Saturday, 25 February 2023

বদলে যাওয়ার এই কি সময়?

নিকট ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে...

অমিত ভাদুড়ী



ফ্যাসিবাদের সঙ্গে একনায়কতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলামতো ভ্রান্ত ধারণা প্রায়ই দেখা যায়। দুটো বিষয়কে অনেক ক্ষেত্রেই এক মনে হয়, তবে তারা এক নয়। মার্কসবাদী দর্শনে ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ এক লের প্রভাবে একটা শ্রেণির আধিপত্যের কথা বলে, কিন্তু শেষে অনেক সময়ই তা নিয়ে আসে একজন শক্তিশালী নেতাকে। একনায়করা সাধারণত একজন ব্যক্তি, আর পুরো শাসক দল সেই ব্যক্তিরধীনে থাকে। ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একজন বড় নেতা থাকেসেই নেতাকে পার্টি গড়ে তোলে না, বরং গড়বার কাজটা তিনি নিজেই করেনঅনেক সামরিক একনায়ক ছিলেন যারা দলীয় নেতা নন, কিন্তু সেনাবাহিনীর এক বিরাট অংশের সমর্থন পেয়েছেন বা কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কাজে সিআইএ’র সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছেন 

ফ্যাসিবাদ আর একনায়কতন্ত্র- দু বিষয়েই দেখা যায় একজন ব্যক্তির সর্বাত্মক কর্তৃত্বের মনোভাবফ্যাসিবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলা হয় একজন শত্রু নির্মাণের মাধ্যমেঅন্যদিকে আবার অনেক একনায়ক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলে যে তার উদ্দেশ্য নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিস্থিতি বুঝে আরও নানান যুক্তি দেখায় তারাকিন্তু ফ্যাসিবাদকে আরও কার্যকর করে তোলার জন্য শত্রুপক্ষের ডেকে আনা বিপদের শঙ্কাকে আরও বেশি করে জাগিয়ে তোলা হয়এটা খুবই জরুরি শর্ত

তবে শত্রুকে ‘আমরা’ নয় ‘ওরা’ বলে চিহ্নিত করে দেওয়াটা ফ্যাসিবাদের কাছে কেবলমাত্র এক সাংস্কৃতিক নির্মাণ হতে পারে নাএর আগ্রাসী মনোভাব শুরু হয় এই শত্রুকে বিপজ্জনক বলে তুলে ধরার মাধ্যমেবিপজ্জনক মানে তা এতটাই বিপজ্জনক যে ‘আমাদের’ অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারেগোলওয়ালকর ও সাভারকর উভয়েই হিন্দুদের অস্তিত্বের পক্ষে প্রধান বিপদ হিসেবে মুসলমানদেরই বেশি করে চিহ্নিত করেছেন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের নয়যখন অস্তিত্বের সঙ্কটের ধারণাটাকে উস্কে দিয়ে চিহ্নিত জনসংখ্যার একটা বড় অংশের মন জয় করে নেওয়া যায়, তখনই ফ্যাসিবাদের শিকড় গজায়মানে ফ্যাসিবাদকে শুধুই সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’র মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা যায় নাএটা শুধুই ধর্মীয়, জাতিগত বা অন্যান্য পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভেদের ব্যাপার নয়এই পরিচয় অবশ্যই ‘ওদের’ প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়ায় গর্ব করার বিষয়ও, কারণ ওরা ‘আমাদের’ অস্তিত্বের পক্ষে বিপদ

এখানেই গান্ধীজীর সঙ্গে আরএসএস-বিজেপি যুগলবন্দীর তফাত রয়েছেগান্ধীজী একজন হিন্দু ছিলেন এবং হিন্দু হিসেবে গর্বিত ছিলেনকিন্তু এই গর্ব যাতে মুসলমানদের প্রতি আক্রমণাত্মক না হয়ে ওঠে সে বিষয়ে সতর্ক ছিলেনযদিও এটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে হিন্দুত্ব নিজেই নিচু জাতের প্রতি বিরূপ হতে পারেএ ক্ষেত্রে গান্ধীজীর বাণীকে না হলেও কর্মকে কিন্তু সম্পূর্ণ দোষমুক্ত বলা যায় না

অপর দিকে গোলওয়ালকার আবার জাতপাতের বিভেদ আর ‘মনুস্মৃতি’তে মহিলাদের মর্যাদাহীন অবস্থানকে সমর্থন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেনরাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থান থেকে সরে আসা হিন্দুত্ব- যা কিনা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি- তা অবশ্যই হিন্দুত্বের এই ধারণাএই হিন্দুত্ববাদ সবসময় হিন্দু গৌরবের অস্তিত্বের সংকটের কথা বলে। এই অস্তিত্বের সঙ্কটকে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনপীড়ণ আর হিংসার খুব দরকার; অন্যদিকে হিন্দু গৌরবকে তুষ্ট করতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও প্রয়োজনঅর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য এই ধারণার বিষয় নয়হিন্দুত্ববাদের এই সংজ্ঞায় সহজাত জাতপাত এবং লিঙ্গবৈষম্য আছে বলেই এই হিন্দুত্ববাদ সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে          

যদিও, শত্রুর কাছ থেকে পাওয়া এই অস্তিত্বের সংকটের কারণ অভ্যন্তরীণও হতে পারে আবার বাইরেরও হতে পারেএই দুই কারণ এক হলে ফ্যাসিবাদের ভিত শক্ত হয়ে ওঠেশত্রু বিদেশি হলে চাই পেশিবহুল জাতীয়তাবাদশত্রু যদি ভেতরের হয় তাহলে জোরদার আভ্যন্তরীণ নজরদারি  চালানো (যেমন পেগাসাস বা বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা) এবং সাংবাদিক, অধ্যাপক, গবেষক অথবা সুশীল সমাজের অন্যান্য মানুষদের ভিন্নমতকে দমন করার প্রয়োজন হয়অতঃপর ফ্যাসিজম চলতে থাকে, পেশিবহুল জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত ঘৃণাভরা ভাষণ এবং গানের মাধ্যমে, যা ‘ওদের’  আক্রমণ করবার জন্য ‘আমাদের’ প্রস্তুত করে

আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে দেশের সুরক্ষা’ হচ্ছে সেই খেলার নাম যা আভ্যন্তরীণ এবং বাইরের ফ্রন্টে চালানো হয়এটাই একমাত্র কাঙ্খিত খেলা হয়ে ওঠে যা ফ্যাসিবাদী সরকারকে ‘রাষ্ট্র’, ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘ আতঙ্কবাদ’এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করার অধিকার দেয়এভাবেই সংবিধান এবং সরকারকে ইচ্ছেমতো চালনা করাটাকে এক বহুমুখি দৈত্যাকার বিপদকে ঠেকাতে গিয়ে হয়ে যাওয়া সামান্য আনুষঙ্গিক ক্ষতি হিসেবে দেখানো সমর্থনযোগ্য হয়ে ওঠে     

এটা ভারতবর্ষে কীভাবে কাজ করেছে? গোধরার হিংসার ঘটনার উৎস এখনও রহস্যাবৃতসেই হিংসাকে উপস্থাপিত করা হয়েছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে, ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে ত্রাসের কারণ মুসলমানরাবালাকটের ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ হচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন পেশিবহুল জাতীয়তাবাদের প্রকাশবাইরের এবং ভেতরের বিপদকে মুসলমান আতঙ্কবাদের বিভিন্ন দিক হিসেবে সুবিধেমতো মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার থেকে কিনা সরকার ‘আমাদের’, মানে হিন্দুদের রক্ষা করেএই মতের বিস্তার একটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, আর জনতার কাছে এই মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতার সূচক হিসেবে সরকার এটা সানন্দে মেনে নেয়অনেক উৎসাহীরা বিশ্বাস করেন (জনগণনা তথ্য যাই হোক না কেন) যে ভারতে মুসলমানরা ইচ্ছে করে বেশি মাত্রায় নিজেদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে সংখ্যাগুরু হিন্দু গণতন্ত্রকে নষ্ট করার উদ্দেশ্যেই দেশের জনসংখ্যা সংক্রান্ত ভারসাম্যকে নষ্ট করে চলেছেএসব বিশ্বাসকে উন্মাদের বিশ্বাসের মতো শোনাতে পারে, তবে এর পরিণাম কিন্তু অনেক সময়েই মর্মান্তিক হয়মুসলমানদের গণহত্যা করা বা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হবার ঘটনার জন্য চার্চের বিরুদ্ধে হিংসা, অথবা ‘লাভ জিহাদ’এর মতো ভিন্ন ধর্মের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনার কারণে

