Tuesday, 25 February 2025

জার্মানির নির্বাচনী ফলাফল

কোন পথে বিশ্ব ও দেশ?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

বিশ্ব আজ এক বিচিত্র অভিসারে চলেছে। গত এক দশকে প্রযুক্তি, রাজনীতি ও অর্থনীতির জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল চরম দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির উত্থান। এই উত্থান এখন আর কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসের বিচারে এ হয়তো এক সাময়িক ঘটনা, কিন্তু এর প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে বিদ্বেষ, হানাহানি, ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। মনুষ্য পরিবেশ আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, যদিচ এর শিকড় বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত।

প্রশ্ন, কেন এমন হল? কীভাবে এই পরিস্থিতির উদয়?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এবং জার্মানিতে নাৎসি অনুপ্রাণিত AfD (Alternative für Deutschland) দলের উত্থান (২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত) এই প্রবণতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ট্রাম্পের বিজয়ের পর জার্মানির সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে AfD দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে যা অভূতপূর্ব। উপরন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের (SPD) এবারে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হয়েছে। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ইউরোপ ও বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। যদিও প্রথম স্থানাধিকারী CDU (Christian Democratic Union) এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী SPD (Social Democratic Party) মিলে জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনাই প্রবল, কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী ধরনের শক্তির ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন রাজনৈতিক পরিসরে এক তুমুল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

জার্মানির এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ফ্যাসিস্ট AfD’র গতবারের ভোট প্রাপ্তি ১০.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে এবারে ২০.৮ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও গ্রিন’দের ভোট গতবারে যথাক্রমে প্রাপ্ত ২৫.৭ ও ১৪.৭ শতাংশ থেকে কমে এবারে ১৬.৪ ও ১১.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। CDU একটি দক্ষিণপন্থী দল হলেও তারা ফ্যাসিবাদী নয়, কিছুটা ইংল্যান্ডের কনজার্ভেটিভ দলের মতো; তাদের ভোট শতাংশ অবশ্য এবারে বেড়ে ২৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে (গতবারে যা ছিল ২৪.১ শতাংশ)। মোট ৬৩০ আসন বিশিষ্ট জার্মানির সংসদে CDU (২০৮ আসন) ও SPD (১২০ আসন) মিলে জোট সরকার তৈরি করলে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিশ্চিতি নিয়ে অবশ্য কোনও সংশয় নেই।

তবে বিশ্ব জুড়ে রাজনীতির অঙ্গন যে ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠছে তা স্পষ্ট। ইতালির চরম জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি নিজেকে ট্রাম্প ও মোদির সঙ্গে এক ত্রয়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তাঁদের তিনজনের কথা শুনলেই নাকি বামপন্থীদের রাতের ঘুম উড়ে যায়। অর্থাৎ, বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটা ঐক্যবদ্ধ অবয়ব গড়ে ওঠার ইঙ্গিত যেন পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন চরম দক্ষিণপন্থী দল ‘Make Europe Great Again’ (MEGA) স্লোগান দিয়ে স্পেনে সমবেত হয়েছে। এই স্লোগানটি ট্রাম্পের ‘Make America Great Again’এর (MAGA) প্রতিধ্বনি মাত্র। শোনা যায়, আমাদের মোদি সাহেবও নাকি অনুরূপ Make India Great Again’এর (MIGA) শ্লোগান তুলেছেন। MAGA-MEGA-MIGA— সম্ভবত এটাই হতে চলেছে বিভাজনের রাজনীতির বৈশ্বিক অক্ষরেখা। এই দলগুলির মূল উদ্দেশ্য হল, জনগণের মধ্যে কোনও এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে বিদ্বেষ ও হিংসার রাজনীতি ছড়ানো। ঠিক যেমন হিটলার ইহুদিদের চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তারা অভিবাসন নীতির সর্বোচ্চ বিরোধিতা করে এবং দাবি করে যে, বাইরে থেকে আসা লোকেরা তাদের দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। অথচ, এরা কিন্তু এতদিন গরিব দেশ থেকে সস্তার শ্রমিক এনেই নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে।

পরিস্থিতি আজ এইরকম এক অবস্থায় এসে দাঁড়ালো কেন? আসলে, আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রযুক্তির অবশ্যম্ভাবী ব্যবহার এবং অন্যদিকে মানুষের কাজ হারানো এবং না পাওয়া দ্রুতই প্রধান ধারা হয়ে উঠছে। ফলে, সামগ্রিক বেকারত্ব যেমন বেড়ে চলেছে, তার উপর স্থায়ী কাজেরও কোনও গ্যারান্টি নেই, যা মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। এই হতাশাকে কাজে লাগিয়ে উগ্র ধর্ম-জাতি-বর্ণ ভিত্তিক শক্তিসমূহ মুনাফা-তাড়িত অর্থনীতির নিয়মের দিকে আঙুল না তুলে মানুষে মানুষে গোষ্ঠী লড়াই লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের পথই হল, এই বিভেদ ও বিদ্বেষকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করা।

