আদিত্যনাথের প্রাণঘাতী রাজনীতি!
অরুণাভ বিশ্বাস
আয়োজনের কোথাও 'খামতি' নেই। 'খামতিহীন আয়োজনের' প্রচারেরও কোনও কমতি নেই। গত এক মাস ধরে সবাই শুনে আসছে ১৪৪ বছর পরে নাকি কী এক সৌরজাগতিক ঘটনার (আদতে বৃহস্পতি, রবি ও চন্দ্রের এক সরলরেখায় আসা) সমাপতন! কিন্তু ঘটনাটা ঠিক কী সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাসম্পন্ন লোকজন যদিও সেভাবে চোখে পড়ছে না। তাই বলে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে মহাকুম্ভ নিয়ে প্রচারের কিছু আর বাকি নেই। বায়ো-টয়লেট থেকে ফাইভ-স্টার তাঁবু, অদ্ভূতাচারী নানারকম তথাকথিত বাবাজী বা মাতাজীর কর্মকাণ্ডের ছোট ছোট ভিডিও, ড্রোন ক্যামেরায় তোলা লংশট, লংশটে পুণ্যস্নানে জাতপাত ভুলে অগণিত মানুষের একই গঙ্গাজলে অবগাহন বা ডুবস্নান– সবই প্রচারিত হয়েছে ফলাও করে। সে সব আমরা প্রায় এক মাস ধরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। অথচ এসব যে আদতে তথাকথিত হিন্দু ধর্মের এক অসহ্য গর্বোদ্ধত প্রচারসর্বস্বতা, তা তাকিয়ে থাকলেও দেখতে পাইনি কেউই। এই প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক পরপর কয়েকটি অনভিপ্রেত ঘটনা বুঝিয়ে দিল উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকারের ফাঁপা আস্ফালন।
প্রচার হয়েছিল একই গঙ্গাজলে শূদ্র থেকে ব্রাহ্মণের পুণ্যস্নানকে নিয়ে। কোটি কোটি লোকের সমাগমকে বলা হয়েছিল ভারতের এক মহামিলনের জয়গান। সোশাল মিডিয়ায় মিম ছড়িয়ে প্রচার হয়েছিল জাতপাত নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষের একত্র স্নানে বামপন্থীরা নাকি ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। অথচ কেউ ভেবে দেখিনি, বাতানুকূল বিলাসবহুল তাঁবু, পৃথক ভিআইপি করিডর, স্পেশাল সিকিউরিটি ইত্যাদি তীর্থযাত্রার কায়িক ক্লেশের ধারণাকে স্বীকার করে না। তা আদতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র বিভেদকেই মান্যতা দেয় এমনভাবে যেখানে ধর্ম-বর্ণ ভিত্তিক জাত বিভাজন আসলে টাকার গরমে বা ক্ষমতার দর্পে আর্থ-সামাজিক শ্রেণি বিভাজনে পর্যবসিত হয়েছে।
অন্যদিকে শূদ্রদের যদি পুণ্যস্নানে বাধা দিতে হত তাহলে তো পুণ্যস্নানের মূল ভিত্তিই নড়ে উঠত এই মর্মে যে শূদ্রের স্নানের ফলে 'গঙ্গা মাঈয়া ভী ময়লি হো জাতি হ্যায়।' তাহলে আর এত ঝামেলা করে স্নানের কী দরকার! কাজেই বাধ্য হয়ে ব্রাহ্মণ আর শূদ্রদের এক ঘাটে স্নান করতে হয়েছে। তাই এটা যোগী আদিত্যনাথের প্রচারে যতই কাজে আসুক সত্যটা নিহিত আছে স্নানের ধর্মীয় উপচারেই। কারণ, তা না হলে পতিতপাবন গঙ্গার ধারণাটাই সে ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়ে যেত। এ অনেকটা লাইসেন্সড একাত্মতা– সনাতনীরাই বিভেদ করেছে বর্ণাশ্রমে, আবার তারাই একাত্মতার প্রচার করছে পুণ্যস্নানের শাঁখের করাতে পড়ে।
