Sunday, 21 April 2024

সোনার হরিণ চাই!

বদলে যাওয়া 'সোনা'র অর্থনীতি

পার্থ হালদার



কিছুদিন যাবৎই নিয়মিত যে খবরটা চোখে পড়ছে বা কানে আসছে তা হল, সোনা বা রূপোর দামের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। যাদের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে বা কোনও অনুষ্ঠান আছে, তাদের প্রায় মাথায় হাত; অন্যদিকে, যাদের বাড়ির সিন্দুকে বা ব্যাঙ্কের লকারে স্বর্ণালঙ্কার মজুত আছে, তারা বেশ উল্লসিত। আবার অনেকেই ভাবছেন, এখন যদি সোনার অলঙ্কারে বিনিয়োগ করি তাহলে কতটা লাভ বা লোকসানের সম্ভাবনা? 

প্রশ্ন হল, হঠাৎ সোনা-রূপোর দামের এই দ্রুত উত্থানের কারণ কী? তা বুঝতে হলে আমাদের কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে সেই করোনার সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্টের ফেডারেল রিজার্ভ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক গুন বেশি ডলার ছাপিয়ে তাদের নিজেদের ও অন্যান্য দেশে জোগান দিতে থাকে, যার পোশাকি নাম Quantitative Easing বা QE। ফলে, করোনার পরবর্তীকালে এক অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয় আমেরিকা সহ গোটা পৃথিবী। এই মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে বাঁচবার জন্য করোনার পরবর্তী বছরগুলিতে আমেরিকার ফেডারাল রিজার্ভ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক (ভারতের ক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক) সুদের হার বৃদ্ধি করতে থাকে; অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে 'Tightening'। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্টের মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে মাথা নামাতে শুরু করে। আমাদের দেশেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে যে পাইকারি মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও মাথা তুলে আছে খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি এবং এই অবস্থায় আমেরিকা সহ সমস্ত দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সুদের হার আর বৃদ্ধি করছে না, বরং আগামী এক বছরে তা কমানোর কথা ঘোষণা করেছে; যার দরুণ বিকল্প রাস্তায় অধিক উপার্জনের জন্য পৃথিবীব্যাপী সোনা এবং রূপোতে বিনিয়োগ শুরু হয়ে যায়, আর তা থেকেই এই দৌড়ের সূত্রপাত।

অনেকেই বলবেন, শেয়ার বাজারও তো রোজই নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে, অতএব, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলেই তো হয়! কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ করলে অনেকেই বুঝতে পারছেন যে, বহু মিডক্যাপ ও স্মলক্যাপ শেয়ার কিন্তু পূর্বের উচ্চতা থেকে বেশ নিচে নেমে গেছে। তাছাড়া, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু ৯০ ডলারের উপর পৌছে যাওয়ায় ভারতের মতো দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমার এই মুহূর্তে কোনও লক্ষণ নেই। তাই, শেয়ার বাজারের ভিত কতটা মজবুত তা বলা মুশকিল; সামান্য একটু উত্থানের পর তা বারবার নিচে নেমে আসছে। এই অবস্থায় তুলনামূলক বিচারে সোনা বা রূপোতে বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত স্বস্তিদায়ক ও লাভজনক বলে বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন।

সোনা বা রূপোতে বিনিয়োগ বলতেই আপামর বাঙালির চোখের সামনে জুয়েলারি দোকানের ছবি ভেসে ওঠে এবং সোনা কেনা মানেই স্বর্ণালঙ্কার, এরকম একটি প্রচলিত ধারণা আছে। কিন্তু এর বাইরেও জগৎ আছে। সেই বিকল্প রাস্তাটি হল: (১) গোল্ড বন্ড ও (২) গোল্ড ইটিএফ। 

গোল্ড বন্ড যা ভারত সরকারের অনুমতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দ্বারা জারি করা হয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং স্টক হোল্ডিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া'র মাধ্যমে তা বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছে যায়। এই বন্ডের দাম সোনার বাজার দরের উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ, বন্ডে বিনিয়োগের সময়ে প্রতি গ্রাম সোনার বাজার দর ও ম্যাচিওরিটির সময় সোনার বাজার দরের যা তফাত তা বিনিয়োগকারী মোট বিনিয়োগকৃত পুঁজির সঙ্গে পেয়ে থাকেন। ম্যাচুওরিটির সময়ে লাভের উপর কোনও কর দিতে হয় না। 

