Saturday, 20 April 2024

শিল্পীকৃত বই

একাধারে বই ও শিল্পবস্তু

তন্ময় সাঁতরা



দৃশ্যকলা চর্চা ও সৃজনের অঙ্গনে শিল্পীকৃত বইয়ের (artist’s book) একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এই বই মূলত শিল্পী নিজেই বানায়, যা প্রদর্শিত হয় শিল্পবস্তু (art object) হিসেবে। বই বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, তার মতো এও লেখক (এ ক্ষেত্রে শিল্পী) ও পাঠকের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। তবুও এর কিছু বিশেষত্ব আছে যা একে কিছুটা আলাদা করে চেনায়। এর মধ্যে হাতে লেখা অংশ কিংবা ছাপা অক্ষর (text), রেখাচিত্র, রঙিন চিত্রিত অংশ, ছাপাই ছবি, কোলাজ— এরকম বহু কিছু থাকতে পারে। সে-হিসেবে এটি ইউনিক বা অনন্য এবং কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া এর দ্বিতীয় বা একাধিক কপি থাকে না। তাই শিল্পীকৃত বই তথাকথিত বইয়ের সীমা তো অতিক্রম করেই; তাছাড়াও দৃশ্যতা ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে এর প্রসারের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।




যদিও ‘বই’ বলা হচ্ছে, তবুও শিল্পীকৃত বই অনেক ক্ষেত্রেই বইয়ের আকারেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই এর রূপ বা আকার কখনও স্ক্রোল পেইন্টিং-এর মতো, কখনও জাপানি পাখা বা অ্যাকর্ডিয়নের মতো, কখনও বা কিছুটা ভাস্কর্য-সুলভ হয়ে উঠতে পারে। কখনও বা এর পৃষ্ঠাগুলি বাঁধাই না করে একটি বাক্সের মধ্যে রেখে দেওয়া হল দর্শক বা পাঠকের জন্য। এই ধরনের বেশির ভাগ বই হাতে নিয়ে পড়ার জন্য নয়। হয়তো টেবিল বা অন্য কিছুর উপর রাখা থাকল। কখনও বা দর্শক বা পাঠক এই  শিল্পবস্তুটির চারদিকে ঘুরে ঘুরে এর লেখাগুলি পড়েন। এখন এও নিশ্চয় খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে যে শিল্পীকৃত বইয়ের উপকরণ কেবল মাত্র কাগজ হবে না। কাপড়, প্লাস্টিক, ধাতব পাত, কাঠ, প্লাইউড, চামড়া—এমন অনেক কিছুই এই শিল্পবস্তু তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে। 



প্রকাশ-ভঙ্গি, বিষয় ও শৈল্পিক প্রয়োজন অনুযায়ী মাধ্যম নির্বাচন করে নেন শিল্পী। এই প্রকার বই নির্মাণে তাই শিল্পীর থাকে অবাধ স্বাধীনতা। আর তাই প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি পৌঁছেও যেতে পারেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত শৈলী ও নির্মাণের ভাষাতে। কোনও কোনও শিল্পী পুরনো ও পরিত্যক্ত বইকে শিল্পবস্তুতে রূপান্তরিত করতে ভালবাসেন। শিল্পীকৃত বইয়ের এও একটি প্রকার। সেখানে বইটি নব কলেবর লাভ করে এবং পুনরাবিষ্কৃত হওয়ার সুযোগ পায়। কখনও কখনও আলোর ব্যবহার করেও এই প্রকার শিল্পবস্তুর দৃশ্যতায় আরেকটি মাত্রা যোগ করা হয়ে থাকে। ওয়াটারমার্ক বা কাগজের অন্তর্নিহিত স্তরের কিছু অংশ তাতে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।



