Tuesday, 28 January 2025

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বযুদ্ধ!

কার হাতে রথের রশি?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ২০ জানুয়ারি যেদিন ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিলেন, সেদিনই বিশ্বের অপর প্রান্তে চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্টার্ট-আপ DeepSeek আন্তর্জাতিক বাজারে উন্মোচিত করল DeepSeek-R1 নামক একটি LLM বা Large Language Model (চলতি ভাষায় ‘চ্যাটবট’)। তারপরই হৈচৈ কাণ্ড! দেখা গেল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই নতুন উদ্ভাবন -- যা মাত্র ৫.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা হয়েছে -- বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলগুলিকে টপকে যেতে সক্ষম। এমনকি স্যাম অল্টম্যানের OpenAI ও তাদের ChatGPT অথবা গুগল’এর ‘জেমিনি’র বাগাড়ম্বরকেও এখন বেশ স্তিমিত দেখাচ্ছে।

DeepSeek-R1'এর আবির্ভাব সিলিকন ভ্যালির হাই-টেক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শুধুমাত্র হতবাক করেনি, বলা ভালো, বিশ্বের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এতদিন মার্কিন দেশের টেক দৈত্যদের যে আধিপত্যের কথা বড়াই করে বলা হত এবং সেই আধিপত্যকে বজায় রাখতে তাদের তরফে নানারকম বাণিজ্যিক বিধিনিষেধও বেশ সগৌরবে চালু ছিল, সে সবেরও থোতামুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বড় বড় টেক দৈত্যরা যেখানে AI LLM’এর পিছনে এ তাবৎ বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, সেখানে DeepSeek মাত্র কয়েক মিলিয়নে এই অভিনব কাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেলেছে; কেবলমাত্র তাই নয়, জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধানে, উন্নতমানের কোডিং লেখায়, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার ও বিশ্লেষণে, তুখোড় বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে, দুরন্ত সৃজনশীলতায় এবং সর্বোপরি শিখে-পড়ে নেওয়ার অসামান্য ক্ষমতায় সে সক্ষম ও পারদর্শী। উপরন্তু, তাকে পাওয়া যাচ্ছে একেবারেই বিনামূল্যে এবং সে open-sourced (অর্থাৎ, যে কেউ তার উপরে আরও বিদ্যে ফলাতে পারে)।

এই প্রযুক্তির আবির্ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে এক নতুন প্রতিযোগিতার সূত্রপাত শুধু নয়, কেউ কেউ বলছেন, এক নবতর যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বযুদ্ধ; অনেকটা সেই ৫০’এর দশকের ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধের’ মতো। ফারাক, এখানে যুদ্ধাস্ত্রের ঝনঝানানি নেই, আছে প্রাযুক্তিক বুদ্ধিতে দখলদারির নানান কলাকৌশল। তা এতটাই ব্যাপ্ত যে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাগতিক অস্তিত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বলয়ে অনুপ্রবেশ ও দখলদারিতেই তার আধিপত্য ও বাণিজ্যিক সাফল্য। বলাই বাহুল্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন জাতীয় শক্তির একটি মূল উপাদান এবং এই প্রযুক্তির নেতৃত্ব দখল করার জন্য দেশগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আজ আমেরিকায় এলন মাস্ক সহ প্রায় সমস্ত টেক দৈত্যের কর্ণধারদের যে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের পাশে সদাই দেখা মিলছে, তা সেই দ্বৈরথেরই ইঙ্গিত। এই প্রতিযোগিতার কী পরিণতি হবে এবং এর ভবিষ্যৎই বা কী, তা এখনও অজানা।

