Sunday, 24 December 2023

‘বেটি পেটাও…’

ব্রিজভূষণরাই যখন দেশ চালাচ্ছে

প্রবুদ্ধ বাগচী


 

গত কয়েক দশকে দেশের শাসনকর্তাদের থেকে দুটো আপ্তবাক্য শুনে শুনে আমরা পরিশ্রান্ত তার একটি হল সুশাসন, অন্যটি উন্নয়ন’। এই দুটো শব্দের ব্যঞ্জনা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে, থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু দেশের গড়পড়তা আমজনতার কাছেও এর একটা গ্রাহ্য চেহারা আছে সুশাসন বলতে তাঁরা মনে করেন, দেশের আইন যারা ভাঙেন সরকারি প্রশাসনের উচিত তাঁদের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করে দেশের সাধারণ নাগরিককে সুরক্ষিত রাখাএটা একটা খুবই সহজ ন্যারেটিভ যে রামচন্দ্রকে নিয়ে আজ সারা দেশকে উত্তেজিত করার চেষ্টা হচ্ছে, তাঁর মুকুটেও আছে এই সুশাসনের পালক কিন্তু রামের মতো পুরাণপুরুষকে যারা দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে মরিয়া, তাঁদের রক্তে যে সুশাসনের কোনও বালাই নেই, তা প্রমাণ হয়ে গেল আবার; যখন কুস্তিগীর সাক্ষী মালিক তাঁর খেলার জুতোটি সাংবাদিক সম্মেলনে টেবিলে তুলে রেখে জানিয়ে দিলেন, আর তিনি খেলায় নেই তাঁরই অনুসরণে পরদিন বজরং পুনিয়া প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে দিল্লির রাজপথে বিছিয়ে দিলেন তাঁর পদ্মশ্রী খেতাব ও রেখে এলেন একটি বিনম্র প্রতিবাদ-পত্র। এখনও অবধি যা সংবাদ, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশের ক্রীড়াবিদরাই ক্ষুব্ধ ও বিড়ম্বিত বোধ করছেন অচিরেই আরও কোনও প্রোজ্জ্বল ক্রীড়াবিদ যদি তাঁর খেতাব ফিরিয়ে দেন, তাতে অবাক হওয়ার কারণ নেই কিন্তু এই পরিস্থিতি তৈরি হল কীভাবে?



ঘটনাটা সবাই জানেনসাক্ষী মালিকের মতোই একদল জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কুস্তিগীর যারা আন্তর্জাতিক আসরেও দেশের হয়ে পদক জিতেছেন, তাঁরা একযোগে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংএর দিকে উত্থাপিত অভিযোগ নারী কুস্তিগীরদের ওপর তাঁর নিয়মিত যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানির দেশের আইন বলে, এইসব গুরুতর অভিযোগের খবর পাওয়া মাত্র পুলিশকে দ্রুত এফআইআর দায়ের করে আপাত-অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে শুরু করতে হয় তদন্ত দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন এবং অভিযুক্ত ‘মহাপুরুষ’টি যেহেতু বিজেপি প্রজাতিভুক্ত, তাই দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রে পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকে ক্ষোভ বাড়তে থাকে আক্রান্তদের মধ্যে, যা অচিরেই নেমে আসে নয়াদিল্লির রাজপথে (আপাতত নাম পাল্টে যা ‘কর্তব্যপথ’)। কার কর্তব্য কে করলেন জানা যায়নি, তবে বিক্ষোভের তীব্রতা দেখে দিল্লি পুলিশ অবস্থানে বসা খেলোয়াড় ও কুস্তিগীরদের টেনে হিঁচড়ে কুৎসিত ভাবে গ্রেফতার করে ও ছত্রভঙ্গ করে দেয় অবস্থানকারীরা কেউ সশস্ত্র ছিলেন না, আর প্রায় প্রত্যেকেই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পদকজয়ী দেশের হয়ে যারা মুখ উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদের গুরুতর অভিযোগ প্রশাসন উপেক্ষা করে এই উপেক্ষার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কুস্তিগীররা সিদ্ধান্ত নেন বারাণসীর গঙ্গায় তাঁরা তাঁদের পদক ভাসিয়ে দেবেন

