কেনাকাটার সত্যি-মিথ্যে
অমিতাভ গুহ সরকার
প্রতি বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর দেশ জুড়ে চলে নানা উৎসব। মরশুমের গোড়ায় একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো আর প্রতিবারই রাস্তায় মানুষের ঢল নামে কয়েক দিন আগে থেকেই। পুজো যতটা না ধর্মীয় অনুষ্ঠান তার থেকে অনেক বেশি সামাজিক, কলাকাজ এবং ব্যবসায়িক কাজকর্মে থাকে ঠাসা। পুজো মানেই দেদার কেনাকাটা। আর এই কেনাকাটা শুরু হয়ে যায় মাস দুয়েক আগে থেকেই। নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে ব্যবসায়ীরাও বাজারে হাজির হন যথাসময়ে। পুজো শুরু হওয়ার আগে থেকেই মাঝারি থেকে বড় শহরগুলি ঢাকা পড়ে ঢাউস বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপনে ঠাসা কয়েকটি পাতা ওল্টানোর পর হদিশ পাওয়া যায় খবরের কাগজের প্রথম পাতার। অনেক বিজ্ঞাপনেই থাকে ছাড়ের বন্যা। একটি কিনলে আরেকটি বিনামূল্যে। কখনও আবার দুটি। এছাড়া বিভিন্ন পণ্যে থাকে দেদার ছাড়। ৮০ শতাংশ বা তার কিছু কম বেশি ছাড়ের হাতছানিও এই বাজারে বিরল নয়। এই ছাড় যেন এখন আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শুধু দুর্গাপুজোতেই নয়, ছাড় পাওয়া যায় ধনতেরাস, দেওয়ালি, ভাইফোঁটা, ঈদ, বড়দিন, নতুন বছর, ১৫ অগস্ট ইত্যাদির মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। চৈত্র সেল তো বাঙালির জীবনে একটি উৎসব।
মোটা ছাড় পেয়ে জিনিস কিনে অনেকেই বেশ খুশি হন। আবার অনেকে ধন্ধে পড়েন, সস্তায় কিনে ঠকলাম না তো?
কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি জিনিস কিনে বিনামূল্যে আরেকটি পাওয়ার ফাঁদে পড়ে দুটোরই গুণগত মান নিয়ে পরে কিছুটা অসন্তুষ্টি থেকে যায়। ছাড় দেওয়া অনেক পণ্যে আবার বিক্রির পর কোনও পরিষেবা অথবা ‘ওয়ারেন্টি’দেওয়া হয় না। একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এই মাগ্গি গণ্ডার বাজারে একদম বিনামূল্যে কিংবা মোটা ছাড়ে সত্যিই কি কোনও পণ্য বিক্রি করা সম্ভব? আসলে, ব্যবসার জগতে 'ফ্রি' বলে কিছু হয় না। ব্যবসা কোনও দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। সব কিছুরই কোনও না কোনও মূল্য আছে। সোজা অথবা বাঁকা পথে ক্রেতাকেই এই মূল্য চোকাতে হয়। অনেক সময়ে হোটেলে ঘর নেওয়ার সময়ে বলা হয় ‘ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি', অর্থাৎ, তার জন্যে কোনও দাম দিতে হবে না। সত্যিই কি তাই? আসলে ঘরের দামের মধ্যেই সেঁধিয়ে থাকে প্রাতরাশ বাবদ খরচ। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিনা প্রাতরাশে ঘর নিলে দাম কিছুটা কম হয়।
মোটা ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ আছে সোনা হীরের গয়নাতেও। না, গয়নাতে নয় তার মজুরিতে। এই ছাড় দেওয়া হয় বিশেষ কিছু দিনকে কেন্দ্র করে এবং বিয়ের মরশুমে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, হীরে বসানো গয়নাতে অনেক ক্ষেত্রে পুরো মজুরিটাই মুকুব করা হয়। আসলে, সোনার দাম যতটা স্বচ্ছ হীরের ক্ষেত্রে তা ততটা নয়। হীরে কতটা খাঁটি তা যাচাই করাও সহজ কাজ নয়। অর্থাৎ, দাম বাড়িয়ে ছাড় দিলে তা ধরার উপায় নেই। মজুরি মকুব করা হচ্ছে তার মানে এই নয় যে কারিগর কোনও পারিশ্রমিক পাচ্ছে না।
ভারত এখন দ্রুত হাঁটছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ার’ পথে। লাফিয়ে বাড়ছে ই-বাজারে কেনাকাটা। রমরমিয়ে বাড়ছে অ্যামাজন, ফ্লিপকার্টের মতো কোম্পানির ব্যবসা। ডিসকাউন্টের ছড়াছড়ি ই-বাজারেও। নেট খুললেই বিজ্ঞাপনের উপদ্রব। পণ্যের ছবির নীচে তার দাম লিখে কেটে দেওয়া থাকবে। তার নীচে থাকবে আরেকটি দাম যা কেটে দেওয়া দামের তুলনায় অনেকটা কম। পাশে থাকবে আপনি কতটা ছাড় পাচ্ছেন তার শতাংশ। বাজারে যাচাই করলে দেখা যাবে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রকৃত দাম আরও কম। তাছাড়া অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে ছবিতে যে পণ্য অথবা যে রঙ দেখানো হয়, পণ্যটি বাড়িতে পৌঁছনোর পর দেখা যায় তা ঠিকঠাক মিলছে না। নানা অভিযোগ থাকলেও তরুণ প্রজন্ম এই বাজারেই সওদা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
