বাংলা শিক্ষার হাল-হকিকত
প্রজ্ঞা পারমিতা
বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরনের হা-হুতাশ সরিয়ে রেখে, যারা ভাষাটা শিখছে তাদের মধ্যে কিছু কাজ করে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও আনা যায়, সেই তাগিদ থেকে আমরা স্কুলে স্কুলে বাংলা বানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করা শুরু করি ২০২২ সাল থেকে। বিগত তিন বছর ধরে সেই কাজ করতে করতে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষত বাংলা শিক্ষার মান নিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তা জানানোর উদ্দেশ্যেই আজ লিখতে বসা। যদিও আমরা কী করেছি তার ঢক্কানিনাদ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর যে বাস্তব ছবিটা পেয়েছি, তা কী করে সম্ভব হল, সে সম্পর্কে প্রথমে একটু লিখতেই হবে; অন্যথায় পূর্বোক্ত ‘আমরা’ কথাটাও স্পষ্ট হবে না।
বাংলা নিয়ে বানান প্রতিযোগিতার এই ভাবনাটি সুমন গাঙ্গু্লি মহাশয়ের। তিনি ও আমি ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’ নামে একটি দল পরিচালনা করি যার উদ্দেশ্য বাংলা ভাষা চর্চা। এই গোষ্ঠীর নামেই আমরা প্রতিযোগিতাটি করি যার নাম দিয়েছি ‘বানানবাজি’, সহজ ভাষায় যার অর্থ বানানের বাজি। এখন কথা হল, বানান প্রতিযোগিতা– এই শব্দবন্ধ উচ্চারিত হওয়া মাত্র নিশ্চিত সবার মনে ‘স্পেলিং বি’ এই শব্দ দুটোই ঘাই মারে। অথবা মনে পড়তেও পারে রিচার্ড গিয়র ও জুলিয়েট বিনোশে অভিনীত ‘বি সিজন’ ছবিটির কথা, যে ছবি পৌঁছে দেয় শব্দ ও অক্ষরের অমেয় রহস্যময়তার কাছে। কিন্তু যদি বলি বাংলা বানান প্রতিযোগিতা, তবে মগজের লিঙ্ক-লিস্ট বেমালুম ঘাবড়ে যায়। আসলে দুয়োরানি বাংলা ভাষার তেমন কিছু নেই যে! এই ছবিটা বদলাতে চাইছিলাম আমরা। লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটা আবেগময় সচেতনতা সৃষ্টি ও শুদ্ধ বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা। এই লক্ষ্য হয়তো অনেকের অতিউচ্চাশী মনে হবে। কিন্তু বাংলা ভাষার কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই যাবতীয় দ্বিধা-সংশয় নস্যাৎ করে সেই ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আমরা। আমি দেখেছি, কী অবলীলায় একজন সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী বাঙালি ‘স্বর্গ’ এবং ‘সর্গ’-- এই দুটো বানানের প্রভেদ না করে প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। আমি নিশ্চিত তিনি ‘night’ এবং ‘knight’ বানান দুটি যে আলাদা তা যত্ন নিয়ে খেয়াল রাখেন। কিন্তু বাংলার বেলায় সেই দায় নেই কেন? এত তাচ্ছিল্যই বা কেন? সুতরাং, 'catch them young'।
এ কথা সত্যি যে বাংলা বানান নিয়ে সমস্যা আছে। নতুন বানান বিধি, পুরনো বানান, কাগজে কাগজে প্রচলিত ইচ্ছেমতো বানান– এইসব নিয়ে সে এক ঘোর অবস্থা। কিন্তু যারা বাংলা শিখতে শুরু করেছে তাদের তো একটাই এবং সঠিকটা শিখে নিতে সাহায্য করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলা ভাষা তার কাছে একটু যত্ন দাবি করে। আমরা সেই ভাবেই সাজাই আমাদের প্রতিযোগিতা। মধ্য শিক্ষা পর্ষদের বাংলা পাঠক্রম আধুনিক বানান বিধি অনুসরণ করে। আমরা সাধারণত অষ্টম, নবম এবং দশম শ্রেণিতেই এই প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে থাকি এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যবই থেকেই শব্দ বাছাই করি। তাদের যত দূর পড়ানো হয়েছে খোঁজ নিয়ে সেই অংশ থেকেই বানান ধরা হয়। অর্থাৎ, তাদের শক্ত বা অজানা শব্দ ধরে ভড়কে না দিয়ে, যা শিখছে সেটাই কতটা শিখেছে তা একটা আনন্দানুষ্ঠানের মোড়কে বুঝতে পারার সুযোগ তৈরি করা।
এই প্রতিযোগিতাটি হয় দুটি পর্যায়ে, যার দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের লেখার দক্ষতা ও শুদ্ধ বানান সম্পর্কে জ্ঞান এই দুটো বিষয়েরই আন্দাজ পাই আমরা। প্রথমত একটি ছোট অনুচ্ছেদ থেকে শ্রুতিলিখন দিয়ে সবচেয়ে কম বানান ভুলের উপর ভিত্তি করে প্রতিযোগী বেছে নেওয়া হয়। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রত্যেককে দশটি করে বানান জিজ্ঞাসা করা হয়। এভাবে সেই স্কুলের পঠনপাঠন সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এবং এই পদ্ধতিতে ক্রমাগত কাজ করতে করতে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার যে ছবিটা ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে তারই আভাস দেওয়ার চেষ্টা করছি বর্তমান লেখায়।