একে পুণ্যতোয়া জাহ্নবী অন্যদিকে বারাণসীর সাংসদের ওজন অত্যন্ত বেশি, তাই তড়িঘড়ি কেন্দ্রের ক্রীড়ামন্ত্রী যিনি ‘গোলি মারো শালোকো’ বাচনের জন্য সুবিখ্যাত, আসরে নামেন তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ছিল, ওই অভিযুক্ত ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তদন্ত করা হবে এবং তিনি বা তাঁর নিকটজন অথবা তাঁর পরিবারের কেউ যাতে আর জাতীয় কুস্তিগীর ফেডারেশনের সঙ্গে সংশ্রব না রাখেন, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে যদিও এই প্রকরণকে তথাকথিত সুশাসনের নজির বলা যাবে না, কারণ, এই পদক্ষেপের জন্য পুলিশের হাতে থাকা আইনি সংস্থানই ছিল যথেষ্ট রাতারাতি নোটবন্দি করে যেমন ‘কালাধন’কে ঘরে ফেরানো যায়নি বা সন্ত্রাসীদের অর্থের উৎস বন্ধ করা সম্ভব হয়নি, বা যেমন থালা বাজিয়ে আটকানো যায়নি করোনা ভাইরাসকে, সেইভাবেই বিজেপির এই ‘কালাধন’কেও সবক শেখানো গেল না তা সম্ভবও ছিল না, কারণ বিগত কয়েক মাসে পুরনো অভিযোগে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি, তিনিও বুক ফুলিয়ে নয়াদিল্লিতেই ছিলেন- তাঁর বিরুদ্ধে কোনও তদন্তও হয়নি যদিও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ বা কেন্দ্রীয় এজেন্সি তাঁদের চক্ষুশূল নানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রাগৈতিহাসিক অভিযোগ খুঁচিয়ে তুলে তাঁদের ‘ফাঁসিয়ে দেওয়া’কে একেবারে তাঁদের নিত্যকর্ম পদ্ধতির অঙ্গ করে নিয়েছে—- কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনের দুচোখে তাঁরা নিজেরাই এমন দলীয় আধিপত্যের ঠুলি পরিয়ে রাখলেন যে দেশের বিশিষ্ট কুস্তিগীরদের আজ নেমে আসতে হল অপমানের তলে

দেশের কুস্তিগীর ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রক কমিটিতে জয়ী হলেন সেই কুকীর্তির নায়কেরই ‘আপনজন’—- যার বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীররা ধারাবাহিক শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছিলেন, যাকে আড়াল করার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসন মায় ‘খেল’মন্ত্রী অবধি বাজার গরম করেছিলেন—- সেই ‘মহারাজ’ যদি আজ ‘সাধু’ হয়ে যায় তাহলে আর কীই বা করতে পারেন অপমানিত ক্রীড়াবিদরা? তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জেনেছেন, মল্লযুদ্ধের আসরে মঞ্চের প্রতিযোগীকে মোকাবিলা করা যায় খেলার নিয়মে-- কিন্তু যে খেলায় কোনও নিয়ম নেই, যার সবটাই ক্ষমতার দাপট আর নারী-অধিকার ও সম্মানকে ধ্বস্ত করার এক ব্যাপ্ত আয়োজন, সেখানে কী করবেন তাঁরা? সেখানে কতদূর পর্যন্ত উচ্চকিত করা যায় তাঁদের কন্ঠ? কত নগ্নভাবে প্রদর্শন করা যায় নিজেদের ক্ষত? যে মহাভারত আমাদের সভ্যতার গর্ব, সেখানেও রাজসভায় আক্রান্ত পাঞ্চালী তাঁর অবমাননা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সভার প্রবীণ গুরুজনদের দিকে—-- ক্ষমতার বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ 'রা কাড়তে পারেননি আজকের ভারতেও কোনও সংবেদী ‘গুরুজন’ আর কেউ নেই, যিনি এই অনাচারের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারেন তাঁর প্রতিবাদের বিভা, প্রতিরোধের দ্যুতি!

কী করবেন আমাদের ঘরের এই মেয়েরা? যারা অনেক কষ্ট করে খেলা শিখেছেন, নিজেদের প্রস্তুত করেছেন কঠিন প্রতিযোগিতার জন্য, দাঁতে দাঁত চেপে বিদেশের মাটিতে দেশের নামে শপথ নিয়ে লড়াই করেছেন আর জয় করেছেন পদকের পর পদক—- এই যাবতীয় অর্জন আজকে কোথাও যেন তরল হয়ে যায় এসবের মূল্য কি এক ধর্ষকাম পুরুষের কাছে নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন, তাঁর সবল ক্ষমতাবৃত্তের সামনে অসহায় নতজানু হয়ে থাকা? ‘সুশাসন’ বলে আর কণামাত্র কিছু কি আছে এই পোড়া দেশে? নাকি যা আছে তা কেবল প্রকীর্ণ অন্যায় আর কণ্ঠরোধের ধারাভাষ্য? এর জবাব পাননি সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগট, সঙ্গীতা ফোগট, বজরঙ্গ পুনিয়া'রা। তাই তাঁরা নিজের নিজের মতো তৈরি করেছেন প্রতিবাদের আদল

দশ বছরের রাজ্যপাটে ভাজপা সরকারের নতুন করে বলার মতো তেমন কিছু নেই ‘উন্নয়ন’ বলতে তাঁরা যা বোঝেন বা বোঝাতে চান তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের চাহিদার তেমন কোনও যোগ নেই আর যোগ নেই বলেই আজ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘রাম মন্দির’এর মতো একটা বায়বীয় ইস্যু নিয়ে তাঁদের পথে নামতে হচ্ছে কিন্তু এই এক দশকে তাঁরা যেটা করেছেন, সারা দেশে যে কোনও বিরোধী পরিসরকে তাঁরা সংকীর্ণতর করতে করতে প্রায় লুপ্ত করে ফেলেছেন শুধু তাই নয়, সংগঠিত অপরাধের সঙ্গী হিসেবে তাঁদের নিজেদের নেতা কর্মী সংগঠকরা যখন নানাভাবে যুক্ত, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসন নীরব উত্তরপ্রদেশে যখন কিশোরী ধর্ষণের পক্ষে ভাজপা নেতা মিছিল করেন, দলিত নিগ্রহের সপক্ষে গলা ফাটান অথবা গুজরাটের ছাড়া পাওয়া ধর্ষকদের সম্বর্ধনা দেন—- তার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রশাসন ও দলের পক্ষে পালন করা হয় হিরণ্ময় নীরবতা অন্তত কেউ তাঁদের ‘দুষ্টু ছেলে’ বলে নরম করে ‘বকে দেওয়ার’ কথাও বলেন না! এমন নয় যে ওইসব ‘দলীয় সম্পদ’ ছাড়া দলের রথচক্র মাটিতে বসে যাবে, তবু এইটাই রীতি, এইটাই তাঁদের স্পর্ধার দর্পিত রক্তচোখ