আশ্চর্যের হলেও সত্যি, এত স্বল্প ব্যয়ে DeepSeek-R1’এর এই অভূতপূর্ব উত্থানে দুনিয়া জুড়ে এক ঝড় উঠেছে। ChatGPT’কে ছাপিয়ে সে এখন অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। মাইক্রোসফট’এর সিইও সত্য নাদেলা জানিয়েছেন, DeepSeek-R1’কে আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি, DeepSeek-R1’এর অভিঘাতে স্টক মার্কেটে ধসে পড়ছে বড় বড় টেক দৈত্যরা-- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপ-নির্মাতা সংস্থা Nvidia’র পতন প্রায় ১৮ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য ৫৬০ বিলিয়ন ডলার (এখন পর্যন্ত এত বড় পতন শেয়ার বাজারের ইতিহাসে নাকি দেখা যায়নি)। এই পতনের বিশাল অর্থমূল্য রিলায়েন্স, টিসিএস ও এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের একযোগে মোট বাজার মূল্যের সমান। অবশ্য, শেয়ার বাজারের এই পতন থেকে কেউই বাদ যাচ্ছে না— মেটা, মাইক্রোসফট, গুগল’ও ধাক্কা খেয়েছে। মুখ্য কারণ দাঁড়াচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত কোম্পানিগুলিকে আরও একবার মূল্যায়ন করে বুঝে নিতে চাইছেন, এতদিনের এত বিপুল পরিমাণে তাঁদের লগ্নি আদপে কতটা ঘরে ফেরত আসবে! DeepSeek-R1 যদি এত স্বল্পমুল্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতি-উন্নত ব্যবহারকে সম্ভব করতে পারে, তাহলে এই ক্ষেত্রে এতদিনের বিপুল পরিমাণের অতি-বিনিয়োগ কোন কম্মে লেগেছে? এমত ভাবনা-চিন্তা কিন্তু অর্থনীতিকে ওলটপালট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। খেয়াল রাখতে হবে, ট্রাম্প রাষ্ট্রপতির আসনে বসেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘প্রজেক্ট স্টারগেট’ প্রকল্পে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, তা কি এখন অথৈ জলে পড়ে গেল? এই ভাবনা অমূলক কিছু নয়!

কেন সকলে DeepSeek-R1’এর উত্থানে ঘাবড়ে গেছে?

এক) এদের অতি-সস্তায় (যা বড় বড় টেক কোম্পানির খরচের ভগ্নাংশ মাত্র) উন্নতমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি নির্মাণে বাকী কর্পোরেটরা আশঙ্কিত;

দুই) শুধুমাত্র কম খরচের দিক থেকে নয়, DeepSeek-R1’এর যুক্তিবুদ্ধি এবং সমস্যা সমাধানে নিপুণতা ও পারদর্শিতা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তাদের বড়সড় সুবিধা করে দিচ্ছে;

তিন) দেশ হিসেবে চীনের হাতে তাদের দেশিয় সংস্থার এই সাফল্যটি চলে আসায় মার্কিন-চীন সম্পর্কের বলয়ে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড়সড় রদবদল ঘটতে পারে;

চার) নিজে নিজে শিখে-পড়ে নিতেও DeepSeek-R1 আরও বেশ পারদর্শী;

পাঁচ) এমন একটি উদ্ভাবনের ফলে উৎপাদনশীলতা যথেষ্ট বেড়ে যাবে যা আবার হয়তো চাকরি ফুরিয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাকে আরও ব্যাপক করবে।

মোদ্দা কথায়, খুব কম খরচে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদগত অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন একটি চ্যাটবট (LLM) যদি পাওয়া যায়, দীন-দুনিয়ার প্রায় সমস্ত কাজই যদি সে করতে পারঙ্গম হয়, তাহলে তাকে যে প্রতিপক্ষের অর্থশক্তির ধমকানির সামনে পড়তে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৎসত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে দেখা গেল যে অর্থ-প্রাবল্য কিছুটা পিছু হঠল। অর্থাৎ, বড় বড় বিনিয়োগকারীরা ভাবতে শুরু করলেন, তারা কি এতদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পিছনে অযাচিত অর্থ ব্যয় করেছেন? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি এমন এক ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারে না যেখানে স্বল্পমূল্যে তাকে অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলা যায়? এমনকি তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহারের জন্য তাকে open source হিসেবে বাজারে ছাড়া যায়! DeepSeek-R1 ঠিক এই অসাধ্যসাধনকেই সম্ভব করেছে। আর এখানেই যেন এক বাঁক-ঘোরানো মোড় উপস্থিত! যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ওপর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে।