ফ্যাসিবাদের দিকে স্বাভাবিক ভাবে ঝুঁকে থাকা উগ্র জাতীয়বাদ বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, কোনওটাই কিন্তু শক্তিশালী আর্থিক মদত ছাড়া টিকে থাকতে পারে নাবড় বড় বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে পেশিবহুল জাতীয়তাবাদের সংযোগ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েজনমত প্রচারের যন্ত্রকে খুব মসৃণভাবে চালানোর জন্য দরকার হয় কিছু মিডিয়ার, যারা বানানো খবর এবং সন্তর্পণে বাছাই করে নেওয়া কিছু খবর ছড়ায়, আর এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুয়ো খবর ইচ্ছাকৃত ভাবে ছড়ানো হয়ে থাকেহিটলারের তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে, লোকেরা বর্গক্ষেত্রকেও বৃত্ত বলে বিশ্বাস করবে, যদি তুমি বারংবার আরও বেশি বেশি করে সেটা বলে যাওসুতরাং, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে মানুষকে মোদির সেই বড় বড় সাফল্যের কথা বিশ্বাস করানো যাবে না, যার মধ্যে  রয়েছে তার কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ (১৫ লাখ দেওয়ার সেই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও), হঠাৎ করে নোটবন্দির সিদ্ধান্তের বিচক্ষণতা (অসংগঠিত ক্ষেত্রে অনেকের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও) আর অতিমারির দিনে হঠাৎ করে লকডাউনের ঘোষণা, সঙ্গে ছিল মোমবাতি জ্বালিয়ে আর বাসনপত্র বাজিয়ে অতিমারিকে দূর করার জন্য প্রাথমিক উপদেশ (তারপর গঙ্গায় অসংখ্য শবদেহের ভেসে ওঠা সত্ত্বেও)

ভারতের উন্নয়নের গল্পটা তেমনই হত, যদি উন্নয়নকে শুধুমাত্র জিডিপি'র সংখ্যায় নয় বরং সাধারণ নাগরিকের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের নিরিখে দেখা হতপ্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে স্বল্পমূল্যে তুলে দেওয়া হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু আস্থাভাজন সংস্থার হাতে (মূলত দুজন)। ফলে, প্রকৃতির ক্ষতি হয়েছে এবং গরিব মানুষ বাড়িঘর ও জীবন-জীবিকা হারিয়েছেন, বেকারের সংখ্যা বেড়েছেকর্মসংস্থান বা জীবিকার বিকল্প উপায়ের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও কোনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য মেলেনি, আর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্যের মতো সামাজিক পরিষেবার ক্ষেত্রে অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি, শুধুমাত্র কোনও মহান নেতার ইচ্ছামতো করা দানখয়রাত ছাড়াএকজন নেতাকে মানুষের একমাত্র পরিত্রাতা বানিয়ে ফেলার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের এই প্রকাশ মানুষকে মনে করিয়ে দেয় হিটলারকে নিয়ে বলা এক গল্প কথাপার্টির এক মিটিং’এ তিনি একটা মুরগি নিলেন এবং একটা একটা করে তার পালক ছিঁড়তে লাগলেনতারপর ওই বেচারা পালকহীন পাখিটিকে মাটিতে রাখলেন আর পকেট থেকে বের করে করে কিছু দানা একটা একটা করে মাটিতে ছড়াতে লাগলেনওই অসহায় মুরগিটা কৃতজ্ঞচিত্তে হিটলারকে অনুসরণ করে হাত থেকে পড়া দানার টুকরোগুলো খেতে থাকলতারপর মুরগিটাকে দেখিয়ে উনি ওঁর ভক্তদের বললেন, ‘এই হল আমাদের জনগণ  

গৌতম আদানি আদপে সত্য কথাই বলেছেন যে হিন্ডেনবার্গের হতাশাজনক রিপোর্ট তাঁকে নয়, বরং ভারতকে আক্রমণ করেছেউনি শুধু এটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন যে এ হল সেই ভারতবর্ষের ধারণা- যা এমন অল্প কয়েকজন কোটিপতিদের দেশ যারা মোদি শাসিত হিন্দুরাষ্ট্রকে সমর্থন করে    

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমর্থিত পেশিবহুল হিন্দুরাষ্ট্র প্রকল্প ‘রিসার্জেন্ট গুজরাট’ প্রোজেক্ট দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০০২’এর দাঙ্গা এবং হাজার হাজার মুসলমানদের হত্যার পরেএটা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ও অনেক শিল্পপতিকেও (যেমন রাহুল বাজাজ মনে করেছিলেন এটা ভারতের বাণিজ্যের পরিবেশের পক্ষে ভাল নয়) নাড়া দিয়েছিলমুসলমান বিদ্বেষের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মোদিসুলভ ‘প্রশাসন’কে অনেকে অবাঞ্ছিত বলে অনুভব করেছিলেনকিন্তু, সেই সময়ে স্বল্প পরিচিত গৌতম আদানি দুঃসময়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন আর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এমন এক বাণিজ্য মডেল তৈরি করলেন, যাতে রাজ্য সরকারের থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো বিদ্বেষে ভরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে নির্বিঘ্নে মিশে যায়প্রচার এবং টাকা দিয়ে খুব সযত্নে লালিত এই ‘উন্নয়নের গুজরাত মডেল’ আদানির হাতে পড়ে মোদির পৃষ্ঠপোষকতায় অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গেল আর বন্দর থেকে শুরু করে বিমানবন্দর কিংবা বিদ্যুতের মতো আরও বহু ক্ষেত্রে প্রসারিত হলআদানি এর সুফলটা পেলেন বিশ্বের তিন নম্বর ধনী ব্যক্তি হিসেবে উঠে এসেএটা কি হিন্দু গৌরবের প্রকাশ না ভারতের জনগণের জীবন থেকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সাফল্য?

ব্যবসার এই বৃদ্ধির ব্যাপারটা কতটা অসাধু হয়ে উঠেছে, তা দেখাবার জন্য পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও রবি নায়ারের মতো কয়েকজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক অনেক প্রবন্ধ প্রকাশ করেনএর প্রভাব খুবই সীমিত ছিলবিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়ারা সেগুলো নস্যাৎ করল, মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিছুটা ভয় পেল আর স্টক মার্কেটে বিশেষভাবে দেখানো বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেখে চুপ করে গেলমোদির নেতৃত্বে সংখ্যাগুরু গেরুয়া গণতন্ত্র নির্বাচনী সাফল্য পেয়ে ভিন্ন স্বরকে আইনি এবং বেআইনি পদ্ধতিতে রাষ্ট্রশক্তির জোরে দমন করে এগোতে থাকলআর এর দোসর হয়ে এই অসাধু ব্যবসা এই তামাশাকে চালু রাখার জন্য অক্সিজেন জুগিয়ে গেল      

এটাই হয়তো আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের দ্বারাও প্রশংসিত সেই নব্য উদারপন্থার গল্প, যেখানে রাষ্ট্র জোরদারভাবে বেসরকারি ব্যবসাকে তুলে ধরে ভারতীয় গণতন্ত্রের মঞ্চে বিপুল বৃদ্ধি নিয়ে আসা এবং মার্কিন কর্তৃত্বের একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিনের বাড়তে থাকা বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্যগুজরাত গণহত্যায় জন্ম নেওয়া এই বেবি গ্রোথ মডেল খুনে দৈত্য হবার জন্যই জন্মেছেবিজেপি একে বিশ্বগুরু বলে থাকেতবুও দেখা গেল, এটা গরম হাওয়া ভরা একটা উড়ন্ত বেলুনএই বেলুন হঠাৎ ফেটে গেল যখন প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা উৎসাহিত আদানির ব্যবসার বাস্তব চিত্রটা জানা গেলসেই বিজনেস মডেলের দিন এখন গত হয়েছে, একে তোল্লাই দেওয়া সেই জাতীয়তাবাদী স্বর অনেক দুর্বল হয়েছে আর ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের বুকে নেমে এসেছে এক ভয়ানক নীরবতাসিবিআই, ইডি, আরবিআই, এলআইসি, সেবির মতো ভারতবর্ষের সব সংস্থা, যারা এই মডেলের সেবা করার জন্য একজোট হয়ে এগিয়ে এসেছিল, তাদের কিন্তু হিজ মাস্টার্স ভয়েসের পরবর্তী আদেশের জন্য খুব অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে

পরপর নির্বাচন আসছেপ্রথমে বিভিন্ন রাজ্যের, তারপর কেন্দ্রের নির্বাচন দেখা যাবে ভারতের গণতন্ত্রের এই মঞ্চেবদল কতটা হবে তা আগামী দিন বলবেযদি আদপেই তা হয় তাহলে কি শুধুমাত্র শাসক দল বদলাবার সাথে সাথে এই দুর্গন্ধময় ঘৃণার পরিবেশ কিছুটা শান্ত হবে, যেটা রাহুল গান্ধী তাঁর যাত্রার সময় বারবার বলেছেন? নাকি এমন কোনও রাজনৈতিক সংগঠন আছে, যাদের লক্ষ্য আরও উন্নত হতে পারে, আর যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা অন্যরকম মডেল নিয়ে আসতে পারে, যে মডেল প্রাথমিক ভাবে শুধু মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে থাকে না?  