এই পরিবর্ধিত এক দাপটের আবহেই কীর্তিমান ব্রিজভূষণ না হলেও তার ‘জিগরি দোস্ত’ জনৈক সঞ্জয় সিং যখন সর্বৈসর্বা হয়ে ওঠে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের—-- উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে ব্রিজভুষণ, যেন বা এক ‘হেলায় লঙ্কাজয়’ ঘটিয়ে ফেলল সে ফুলের মালা আর স্লোগানের আওয়াজে কেঁপে ওঠে শীতার্ত দিল্লির সন্ধ্যে—- আর এই হিম অন্ধকারে মুখ লুকোয় যাবতীয় সুশাসন ও আইনের ধারা-উপধারাএকা সাক্ষী মালিক এবং আরও অনেকে আরেকবার বুঝে যান, তাঁদের শ্রম, নিষ্ঠা আর উদ্যোগ দিয়ে যে দেশকে তাঁরা উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন বিশ্বের মঞ্চে, সেই দেশ আজ আর তাকে তাঁদের যোগ্য প্রতি-সম্মান ফিরিয়ে দিতে নারাজ কখন যেন তাঁদের দেশ আর তেমন করে আর তাঁদের দেশ নেই-- এখানে শুধুই এক গর্ব-নিনাদ ছেয়ে ফেলছে নারীর সম্ভ্রম, দলিতের জীর্ণ কুটির, সংখ্যালঘুর জড়োসড়ো অস্তিত্ব এই দেশের জন্য তো সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ারা মাঠে নামেননি!

যেহেতু জেগে থাকাও একরকমের ধর্ম, তাই কেউ কেউ নিশ্চয়ই জেগে আছেন এক দেশ এক আইন এক ধর্মের পাশে পাশে এক মিডিয়াও যখন প্রায়-বাস্তব তবু বিকল্প কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, যারা এই ‘ন্যায় সংহিতা’ বিল পাশ করানো সরকারকে ন্যায় অন্যায়ের তফাতের কথা চিনিয়ে দিতে চায় প্রতিবাদ ছড়াচ্ছে কৃষ্ণা কাবেরী থেকে নর্মদা গোমতীর বাঁকে বাঁকে বছর শেষের এই উৎসব-নন্দিত ঋতুতে কেউ ভাল থাকবেন না, সজাগ থাকুন


Saturday, 16 December 2023

রঙ দে বাসন্তী

চিন্তাশক্তি কি বাজেয়াপ্ত হয়?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

৮ এপ্রিল ১৯২৯। হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’এর তরফে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দর্শক আসন থেকে দিল্লির সংসদে দুটি নিরীহ বোমা ছোঁড়েন। চারপাশ ধোঁয়ায় ভরে গেলেও তাঁরা কেউই পালাবার চেষ্টা করেননি। কিছু লিফলেট ছুঁড়ে দেন মাত্র ও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগানে মুখরিত করেন সভাকক্ষ; আর অপেক্ষা করেন সমস্ত কিছু স্বাভাবিক হলে কখন পুলিশ এসে তাঁদের গ্রেফতার করবে। বোমা দুটি থেকে ক্ষয়ক্ষতিরও কোনও আশঙ্কা ছিল না। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, নাটকীয় এই ঘটনাটি ঘটিয়ে দেশবাসীর কাছে এক বার্তা পাঠানো, যে বার্তায় নিহিত ছিল সামাজিক-অর্থনৈতিক শৃঙ্খল ও পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির আহ্বান। তাঁরা বিচারেরও অপেক্ষায় ছিলেন, যেখানে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁরা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বহু কথা বলতে পারবেন। কারণ, ঘটনার নাটকীয়তা এতটাই প্রবল ছিল যে তা সমস্ত মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দেশবাসী ভগৎ সিং’এর কথা শোনার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন।

ঠিক ৯৫ বছর পর গত ১৩ ডিসেম্বর নতুন সংসদ ভবনে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। এবারে ছিলেন চারজন। দুজন সংসদ কক্ষের ভেতরে, দুজন বাইরে। ফেসবুকে ‘ভগৎ সিং যুবা ফ্যান’ নামে একটি পেইজের ফলোয়ার তাঁরা। রঙমশাল ধরনের নিরীহ বাজি এনে চেষ্টা করলেন দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিজেদের বক্তব্য পেশের। এক দুঃসাহসিক অভিযান। এই চারজন কারা?