সাবেক বামপন্থীরা এইসব ক্ষেত্রে বহু অর্থে ব্যর্থ। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিশীলতাকে না বুঝে পুরনো শ্লোগান ও ভাবনাচিন্তার গোলকধাঁধায় আটকে আছে। ফলে, তারা নতুন কোনও পথের সন্ধান দিতে পারছে না। এই ব্যর্থতা চরমপন্থী শক্তিগুলিকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। যদিও এ তাবৎকালের রাজনৈতিক ব্যাকরণকে অস্বীকার করে নতুন ধারার কিছু ইতিবাচক শক্তির উত্থান হচ্ছে যারা সাবেক বামপন্থার পথানুসারী নয় কিন্তু উগ্র দক্ষিণপন্থার ঘোরতর বিরোধী। নামে কিবা আসে যায়! কোথাও কোথাও এদের নতুন ধারার বামপন্থী শক্তি হিসেবেও কেউ কেউ চিহ্নিত করছেন অথবা নিজেরাও নিজেদের তেমনই বলতে চাইছেন। বরং এই শক্তি কোনও কোনও দেশে ফ্যাসিস্ট দক্ষিণপন্থী উত্থানকে প্রতিহত করতে সক্ষম হচ্ছে – যেমন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে, এমনকি আমাদের দেশের কিছু রাজ্যেও। জার্মানির নির্বাচনেও দেখা গেল, কিছুটা ভিন্নধর্মী বামপন্থী দল Die Linke, যারা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ও বামপন্থায় আস্থা রাখে, তাদের ভোট প্রাপ্তি এবারে বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (গতবার যা ছিল ৪.৯ শতাংশ); এবার তাদের মোট আসন প্রাপ্তি ৬৪। অতএব, ফ্যাসিস্টধর্মী দক্ষিণপন্থীদের অগ্রগতিকে রোধ করতে হলে বিরোধী সব ধরনের শক্তিকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির পাঠ নতুনভাবে নিতে হবে। সম্যকভাবে বুঝতে হবে এই অর্থনীতির চরিত্র ও ক্ষমতাকে এবং তদানুসারী রাজনৈতিক পদক্ষেপে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে, যা হবে সম্পূর্ণত নতুন কোনও পথ বা অনুশীলন। আজকাল কিছু কিছু বাম ঘেঁষা মধ্যপন্থী দল বাস্তব রাজনীতির চাপে জনকল্যাণমূলক রাজনীতির পথ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই পথের কার্যকারিতাকে বামপন্থীদেরও নতুন আলোকে বিচার করে দেখতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অর্থনীতি যদি যথেচ্ছ উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে, জনকল্যাণের পথে যদি সেই উদ্বৃত্ত থেকে জনতার ন্যূনতম খিদে-তৃষ্ণা মেটে, তাতে অসুবিধা কী? এই সূত্র ধরে যদি বৃহৎ কোনও অর্থনৈতিক কার্যকারণে পৌঁছনো যায়, নতুন একটি অর্থনৈতিক ন্যারেটিভ নির্মাণ সম্ভব হয়, নতুন কোনও সাম্য-ভাবনার উদয় হয়, সেটাই তো নতুন যুগের নতুন কাজ! আমাদের মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদী বিদ্বেষী রাজনীতির রথকে যদি শুধুমাত্র এখনই নয়, দীর্ঘমেয়াদে না থামানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে মানবজাতি এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। ট্রাম্পের মুখে কিন্তু ইতিমধ্যেই গ্রিনল্যান্ড, কানাডা, গাজা ও পানামা খাল দখল সহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুঙ্কারও শোনা গিয়েছে।

আমাদের দেশেও আমরা একই ধরনের বিপদের দিকে এগোচ্ছি। ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ছড়ানো হচ্ছে। এই রাজনীতির গতিকে যদি এখনই রুদ্ধ না করা যায়, আমাদের সমাজ ধ্বংসের দিকে এগোবে। ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষের রাজনীতি দেশের ঐক্য ও সংহতিকে ধ্বংস করবে।

বলাই বাহুল্য, বিশ্ব জুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি, বিশেষত ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান একটি জটিল ও উদ্বেগজনক ঘটনা। তা আজকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার ফল। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের নতুন ভাবে সূত্রায়ন এবং নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। নানা ধরনের বহুমুখি শক্তিকে একত্র হয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য।


No comments:

Post a Comment