বাংলা অনুবাদ: মঞ্জিস রায়

       

 

     

 

 

Monday, 20 February 2023

দেবাশিস ভট্টাচার্য

আমার ভালবাসার মানুষ

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


(১৯৫২ - ২০২৩)

ভাবিনি কখনও আপনার স্মৃতি তর্পণে আমাকেও লিখতে হবে কিছু। খানিক বাধ্য হয়েই লিখছি। বাধ্য করলেন আপনি নিজেই। মনে পড়ছে কত কথা। সবার আগে মনে পড়ছে কৃপাল সিং'এর স্মরণে বিষেণ সিং বেদীর লেখা। তেমন লিখব সে যোগ্যতা নেই। তবু লিখতে হবে। 

বলতে পারি না আচমকা গেলেন; যেমন আচমকা ডিমনিটাইজেশনের ঘোষণা শুনি আমরা দুজনে সেদিন আশিস চট্টোপাধ্যায়ের চ্যানেল থেকে বেরিয়েই। আশিস তারপরও নানা জায়গায় ঘুরে আবারও এসেছে কলকাতা টিভিতে। সেই কলকাতা টিভি। যার উপদেষ্টা ছিলেন আপনি।

মনে পড়ে, আশিস আর আপনি দুজনে আমার সাথে ছিলেন বাংলা একাডেমি আয়োজিত এক গল্পপাঠের আসরে। যেন এই তো সেদিন। সঞ্চালকের ভূমিকায় ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়। আপনার সম্পাদিত কাগজেও তো অনেক লিখেছি। কিন্তু গল্প! না, লিখিনি কখনও। সে সবে যেন আগ্রহই ছিল না আপনার। আপনি এক বিরল সাংবাদিক। এমন নির্ভীক ও সৎ সাংবাদিক আমি আমার জীবনে দেখিনি। সাংবাদিকতা করেছেন আজকাল, আকাশ, প্রতিদিন কাগজে। সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা ও বোধ থেকেই সম্পাদনা করতেন। পত্রিকা চালাতেন নিশ্চয় সেই অভিজ্ঞতা ও বোধেই । সে পত্রিকাকে 'বিনোদন' উপযোগী করার বুঝি কোনও বাসনাই ছিল না। 

বাসনা ছিল না 'দেশ শাসনের'ও। প্রতিদিন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে আনাগোনা ছিল সে সময় কিছু সাংবাদিকের। সে দলে ভেড়েননি এবং লেখেননি কোথাও সুনীলের মতো- 'কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক'। অথচ, কার্যত তাই নাকি ঘটেছিল সেই সময়। শুনেছি, চারজন সাংবাদিক দেশ শাসনের বিষয়ে নিয়মিত মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের কথা শুনতেন কিনা জানি না। শান্তনু বসুও সম্ভবত জানতেন না। আমি বা আমার মতো কেউ কেউ জানি শুধু এই যে, আপনি কদাচ থাকতেন না তাদের দলে। গল্প লেখার মশলা সংগ্রহের লোভেও না। 

চিরদিন কাটিয়েছেন সামান্য আসবাবে। বন্ধু শুভাশিসের সঙ্গে আপনার বাড়িতে ঢুকে বিস্মিত হয়েছি। আপনার সরল জীবনযাপন নিয়ে যা লেখার লিখেছে উত্তান। কেবল এটুকু বলি, আপনি কখনও সরকারের কৃপাপ্রার্থী হননি। হবেন না যে, তাও তো জানা ছিল। প্রয়োজন ছিল না এমন তো নয়। তবু অনেকে নিন্দে করেছেন আপনার, যখন আপনি সাময়িকভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেস সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শদাতা হ'ন।

প্রথমবার আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করি। তিনি জানতেন, আপনার খবর রাখতেন  এবং আপনার চিকিৎসার সব বন্দোবস্ত করেন। আপনি সে সব উদ্যোগ ব্যর্থ করে চলে গেলেন।

মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী একটা দল বানালেন। সে দলে আপনার সঙ্গে কাজ করেছি, সরকারের থেকে কোনও অর্থ বা সুবিধা না নিয়ে। অনেকে সমালোচনা করেছেন। আপনি গুরুত্ব দেননি। নিশ্চয় বলতে দ্বিধা নেই যে, আমরা শান্তিস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছি। অন্তত সাধারণের তাই ধারণা। চেয়েছিলাম, রাজনৈতিক বন্দীদের অন্তত মুক্তি দেওয়া হোক, তাও হয়নি, তখনকার মন্ত্রী ও আমলাদের কৌশলে। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাকে বিশেষ পছন্দ করতেন তা সত্ত্বেও আপনি হতাশ হ'ননি, কিষেণজী হত্যাকাণ্ডের পর একযোগে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি। কেবল তো একজন সাংবাদিক নন, আপনি তারও আগে বন্দীমুক্তি কমিটি, এপিডিআর-এর প্রাক্তন কার্যকর্তা। যত দূর মনে পড়ে, গৌতম ভদ্রের পর এপিডিআর'এর হাল ধরেন আপনি। তখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী আপনাকে পছন্দ করেনি। জরুরি অবস্থাকালে কেন্দ্রের শাসক দলও পছন্দ করেনি আপনার ভূমিকা। আপনি সে অপছন্দকে কোনও গুরুত্বই দেননি। বদলা নেবার কোনও অভিসন্ধিও দেখিনি কখনও। 

রক্ত থেকে তথ্য- নানা প্রয়োজনে মানুষ আপনার দ্বারস্থ হয়েছে বারেবারে। মন্ত্রী, আমলা, আমার মতো সাধারণ মানুষ, আপনি কাউকেই হতাশ করেননি। কানোরিয়া জুট মিলের আন্দোলনরত শ্রমিকরাই বা আপনাকে ভুলবে কেমন করে?

সাংবাদিক দেবাশিস ছিলেন অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী, যে গুণে আমাদের কাছে তো বটেই, সাংবাদিক মহলেও তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আজও বিস্মিত হই এ কথা ভেবে যে, এইসব শুকনো তথ্যরাশি আপনি মনে রাখতেন কেমন করে? ভালবাসা ছাড়া যে হয় না তা। শুভাশিস বলছিলেন, বাজেটের পরই অসুস্থ অবস্থাতেই আপনি বাজেট বিশ্লেষণে লেগে পড়েন। কোথায় পাব আর এমন বিশ্লেষক? মোদী শাসনে এমন বিশ্লেষক আর কে আছেন যিনি দূরের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান, শোনাতে পারেন?

আমার ভালবাসার মানুষ দেবাশিস চলে গেলেন। বয়সে বুঝি অল্প ছোটই ছিলেন, তবু চলে যেতে হল। কেন? কেন পারছি না আপনার স্মরণে বেদীর মতো লিখতে?


Monday, 13 February 2023

আদালত ও শিক্ষাক্ষেত্র

মাইলফলক না মরীচিকা!

সোমনাথ গুহ

 



ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখ কলকাতা হাই কোর্ট এক উল্লেখযোগ্য রায়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে নিয়োগ হওয়া ২৮১৯ জন গ্রুপ-ডি শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করার  নির্দেশ দেয়। এঁদের প্রত্যেকের উত্তরপত্র ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এঁরা নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১১ জন নিয়োগের সুপারিশপত্রও পেয়ে গিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশের ফলে তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ৮০০ জন শিক্ষক যাঁরা অবৈধ ভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের চাকরি বাতিল করার কথাও ঘোষণা করেছে এসএসসি। অভূতপূর্ব ভাবে আদালত এঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এঁরা এতদিন যে বেতন পেয়েছেন তা ফেরত দিতে হবে এবং ভবিষ্যতে আদালতের অনুমতি ছাড়া এঁরা কোনও সরকারি চাকরি পাবেন না।  

এই রায় কি ভবিষ্যতে যুগান্তকারী হিসাবে গণ্য হবে? এই রায় কি শিক্ষক নিয়োগের হিমালয়সম দুর্নীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক? শিক্ষাক্ষেত্রে আর কত নীচে নামবে পশ্চিমবাংলা? 

সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে, এই বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা চার লক্ষ হ্রাস পেয়েছে (চার লক্ষ! ভাবা যায়?)! গতবারের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০.৯৮ লক্ষ, এবারে ৬.৯৮! এর ফলে নবান্ন নাকি নড়েচড়ে বসেছে। স্কুল শিক্ষা দফতর গুঁতো খেয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মনে হয়েছিল সেই করোনা অতিমারিকেই তারা এর জন্য দায়ী করবে। কিন্তু না, তারা নিজেরাই এতদিনে উপলব্ধি করেছে যে ছাত্র/শিক্ষক অনুপাত নাকি লজ্জাজনক ভাবে কম। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী যা হওয়া উচিত ৩০:১, সেটা বাংলার গ্রামাঞ্চলে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭০:১! মাননীয়দের বোধোদয় হয়েছে যে সরকারের বদলি নীতির ফলে গ্রামে নিযুক্ত শিক্ষকরা রাজনৈতিক দাদাদের ধরে, নিন্দুকেরা বলে ঘুস দিয়ে, বাড়ির কাছে স্কুলে চলে যাচ্ছেন। ফলে, গ্রামে শিক্ষকের বিপুল ঘাটতি। বহু স্কুলে অঙ্ক, বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। নিয়মিত ক্লাস হয় না। ছাত্র-ছাত্রীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। 

শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটাই একটা প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি সর্বব্যাপী এবং এতই গভীর যে এর তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটা আজ থেকে শুরু হয়নি, বহু বছর ধরেই চলছে। আগে ছিল লুকোছাপা, এখন ন্যাক্করজনক ভাবে প্রকাশ্য। বাম আমলেও দুর্নীতি হয়েছে। ২০০৬ সালে এনসিটিই (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ টিচার্স এডুকেশন) শিক্ষক প্রশিক্ষণরতদের ট্রেনিং বাতিল করে। ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য যে কলেজগুলিকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছিল তাও এনসিটিই বাতিল করে দেয়। তারা যুক্তি দেয় যে প্রশিক্ষণের ন্যূনতম যোগ্যতামান না মেনেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। তখন প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বে ছিল ডিপিএসসি (ডিস্ট্রিক্ট প্রাইমারি স্কুল কাউন্সিল)। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এগুলো বাম সমর্থকদের ঘাঁটি ছিল। ২০১১'এ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তারা তাদের নিজেদের নিয়োগ পদ্ধতি চালু করল- শুরু হল টেট (টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট)। ২০১২ সালে প্রথম টেট পরীক্ষা থেকেই দুর্নীতি চরমে উঠল। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৫৫ লক্ষ, পাশের হার ০.৩ শতাংশের কাছাকাছি। পুরো পদ্ধতি নিয়ে ছিল বিস্তর অভিযোগ। এনসিটিই'র স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্নপত্রের সাথে টেটের প্রশ্নপত্রের কোনও সঙ্গতি ছিল না। এছাড়াও ছিল আরও নানা অভিযোগ, যেমন ওএমআর (অপ্টিমাল মার্ক রেকগনিশন) শিট ও মেধা তালিকায় হেরফের করা, টাকা নিয়ে নিয়োগ করা এবং অবশ্যই স্বজনপোষণ। এক তৃণমূল বিধায়কের পরিবার ও স্বজন মিলিয়ে মোট ১৩ জন চাকরি পেয়েছিলেন। 

এরই মধ্যে শিক্ষকতার জন্য বিএড বা ডিএলএড পাশ করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হল। এই কোর্সগুলি করার জন্য রাজ্য জুড়ে প্রায় ৬৫০ কলেজ গজিয়ে উঠল। এদের মোট আসন সংখ্যা ৪৫৭০০, যার মধ্যে সরকারি মাত্র ৩৭০০। নজিরবিহীন ভাবে শিক্ষার বেসরকারিকরণ শুরু হল। এসব বেসরকারি কলেজগুলিতে ভর্তি হওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা লাগে কিন্তু তারপরেও চাকরির কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। বহু ছেলেমেয়ে এই কোর্সগুলি করেও চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। এই পরিস্থিতিতে দালালদের হয় পোয়াবারো। নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে অনেকেই এদের খপ্পরে পড়ে। নেতা, মন্ত্রী, আমলা, রাজনৈতিক দাদা, চুনোপুঁটি, দালাল সহ বহু স্তরে দুর্নীতি বিবিধ রূপে অভাবনীয় রূপে ছড়িয়ে পড়ে। 

২০১৫ সালে দ্বিতীয় টেট পরীক্ষা নেওয়ার আয়োজন হয়। বিএড, ডিএলএড পাস করা ছাত্রছাত্রীরা আবেদন করে। কিন্তু এনসিটিই'র নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষকতার চাকরির জন্য এই কোর্সগুলি পাস করা বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও শাসক দল বহু প্রশিক্ষণহীন ছেলেমেয়েকে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার ফর্ম ভরতে দেয়। এর ফলে এক অরাজকতা সৃষ্টি হয়। রাজ্য সরকার এনসিটিই'কে শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম শিথিল করার জন্য অনুরোধ করে। অবশেষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন উভয়কে নিয়েই পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত হয়। শুরুতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ২০১৭ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিস্তর অভিযোগ উঠতে শুরু করে। প্রচুর টাকাপয়সা লেনদেন হয়, অভিযোগ ১০-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়। এছাড়া সংরক্ষিত আসনে অসংরক্ষিত প্রার্থী নিয়োগ, কাউন্সেলিং'এ পক্ষপাতিত্ব ও ভুরিভুরি অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ঠিক কত শিক্ষক যে এই টেট পরীক্ষার পর নিয়োগ হয়েছে তা আজও পরিষ্কার নয়। 

টেট পরীক্ষা ছাড়াও এসএসসি'র বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় লাগামছাড়া দুর্নীতি হয়েছে। ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এসএসসি'তে দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারী যিনি ঐ সময় তৃণমূলে যোগ দেন, তাঁর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী র‍্যাঙ্ক জাম্প করে ওয়েটিং লিস্টের ওপরে উঠে আসেন এবং চাকরিতে নিযুক্ত হন। নানা গড়মিলের এরকম ভুরিভুরি নিদর্শন দেখানো যায়। এগুলো ঘটেছে বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এমনকি নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রে। 

২০১৬ থেকে বঞ্চিত প্রার্থীরা নানা ভাবে এই চরম অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। ২০১৯'এর লোকসভা ভোটের আগে প্রায় ৪৫০ জন পরীক্ষার্থী নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘এসএসসি যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ’ গঠন করেন এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশনে বসেন। অনশন ২৯ দিন চলে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু সুস্থ হয়েই আবার ধর্ণামঞ্চে ফিরে আসেন। সরকার নানা ভাবে আন্দোলন ভাঙ্গার চেষ্টা করে। জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, চোরাগোপ্তা হুমকি দেয়, কিন্তু আন্দোলনকারীরা অনড় থাকেন। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের পরে তাঁদের সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দেওয়ার পরে তাঁরা অনশন তুলে নেন। এরপরে বহু নির্বাচন আসে যায় কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস ফাঁপা প্রতিপন্ন হয়। সমস্যার কোনও সুরাহা হয় না। অবশেষে আদালত ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তারা সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়, সিট (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম) গঠন করে। এদের তদন্ত অনুযায়ী, শিক্ষক নিয়োগের সর্বস্তরে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে। নিয়মবহির্ভূত ভাবে ২১০০০ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। সিবিআই আরও জানায়, যদিও র‍্যাঙ্ক জাম্প করা দিয়ে তাঁদের তদন্ত শুরু হয়েছিল, পরে তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সর্বস্তরে গোলমাল খুঁজে পায়। মেধা তালিকা, ওয়েটিং লিস্ট, ওএমআর শিটে পরিবর্তন, সব কিছুতেই সীমাহীন গণ্ডগোল। 

আজ রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। যেখানেই হাত দেওয়া হচ্ছে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপচে পড়ছে। করোনার অতিমারির কারণে সারা দেশ জুড়ে শিক্ষার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বহু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল খোলা নিয়ে বেশ কিছু দিন টালবাহানা চলে যার ফলে সমস্যা আরও প্রকট হয়। বহু স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২ সালে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুল ছিল ৭৪৭১৭, ২০২২'এ যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭৬৯৯'এ। ভুয়ো শিক্ষক নিয়োগের ফলে শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। অ্যানুয়্যাল স্টেটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪০ শতাংশ ক্লাস থ্রি'র ছাত্র ক্লাস টু'এর বই পড়তে পারত, সেটা ২০২১'এ ২৯.৩ শতাংশে নেমে গেছে। এছাড়া দেখা গেছে, এই রাজ্যে ৭৩.৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট টিউশন নিয়ে থাকে, যা দেশে সর্বোচ্চ। এর থেকে বোঝা যায় বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান কতটা নিম্নমানের। 

এরই মধ্যে ২০২২'এর টেটের ফল বেরিয়ে গেছে কিন্তু সেখানেও নিয়োগ নিয়ে সংশয়। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, কোনও দালাল বা দুষ্টচক্রের ফাঁদে যদি কেউ পা দেন তাহলে তিনিও সমান ভাবে অপরাধী। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন অবধি যত দুষ্টচক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে তারা সবাই শাসক দলের সঙ্গে জড়িত। সফল প্রার্থীদের জ্ঞান বিতরণ না করে তিনি নিজের দলকে শোধরালে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হয়। আদালতের রায়ের ফলে শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষকদের শূন্যপদ সৃষ্টি হয়েছে। আদালত অবিলম্বে কাউন্সেলিং করে এই সব পদ যোগ্য প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, যাঁদের আন্দোলন ৭০০ দিন পূরণ করল, যাঁরা যোগ্য প্রার্থী, তাঁরা কি অবশেষে চাকরি পাবেন? অন্যত্র উচ্চ প্রাথমিক ও শিক্ষাকর্মী যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন তাঁরাও কি চাকরি পাবেন? আদালতের এই রায় কি সত্যিই একটা মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হবে, নাকি এটাও হবে একটা মরীচিকা? 