আমরা সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি তিন ধরনের স্কুলেই কাজ করেছি, ইংরেজি ও বাংলা দুটি মাধ্যমেই। কলকাতা ও মফসসলের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে কিন্তু বিস্তর ফারাক, সে ছাত্র সংখ্যা বা শিক্ষার মান যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা যাক। কলকাতার সরকারি ও আধা-সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছবি অত্যন্ত হতাশাজনক, অবশ্যই হাতে গোনা কয়েকটি বাদ দিয়ে। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অতি অল্প এবং ক্রমাগত নিম্নগামী। পড়াশোনার মান কল্পনাতীত রকমের খারাপ। অবশ্যই প্রতি ক্লাসে একজন বা দুই জন ভালো ছাত্র বা ছাত্রী আমরা পেয়ে যাই, কিন্তু তাতে সামগ্রিক চিত্রে কিছু হেরফের হয় না। অধিকাংশ স্কুলে ৭০ শতাংশ ছাত্রকে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে ৩০ থেকে ৩৫টি বানান ভুল করতে দেখেছি। অতি সাধারণ বানানও ভুল করা দেখে বোঝা যায় যে তারা উচ্চারণ বুঝে বানান করে লিখতেও শেখেনি। বহু খাতা পড়ে ওঠা দুষ্কর বলে বাতিলও করতে হয়। প্রথমেই জানিয়েছি যে আমরা তাদের পাঠ্যবই থেকেই শ্রুতিলিখন দিয়ে থাকি এবং অবশ্যই সেই সময় ক্লাসে যত দূর পড়ানো হয়েছে তা থেকেই। এবং আমরা যে আসছি তা আগে থেকেই তারা জানে। তবুও এ হেন ভুল দেখে নানা ধরনের প্রশ্ন জাগে মনে যার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বানান ধরি তাদের। এই পর্যায়ে যেহেতু সবচেয়ে ভালো ছাত্র বা ছাত্রীকে আমরা তুলে নিয়েছি, তাই দশটির মধ্যে দশটি বানান ঠিক করেছে এমন বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি। কিন্তু কোথাও আবার আরও হতাশাজনক অবস্থা পেয়েছি। বেশ কয়েকটি স্কুলের ছাত্রীদের যথাযথ বর্ণপরিচয় হয়নি। তারা আঙুল দিয়ে বাতাসে লিখে অক্ষর বোঝাচ্ছে। এ-কার উ-কার ইত্যাদিও আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তাদের যুক্তাক্ষর পরিচয় নেই। কোন অক্ষরের সঙ্গে কোন অক্ষর জুড়ে সেই যুক্তাক্ষরটি তৈরি হয়েছে সে ধারণা ভাসা ভাসা। এই ভয়াবহ ছবিটা পেয়েছি বেশিরভাগ সিক স্কুলে বা হাবে। এখানেই একটা প্রশ্ন আসতে বাধ্য। সিক স্কুলগুলোতে কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত শক্তিশালী। একটি স্কুলে যদি ১৬৩ জন ছাত্রী হয় এবং ১০ জন শিক্ষিকা তবে তো অতি অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়েকে পড়াতে হয় এবং ব্যক্তিগত খেয়াল রাখা আরও সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। শ্রুতিলিখন দিতে গিয়ে দেখেছি ৯ জন ছাত্রী একটি ক্লাসে, কিন্তু নবম শ্রেণির ছাত্রী অতি সাধারণ বানান করে উঠতে পারা তো দূর, অক্ষরের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে কি শিক্ষকরা দায় এড়াতে পারেন?! তাঁদের পড়ানোর আগ্রহ নিয়েও কি সংশয় জাগা স্বাভাবিক নয়।
প্রথমত এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে নামী দামী হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল ছাড়া আজ বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়তে আসে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে। এবং তাদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। একটি ছেলের নাম বাপি দাস। এতেই স্পষ্ট যে একটা ভালো নাম রাখাও বিলাসিতা তাদের পরিবারে। তাহলে এটাও বোঝা যায় যে তার বাড়িতে পড়ায় ভুল ধরানোর মতো কেউ নেই। সে যেটুকু শিখবে স্কুল থেকেই, সে ক্ষেত্রে স্কুলের দায় আরও বেড়ে যায় না কি? অথচ আমরা একটি স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্রকে তার নামের বানান লিখতে দেখলাম 'দিপায়ন' দাস। প্রশ্ন করে জেনেছি, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম পর্যন্ত দশ বছর সে ওই স্কুলেই পড়েছে। তবু কেউ তার বাংলা নামের ভুলটুকু শুধরে দেয়নি। আজকাল নানা খাতে সরকারি সাহায্য পাওয়ার কার্ডে নাম তোলাতে হয়। সে দোহাই দিয়েও ভুল রেখে দেওয়া অযৌক্তিক, কারণ, ভোটার কার্ড থেকে আধার কার্ড সবই শোধরানো যায়। এই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট বাংলা শিক্ষিকাকে করায় উত্তর পেয়েছিলাম, 'আজকাল তো কোথাও বাংলায় নাম লিখতে হয় না, পরীক্ষার খাতায়ও ইংরেজিতে নাম লেখাই দস্তুর। তাই জানাই যায় না যে বাংলায় তারা কোন বানান লেখে।' স্তম্ভিত হতেও ভুলে গিয়েছিলাম এই জবাব পেয়ে। ছাত্রছাত্রীদের বিষয় ভিত্তিক একটি খাতা থাকার চল কি আজ আর নেই! বাংলা খাতায়ও কি তারা ইংরেজিতে নাম লিখে থাকে?!