শিল্পীকৃত বইয়ের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রসিদ্ধ কবি ও শিল্পী উইলিয়াম ব্লেকের কাছে। তাঁর ‘Songs of Innocence and of Experience’ বইটির পাতাগুলি ভরে উঠেছিল তাঁরই লেখা কবিতা, আঁকা ছবি, এনগ্রেভিং ইত্যাদির অনবদ্য সমাহারে। এই সৃজনে তাঁর সাহিত্যকর্ম ও শিল্পকর্ম একীভূত হয়েছিল। তাই বিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে শিল্পীদের মধ্যে এই আর্ট ফর্মটির প্রতি আগ্রহ বর্ধিত হওয়ার ব্যাপারে বিগত শতকের শিল্পী-কবি উইলিয়াম ব্লেকের অগ্রণী ভূমিকা অসীম। এই ধরনের বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও শিল্পী (বা লেখক) পেয়ে যান এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতার স্বাদ— বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনিই প্রকাশক ও পরিবেশক। শিল্পীমহলে এর জনপ্রিয়তার প্রসারের কারণ হিসেবে এও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। 

এ কথা সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই ধরনের সৃজন ও নির্মাণের জন্য একসঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের দক্ষতার প্রয়োজন। তাই কখনও একাধিক ব্যক্তির সহযোগিতায় তা হয়ে উঠতে পারে কোলাবোরেটিভ। তবে এ কথা বলা চলে না যে, শিল্পকলায় শিক্ষা-প্রাপ্ত পেশাদার শিল্পী বা নকশাকাররাই কেবল এই আর্ট ফর্মটির সৃজনের সঙ্গে যুক্ত। সংবেদনশীল মন এবং সৃজনের আগ্রহও কাউকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর পথ। ইউরোপ, আমেরিকা ও সুদূর প্রাচ্যের অনেক দেশেই এর চর্চার প্রসার ও জনপ্রিয়তা দেখা গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এমন কি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠনেও স্থান পেয়েছে শিল্পীকৃত বই। তেমন অনেক দেশের কিছু প্রকাশনা সংস্থারও যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা গেছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ও সচেতনতার অভাবে এ দেশে এর প্রসার, প্রচার ও চর্চা সীমিত থেকে গিয়েছে। তাই এ দেশের হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পীই এই আর্ট ফর্মটিকে তাঁদের অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই মাধ্যমটির বিশেষত্ব এবং সম্ভাবনাই তাঁদের এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 



কখনও সখনও শিল্পীকৃত বইয়ের একাধিক কপি তৈরির কথা ভাবা হয়ে থাকে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে লিমিটেড এডিশন। আর প্রায়শই সেগুলি দেখতে হুবহু এক হয় না। সেই কারণে তথাকথিত বইয়ের তুলনায় এর অর্থমূল্য অনেক বেশি হয়। আর্ট গ্যালারি বা কয়েকজন শিল্পকলার সংগ্রাহক ছাড়া কজনই বা আমাদের দেশে এর কদর করেন বা সংগ্রহ করার জন্য এগিয়ে আসেন?

এই আর্ট ফর্মটি সম্পর্কে বর্তমান প্রবন্ধকারের অল্প-স্বল্প কিছু ধারণা ও সৃজনের বাসনা থাকলেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত হাতেকলমে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। কিছু বছর যাবৎ ডায়েরির পাতাগুলিকে লেখায় আঁকায় ভরিয়ে তোলার প্রয়াস ছাড়া তা বেশি দূর প্রসারিত হতে পারেনি। এ হেন সময়ে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগে জার্মান শিল্পী ক্যাথেরিনা হোলস্টেইন-স্টুর্মের কর্মশালার আয়োজন খুবই উপযোগী ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। কর্মশালার বিষয় ছিল: শিল্পীকৃত বই (Book Art, Artist’s Book)। ২০২৩-এ প্রথমবার। দ্বিতীয়বারের সপ্তাহব্যাপী কর্মশালা হয়ে গেল এ বছরের (২০২৪) মার্চে।




এটি বর্তমানে আমার কর্মস্থল। এই কর্মশালায় অতিথি শিল্পীর সঙ্গে কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানা গেল। এই আর্ট ফর্মটির কিছু পরিমাণ ইতিহাস এবং সমকালে এর চর্চার নানান বৈচিত্রের দিকগুলি সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ হল। শেখা গেল কাগজ ভাঁজ করার কিছু অভিনব পদ্ধতি আর বই বাঁধাইয়ের কয়েকটি প্রাথমিক টেকনিকও। ছাত্রছাত্রীরা উদ্যমের সঙ্গে হাতেকলমে কাজ করল। সৃজনের সেই পরিবেশ আমাকেও হাতেনাতে কাজ করায় উৎসাহিত করল। তৈরি হল প্রচুর বই। নানা রঙের, নানা ঢঙের। শিল্পকলা বিভাগের প্রাঙ্গণে দু’-দিনের প্রদর্শনীর আয়জনও হল। সেখানে দেখা গেল নানান প্রকার শিল্পীকৃত বইয়ের সম্ভার।