সর্বশেষ খবর, যে ১৯১১ জনের নিয়োগপত্র আদালত বাতিল করেছে, তাঁরা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের কাছে আপিল জানিয়েছেন। এরপর কি তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন? এইভাবেই কি বয়ে যাবে সময়? যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তাতেই আজীবন থেকে যাবেন?


Saturday, 11 February 2023

ওদের ০.০১ শতাংশ আপনার ১০০

শাক দিয়ে মাছ ঢাকা

মালবিকা মিত্র


যে বছর জেলে এলাম

একটা পেন্সিল ছিল

লিখে লিখে খুইয়ে ফেলতে এক সপ্তাহ লাগেনি। 

পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে

'একটা গোটা জীবন।'

আমি বলব:

'এমন আর কী, একটা সপ্তাহ।'

- কিছুই নয়, অণুমাত্র কাল (নাজিম হিকমত)।


আসল কথা হল, কে কোন অবস্থান থেকে দেখছি। ডাক্তারবাবু প্রবল গর্বে ও দর্পে বলতেই পারেন, 'আপনি সামান্য একটা বাচ্চার মৃত্যুর কারণে আমাকে দুষছেন! জানেন, কত হাজার হাজার শিশু আমার কাছে জীবন ফিরে পেয়েছে!' ডাক্তার শতাংশ হিসাবে ব্যস্ত। সন্তানহারা মায়ের কাছে তো একটায় একটা, একশো শতাংশ। 

প্রেমাংশু চৌধুরী কেন্দ্রীয় অর্থ সচিব টি ভি সোমনাথনের সাক্ষাৎকার নিলেন (আবাপ/ ৪ ফেব্রু ২০২৩)। বিষয়: শেয়ার বাজারে আদানি গ্রুপের উল্লেখযোগ্য পতন। এর ফলে ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানির লোকসানের সম্ভাবনা আছে কিনা। অর্থ সচিবের উত্তর, 'যে বেসরকারি সংস্থাটি এই সপ্তাহে খবরে রয়েছে, সেই সংস্থায় এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের এক শতাংশেরও কম অর্থ আটকে রয়েছে। ফলে, সঞ্চয়কারীদের অর্থের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার দরকার নেই। সামগ্রিক অর্থনীতির দিক থেকেও চিন্তার কারণ নেই।'

অর্থ সচিবের কথায় এটা স্বীকৃত যে, 

১) এলআইসি ও স্টেট ব্যাঙ্কের অর্থ আদানি গোষ্ঠীর হাতে আটকে গেছে; 

২) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানিতে আমরা মধ্যবিত্তরা অর্থ আমানত করি বেশি লাভের উদ্দেশ্যে নয়, বরং কম লাভ ও অধিক নিরাপত্তার আশায়। আমরা রেসের মাঠে, বেটিং চক্রে বা স্পেকুলেশন নির্ভর শেয়ার বাজারে দৌড়ই না। সরকারি নীতির ফলে আমার আমানত শেয়ার বাজারে লগ্নি হয়েছে; 

৩) আমার ভয় সত্য হয়েছে। শেয়ার বাজারের ওঠা নামায় আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরোক্ষে আমাকে নামানো হয়েছে;

৪) আদানি গ্রুপের শেয়ার কিনব নাকি ইনফোসিসের, সে ক্ষেত্রে আমার মতামত নেওয়া হয়নি;

৫) আদানির বাড়বাড়ন্ত দেখে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা লগ্নি করল, তারপর অকস্মাৎ পতন। মিথ্যা বেলুনে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কে বা কারা দেখাল? স্ট্যানলি মর্গান, লেম্যান ব্রাদার্স, মেরিল লিঞ্চ এরাও তো এভাবেই মিথ্যার ফানুস ফুলিয়ে রাতারাতি ফানুস ফুটো করেছিল দুই দশক আগে। এসবই পরোক্ষ ভাবে মেনে নিয়েছেন অর্থ সচিব। 

এবার উঠে এল অন্য প্রশ্ন। শতাংশের পরিসংখ্যান:

১) সম্রাট আকবরের সময় মুঘল মনসবদারদের মধ্যে রাজপুতের অংশ ছিল ২২ শতাংশ, ঔরঙ্গজেবের সময় এটা কমে দাঁড়িয়েছিল ১৬ শতাংশে, অতএব, ঔরঙ্গজেবের রাজপুত বিদ্বেষ প্রমাণিত। 

২) আকবর সাম্রাজ্যের সূচনা পর্বে মনসবদারের সংখ্যা কম, ৩৫০০-এর কমবেশি। তুলনায় ঔরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের চরম বিকাশ পর্বে মনসবদারের সংখ্যা ৮০০০ কমবেশি। অতএব, মনসবদারের সংখ্যা দ্বিগুনের বেশি। ফলে, রাজপুতের শতাংশ কমেছে, কিন্তু মোট সংখ্যা বেড়েছে। 

৩) আকবরের সময় সাম্রাজ্য প্রধানত উত্তর ভারতে বিস্তার লাভ করেছে। রাজপুতেরা মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের জাতি। রাজপুতদের সংখ্যা ও শতাংশ তাই বেশি। ঔরঙ্গজেবের সময় সাম্রাজ্য দক্ষিণে ও প্রান্তদেশে প্রসারিত। স্বভাবতই অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ফলে রাজপুতরা শতাংশের হিসেবে কমেছে, কিন্তু মোট সংখ্যায় বেড়েছে। শতাংশ অনেক  কিছুই প্রমাণ করে না। 

৩০ জানুয়ারি ২০২৩ এলআইসি'র পক্ষ থেকে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়- LIC's exposure in Adani Group, as on the day, is 0.975% of LIC's total AUM। অর্থাৎ, এক শতাংশেরও কম। অতএব গ্রাহকগণ, মাভৈঃ। এবার দেখা যাক এই এক শতাংশেরও কম বলতে অর্থের পরিমাণ কত? The total amount invested under Adani Group, amounts to Rs. 36,474.78 crores, as on the day। আমাদের ১৪০ কোটির দেশে ভারত সরকারের এই বছরের বাজেটে নারী ও শিশু কল্যাণ খাতে বরাদ্দ আছে ২৫,৪৪৮.৭৫ কোটি টাকা। 

এবার একটি রাজ্যের দিকে তাকানো যাক। মিজোরাম সরকারের বার্ষিক বাজেটের মোট পরিমাণ ১৪,০০৮.১৫ কোটি টাকা। বিজেপি শাসিত ডবল ইঞ্জিন সরকার ত্রিপুরা সরকারের বার্ষিক বাজেট আরও সামান্য- 5285 Cr in Budget Estimates of 2022-23 from Rs. 2651 Cr in BE of 2021-22. It is through this Capital Expenditure, Tripura Economy will grow at a very high rate। বিজেপি শাসনে ত্রিপুরার দ্রুত গতিতে বিকাশের ঘটা করে প্রচার। তাই বলছি, আদানি গ্রুপে এলআইসি'র ১ শতাংশ বিনিয়োগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের মোট বাজেটের সমান। 

আচ্ছা, যে রিক্সাচালক রিক্সার জন্য ১৫ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে অনিচ্ছুক ডিফল্টার হয়, সেই সংখ্যাটা শতাংশের হিসেবে কত? দশমিকের পর কটা শূন্য বসাতে হবে? অথচ তাই নিয়ে ব্যাঙ্ক, এলআইসি'র কত মাথাব্যথা। হাঁড়ি চাটা হাড় হাভাতের দলই ব্যাঙ্কের বোঝা। তাদের ঋণ উশুল করার জন্য আছে মাস মাইনে দেওয়া মাসলম্যান। পোশাকি নাম বাউন্সার। কত আয়োজন ঋণ আদায়ের। এই ঋণের পরিমাণ কত শতাংশ একটু জানাবেন সচিব মশায়?