চিরকালই কিছু স্কুল সাধারণ হত, কিছু স্কুল নামকরা হত-- স্কুলের পড়াশোনার মান ও ছাত্রছাত্রীদের মানের উপর ভিত্তি করে। আমাদের অনেকের বাবা মায়েরাই হয়তো সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু এত ভয়াবহ পড়াশোনার মান কী আগেও ছিল? আলোচনা করে দেখেছি, সম্ভবত না। আমি কিন্তু কলকাতার বাংলা মাধ্যম সরকারি বা আধা-সরকারি স্কুলের কথাই বলছি, অবশ্যই কিছু নামী স্কুলের কথা বাদ রাখছি।
আরও কিছু অদ্ভুত সত্যের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চলের স্কুলে আমরা একশো শতাংশ মুসলমান ছাত্র বা ছাত্রী পেয়েছি। একটা ভালো দিক যে তারা মাদ্রাসায় পড়াশোনা না করে মূল স্রোতের স্কুলে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তারা অনেকেই হিন্দিভাষী। বোঝা যায় অন্য সুবিধা গ্রহণে অপারগ হয়েই তারা বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। এই স্কুলগুলিতে আগে থেকেই আমাদের জানিয়ে রাখা হয় যে এরা বাংলা পারে না, কারণ, এরা সবাই অবাঙালি। আশ্চর্যের বিষয়, আমরাও তো অ-ইংরেজ হয়েই A B C D শিখতে পেরেছি। সেখানে একটি নবম শ্রেণির ছাত্রীর অক্ষর পরিচয় না থাকাটা কি তার অবাঙালি হওয়াকে দায়ী করা যায়? অবশ্যই পাশ ফেল তুলে দেওয়া জাতীয় নানা সরকারি সিদ্ধান্ত শিক্ষার অবনমন ঘটিয়েছে। অনতি অতীতের কোভিড একটি ব্যাচকে দুর্বল করে দিয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু তারপরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। পাশ ফেল উঠে যাওয়ায় ঠিকঠাক শেখানোর প্রয়োজনটাও কি উঠে যায়?! তাহলে নৈহাটি বা বহরমপুরের স্কুলে অন্যরকম ছবি কেন দেখলাম! এমন কি শহরতলির স্কুলেও। সে সব স্কুল তো চিরকালীন স্বাভাবিক ছবিই আঁকলো– কিছু অমনোযোগী, কিছু সাধারণ এবং বেশ কিছু ভালো ছাত্রছাত্রী পেয়েছি যাদের নিয়ে অসাধারণ সুন্দর কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষা ছুঁয়ে।
এতক্ষণের আলোচনা ছিল বাংলা মাধ্যম নিয়ে। ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনার মান অতিউচ্চ, কিন্তু বাংলা ভাষা সেখানেও দুয়োরানী। বেশিরভাগ বাংলায় নামটুকুও লিখতে শেখেনি। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবর্গ পরিবারের প্রদীপগুলি এই সব স্কুলেই জ্বলছে। কিন্তু চ্যাটার্জি, ঘোষ বা গুহদের ছেলেমেয়েদের অনেকেই বাংলায় নাম লিখতেই শেখেনি। এটাই আজকের বাস্তব চিত্র।
আরও জানতে, বাংলা বানানবাজি নিয়ে এই দৃশ্য-নিবন্ধটি দেখতে পারেন:
https://www.youtube.com/watch?v=6mAH6P3e0bo&t=7s
একদম সঠিক ছবি এটাই। সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের মাইনে বেড়েছে। স্মার্ট ক্লাসরুম ইত্যাদি জুটেছে কিন্তু শিক্ষকদের আগ্রহের অভাব। সরকারি আর সব কিছুর মতো।
ReplyDelete