এক অসম যুদ্ধের পরিণতি
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
দিল্লি নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ
পেতেই জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী এবং ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম নেতা ওমর আবদুল্লা
এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট দিয়েছেন: ‘অউর লড়ো আপস
মে’। দেখাই গেল, সাম্প্রতিক হরিয়ানা ও দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোটের
অন্যতম দুই মুখ্য শরিক আপ ও কংগ্রেসের মধ্যে ন্যূনতম কোনও আসন সমঝোতা তো হয়ইনি, উপরন্তু,
পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছে এবং দুই রাজ্যেই বেশ
ভালোরকম ভাবে পরাজিত হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও
ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। তাহলে ইন্ডিয়া জোটটা তৈরি
হল কেন? ওমর আবদুল্লার পোস্টে তেমনই যেন এক প্রশ্ন লুকিয়ে।
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে
দেখা গেল, অন্তত ১৪টি বিজেপির জেতা আসনে তাদের জয়ের মার্জিন থেকে কংগ্রেস বেশি ভোট
পেয়েছে। অর্থাৎ, কংগ্রেস ও আপ’এর প্রাপ্ত ভোট বিজেপির থেকে বেশি। এই হিসেব দিয়ে
কেউ কেউ বলছেন, যদি কংগ্রেস ও আপ’এর মধ্যে প্রাক-নির্বাচনী সমঝোতা হত, তাহলে বিজেপির
পরাজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে তেমন সমঝোতা করেও তো একটি
আসনেও কংগ্রেস বা আপ জিততে পারেনি! বুঝতে হবে, জোটের ভোটে পাটিগণিতের হিসেব কাজ
করে না; তা এমন এক রসায়ন, প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রবহমানতাতেই এর অনুশীলন। তাই,
কংগ্রেস-আপ জোট হলেই এই নির্বাচন যে জেতা যেত তেমন কোনও নিশ্চয়তা যেমন দেওয়া যায়
না, তেমনই আপ হয়তো একা লড়েও জিততে পারত। আসলে, আপ ও কংগ্রেসের মধ্যে এতটাই
রেষারেষি যে, যদি জোট হত তাহলে হয়তো দু’ দলের পুরো ভোট পরস্পরের বাক্সে না পড়ে
বিজেপির ডালিতেও যেতে পারত। লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে কতকটা তেমনই হয়েছে; যা আমরা
পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ও কংগ্রেস জোটের মধ্যে দেখি। বরং বলা ভাল, এই অসম নির্বাচনী
লড়াইটা হয়েছে এক অমিত শক্তিধারী কেন্দ্র’র সঙ্গে এক অর্ধ-রাজ্যের, যে রাজ্যকে গত
২-৩ বছর ধরে নানা অজুহাত ও ধমকি দিয়ে প্রায় অকেজো করে ফেলা হয়েছিল।
দিল্লিতে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে
থাকবে (লেফট্যান্যান্ট গভর্নর না রাজ্য সরকার)— এই সংক্রান্ত একটি মামলায় তা
নির্বাচিত সরকারের ওপরেই ন্যস্ত বলে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নস্যাৎ করতে
কেন্দ্র থেকে প্রথমে অর্ডিন্যান্স ও পরে একটি আইন পাস করা হয়— The Government of National Capital Territory of Delhi (Amendment) Act 2023 বা
GNCTD Act। এই আইনের বলে দিল্লির লেফট্যান্যান্ট গভর্নরকে (এলজি)
যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয় রাজ্য সরকারের ওপর খবরদারি করার জন্য। বলা হয়, রাজ্য
সরকারের সমস্ত কাজকে এলজি’র অনুমোদন নিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। অনতিবিলম্বেই
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গুজরাতের বিজেপি নেতা বিনয় কুমার সাক্সেনাকে এলজি
পদে নিয়োগ করে। এই লোকটি তাঁর চেয়ারে বসেই আপ সরকারের অগণিত কার্যক্রমের ওপর
তদন্তের নির্দেশ দেন এবং খুব সুচতুরভাবে জনপ্রিয় মহল্লা ক্লিনিকের ওপরে তাঁর প্রথম