মাননীয় অর্থ সচিব তো শতাংশের হিসেব দিয়ে আশ্বস্ত করলেন। ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের ক্ষেত্রেও একই মেজাজে বলতেই পারেন, বিজয় মালিয়ার অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ব্যাঙ্ক অ্যাসেটের ০.২ শতাংশের কম। আচ্ছা, নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, শতাধিক ডিফল্টার ঋণ গ্রহীতার অনাদায়ী পরিমাণ যোগ করলে চিত্রটি কী দাঁড়াবে? রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজন তো প্রধান একশোটি অনাদায়ী ঋণের নাম প্রকাশ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি দেওয়া হয়নি ভাগ্যিস, তালিকা প্রকাশ পেলেই বোঝা যেত বিন্দু বিন্দু'র সাথে সিন্ধুর সম্পর্ক। দেশের রাজকোষ কড়ে গোনা কিছু ভাগ্যবানের নিয়ন্ত্রণে। 

তো তাতে কী? দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এরাই। এই অনাদায় নাকি অর্থনীতির মধ্যে ধরাই থাকে। এরা কত ঝুঁকি বহন করে শিল্প বাণিজ্য চালায়। তাই কৃতজ্ঞতা হিসেবে এদের অনাদায়ী ঋণ ঠিক মকুব নয়, রাইট অফ, অভিধানে যার অর্থ- cancel the record of a bad debt; acknowledge the loss of or failure to recover an asset। সোজা বাংলায় তামাদি। খাতা বন্ধ। মানে, বিজয় মালিয়া নীরব মোদি আবার ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানির ঋণ চাইলে তাদের আগের খাতা দেখা হবে না। ওটা বন্ধ। এ না হলে বিনিয়োগ হবে কেন। আর বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়ন হবে না। অতএব, এরা আবার একটা নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঋণ পাবে।  

এরা ঠিক কতটা ঝুঁকি নেয়? সরকার শিল্পের জন্য জমি দেবে, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা, কর ছাড়, বিনিয়োগকারীর শর্ত পালন। পুঁজি আসবে ব্যাঙ্ক ঋণ থেকে। মুনাফা ঘরে ঢুকবে, পিএম কেয়ার্স ফান্ড, সিএসআর স্কীমে পুজো দিলেই হল। পাঁঠা মানত করা আরকি- সমস্ত ধরটা আমার, কেবল মাথাটা দেবতার ভাগে। আর শেষাবধি তো অনাদায়ী ঋণের রাইট অফ আছেই। তাহলে কোথায় ঝুঁকি? 

আরও মজার কথা হল, সরকার যখন কোনও ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, দু/পাঁচ বছর পর ওই সংস্থা জলের দরে বিক্রি হয় অলাভজনক অজুহাতে। জাহাজ বন্দর, বিমান বন্দর, খনি, রেল, ভেল, বিএসএনএল সব বিক্রি হয়। পাবলিক মানি কর্পোরেট তস্করের হাতে তুলে দেওয়ার কত না আয়োজন। কোথায় ঝুঁকি বলুন দেখি? এ কার বিকাশ, কার উন্নয়ন? জনগণের অর্থে উন্নয়ন, লাভের গুড় আমার, লোকসান হলে তোমার (জনগণের)। আর তস্কররা, তাদের স্যাঙাৎরা যখন কথার জাগলিং করে বলে, তাহলে কি উন্নয়ন হবে না? আমরা জনগণ তোতলামি করি, নাআআ, তা হবে না কেন? বুক টান করে বলতে পারি না, হ্যাঁ এই পাবলিক মানির শ্রাদ্ধ চাই না, এই উন্নয়ন চাই না। অপার সাগর মহাসাগরের ০.১ শতাংশেরও বিষক্রিয়া চাই না, ফুকুশিমা চাই না। চার ধাম সংযোজন, রাস্তার সম্প্রসারণ, পাহাড়ে টানেল খনন চাই না। এই উন্নয়ন আমি চাই না। আমার নিরাপত্তার অর্থ শেয়ার ফাটকা বাজারে বিনিয়োগ আমি চাই না। আমার অর্থে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জলের দরে বিলগ্নিকরণ চাই না। আমি সকলের সাথে সম অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই। এ কথা বলতেই পারি না, কারণ মন থেকেই এ কথা বিশ্বাস করি না। জীবন যাপনের তরিকাই এখন ঢের পাল্টে গেছে। আমি বরং প্রলুব্ধ হই, মন্দ কি, আমার হয়ে যদি ব্যাঙ্ক এলআইসি শেয়ার বাজারে টাকাটা বাড়াতে পারে, আমারই লাভ। এই সভ্যতা যা আছে তাই নিয়ে তৃপ্ত থাকে না। অতএব, এই সভ্যতার মর্মে কীটের বাসা, আর কপালে শনির দশা। 

সেই কারণেই কখনও প্রশ্ন করতে পারব না, রিয়াল ইকনমিতে সত্যিই কি আদানির বাড়বাড়ন্ত ছিল? নাকি একটি কুচক্র আদানির বেলুন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সেখানে সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার লগ্নি বাড়িয়েছে! তারপর অকস্মাৎ বেলুন ফুটো। কুচক্র যে যার ভাগ-বাঁটোয়ারা করে সাগর পার। এই সন্ধান করবই না। বরং আরও কোনও সহজ পথে আমার ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নেওয়া যায় কিনা, সেই সন্ধান করব। প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিতে শুধু শিল্পপতি প্রতিযোগিতা করে না, এটা শুধু অর্থনৈতিক ক্যাটাগরি নয়, একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রবণতা। প্রত্যেকে ছুটছে প্রত্যেকের আগে, প্রতিবেশীকে পিছনে ফেলে। একটা কথা শুধু মনে রাখবেন, ডাক্তারের কাছে আপনার প্রাণ ০.০১ শতাংশ হতেই পারে, আপনার কাছে আপনার প্রাণ একটাই (১০০ শতাংশ)। আপনি সব হারাবেন।


Wednesday, 8 February 2023

বিশ্ব জুড়ে কর্মী ছাঁটাই

চাকরির ভবিষ্যৎ কি সঙ্গীন?

শোভনলাল চক্রবর্তী


 

বিশ্ব জুড়ে চলা আর্থিক মন্দার কারণে একের পর এক সংস্থা তাঁদের কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ঠিক কী কারণে এই ছাঁটাই? আর্থিক মন্দার যে ধুয়ো তোলা হয়েছে তা কি ঠিক? আমরা যদি সংস্থাগুলোর বিগত দিনের কর্মপদ্ধতির  দিকে নজর ফেরাই তবে দেখব যে আর্থিক মন্দার থেকেও অন্যান্য কারণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

যেমন, নেটওয়ার্কিং সংস্থা 'সিসকো' তাঁদের কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রায় ৪,০০০ কর্মী ছাঁটাই করতে চলেছে এই সংস্থা, যা মোট কর্মীর প্রায় ৪ শতাংশ। সারা বিশ্ব জুড়ে এদের অফিসগুলিতে ৮৩,০০০ কর্মী রয়েছে। যদিও এই কর্মী ছাঁটাই নিয়ে বিশদে কিছুই জানাতে রাজি হননি সিসকোর চেয়ারম্যান ও সিইও চাক রবিনস। তবে এই ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়াকে একটি রি-ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন সংস্থার চিফ ফাইন্যানশিয়াল অফিসার স্কট হেরেন। আর্থিক মন্দা আসতে চলেছে, তাই খরচ কমানোর জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেই জানিয়েছেন তিনি। তাঁর অভিমত, অন্য খাতে অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে, যে সব ক্ষেত্রে এই সংস্থা বিনিয়োগ করবে, সেই সব ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে বলেই দাবি করেছে এই সংস্থা। যে সব কর্মীদের নতুন ক্ষেত্রগুলিতে কাজ করার দক্ষতা রয়েছে, তাঁদের সেই সব ক্ষেত্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানির মাথায় বসে যাঁরা কর্মপদ্ধতি নির্ণয় করেন, তাঁদের ব্যবসার ধারা বদল করার চেষ্টার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কর্মী ছাঁটাইয়ের আসল কারণ। নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এত দ্রুত তার বাঁক বদল করছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না তথাকথিত ম্যানেজমেন্ট গুরুরা। সেই কারণে অর্থনৈতিক মন্দার ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাঁরা পার পেতে চাইছেন। কিন্তু সমস্যা আরও গভীরে। নয়া শিল্প বিপ্লবের প্রকৃতিকে না ধরতে পারলে এই সমস্যা চলবে এবং কর্মী ছাঁটাই করে এই সমস্যা মিটবে না। 

ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মেটা, টুইটার, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন সহ বেশ কিছু টেক সংস্থা। বিগত কয়েক মাস ধরেই কমেছে এই সংস্থাগুলির আয়। কেন কমল আয়? কারণ, এই টেক কোম্পানিগুলো ধরেই নিয়েছিল যে করোনার কালবেলা পৃথিবীর বুকে স্থায়ী হবে। হয়তো হতও, যদি না ফার্মা লবি ও বৃহৎ পুঁজির এই কারবারিদের বিরুদ্ধে মানুষ না জাগ্রত হত।এদের লকডাউনের খেলা ধরে ফেলে মানুষ। বাইরে বেরিয়ে আসেন তাঁরা, ফলে, মাঠে মারা যায় বৃহৎ পুঁজির প্রকল্প। কিন্তু ততদিনে তারা ব্যবসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে ফেলেছে করোনা বাজারের ফুলে-ফেঁপে ওঠা লাভের ভিত্তিতে। আজ সেই বাজারে ঘাটতি পড়তেই তারা বলছে বাজারে টিকে থাকতে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

শুধুমাত্র তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিই নয়, শিক্ষা সম্পর্কিত বেশ কিছু অনলাইন সংস্থাও তাঁদের কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে একেবারে প্রথমেই রয়েছে বাইজুস-এর নাম। একদিনের নোটিশে কয়েকশো কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে। এছাড়াও, ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের বাউন্সার দিয়ে অফিসের বাইরে বার করে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। 

মূলত মাঝারি ও সিনিয়র লেভেলের কর্মীদেরই ছাঁটাই করা হচ্ছে। যখন প্রোডাক্টের রিভ্যাম্প প্রয়োজন পড়ে তখনই এই কর্মীদের কাজ। কিন্তু এই প্রোডাক্ট রিভ্যাম্পের কাজ শেষ। তাই এই সব কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এছাড়াও, বেশ কিছুদিন আগে একটি বৈঠকে বেশ কিছু বিভাগ, যেগুলির কাজে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, সেখান থেকেও কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। ফুড ডেলিভারি সংস্থা জোমাটোও কর্মী ছাঁটাই করেছে। ক্লাউড কিচেনের কাজের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট ম্যানেজারদের ছাঁটাই করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সংস্থার টপ ম্যানেজমেন্টের বেশ কিছু আধিকারিক সংস্থা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফলেও সংস্থায় টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে শুধুমাত্র নামীদামী নয়, বেশ কিছু স্টার্ট-আপ থেকেও কর্মীদের ছাঁটাই করার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। 

আর্থিক মন্দার কারণে হওয়া ক্ষতি সামাল দিয়ে বাজারে টিকে থাকতে বহু সংস্থাই এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে টুইটার। জনপ্রিয় এই মাইক্রো ব্লগিং ওয়েবসাইটের তরফে জানানো হয়েছিল, কোম্পানিকে বাঁচাতে এটাই একমাত্র উপায়। টুইটার প্রধান এলন মাস্ক জানিয়েছিলেন, প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তারা। এই পরিস্থিতিতে টুইটারকে বাঁচাতেই কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য, ক্ষতির মূল কারণের  বিশ্লেষণে না গিয়ে কর্মী ছাঁটাই কোনও স্থায়ী সমাধান নয়।

আমাদের জন্য যা খুব চিন্তার- কর্মী ছাঁটাই নিয়ে আমাদের মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে কোনও আলোচনা চোখে পড়ছে না, তাঁরা শুধু খবরটুকু করেই দায় সারছে। ছাঁটাই যা হয়েছে তা মূলত আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়। ছাঁটাইয়ের ঢেউ সেভাবে ভারতে এখনও আছড়ে পড়েনি। আজ হচ্ছে না বলে যে কাল হবে না, তার কোনও গ্যারান্টি তো নেইই বরং উল্টোটা ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর। কারণ, আজকের বিশ্বের অর্থনীতির শিকড়ে কে কার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়ে আছে তা বোঝা দুঃসাধ্য। তাই আজ যারা চায়ের দোকানে বসে সুন্দর পিচাইয়ের মাইনে কমে যাওয়া নিয়ে টিপ্পনি কাটছে, তারা বুঝতেও পারছে না, যে কোনও সময়ে ছাঁটাইয়ের কোপ এসে পড়বে তাদেরই বাড়ির ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে। গতকালই ডেল'এর ব্যাঙ্গালোর অফিসের বহু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। যদিও ডেল মোট যে সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে তার তুলনায় ব্যাঙ্গালোরে ছাঁটাই হওয়া কর্মীর সংখ্যাটা কম, কিন্তু তবু বিপদ যে আসছে তা বোঝা যাচ্ছে। এর আগে টুইটার যখন ভারতীয় কর্মীদের ছাঁটাই করেছিল, তখন টাটা মোটরস'এর তরফে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করার কথা আমরা জেনেছিলাম। কিন্তু এই পথে তো সমাধান আসবে না। 

সমাধানের জন্য আগে আজকের নয়া প্রযুক্তির বৈশ্বিক রূপটা ভালো করে বুঝতে হবে। সেটা কেবলই চাহিদা আর জোগানের খেলা। শুধু তাই নয়, অতি দ্রুত এই চাহিদা বস্তুটির রকমফের হচ্ছে। আজ যে বস্তুটা নতুন, ছয় মাস যেতে না যেতেই তা হয়ে যাচ্ছে পুরনো। তার ফল কর্মক্ষেত্রে হচ্ছে দু'রকম। একদল যেমন বাতিল হয়ে যাচ্ছেন, তেমনই একদম নতুন ধরনের কাজ করতে পারেন এরকম কর্মীদের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে, এখন কর্মক্ষেত্রে এমন কর্মী দরকার যাঁরা জ্যাক অফ অল ট্রেডস মাস্টার অফ ওয়ান। একটি কাজ ভালো করে জানার সঙ্গে সঙ্গে আরও চারটি কাজ জানা দরকার হয়ে পড়ছে। এই শ্রেণির কর্মী তৈরির কথা প্রথম লিখেছিলেন আলভিন টফলার তাঁর জগৎ বিখ্যাত গ্রন্থ 'ফিউচার শক'-এ। এই ধরনের কর্মী তৈরি করতে গেলে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে সিলেবাসের আমূল পরিবর্তন করে নতুন পাঠ্যক্রম চালু করার প্রয়োজন। আমরা সে সবের ধারে কাছে নেই। আমরা তো কোন ছাড়, আমেরিকাও নেই, ইউরোপও নেই। যে দুটি দেশ মোটের উপর প্রস্তুত আছে, যাদের উপর এই কর্মী ছাঁটাইয়ের অভিঘাত তেমন ভাবে পড়বে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বলাই বাহুল্য সেই  দুটি দেশ যথাক্রমে চিন এবং জাপান। এদের পাশে দাঁড়িয়ে হয়তো এই কর্মী সংকোচনের সুনামির হাত থেকে পার পেয়ে গেলেও যেতে পারে ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। নচেৎ, আরও খারাপ দিনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।


Wednesday, 1 February 2023

জালিয়াত চূড়ামণি?

ভারতীয় অর্থনীতি কি বিপর্যয়ের মুখে? 

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

দু’ কথা লিখতে বসতেই হল! আজ এক শূন্যগর্ভ বাজেট পেশ হয়েছে আর গতকাল আদানি সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে আদানি এন্টারপ্রাইজের ফলো-অন পাবলিক অফারের (এফপিও) ২০,০০০ কোটি টাকা আদানির ঘরে তুলে দেওয়া গেছে। তার আগের দিন যেখানে মাত্র ৩ শতাংশ এফপিও সাবস্ক্রাইবড হয়েছিল, তা কোন যাদুবলে জানি গতকাল শেষ দিনে বাকী ৯৭ শতাংশ বিক্রি হয়ে কোটা পূরণ করে ফেলল। যদিও খুচরো বিনিয়োগকারীদের বৃহদাংশ এই অফার থেকে দূরে ছিল, কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী বন্ধুর বদান্যতায় আদানির মুখরক্ষা পেল। মূলত, আবু ধাবি’র ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানির তাহনুন-বিন-জায়েদ-অল-নাহহিন এবং এ দেশের সজ্জন জিন্দাল, সুনীল মিত্তল, মুকেশ আম্বানি’দের (যাদের শেয়ার বাজারে আল্ট্রা হাই নেট-ওয়ার্থ ইনডিভিজ্যুয়ালস (UHNI) বলা হয়) পারিবারিক ব্যবসা থেকে অর্থের সংস্থান করে তবে এ যাত্রায় আপাতত স্বস্তি পেলেন গৌতম আদানি। এই মিলন-উদ্ধারের পেছনে যে এক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বিপদ কি দূর হল?