গত ১৯ জানুয়ারি কুম্ভমেলার তাঁবুতে আগুনের লেলিহান শিখা সকলে দেখেছি। কিন্তু পুণ্যস্নানের সমারোহে ধর্মগ্ৰন্থ ছাপানোর প্রকাশক গীতা প্রেসের তাঁবুতেই আগুন লেগে যাওয়াটা কীসের ইঙ্গিত বহন করে তা স্নানে পুণ্যবান পুণ্যার্থীরা ভালো বলতে পারবেন। কলকাতায় বসে আমার এ নিয়ে মন্তব্যের অবকাশ নেই। কিন্তু এটুকু বলা যায়, অগ্নি নির্বাপণের আগাম পরিকাঠামো যথাযথ ছিল না এবং দাহ্য-দাহকের পৃথক উপস্থিতির প্রাথমিক শর্ত মানা হয়নি। আগাম নজরদারির অভাব ছিল স্পষ্ট। না হলে মুহূর্তে আগুন অতটা ছড়াতো না। এ বিষয়ে বাম আমলে কলকাতা বইমেলার ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া মনে পড়ছে। কুম্ভ হোক বা বইমেলা– অগণিত মানুষের আবেগ যেখানে জড়িয়ে সেখানে প্রশাসনের তরফে আরও দায়বদ্ধতা আশা করে নাগরিক সমাজ। যোগী আদিত্যনাথের পিআর টিম এই দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখেছিল কি?
‘মেলা মানে মিলন’-- সে কথা আমরা উচ্চ প্রাথমিক স্তর থেকে মেলা নিয়ে বাংলায় রচনা লিখতে লিখতে কথাটাকে ক্লিশে বানিয়ে ফেলেছি। যদি ধরেও নেওয়া হয় কুম্ভ মেলা সনাতন ধর্মের একান্ত নিজস্ব একটি মেলা যেখানে একাধিক ভিন্ন সনাতনী আখড়ার সাধু-সন্তরা মিলিত হন, তবুও এইখানে মনে রাখতে হবে, তথাকথিত ‘হিন্দুধর্ম’ বলতে মনোলিথিক কোনও ধর্মমতকে বোঝায় না। তা বোঝায় শাক্ত শৈব বৈষ্ণব গাণপত্য ইত্যাদি নামধারী নানা ধর্মমতের এক বহুত্ববাদী আস্তিক্য ধারার সমষ্টিকে যার সাথে নাস্তিক্যবাদের আপাত বিরোধ থাকলেও সরাসরি সংঘাতের কোনও অবসর নেই। কারণ, পরমতসহিষ্ণুতা সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী তো নয়ই, এমনকী নাস্তিকতা বা বিবিধ নাস্তিক্য দর্শন তথা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনও কিন্তু সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে। তা সত্ত্বেও কেবল মনুবাদী বা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের চক্ষুশূল হল নাস্তিক্যবাদ।
পূর্বোক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতারই এক অনভিপ্রেত প্রক্ষেপ দেখা গেল এবারের কুম্ভমেলায় যেখানে নিছক কুসংস্কার বিরোধী একটি মঞ্চের পক্ষে ভাড়া নেওয়া তাঁবুতে নাগা সন্ন্যাসীদের বেশধারী কিছু বাবাজী ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং ধর্মগ্ৰন্থ, পুস্তিকা বা প্রচারপত্র ছিঁড়ে, মাটিতে ফেলে স্তুপাকার করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। অথচ সূত্রে প্রকাশ, আচার্য প্রশান্তের উক্ত মঞ্চটি আদপে ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে বা নাস্তিকতার সপক্ষে কোনও প্রচার করছিলই না। চরিত্রগতভাবে তা ছিল মূলত ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আশ্রয় না করা একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের তরফে পরিচালিত তাঁবু। এতেও হিন্দুত্ববাদী (প্রকৃতপক্ষে মনুবাদী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী) সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আপত্তি ও তৎপরবর্তী ঘৃণা ও হিংসা প্রাধান্য পেল। যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন এর প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণের কোনও ব্যবস্থা করেছে কি না জানা নেই। ধর্মগ্ৰন্থ পোড়ানোর মতো গুরুতর অপরাধের কোনও শাস্তি হল না, অথচ নালন্দার বৌদ্ধ মহাবিহার মুসলিম শক্তির আগ্ৰাসনে কীভাবে আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল তা ফলাও করে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস প্রচার করে থাকে, বৌদ্ধমতাবলম্বী ও তাদের উপাসনাস্থল বা মহাবিহারগুলির ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের তরফে চলা চরম আক্রোশ তথা হিংসার ইতিহাস গোপন রেখে। যাই হোক, এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং তৎপরবর্তী রাজধর্ম পালনের অনীহা কিন্তু পুণ্যকুম্ভের মিলনস্থলকে অপবিত্রই করেছে। পরিচ্ছন্নতাই পবিত্রতা। মেলার আয়োজকরা যেখানে তাঁবুর অনুমতি দিয়েছিলেন সেখানে এই বিভেদকামী আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া অপরিচ্ছন্ন বা অস্বচ্ছ প্রশাসনের দিকে ইঙ্গিত করে। মনে রাখতে হবে, ‘মেলা’ (অর্থাৎ সামাজিক মিলন বা সমসত্ব সংমিশ্রণ) এবং ‘বিভেদ’ (এ ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মেরই নানা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর পার্থক্য) এক সাথে যায় না।
এই লেখা যখন লিখছি তখন কুম্ভে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শেষ খবর অনুযায়ী, তা ৪০'এর কাছাকাছি। গোদী মিডিয়ার আস্ফালন, ফেক নিউজ, ফেক ভিডিও, ফেক ছবি (একটা নমুনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না যেখানে একটি সোশাল মিডিয়া পোস্টে দেখা যাচ্ছে ট্রাম্প-মাস্ক-পুতিন ত্রয়ীকে পুণ্যস্নান করতে) ইত্যাদির পসরা পেরিয়ে ক্রমশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়ার খবর সামনে আসছে। বেআব্রু হয়ে পড়ছে ৮,০০০ কোটি টাকা (প্রকৃতপক্ষে ৭,৫২৫ কোটি প্রায়) সরকারি ব্যয়ে নির্মিত পরিকাঠামোর ফাঁক-ফোকর। একের পর এক ভিআইপি'র (যার মধ্যে কেন্দ্রীয় স্তরের নেতামন্ত্রী থেকে শুরু করে বলিউড অভিনেতা বা মডেল এমনকী কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের লিড সিঙ্গারও আছেন) সেবায় নিয়োজিত আদিত্যনাথের পুলিশ ও প্রশাসন সাধারণ পুণ্যার্থী মানুষের ঢলকে গুরুত্বই দেয়নি। যাতায়াতের রাস্তা একমুখি ও দ্বিমুখি থাকার সুস্পষ্ট নির্দেশ সব জায়গায় ছিল না এবং যেখানে যেখানে ছিল সেখানে এমন পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না যাতে জনস্রোতের অভিমুখকে সেই অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারত। সন্ত প্রেমানন্দজীর অভিযোগ, আখাড়াগুলোর তরফে বারবার সেনা নামানোর অনুরোধ থাকলেও সম্ভবত আদিত্যনাথের মেগালোম্যানিয়ার কারণে সেনাকে তলব করা হয়নি। ১৫ লাখ পুণ্যার্থী পিছু ১,০০০ মতো পুলিশকর্মীর উপস্থিতি অত্যন্ত অপ্রতুল। মেলামুখি ট্রাফিক জ্যামও ছিল চোখে পড়ার মতো। তারপরেও ভিড় নিয়ন্ত্রণের তুঘলকী সিদ্ধান্তে ৩০টি পন্টুন ব্রিজের অধিকাংশকে বন্ধ রেখে, একেকটা দিন একেকটাকে খুলে, ভিড়কে এক জায়গায় আটকে রেখে ড্রোন শট নিয়ে প্রচার করা