হয়তো তার প্রমাণও মিলছে। ইতিমধ্যেই DeepSeek-R1’এর ওপর শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক ‘গোলাবর্ষণ’। সাইবার দস্যুরা তাকে ঘিরে ধরে তার উপর পরপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে, আপাতত তারা নতুন ‘User Registration’ করতে পারছে না। যারা এই মুহূর্তে চাইছেন user id তৈরি করে সেখানে বিচরণ করতে, তাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে সে আত্মরক্ষায় সক্ষম। তাই তাকে কোনওভাবেই অকেজো করে দেওয়া যায়নি। তবে এর অন্য একটি বিপদও আছে। চীনের আভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ে DeepSeek-R1’কে প্রশ্ন করলে সে কিছু জানে না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, এই প্রযুক্তির প্রাপ্ত ট্রেনিং’এর মধ্যে self-censorship’এর উপাদানও বেশ জোরালো ভাবে পুরে দেওয়া আছে। তার মানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও এমন এক ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে পারে যা অর্ধসত্য বা ইচ্ছাকৃত ভাবে অজানা। অবশ্য এই ফাঁকেই মনুষ্য-চৈতন্যের বাস, যেখানে শেষ বিচারে সে যন্ত্রের ওপর বিরাজ করে। সে অন্য প্রসঙ্গ।

আপাতত শেয়ার বাজারে Nvidia’র পতনের (উপরে উল্লিখিত) পাশাপাশি Nasdaq’এর সুচক ৩ শতাংশ পড়ে গেছে যার অর্থমূল্য ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এমনকি যে সব কোম্পানি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিকাঠামোর জন্য বিদ্যুৎ সরঞ্জাম সরবরাহ করে— যেমন, Siemens Energy, Schneider Electric-- তাদেরও শেয়ার মূল্য যথাক্রমে ২০ ও ৯ শতাংশ পড়ে গেছে। ফলে, এতদিন উচ্চমূল্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিপ বিক্রির যে রেওয়াজ ছিল তার হয়তো ইতি হতে পারে। অনেক কম খরচে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নাগাল পাওয়াটা এখন সম্ভবত আর অলীক ঘটনা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নামে কতিপয় কর্পোরেট দৈত্যের তুমুল মুনাফা লুঠের যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল তার অবসান হয়তো সময়ের অপেক্ষা মাত্র। উল্লেখ্য, OpenAI যেখানে কাজ করে ৪,৫০০ কর্মচারী নিয়ে, DeepSeek সেখানে মাত্র ২০০ জনকে দিয়ে এই অসাধ্যসাধন করতে পেরেছে!

নিঃসন্দেহে DeepSeek প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির জগতে এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও ফলাফল কোনদিকে আমাদের নিয়ে যাবে তার দিকে আপাতত তাকিয়ে থাকাটাই শ্রেয়। তবে আমরা কি বলতে পারি, এইসব টানাপোড়েনে অবশেষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন ক্রমেই সাধারণেরও হাতের নাগালের মধ্যে?

 

3 comments:

  1. ভাবার মতো যথেষ্ট উপাদান আছে।
    তবে রাজার বাজার যুদ্ধে আমাদের হিসাব মিলবে কি?
    অসিত

    ReplyDelete
  2. অভিজিৎ দাস29 January 2025 at 13:07

    বেশ স্বচ্ছ ও সাবলীলভাবে আলোচনা করেছো। চীনের এই স্বল্প মূল্যের ডিপসীক-আর আই মডেলের অভিঘাত আগামী দিনে কি ভাবে আবর্তিত হয়, তা দেখার অপেক্ষায়। তোমার লেখাটা বেশ ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. লেখাটি ভালো । DeepSeek খরচ কমাতে যেমন NVIDIA'র চলতি Gaming CPU ব্যবহার করেছে তাদের উচ্চমূল্যের AI CPU ' র বদলে, তেমন তাদের ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার-রা অধিকাংশ সদ্য ডক্টরেট পাওয়া স্নাতক হওয়ায়, manpower-cost আমেরিকান কোম্পানিগুলোর থেকেও অনেক কম। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার ক্ষেত্রে যে কত উন্নতমানের, সেটা তাদের স্নাতকদের মানের পরিচয় থেকেও জানা যায়।

    ReplyDelete