সবচেয়ে বড় বিপদ ভারতীয় অর্থনীতির। দেশের দুই বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এলআইসি ও স্টেট ব্যাঙ্কের বিপুল শেয়ার আদানির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা আছে এবং স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে আদানির ঋণের পরিমাণও কম নয়। প্রবল আশঙ্কা এই যে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’এর রিপোর্ট আসার পর ডুবতে থাকা আদানির সাম্রাজ্য যদি এইবার ভেঙ্গে পড়ে তাহলে এই দুই রাষ্ট্রীয় সংস্থা সহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রায় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাই সকলের নজর ছিল আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও’র গতিবিধির উপর। যেভাবেই হোক, এফপিও’কে উতরে দেওয়া গেছে। তাই, কেউ কেউ ভেবেছিলেন, বাজেটের হৈ-হট্টগোলে আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ এবার ধামাচাপা পড়ে যাবে আর শেয়ার বাজারেও চাঙ্গা ভাব ফিরে আসবে। কিন্তু তা একেবারেই হয়নি। বিতর্কিত আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার আজ সারাদিন (১ ফেব্রুয়ারি) হুড়হুড় করে নামতে থেকেছে (২৬ শতাংশ পতন) যা নিচের চিত্র থেকে আরও পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে:

 

শুধু আদানি এন্টারপ্রাইজ নয়, আদানি গোষ্ঠীর অন্যান্য শেয়ারের মূল্যও আজ বিপুলভাবে পড়েছে এবং নিফটি রেড অ্যালার্ট দিয়ে বাজার বন্ধ করেছে। উল্লেখ্য, আজ আদানি পাওয়ার ও আদানি উইলমার উভয়েরই শেয়ারের দামে ৫ শতাংশ পতন হয়েছে এবং আদানি টোটাল গ্যাস, আদানি ট্রান্সমিশন ও আদানি গ্রিন এনার্জি’র পতন যথাক্রমে ১০, ৩ ও ৫.৭ শতাংশ। ইতিমধ্যে আবার আজই আন্তর্জাতিক ‘ক্রেডিট স্যুইস’ ব্যাঙ্ক ঋণদানের ক্ষেত্রে আদানির বন্ডকে বাতিল করেছে। অর্থাৎ, এই ব্যাঙ্ক কাউকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আদানির বন্ডগুলিকে মর্টগেজ হিসেবে আর গ্রহণ করবে না। অস্যার্থ, আদানির বন্ডের মূল্য দাঁড়াল শূন্য। নিঃসন্দেহে এই ঘটনা বিশ্বের আর্থিক বাজারে আদানিকে একঘরে করে দেবে। বলা যেতেই পারে, আদানির বাণিজ্য সাম্রাজ্যের পতন পর্ব শুরু হয়েছে। আজ দিনের শেষে আদানি কোম্পানির গত কয়েকদিন মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৬ বিলিয়ন ডলারে। ফোর্বস’এর ধনী তালিকায় আদানি আজ নেমে এসেছে ১৫ নং স্থানে, যেখানে অম্বানির স্থান এখন নবম। ফলাফলে, ভারতের মার্কেট ক্যাপ (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন) নেমে গেছে ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলারে। ফ্রান্সের থেকে পিছিয়ে পড়ে ভারত এখন মার্কেট ক্যাপের বিচারে ষষ্ঠ স্থানে নেমে এসেছে; দুদিন আগেও প্রথম পাঁচে রয়েছে বলে মোদি সরকার বুক ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়েছিল।

মাত্র সাতজনের একটি ছোট্ট কোম্পানি ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ কী এমন বোমা ফাটালো যে আদানির সাম্রাজ্য আজ টলোমলো? আর সে ব্যাপারে শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক এখনও মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে কেন? তাহলে কি সত্যিই ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়?’

হিন্ডেনবার্গের প্রধান ও মূল অভিযোগ হল, আদানি গোষ্ঠী তার শেয়ারের দরকে অন্যায় ভাবে ও তঞ্চকতা করে বাড়িয়ে রেখেছে। আর সেই বাড়তি শেয়ারের মূল্যের অজুহাতে তারা ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এবং শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলেছে। স্টেট ব্যাঙ্কের প্রচুর টাকা এইভাবে আদানি গোষ্ঠীর কাছে ঋণ মারফত জমা হয়ে রয়েছে। প্রশ্ন উঠবে, কীভাবে শেয়ারের এই মূল্যস্ফীতি করা হল? দু’ বছর ধরে প্রভূত তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা করে হিন্ডেনবার্গ এই রহস্য উন্মোচন করেছে। তারা দেখাচ্ছে, প্রমোটার হিসেবে আদানি গোষ্ঠী একেকটা কোম্পানিতে ৭০ থেকে ৭৩ শতাংশ মতো শেয়ার নিজেরা কিনে রেখেছে (প্রমোটার ৭৫ শতাংশের বেশি হোল্ড করতে পারে না) আর বাকী ১৫ শতাংশ শেয়ার এসেছে মরিশাস, কেম্যান দ্বীপের মতো জায়গাগুলি থেকে শেল কোম্পানি মারফত। এইগুলি আদানিরই বেনামী কোম্পানি। আর এই কাজে আদানিকে সহায়তা করেছে তাঁর ভাই বিনোদ আদানি ও এক নিকটাত্মীয় রাজেশ আদানি। অর্থাৎ, একেকটা কোম্পানিতে আইনি-বেআইনি জুড়ে আদানির শেয়ারের পরিমাণ আদতে দাঁড়াচ্ছে ৯০ শতাংশের আশেপাশে। ফ্লোটিং শেয়ার হিসেবে অন্যান্যদের কাছে থাকছে মাত্র ১০ শতাংশ মতো। যখন শেয়ারের দাম বাজারের নিয়মে পড়তে থাকে তখন আদানিরা (প্রায় ৯০ শতাংশ অংশীদারি থাকায়) এই শেয়ারগুলিকে ধরে রেখে দেয়। অন্যান্য ফ্লোটিং শেয়ার-হোল্ডাররা নিজেদের কাছে গচ্ছিত শেয়ার বিক্রি করলেও তা যেহেতু ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র, তাই শেয়ার বাজারে তার কোনও প্রভাব পড়ে না। ফলে, আদানির শেয়ারের মূল্য সবসময়েই স্ফীত থাকে; এই ‘ফোলানো মূল্য’ দেখিয়েই আদানি গোষ্ঠী বাজার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রভূত পরিমাণে ঋণ সংগ্রহ করে। আর সেই অর্থ দিয়ে একের পর এক কিনতে থাকে এয়ারপোর্ট থেকে বন্দর, খনি থেকে জঙ্গল, হাইওয়ে থেকে পাহাড়। প্রশ্ন, অর্থের এক বড় অংশ কি চলে যায় ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’এর মাধ্যমে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের কাছে, যাদের বদান্যতায় নির্বিঘ্নে ও বেপরোয়া উপায়ে এই কর্মগুচ্ছ চলতেই থাকে? তাহলে কি এইভাবেই অর্থ ও রাষ্ট্রের জোরে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠী পরস্পর সমৃদ্ধ হতে থাকে? স্বৈরাচারের উৎসভূমি?

এছাড়া আরও বহু অভিযোগ হিন্ডেনবার্গ’এর তরফে তোলা হয়েছে। গত তিন বছরে আদানির সাতটি কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ গড়ে ৮২০ শতাংশ বেড়েছে। মোট ৮৮টি প্রশ্ন আদানি গোষ্ঠীর কাছে হিন্ডেনবার্গের তরফে রাখা হয়েছে যার কোনও উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। ‘মিথ্যাচার’, ‘ভারতের ওপর হামলা’, ‘মামলা করব’, ’৩১ জানুয়ারির পর দেখে নেব’- এইসব বড় বড় বুলি আউড়ে আদানি আপাতত শেয়ার বাজারে নিজেদের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। মামলা করার হুমকিকে হিন্ডেনবার্গ সাধুবাদ জানিয়েছে এবং আমেরিকার আদালতে যেন মামলাটি হয় সেই দাবি রেখেছে; কারণ, সে ক্ষেত্রে আদালত আদানিকে বাধ্য করতে পারবে অভিযোগ সম্পর্কিত সমস্ত নথি জমা করতে। একইসঙ্গে নানান কুনাট্যও শুরু হয়েছে। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ সমূহকে আদানি’র মুখপাত্র জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড-তুল্য একটি আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন। এই তুলনাটি ভয়ানক। ইংরেজ শাসকের হুকুমে জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলি চালিয়েছিল যে ভারতীয় সেনারা, তাদের সঙ্গে তিনি খুচরো বিনিয়োগকারীদের তুলনা টেনেছেন; এই অর্থে যে, বিদেশি একটি সংস্থার অভিযোগকে মান্য করে একইভাবে খুচরো বিনিয়োগকারীরা আদানির শেয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

বলাই বাহুল্য, ভারতীয় অর্থনীতি আজ ভয়ঙ্কর এক বিপদের মুখে। সাধারণ মানুষের লক্ষ কোটি টাকা হস্তগত করে রেখেছে এক কর্পোরেট গোষ্ঠী, যারা এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। মৌন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি তাদের পরোক্ষে মদত দিচ্ছে। ভাবছে, সময় পেরিয়ে গেলে সব আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। অবিলম্বে আওয়াজ উঠুক, সেবিকে তদন্ত করে সমস্ত জালিয়াতির পর্দা ফাঁস করতে হবে।