বিষয় হিসেবে উঠে এল মানচিত্র, প্রকৃতি, স্থাপত্য, জীবনযাপন, মানবজীবনে প্রযুক্তির প্রভাব এবং মনোজগতের বিচিত্র দিকগুলি। মাধ্যম হিসেবে কাগজের পাশাপাশি কেউ বেছে নিয়েছে কাপড়, কেউ ধাতব পাত, কেউ প্রাকৃতিক উপাদান—যেমন গাছের শুকনো পাতা, ফুল, শাখা-প্রশাখা। কেউ বা ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’ বেছে নিয়েছে। আকার-আকৃতি এবং আঙ্গিকেও দেখা গেল বৈচিত্র্য ও বিস্তারের বিভিন্ন প্রয়াস।  



যে কোনও বইয়ের বিষয়, অন্তর্গত গুণ ও সমৃদ্ধি ছাড়াও একটা আঙ্গিকের দিক থাকে। সামগ্রিক দৃশ্যতা— যেমন প্রচ্ছদ, অক্ষর বিন্যাস, ভেতরের অলংকরণ বা গ্রাফিক্স, অনেক কিছুই তার মধ্যে পড়ে। কোনও কোনও পাঠক বা গুণগ্রাহীর কাছে এই দিকগুলিও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পীকৃত বই এই বিশেষ দিকটির সুপ্রসারণ ও বিস্তার ঘটায়, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শিল্পীকৃত বই একাধারে বই এবং শিল্পবস্তু। এর পঠিত হওয়ার সম্ভাবনাগুলিও বহুধা বিস্তৃত। সে কারণে এ দেশেও এর চর্চা, সৃজনের সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার বিশেষ প্রয়োজন। আরেকটি কথা, ই-লাইব্রেরি, ই-বুক আর অনলাইন ভার্সানের এই যুগে বইয়ের পাতার স্পর্শ ও গন্ধ যখন সুদূর স্মৃতির মতোই ম্রিয়মান, তখন বইয়ের এমন সুমধুর উদ্‌যাপন বড়ই তৃপ্তির, আনন্দের। 

কৃতজ্ঞতা:

১) ক্যাথেরিনা হোলস্টেইন-স্টুর্ম; 

২) অনুপম চক্রবর্তী, ‘বুক আর্ট’, ১৭৭৮ গ্রন্থচর্চা, ভলিউম-১।


6 comments:

  1. কলকাতাতে এই কাজটি করেন শিল্পী সুমন চৌধুরী। তবে মূল বইটি ওঁর কাছেই থাকে উনি বইটির প্রিন্ট করে বিক্রি করেন। তার মূল্য বেশি হয় না। কিন্তু যেটা হয় প্রত্যেকটা বইয়ে উনি আলাদা করে কিছু না কিছু টাচ করে দেন। যেমন একটা চায়ের দোকান সিরিজ আছে ওঁর । কোথাও চায়ের কাপের গায়ে বাড়তি আঁচড় কেটে দিলেন কোথাও একটা ল্যাম্পপোস্টের বাতিকে উজ্জ্বল করে দিলেন কখনো সই করে দিলেন, এরকম। আর বইটি দেখতে হয় পিয়ানো একর্ডিয়ানের বেলোর মতো। ওইভাবে খোলা হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই প্রবন্ধটি পড়ার জন্য, আর উপরোক্ত তথ‍্যটির জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

      Delete
  2. Anek kichu jana holo

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রবন্ধটি পড়ার জন্য এবং মন্তব‍্যটির জন্য ধন্যবাদ জানাই।

      Delete
    2. ইন্দ্র-দা, অনেক ধন্যবাদ।

      Delete