সাগর শর্মা- লক্ষ্ণৌ শহরে ই-রিক্সাচালক; অমল শিণ্ডে- লাতুরের এক দলিত পরিবারের ছেলে; মনোরঞ্জন ডি- মাইসুরু’র কম্পিউটার বিজ্ঞানের স্নাতক ও স্বেচ্ছাকৃত বেকার, স্বামী বিবেকানন্দ’র ভক্ত; নীলম আজাদ- এমফিল ও হরিয়ানার টেট পাশ এক যুবতী। আরও কেউ কেউ হয়তো পিছন থেকে এঁদের সহায়তা করেছেন।

বিজেপি’র এক সাংসদের থেকে প্রবেশ-পাস জোগাড় করে সাগর শর্মা ও মনোরঞ্জন ডি সংসদের দর্শক গ্যালারিতে পৌঁছে যান কতকগুলি লিফলেট ও রঙমশাল নিয়ে। এরপরের ঘটনাবলী আমরা সকলে জানি। লিফলেটগুলি সম্ভবত তাঁরা বিলি করতে পারেননি। উপরন্তু, সাংসদদের হাতে ধরা পড়ে সাগর বেধড়ক মার খান। আশ্চর্যের ঘটনা হল, চোর ধরার পর যে ভাবে গণ-পিটুনি দেওয়া হয়, যা সর্বৈব ভাবে বেআইনি, সে ভাবেই আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ছেলেটিকে পাকড়াও করে কয়েকজন সাংসদ তাকে আচ্ছা করে ধোলাই দেন। ছেলেটি তখন কাতর স্বরে বলছেন, আমি তো কারও ক্ষতি করিনি, আমাকে মারছেন কেন? যে কক্ষ আইন পাশ করে, সে কক্ষেই আইন রচয়িতারা এইভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে নিজেদের বাহুবল দেখাবেন, তা ৭৫ বছর বয়সী ভারতীয় প্রজাতন্ত্র কখনও কল্পনা করতে পেরেছে কী? বিশ্বের তারিফ আদায়ে ব্যাকুল যে সব নেতারা, তাঁরা কি মনে করেন, এই ছবি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মুখকে আরও উজ্জ্বল করল? অন্যদিকে, সংসদের বাইরে বাকী দুজন রঙমশাল জ্বালিয়ে ‘তানাশাহি নেহি চলেগি’ শ্লোগান তুলে বক্তব্য রাখেন; ভারত সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, শ্রমিক-কৃষক-ছোট ব্যবসায়ীরা নির্যাতিত হচ্ছেন, কেউ মুখ খুলতে পারছে্ন না, সবার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, আমরা ছাত্র ইত্যাদি।

চারজনকেই ইউএপিএ’তে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে সরকার আদালতে জানায়, সংসদে ‘হল্লাবাজি’, ‘মোদি নিরুদ্দেশ’ এই শিরোনামে তির্যক লিফলেট বিলির চেষ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি ভয়ঙ্কর গর্হিত কাজ; অতএব, সন্ত্রাসবাদ নিরোধক আইন দিয়েই এই ‘ঔদ্ধত্য’কে নিকেশ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলরাম সিং ‘দ্য জনতা লাইভ’ ইউটিউব চ্যানেলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে তাদের ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করেছে, সংসদ ভবনের টুটাফাটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ধরিয়ে দিয়েছে, দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে নিজেদের মতামত রেখেছে, তার জন্য তাদের ওপরে একেবারে ইউএপিএ প্রয়োগ? বরং, ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে উন্মোচিত করে তারা তো ভবিষ্যতের সুরক্ষাকে নিশ্চিত করে দেশরক্ষার কাজ করেছে, এ জন্য তাদের সংসদের তরফে পুরস্কৃত করা উচিত।

অবশ্য, এ কথা সত্যি, সংসদের ভিতরে ওই দুই যুবক আইন ভেঙ্গেছেন; বটেই তো, যে ভাবে রাজনৈতিক দলগুলি ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আইন-অমান্য আন্দোলন করে। তার জন্য কি তাদের ওপর ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়? তাহলে এই চারজনের ‘অপরাধের মাত্রা’কে কেন এত বিষিয়ে দেখা হচ্ছে? সরকারের অন্তরেই কি বিষভাণ্ড? প্রতিবাদ বিষয়টাই অন্যায্য? ইতিমধ্যে হরিয়ানার কৃষক সমাজ নীলম আজাদের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন ও পথে নামছেন। তাঁদের বক্তব্য, নীলম তো সংসদের বাইরে সামান্য কিছু শ্লোগান তুলেছেন ও বক্তব্য রেখেছে্ন; তার অপরাধটা কী? ঠিকই তো! নীলম ও অমল, যারা সংসদের বাইরে কিছু শ্লোগান তুলেছেন, তা কী করে সন্ত্রাসবাদী আইনের আওতায় আসে? আমরা কোন শিব ঠাকুরের দেশে বাস করছি?