আক্রমণ নামিয়ে আনেন। এই আইনের বলে প্রতি পদে এলজি কেজরিওয়াল সরকারকে প্রায়-অথর্ব
করে ফেলে। এমনকি দিল্লির পুরসভাকেও এই আইনের অধীনে এনে নাগরিক পরিষেবা থেকে জরুরি কাজকর্ম
সব কিছুকে ধীরে ধীরে শ্লথ ও ক্রমেই অচল করে দেওয়া শুরু হয়। রাজ্যের প্রায় সমস্ত
কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যায়। এই স্তব্ধতা আসলে ছিল দিল্লিবাসীর মাথায় বন্দুক ধরে এই
বার্তাটিই দেওয়া যে, আপ’কে তাড়াও না হলে সব নরক গুলজার করে দেব; তার সঙ্গে আপ’এর
নেতাদের ওপর ইডি ও সিবিআই’এর জোড়া হানা। বলাই বাহুল্য, GNCTD আইন আমাদের দেশের
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করার প্রথম প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ।
তবে এটাও ঘটনা, আপ সরকারের কিছু কিছু
পদক্ষেপে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে সরকারি টাকায় বিলাসবহুল
মুখ্যমন্ত্রীর গৃহ (শিস মহল) নির্মাণ কেজরিওয়ালের মাফলার-ভাবমূর্তির কিছুটা হলেও
ক্ষতি করেছে। তবে অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যে বিপুল বিলাসব্যসনে নিজেদের
আপ্যায়িত রাখেন সে তুলনায় এই ঘটনাটি নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু গোদি মিডিয়া ও
বিজেপির চিল-চীৎকারে এই অপব্যয়কে এক তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার উপর একে একে
শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন জেলবন্দী করে রাখা সরকার ও দলের পক্ষে প্রভূত
ক্ষতিকারক হয়েছে। শীর্ষ আদালতও বহুবার এ ব্যাপারে তদন্ত এজেন্সিগুলোকে তুমুল ভর্ৎসনা
করেছে। কিন্তু দানবীয় পিএমএলএ এমনই এক আইন যেখানে জামিন পাওয়াটা শবরীর প্রতীক্ষার
চেয়েও দীর্ঘ। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় বাজেটে ১২ লাখ টাকা অবধি করমুক্তি ও এলাহী বিহার
প্যাকেজ, অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা, নানারকম সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প (যেগুলোকে
বিজেপি এতদিন ‘রেউড়ি’ বলে কটাক্ষ করেছে) ইত্যাদি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ ও
পূর্বাঞ্চলীয় মানুষজনকে (মূলত বিহারী) প্রভাবিত করেছে। ফলে, ভোটের শতকরা হিসেবে
২০২০ সালে আপ’এর প্রাপ্ত ভোট এবারে ১০ শতাংশ নেমে গেছে; যদিও এত কাণ্ডের পরেও শেষাবধি বিজেপি
ও আপ’এর ভোটের ফারাক কিন্তু দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ শতাংশে।
এবারের ভোটে আরও একটি কৌশল বিজেপি
কাজে লাগিয়েছে-- হিন্দুত্বের রাজনীতির চেয়ে কেজরিওয়ালের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প
রাজনীতির গুরুমারা বিদ্যার প্রয়োগ। ওদিকে কংগ্রেসের একটাই ক্লিশে বাণ— জাতপাতের সেনসাস
ও সংবিধান বাঁচানোর আহ্বান— যে অতি ব্যবহারে ইতিমধ্যেই ভোঁতা হয়ে গেছে তা কে বালক
রাহুলকে বোঝাবে! তবে কংগ্রেস খুব খুশি আপ’এর পরাজয়ে। অবশ্য এ কথা ক্রমশ প্রকাশ্য
যে, টাকাপয়সা দিয়ে এমএলএ কেনাবেচা ও রাজ্যপাল মারফত বিরোধী রাজ্য সরকারগুলিকে
হেনস্থা করার পাশাপাশি বিজেপি এখন ভোটার লিস্টে মূলত অনলাইনে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ
ভুয়ো নাম অথবা অন্য রাজ্যের দলীয় ভোটারদের নাম ঢুকিয়ে এক নতুন ধরনের কারচুপি বা
রিগিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। মহারাষ্ট্র থেকে এর সূত্রপাত, দিল্লিতেও তা