হয়েছে, অন্যদিকে ভিআইপিরা তুলনায় ফাঁকা সঙ্গম স্থলে শৌখিন পুণ্য অর্জন করেছেন। স্নানের ঘাটে এগোতে না পারা এবং স্নান সেরে ফিরতে না পারা বিভ্রান্ত পুণ্যার্থীদের বাধ্য হতে হয়েছে মালপত্র সমেত ওখানেই শুয়ে থাকতে। এরপর যখন ভিআইপি আগমনে পন্টুন ব্রিজ খোলা হয় তখন ধৈর্যের বাঁধভাঙা মানুষজন বন্যার মতো ব্যারিকেড ভেঙে হুড়োহুড়ি করতে শুরু করে এবং শুয়ে থাকা মানুষজন পদপিষ্ট হয়। আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করে নাগা সন্ন্যাসীদের দল বেঁধে স্নান করতে আসার গুজব।
মানুষকে নিয়ে মেলা, মানুষের জন্য মেলা, মানুষের মেলা– সম্ভবত আত্মপ্রচারপ্রিয় আদিত্যনাথের সরকার ও প্রশাসন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিল। মাটিতে পা ছিল না, তাই এত ড্রোনশটের ছড়াছড়ি। মেলায় কারোর মা, কারোর শ্বাশুড়ি মারা গিয়েছেন– সে আর্তনাদ কানে শোনা যায় না। মরদেহ পদপিষ্ট হয়ে পরিচ্ছদহীন হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। মা-মাটি-মানুষের এই অপমান বঞ্চনা আর অবমাননার দায় আর যাই হোক প্রশাসনের তরফে হাজার ক্ষমা স্বীকার বা দোষারোপেও স্খলিত হওয়ার নয়। এ দায় ও দোষ সম্পূর্ণতই আদিত্যনাথ প্রশাসনের।
লেখাটা শুরু করেছিলাম পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর খবর শুনে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়। সেই মৃত্যুর মিছিল এতক্ষণে বেড়ে ৪০ প্রায়। এই অবস্থায় লেখা শেষ করার আগেই আবার আগুন লাগার খবর। এবারে মূল মেলা চত্বরের বাইরে হলেও তারও দায় প্রশাসনের। কারণ বারবার দাবি করা হচ্ছে নাগেশ্বর ঘাটের কাছে সম্ভবত জুনা আখাড়ার তরফে কিছু অননুমোদিত ছোট ছোট তাঁবু ছিল যাদের ১৯টিতে আগুন লেগেছে।
সৌভাগ্যক্রমে এ ক্ষেত্রে হতাহতের খবর নেই। কিন্তু অননুমোদিত তাঁবুগুলোকে প্রশাসন কেন খুলে ফেলতে বাধ্য করেনি তার কোনও সদুত্তর নেই। ঠিক যেমন সদুত্তর পাওয়া যায়নি গীতা প্রেসের তাঁবুতে লাগা আগুন কীভাবে অত অল্প সময়ে একশর মতো ছোট ছাউনি এবং ১০টা বড় প্যাভিলিয়নকে (যদিও হাস্যকর সরকারি সূত্রানুযায়ী সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৮-১০টা তাঁবু) গ্ৰাস করে ফেলল সেই প্রশ্নের।
বিশ্বের বৃহত্তম গণসমাবেশের আয়োজনে আদিত্যনাথের প্রশাসনের হয়তো চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু ২ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হওয়ার আস্ফালন কীসের তা বোঝা গেল না। আদতে তো ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো সরকারের খাতায় আসবে। বাদবাকি সবটাই তো ধর্মকে কেন্দ্র করে ব্যবসা। তা নিয়ে এত প্রচার একদমই বেমানান। তাই উত্তরপ্রদেশ সরকার ও প্রশাসনের সমালোচনা ততটাই প্রাপ্য যতটা প্রশাসন নিজে উদ্যোগী হয়ে নিজ সাফল্য বা আত্মগরিমার প্রচারে ব্যস্ত ছিল। নিজের প্রশংসা নিজে করলে, নিজের পিঠ নিজে চাপড়ালে, নিজের কলার নিজে তুললে, মনে রাখতে হবে, নিজের কান নিজে মুলে নিজেই নিজেকে ওঠবোস করানোর সময়ও আসবে।
No comments:
Post a Comment