মোটের ওপর, এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতিতে এক অভিনবত্ব যোগ করেছে। প্রথমত, যে বিজেপি সাংসদের পাস নিয়ে দুই তরুণ সংসদে প্রবেশ করলেন, সেই সাংসদকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে তদন্ত শুরু করা তো দূর অস্ত, এমনকি জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ, যে সব সাংসদেরা সংসদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা দাবি করলেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে সাসপেন্ড করা হল। দ্বিতীয়ত, এমনতর এক ভয়ঙ্কর নিরাপত্তা জনিত সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে হাজির তো হলেনই না, এমনকি একটা বিবৃতি পর্যন্ত দিলেন না। খবরে শোনা গেল, তিনি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের বিষয়টিকে সংবেদনশীল ভাবে মোকাবিলা করার উপদেশ দিয়েছেন। এর অর্থ কী? তৃতীয়ত, গ্রেফতার হওয়া ছ’ জনের মধ্যে একজনকেও পাওয়া গেল না যার নাম আরবি ভাষা থেকে উদ্গত। চতুর্থত, সংসদে প্রবেশের পাস কোনও বিরোধী সাংসদও ইস্যু করেননি। ফলে, শাসকের তরফে বারবার উচ্চারিত ক্লিশে শব্দগুলোকে এখনও বাজারে নামানো যাচ্ছে না, যেমন, জিহাদি মড্যুল, সন্ত্রাসবাদ, দেশদ্রোহী, হামাস-যোগ ইত্যাদি। সবটা মিলিয়ে সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা।

তবে প্রধানমন্ত্রী একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবদ। তিনি সম্ভবত সমস্যাটা বুঝেছেন, বুঝেই তাঁর মন্ত্রীদের সংবেদনশীলতার উপদেশ দিয়েছেন, যার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। ২০২৪ সালে আগত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দি বলয়ের কিছু ‘রামভক্ত’ এলাকা বাদ দিলে গোটা দেশের অবস্থাটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। যে চার যুবা প্রতিবাদের ঝড় তুললেন, তারা এসেছেন ভারতের চার প্রান্ত থেকে। এটাই প্রধানমন্ত্রীকে ভাবাচ্ছে। যে দুঃসাহসে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ভবিষ্যতের পরোয়া না করে এই চার যুবা দেশের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও বিপন্নতার কথা রঙমশাল জ্বালিয়ে কয়েকটি শ্লোগান ও লিফলেটে তুলে ধরেছেন তা কোটি কোটি মানুষের ভাবনার প্রতিফলন। এই ভাবনা তাঁদের এমনকি চূড়ান্ত আত্মত্যাগেও অনুপ্রেরণা দিয়েছে, যা কোনও বিচ্ছিন্ন, আলটপকা ঘটনা নয়। আত্মত্যাগের এই অনির্বচনীয় দৃঢ়তা আসে গভীর বোধ থেকে, যা সমাজ জুড়ে প্রবহমান। সেই ইঙ্গিত সম্ভবত শাসক দলের প্রধান নেতা টের পেয়েছেন।

সাগর শর্মা ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরিতে তিনি গভীর চৈতন্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। মনোরঞ্জনের বাবা জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে একজন অত্যুৎসাহী পাঠক, স্বামী বিবেকানন্দ’র রচনা গুলে খেয়েছেন। এবার কি তাহলে স্বামীজীর বই বেআইনি ঘোষণার কথা ভাববে শাসক? অমল শিণ্ডের ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। নীলম আজাদ সাধারণ মানুষের যে কোনও আন্দোলনের পাশে বলিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন, মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকেন। নীলমের পারিবারিক পদবী ভার্মা হলেও তিনি তাঁর নামের পাশে আজাদ ব্যবহার করেন।

আপাতত তাঁরা পুলিশের হেফাজতে। পুলিশই বা কী উদ্ধার করবে আর জেরা করে! অন্তরের বোধ আর চিন্তাশক্তি তো বাজেয়াপ্ত করা যায় না। আর সেই চিন্তার যোগও থাকে সমাজ-প্রবাহের সঙ্গে। আগামী দিন হয়তো তার সাক্ষ্য দেবে।

জয় হিন্দ।

       

Monday, 11 December 2023

'ভঙ্গুর স্বপ্ন...'

মায়ানমারের ছবি: চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা

সোমনাথ গুহ



২০২১'এর ১ ফেব্রুয়ারি মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়, জুন্টা ক্ষমতা দখল করে। দেশের অবিসংবাদী গণতান্ত্রিক নেত্রী আঙ সান সু চি গ্রেফতার হন। তাঁর দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। 

সচ্ছল পরিবারের এক মেয়ে কলেজের পরীক্ষায় অসামান্য রেজাল্ট করেছে, তার ভবিষ্যৎ দিগন্ত জুড়ে ডানা মেলার অপেক্ষায়। সেই সময় বন্ধুরা গাড়ি করে এসে হাজির, জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হবে। নির্দ্বিধায় সে তাদের সঙ্গে সামিল হয়। রাজপথ জুড়ে মানুষের মহামিছিল। চারিদিকে তিন আঙুলের প্রতিবাদের স্যালুট ও জয়েন সিডিএম (সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স মুভমেন্ট)'এর পোস্টার, ব্যানার। মেয়েটি তড়াক করে একটি ড্রামে উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করে। বারবার সু চিকে উদ্ধৃত করে বলে, আমাদের ভয় থেকে মুক্তি পেতে হবে, ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার! কয়েক মিনিট মাত্র। পুলিশ পজিশন নেয়, শুরু হয় লাগামছাড়া গুলি বর্ষণ। মেয়েটি ঢলে পড়ে। পুলিশ তার লাশ গায়েব করে দেয়। তার মা যখন মেয়ের মৃতদেহ চায়, পুলিশ জানায়, তিনি যদি তার কন্যার বন্ধুদের চিহ্নিত করেন তবেই তা পাবেন, নচেৎ নয়। 

