কোটি টাকার বিনিময়ে বেআইনি চক্রের মাধ্যমে বহু মানুষ পরিবার সহ আমেরিকায় পাড়ি দেয়। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম পরিস্থিতি কখনও তৈরি হতে পারে। ঘটনা হল, এইসব আজ নতুন নয়, চলছে যুগ যুগ ধরেই। কিন্তু অতীতের কোনও সরকার এসবের থেকে মুনাফা তোলার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমাদের মোদীজী হলেন এক ব্যতিক্রমী দুঃসাহসী। তাই তাঁর এখন মুখ পুড়ছে, তড়িঘড়ি ছুটতে হচ্ছে ট্রাম্পকে বিরত করতে। শোনা যাচ্ছে, আরও ৪০০+ লোকজনের তালিকা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। কিন্তু ট্রাম্প ভারতকে ছাড় দেবেন কি না, বা এমনতর চূড়ান্ত অপমানের হাত থেকে রক্ষা করবেন কি না, সেটা জানেন শুধুই স্বঘোষিত ঈশ্বররূপী ট্রাম্প।
অবশ্য আরও একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, এর বিনিময়ে প্রায় দেড়শো কোটির মানুষের বিশাল বাজারে এলন মাস্ক'এর মতো বন্ধুদের স্বার্থে বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেবেন ট্রাম্প, যা হয়তো এতদিন সম্ভব হয়নি; কিংবা বিনা প্রয়োজনে পুরাতন মডেলের গুদামজাত অবিক্রিত অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রভুত গোলাবারুদ বা অন্যান্য প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম আমাদের দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। মোদী ও ট্রাম্প দুজনেই জানেন, ক্ষমতা থেকে অবসর গ্রহণের আগে এটাই সম্ভবত তাঁদের লাস্ট ইনিংস। অর্থাৎ, আগামী দিনে কী ঘটতে চলেছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট শঙ্কায় থাকা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই।
তবে যে অমোঘ প্রশ্নটির জবাব মানুষ চাইবেই তা হল, যিনি নিজেকে বিশ্বগুরু বলে চ্যালা-চামুণ্ডাদের দিয়ে প্রচার করে থাকেন, সেই ১৫০ কোটির মানুষের দেশকে এভাবে অপমানিত করার সাহস ট্রাম্প সাহেব পান কোথা থেকে? কেউ অন্যায় করলে বিচার মারফত তার শাস্তির বিধান আছে, কিন্তু বিদেশি অসামরিক নাগরিককে শিকল পরিয়ে এ হেন লাঞ্ছনা ও অত্যাচার শুধু সেই ব্যক্তিকেই বিপর্যস্ত করে না, তা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে অত্যন্ত অমর্যাদাকর। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাহস নেই নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি এই অবমাননাকর অপমান ও হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর। ধিক! যদিচ, এই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এবং জনশ্রুতিতে আদানি'র প্রোমোটার মানুষটির দম কতখানি, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা ট্রাম্পের অবশ্যই আছে। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, এমনটা নতুন নয় বহু বছর ধরেই চলছে। কিন্তু সুকৌশলে যে কথাটা এড়িয়ে গেলেন সেটি হল, ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমানে চাপিয়ে এরকম অপমানজনক প্রত্যর্পণ আগে কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে? এবার বিশ্বগুরু নরেন্দ্র মোদী আমেরিকার নয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সকাশে কি বলেন বা মুখরক্ষার জন্য কী আবেদন নিবেদন করেন, সেটাই জানার। কেউ কেউ মজা করে বলছেন, হয়তো কোনওভাবে ট্রাম্প সাহেবের কানে গেছে যে মোদীজী নিজেকে বিশ্বগুরু বলে প্রচার চালাচ্ছেন এবং সম্ভবত সেটি ট্রাম্প সাহেবের হজম হয়নি।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বগুরু নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রের মিল অনেক। দুজনেই উগ্র জাতীয়তাবাদের আবেগে দেশবাসীকে ভাসিয়ে নিয়ে নিজেদের কাজ হাসিলে দক্ষ। ট্রাম্প ও মোদী দুজনেই দেশের মূল সমস্যার সমাধানে আগ্রহী নন, স্রেফ স্বীয় সাফল্যে বিশ্বাসী বা আগ্রহী। সমস্যাসঙ্কুল এই দুনিয়ায় ট্রাম্প আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু মোদী আমাদের দেশের কর্ণধার। তাঁর কোনও ভুল পদক্ষেপ দেশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। ফলে, তাঁর কৃত অন্যায়গুলিকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।
Who will bell the cat?
ReplyDeleteলজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।
ReplyDeleteএমনও হতে পারে পরস্পরের হুঁকোয় তামাক খাওয়া চলছে ।
ReplyDelete