ব্যাপক ভাবে কার্যকর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই অভিযোগের জবাবে নির্বাচন কমিশন
অদ্ভুত ভাবে নীরব। কিন্তু এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তবে তা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও
গণতন্ত্রের ন্যূনতম উপাদানগুলিকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
আশ্চর্যের বিষয় হল, GNCTD আইন নিয়ে ইন্ডিয়া জোট তো দূর অস্ত, কোনও বিরোধী দলও
সেভাবে সোচ্চার হয়নি। যেন, বিষয়টা কেজরিওয়ালের মাথাব্যথা, অতএব তিনি বুঝে নিন। ঠিক
যেমন, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান যে বেশ কিছু বছর ধরে
বন্ধ, সে ব্যাপারে তৃণমূল ছাড়া ইন্ডিয়া জোটের বাকী দলগুলির কোনও হেলদোল
নেই। বরং, কেউ কেউ বিজেপির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বলতে থেকেছে, চুরি হয়েছে তাই
বন্ধ করেছে, ভালই করেছে। ফলে, ইন্ডিয়া জোট কার্যত ভেস্তে গিয়েছে। দীর্ঘদিন এই
জোটের কোনও বৈঠক নেই। আঞ্চলিক দলগুলি নিজ শক্তির জোরে, কোথাও কোথাও স্থানীয় স্তরে
জোট করে বিজেপির আগুয়ান ফ্যাসিবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংসের পরিকল্পিত
কার্যক্রমকে মোকাবিলার চেষ্টা করে চলেছে। লড়াইটা দিনে দিনে আরও দুরূহ হয়ে উঠলেও
হয়তো আশার দিকও কিছু কিছু আছে।
এবার আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিহার
ও পশ্চিমবঙ্গের পালা। বিহারে ইতিমধ্যেই এক মহাগঠবন্ধন মোটামুটি পাকাপোক্ত ভাবে বেশ
কয়েক বছর ধরে অটুট আছে। এই মোর্চায় আরজেডি’র পাশাপাশি সিপিআই(এমএল) লিবারেশন’এর
ভূমিকা সমুজ্জ্বল। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরেই লিবারেশন’এর
সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, এই মহাগঠবন্ধন ‘ভিআইপি’
দলের যোগদানে আগামী নির্বাচনে বিজেপি’কে হারাতে আরও মজবুত ও উদ্দীপ্ত হয়েছে। আগামী
২ মার্চ পাটনার গান্ধী ময়দানে #বদলোবিহারমহাজুতন’ (বিহারকে বদলাতে জোটবদ্ধ হও) ডাক
দিয়ে এক ঐতিহাসিক ও বিশাল জনসমাবেশ হতে চলেছে। দেখা যাক, তা কোনও কার্যকরী দিশারী হয়ে
উঠতে পারে কিনা। তবে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনও জোটের আশা আছে কিনা জানি না, কিন্তু
কংগ্রেস ও তৃণমূল যদি ইন্ডিয়া জোট হিসেবে একত্রে লড়ে তবে মালদহ ও মুর্শিদাবাদে
কংগ্রেস কিছু আসন পেতে পারে শুধু তাই নয়, বিজেপি এই দুটি জেলায় পাওয়া আসন হারাতেও
পারে।
শুধু আপ দল বা তাদের সরকার নয়, গোটা দিল্লিবাসীর মাথার ওপর এবার রাখা ছিল ‘ডেমোক্লিসের তরবারি’। GNCTD আইন দিয়ে দিল্লি সরকারকে পঙ্গু করে দিল্লিবাসীদের এমনভাবে জর্জরিত করে ফেলা হয়েছিল যে, যদি না তারা আপ’কে গদিচ্যুত করে, তাদের নিত্য জীবনকে আরও তছনছ করে দেওয়ার বার্তা তাতে সুপ্ত ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ যারা আপ’এর ভোটার, তারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে, এই লাগাতার অসহ্য অব্যবস্থার মুখে তারা নিজেদের দৈনন্দিনতাকে বাজি রাখতে রাজী ছিল না। তাদের শ্রেণি অবস্থান বিজেপির পক্ষ নেয়। সব মিলিয়ে, এই সামগ্রিক ফ্যাসিবাদী আইনি আক্রমণকে আপ মোকাবিলা করে উঠতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, দিল্লিকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা না দিলে ‘ডেমোক্লিসের তরবারি’ থেকে দিল্লিবাসীর মুক্তি নেই, যা অন্যান্য বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির ওপরেও নানা আইনি আঙ্গিকে নেমে আসছে।
No comments:
Post a Comment