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সদ্য প্রদর্শিত মায়ানমারের ছবি ‘ব্রোকেন ড্রিমস: স্টোরিজ ফ্রম দ্য মায়ানমার ক্যু’র নয়টি গল্পের একটি উপরের ঘটনাটি। প্রতিটি গল্পে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ের বিষাদ, যন্ত্রণা, ট্রমা, বিভীষিকা তুলে ধরা হয়েছে। কিছু মানুষ মারা যায়, বহু লোক দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে দিন গুজরান করে। ‘ডার্ক ট্যাঙ্গেল’ গল্পে কারাবাস ও দৈহিক নির্যাতন যে কী সাংঘাতিক ট্রমা তৈরি করে তা আমরা প্রত্যক্ষ করি। মেয়েটি দিবারাত্র কাটা পশুর মতো যন্ত্রণায় ছটফট করে। নিপীড়নের একেকটি ঘটনা তার মনে পড়ে, সে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কঁকিয়ে ওঠে, তার ভয়ার্ত আর্তনাদ বদ্ধ ঘরের মধ্যে অনুরণিত হয়। পুলিশের হুঙ্কার, জনতার মরীয়া শ্লোগান, গুলিগোলার আওয়াজ, মুমূর্ষু প্রতিবাদীর কান্না- সব কিছু মিলেমিশে তার শরীর, মনকে বেসামাল করে দেয়। শিরা কেটে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তাতেও ব্যর্থ হয়। কয়েক দিনের কারাবাস তাকে অনন্তকালের নরক যন্ত্রণায় ঠেলে দেয়। এক মহিলা তার জেল জীবনের বর্ণনা দেন। বলেন, রক্ষীরা লিঙ্গ উত্থিত করে প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়। সীমাহীন অত্যাচার, অনেকে মারা যায়, লাশ লোপাট হয়ে যায়।

প্রায় চল্লিশ বছর আগে চিত্র পরিচালক মিগুয়েল লিতিন, স্বৈরাচারী অগস্তো পিনোচেতের শাসনাধীন চিলিতে ফিরে গিয়ে গোপনে সেখানকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে দীর্ণ মানুষের যাপনকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর সেই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতাকে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ‘চিলিতে গোপনে’ (ক্ল্যানডেস্টাইন ইন চিলি) নামে একটি ডকু-নভেলে রূপান্তরিত করেছিলেন। ২০১১'এ ইরানের প্রখ্যাত পরিচালক জাফর পানাহিকে সরকার তথাকথিত রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গৃহবন্দী করে। অদম্য শিল্পী ঘরে বসেই তাঁর আই-ফোনের সাহায্যে ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ নামক ছবি শ্যুট করেন এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠিয়ে দেন। বরেণ্য শিল্পীদের এই প্রতিবাদী ঐতিহ্যের সঙ্গে এবার কিছু তরুণ মায়ানমারিজ চিত্র পরিচালকও যুক্ত হলেন। 

‘ব্রোকেন ড্রিমস….’ একই বিষয়ের ওপরে নয়টি ঘটনা/গল্পের একটি কোলাজ। ছবিটির পরিচালক ‘নাইনফোল্ড মোজাইক’- নয়জন অকুতোভয় পরিচালকের একটি সংঘবদ্ধ দল। জুন্টা সরকার এবং থাইল্যান্ডের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পুলিশের প্রখর নজরদারি এড়িয়ে, প্রবল ঝুঁকি নিয়ে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মোবাইল ফোনের সাহায্যে এঁরা এই ছবিগুলি তুলেছেন। বলাই বাহুল্য, জানাজানি হয়ে যাওয়ার কারণে এঁরা সবাই বর্তমানে দেশছাড়া। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ‘মায়ানমার ডায়ারিজ’ নামক তথ্যচিত্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, যে ছবি বার্লিনে সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার পায়।        

প্রতিটি গল্পে স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের ভয়ঙ্কর রূপ ফুটে উঠেছে। প্রবল অত্যাচারের কারণে পুরো সমাজে একটা ত্রাস-আতঙ্কের পরিবেশ, মানুষকে অহরহ তা তাড়া করে বেড়ায়। জীবনের আনন্দ ফুরিয়ে যায়। স্বাভাবিক, সুন্দর সম্পর্কগুলো ভয়, দুশ্চিন্তার তাড়নায় বিষাক্ত হয়ে যায়। ‘টু সোলস’ নামক গল্পে দুই বিপ্লবী থাইল্যান্ডের একটি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। একজন কারাবাসের পর পালিয়ে চলে এসেছে। তার পিঠ জুড়ে প্রহারের দগদগে ঘা, রাতে ঘুমের মধ্যে তার শরীর কেঁপে ওঠে, সে চিৎকার করে। বন্ধুর কাছে সে কবুল করে বিপ্লবের ওপর তার আর কোনও আস্থা নেই। পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস গড়ে ওঠে। দুজনেই সন্দেহ করে অন্যজন বোধহয় অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বন্ধুদের খোঁজখবর জানিয়ে দিয়েছে। আরেকটি গল্পে দুটি মেয়ে, ন্যাও ও জিট, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা পরস্পরকে চোখে হারায়, কোনও বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না, সামাজিক ডামাডোল তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে। দূরে বিস্ফোরণের শব্দ, আকাশে ফাইটার প্লেন, তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, তাদের নির্মল প্রেম, ভালোবাসার মধ্যে তিরতিরে আশঙ্কার স্রোত প্রবেশ করে। মোবাইল ফোন বেজেই যায়, জিট প্রস্তর মূর্তির মতো বন্ধুর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে।  