অপর যে ব্যবস্থাটি-- গোল্ড বা সিলভার ইটি ক্রয়-- ভারতবর্ষে বিএসই বা এনএসই এই দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ-এর ব্রোকারদের মাধ্যমে এখানে বিনিয়োগ করা যায়। এর জন্য ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকা জরুরি। এই ব্যবস্থাটি সাধারণ ভাবে কোনও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন, এসবিআই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, নিপ্পন ইন্ডিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। এর প্রতিটি ইউনিট সোনা এবং রূপোর প্রতি গ্রামের দাম ওঠানামার ওপর প্রায় সমানভাবে নির্ভর করে। এর সুবিধা হল, অত্যন্ত অল্প পুঁজি থাকলেও এতে বিনিয়োগ করা সম্ভব (এমনকি ১০০ টাকাও)। দ্বিতীয়ত, সোনা বা রূপো রাখার জন্য আলাদা কোনও সুরক্ষিত স্থানের দরকার পড়ে না এবং যে কোনও সময়ে তা বাজারে বিক্রি করে পুঁজি এবং লাভ ফেরত নেওয়া যায়।

সাধারণ জুয়েলারি দোকান থেকে সোনার গহনা কেনার থেকে এই বিকল্প ব্যবস্থা দুটি বেশ আলাদা। কারণ, জুয়েলারি দোকানে গেলে অতিথি অভ্যর্থনা, কফি অথবা কোল্ড-ড্রিংক্স এসব পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু গহনা বিক্রির সময় মজুরি, জিএসটি এবং অন্যান্য বহু খরচ বাবদ প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা গচ্ছা যায়। অর্থাৎ, গহনা কেনার পর সোনার দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেলেও বিনিয়োগকারীর হাতে প্রায় কিছুই আসে না। অবশ্য, গোল্ড বন্ড ও গোল্ড ইটিএফ'এর ক্ষেত্রে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এবং তার বাৎসরিক ফি হিসাবে কিছু টাকা দিতে হয়। কিন্তু সে অর্থের পরিমাণ খুবই কম। এই ব্যবস্থায় সোনা বা রূপো কেনার সময় তার বিশুদ্ধতা নিয়ে মাথাব্যথারও কোনও কারণ নেই এবং এর লাভের উপর আয়কর সাধারণ ক্যাপিটাল ট্যাক্সের মতোই। তাছাড়া বিনিয়োগকৃত পুঁজির সামান্য অংশও দরকারে বিক্রি করে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। কিন্তু স্বর্ণালঙ্কারের ক্ষেত্রে এরকম কিছু করা যায় না।

বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে, মুদ্রাস্ফীতির ভূত সারা পৃথিবীময় ছুটে বেড়াচ্ছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। তার হাত থেকে নিস্তারের লক্ষ্যে যদি আরও কিছুদিন সুদ কমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ব্যাহত হতে  বাধ্য। তাই সরাসরি শেয়ার বাজারে সামান্য একটু উত্থান হলেই আবার তা কারেকশন'এর সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে, ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনার মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম বেশ উর্ধ্বমুখি, তাই পৃথিবীর যে দেশগুলি তেল আমদানির উপর নির্ভরশীল তাদের অর্থনীতিতে যে বিপুল চাপ পড়বে তা বলাই বাহুল্য। 

সেই কারণেই যারা অধিক অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন বা করবেন বলে ভাবছেন তারা আলাদা কোনও ঝক্কি ছাড়াই সোনা-রূপোর বাজারে বিনিয়োগ করে নিজেদের ঝুঁকি কম করতে পারেন। তাই অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আজ শেয়ার ও সোনা-রূপো বাজারের অর্থনীতিকেও সম্যক ভাবে বুঝতে হবে। দুনিয়া জুড়ে অর্থের চলমানতায় যে দুরন্ত গতি ও বিচিত্র ধারা এসেছে, প্রযুক্তি বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্মিলনে তার যে বিভিন্ন রূপ ও অবয়ব, তাকে বুঝতে ও যুঝতে হলে উদীয়মান নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতিকে রীতিমতো রপ্ত করতে হবে। 

পৃথিবী যে আগের মতো আর নেই, তা বলাই বাহুল্য। চোখকান খোলা রাখা এবং প্রয়োজনে নতুন চিন্তার কাণ্ডারী ও পেশাদার পরামর্শদাতাদের কথা শোনাও জরুরি। 


4 comments:

  1. শেয়ার বাজারে এক নতুন দিশা , নতুন আশা ও অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত বিষদ আলোচনা অত্যন্ত সময় উপযোগী । ধন্যবাদ মাননীয় পার্থ হালদার মহাশয়কে । 🙏

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর সহজ করে একেবারে আমার মত মোটা মাথার মানুষ দের জন্য উপযোগী লেখা। অর্থনীতির লেখা কিন্তু কঠিন বিষয় ভিত্তিক শব্দ ব্রহ্ম নেই। পার্থ বাবু কে ধন্যবাদ, আরো লেখা চাই আমাদের মোটা মাথা এসোসিয়েশনের সদস্য দের জন্য।
    অপেক্ষায় থাকলাম।

    ReplyDelete
  3. SAMAYUPOJOGI POST

    ReplyDelete
  4. Excellent article! Nicely explained.

    ReplyDelete