অনেক ব্যাগ-স্যুটকেসের দোকানে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ ছাড়ের বোর্ড সারা বছরই ঝুলতে দেখা যায়। এক চশমার দোকানে এক বোর্ড দেখা গেল যেখানে লেখা আছে ‘বিনামূল্যে চশমার ফ্রেম পাওয়া যায়’। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ৪০০০ টাকা দামের একটি বিশেষ লেন্স কিনলে তবেই একটি ফ্রেম বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। অনেক ক্ষেত্রে ছাড়ের শর্ত এত ছোট অক্ষরে লেখা থাকে তা খালি চোখে পড়া একরকম দুষ্কর। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে গাড়ি এবং মোটরবাইকের ক্রেতা টানতে কোনও কোনও মরশুমে দেদার ছাড় দিতে দেখা যায়। একইভাবে মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক ছাড় মেলে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভের মতো মেয়াদি ভোগ্যপণ্যে। চারদিকে এত ছাড়ের কচকচানিতে ক্রেতা বেচারি বুঝতেই পারে না কোনটা ন্যায্য দাম। একটা জিনিস কিনে সে জিতল না ঠকল।
গত এক দশকে ভালই জনপ্রিয় হয়েছে 'ভ্যালেন্টাইনস ডে'। ভালোবাসার এই বিশেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে কেনাকাটাও। সঙ্গে থাকে নানারকম ছাড়ের প্রলোভন। সম্প্রতি আমদানি হয়েছে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নামে আরও একটি কেনাকাটার বিশেষ দিন। আমেরিকায় ধন্যবাদ দেওয়ার (থ্যাঙ্কস গিভিং) দিনের পরের শুক্রবারকে ও দেশে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়। এই দিনটিতে চলে দেদার কেনাকাটা। চলে পরের সোমবার পর্যন্ত, যা ‘সাইবার মানডে’ বলে আমেরিকায় পরিচিত। এই ব্ল্যাক ফ্রাইডের কেনাকাটার হুজুগ চালু হয়ে গিয়েছে ভারতেও। দেশের কয়েকটি নামী ব্র্যান্ডের কথায়, এই তিন চার-দিনে অন্য সপ্তাহের তুলনায় তাদের বিক্রি অনেকটাই বাড়ে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকেই শুরু হয়ে যায় ক্রিসমাসের কেনাকাটা। চলে ছাড়ের যুদ্ধ।
ছাড় নিয়ে মানুষ সব থেকে ধন্ধে ওষুধ কেনার ব্যাপারে। বছর দশেক আগেও ওষুধে কোনও ছাড় পাওয়া যেত না। পরে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে খুলতে শুরু করল ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান। বেশ খানিকটা কম দামে এখানে বিভিন্ন রকমের ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম পাওয়া যায়। এরপরেই দোকানে দোকানে ডিসকাউন্ট দেওয়া শুরু হল। প্রথম দিকে তা ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরের দিকে তা ক্রমশ লাগামছাড়া হতে শুরু করল। তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হল বিভিন্ন ওষুধ বিক্রেতার মধ্যে। ছাড় বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গেল ৩০ শতাংশে। এখানেই শেষ নয়। কিছুদিন আগে এক বড় ওষুধ বিক্রেতার দোকানের সামনে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের বোর্ড ক্রেতাদের নজর কেড়েছে। এর ঢাউস বিজ্ঞাপন এসেছে খবরের কাগজেও। এতটা ছাড় কী করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে তার যুক্তিও অবশ্য দেওয়া হয়েছে। ওষুধে বিভিন্ন ধরনের ছাড়ে একদিকে যেমন অনেকটাই সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে তেমন কিছু মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন, এত ছাড়ে যে সব ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে তার গুণগত মান ঠিক আছে তো? অসুখ সারবে তো? খোলা বাজারে ওষুধে এই মাত্রাহীন ছাড় পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে কিন্তু কোনও ছাড়ই দেওয়া হয় না। রোগীর আত্মীয়দের থেকে ওষুধের গায়ে ছাপা দামের পুরোটাই আদায় করা হয়। একদিকে মাত্রাহীন ছাড় এবং অন্যদিকে ছাড়হীন বিলে সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ।
আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী ওষুধ সহ প্যাকেটজাত এবং বোতলবন্দি বিভিন্ন খুচরো পণ্যের গায়ে তার বিক্রির সর্বাধিক দাম (এমআরপি) লিখতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে দাম যদি এতটাই বাড়িয়ে লেখা হয় যেখানে ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি ছাড় দেওয়া সম্ভব হয় তবে তাতে ক্রেতার কোন উপকার হয়? এসব ক্ষেত্রে একই জিনিসের দাম বিভিন্ন দোকানে বিভিন্ন রকম হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকবে। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই এক শ্রেণির ক্রেতারা ঠকবেন। সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দফতর এই ব্যাপারটি একটু তলিয়ে দেখলে ভাল হয়। অনেকেই মনে করেন, দরদামের সুযোগ যেখানে যত বেশি সেখানে ঠকার সম্ভাবনাও তত বেশি। এই কারণে ‘এক দাম’ বোর্ড লাগানো দোকানে কেনাকাটা করতে অনেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পণ্যের, বিশেষ করে ওষুধের মতো অত্যাবশ্যক পণ্যের দামে অনেক বেশি স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। সঠিক দাম সবার জানার অধিকার আছে। এর জন্যে প্রয়োজন হলে আইনের পরিবর্তন করতে হবে।
ডিসকাউন্ট দিয়ে ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করা এবং তা দেখে কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়া বা না পড়া আসলে একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা (মাইন্ড গেম)। অনেক ক্ষেত্রেই ডিসকাউন্ট পাওয়ার জন্যে একটি ছোট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। লক্ষ্য, ক্রেতার উপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা। অনেকেই এই চাপ এড়িয়ে খোলা মনে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এইভাবে কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয়ে যায়। ক্রেতাদের পণ্য কেনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা এবং ব্যবহার (কনজ্যুমার বিহেভিয়ার) নিয়ে অনেক ভোগ্যপণ্য নির্মাণকারী সংস্থা নিয়মিত সমীক্ষা চালায়। যাঁদের বেশি উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে তাঁদেরই অনেকে ক্ষুরধার বিজ্ঞাপন এবং ছাড়ের ফাঁদে পা দিয়ে থাকেন।
অনেক পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকে। এতে ক্রেতাদের লাভ হওয়ার কথা। প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে পণ্যের উৎকর্ষতা বাড়াতে হয়, দামও রাখতে হয় ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে। তা না করে কোনও কোনও বিক্রেতা অসাধু পথে পা বাড়ান। এর শিকার হয় ক্রেতা সমাজের একাংশ। বার বার ঠকে সামগ্রিকভাবে বিক্রেতাদের সম্পর্কে আমাদের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যেটা বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের দেশে ক্রেতা সুরক্ষা আইন আছে। সেখানে অভিযোগ জানালে অনেক ক্ষেত্রে কাজও হয়। তবে বহু মানুষের কাছে এই প্রক্রিয়াটা অজানা থাকায় অথবা তাঁদের অনীহার কারণে ঠকা সত্তেও অভিযোগ জমা পড়ে না। মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারটি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো আশু প্রয়োজন।
আসল কথা প্রতারকের খপ্পরে পড়া।
ReplyDeleteআশির দশকে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে সোমেনপন্থী হকাররা এক প্রকার খদ্দেরকে প্রতারিত করতো। যেমন কলেজ স্ট্রিট বই হকারদের দৌরাত্ম্য। হাত খিঁচে ঝরত।
আজ বিজ্ঞ প
Daruun.
Deleteখুব সুন্দর explanation
ReplyDelete