এরই মধ্যে ঘটে চলে বিদ্রোহ। ‘ডিক্টেটরস বাথরুম’ গল্পে একনায়ক নিজেই আতঙ্কের শিকার! বাথরুমে কমোডের ওপরে এক বিদ্রোহী তাকে চেপে ধরে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। কেন তোমার মধ্যে এত ঘৃণা? কেন তুমি মানুষ হত্যা করতে এত ভালোবাসো? তুমি কি জানো না কয়েক প্রজন্ম পরে লোকে তোমায় কীভাবে বদনাম করবে? প্রশ্নের কোনও জবাব নেই তার কাছে, সে ভয়ে গুটিয়ে যায়, দিশাহারা হয়ে বারবার জানতে চায় কেন তাকে এভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। 

জুন্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেশের জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। পরিচালক বো থেট হানের ‘ড্যান্সিং ইন দ্য ডার্ক’ সত্যি ঘটনার ওপর নির্মিত। রাজনৈতিক সংকট কী ভাবে কারেন উপজাতিদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে সেটা আমরা এই ছবিটিতে দেখি। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন স্থির, বাহুল্য বর্জিত। তাদের ফ্রিজ নেই, টিভি নেই, মোবাইলের টাওয়ার পেতে তাদের টিলায় আরোহণ করতে হয়। তাদের শান্তি ক্ষণস্থায়ী। সামরিক বাহিনীর দাপটে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, মানুষ লোটাকম্বল নিয়ে অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা শুরু করে। পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে তারা সীমান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করে। চারিদিকে সেনাদের সতর্ক আনাগোনা, তারই মধ্যে এক মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে ছোট বোনকে খুঁজে বেড়ায়। দল থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, টহলদার সেনাদের সন্নিকটে ঘোরাফেরা করে। তাদের আশঙ্কা সত্যি হয়, খাদের প্রান্তে মেয়েটির ছিন্নভিন্ন শরীর পাওয়া যায়। এই ছবিতে থাই শিবিরের উদ্বাস্তুরা অভিনয় করেছেন। বো তিন সপ্তাহ ধরে গোপনে এই ছবি শ্যুট করেন। 

মায়ানমার আজ এক লৌহ যবনিকার অন্তরালে। সারা বিশ্ব জানে সেখানে এক চরম অস্থিরতা চলছে, কিন্তু নির্দিষ্ট খবর পাওয়া দুষ্কর। জানা যায় যে মণিপুর, মিজোরামের আন্তর্জাতিক সীমান্তে বহু বিদ্রোহী সেনা এসে আশ্রয় নিচ্ছে। শোনা যায়, দেশের একটা বৃহৎ অংশ এখন এই বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে। বো থেট হানরা আশায় বুক বেঁধেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার এই লড়াইয়ে চলচ্চিত্রও সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। 


Friday, 8 December 2023

কাজীর বিচারের চেয়েও ভয়ঙ্কর

বড্ড প্রশ্ন তোলে, ওকে নিকেশ করো...

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



কাজীর বিচারেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে। সন্ত্রাসবাদীদের 'ক্যাঙারু আদালতে' সে বালাই'ও নেই। কোন বিচারের প্রহসনে সংসদের নয়া ভবনের অন্দরে আজ সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হল গণতন্ত্রের সামান্য প্রদীপটুকুকেও, সে আলোচনা আগামী দিনের হাতে অর্পিত থাক।

ব্রিজভূষণের মতো ধর্ষকামে অভিযুক্ত, রমেশ বিদুরি'র মতো উগ্র হন্তারক বক্তা- যাদের বিরুদ্ধে আসা ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ নিয়ে সংসদের 'এথিক্স কমিটি'র বসারই সময় নেই (কারণ, এরা সব বিজেপি'র সাংসদ), সেই কমিটিই দর্শন হিরানন্দানি নামে এক ব্যবসায়ীর অভিযোগপত্র পেয়ে রাতারাতি বৈঠকে বসে গেল এবং কোনও তদন্ত ব্যতিরেকেই এবং এমনকি সেই ব্যবসায়ীকে তলব পর্যন্ত না করে, তার তোলা অভিযোগ কতটা সত্য সে বিচারেও না গিয়ে, ৪৯৬ পাতার একটি রিপোর্ট সংসদে দাখিল করে সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কারের সুপারিশ করল। অর্থাৎ, অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, কোনও বিচার প্রক্রিয়াতে না ঢুকেই তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির নিদান দেওয়া হল। বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হল, হিরানন্দানি যেহেতু বলেছে তাই তা ধ্রুব সত্য (কারণ, তিনি তো কোনও বিজেপি'র সাংসদের বিরুদ্ধে এমনতর অভিযোগ আনেননি), অতএব, মহুয়া যে নগদের বিনিময়েই প্রশ্ন তুলেছেন, তা মেনে নিতেই হবে। তথ্যপ্রমাণ এখানে 'জরুরি নয়'। 

আরও অভিযোগ, সংসদে প্রশ্ন তোলার জন্য মহুয়াকে দেওয়া লগিন-পাসওয়ার্ড তিনি হিরানন্দানি'র সঙ্গে শেয়ার করেছেন। যদিও, এই মুহূর্তে র‍্যানডামলি ১০ জন সাংসদকে ডেকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, দেখা যাবে, তাদের মধ্যে ৯ জনই অন্যকে লগিন-পাসওয়ার্ড শেয়ার করেই সংসদে প্রশ্ন তোলেন। আর এ নিয়ে সংসদের কোনও আইন বা বিধিও নেই। কারণ, যে পোর্টালে সেই লগিন-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হয় তা শুধুমাত্র প্রশ্ন তোলার জন্যই এবং সেই প্রশ্ন জমা করার জন্য একটি ওটিপি নির্দিষ্ট সাংসদের মোবাইলে আসে যা পোর্টালে দেওয়ার পরই প্রশ্নটি যথাযথ ভাবে জমা পড়ে। অর্থাৎ, সাংসদের গোচরেই প্রশ্নগুলি জমা পড়ে, প্রশ্নগুলিও তাঁর, হয়তো তিনি টেকনিকালি অন্য কাউকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিয়েছেন। এ হামেশাই হচ্ছে। হিরানন্দানি যেহেতু মহুয়া মৈত্র'র বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, তাই কখনও সখনও তাঁর অথবা তাঁর অফিসের সাহায্য তিনি নিয়ে থাকতে পারেন, যেমন আর সকল সাংসদেরা নিয়ে থাকেন। কিন্তু এখানে নিদান হল, অন্য সাংসদরা তা করলেও এমনটা মহুয়া করতে পারবেন না! 'শিব ঠাকুরের আপন দেশে/ আইন-কানুন সর্বনেশে...'।

বাকী রইল কী? 

তিনি ভয়ঙ্করতম 'অপরাধ করেছেন' আদানির বিরুদ্ধে সংসদে প্রশ্ন তুলে। তা বটে। অগ্নি-বায়ু-জল-স্থল-পাতাল যাকে স্পর্শ করতে পারে না, তিনি আদানি। দেশের প্রায় সমস্ত পোর্ট, বিমানবন্দর, খনি, তেল, রেল স্টেশন, হাইওয়ে, রাস্তাঘাট সহ যাবতীয় পরিকাঠামো ও শিল্প যেনতেন প্রকারেণ যার হাতে তুলে দিলে তবে দেশ বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারবে- তিনি গৌতম আদানি ও তাঁর শিল্পগোষ্ঠী। এ হেন বিকাশপুরুষের বিরুদ্ধে, তায় আবার কিনা পবিত্র সংসদে, ভুরি ভুরি অভিযোগ তুলছে একজন মহিলা? পুরুষোত্তমদের তো মাথা কাটা যাওয়ার কথা! অতএব, এখুনি সে মহিলার মাথা কাটো!

৮ ডিসেম্বর ২০২৩। বেলা বারোটা নাগাদ ৪৯৬ পাতার এথিক্স কমিটি'র রিপোর্ট জমা পড়ল সংসদে। সংসদ মুলতুবি হল বেলা ২টো অবধি। একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে অধিবেশন আবার শুরু হতেই স্পিকার স্পষ্ট করে দিলেন যে, মহুয়া'র 'মস্তক কর্তনের' আলোচনার জন্য সময় দেওয়া হল মাত্র আধঘন্টা, কিন্তু শর্ত, মহুয়া মৈত্রকে কিছু বলতে দেওয়া হবে না। রায়দানের আগেই শাস্তি প্রদান। কিন্তু, এতগুলো পাতা পড়ে ওঠার জন্যও তো সাংসদদের এক-দুদিন সময় দিতে হবে! নাহ! আপনারা দিগগজ লোক, এখুনি পড়ে ফেলুন, আধঘন্টার মধ্যেই আলোচনা সেরে ফেলে এথিক্স কমিটির প্রস্তাব তুরন্ত পাশ করাতে হবে। মোদানি'র যে তর সইছে না। বিজেপি'র সাংসদরা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গতিতে পড়ে ফেলতে পারেন, তাহলে বিরোধী সাংসদরাও বা পারবেন না কেন! অধীর চৌধুরী থেকে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মণীশ তিওয়ারি থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়- সকলেই বললেন, অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য মহুয়াকে নিজের আত্মরক্ষার জন্য বলতে দেওয়া হোক, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার তো Natural Justice'এর মৌলিক ভিত্তি। কাকস্য পরিবেদনা!

একদম উপর থেকে নির্দেশ এসেছে, ঘাড় ধরে বের করে দাও ওই মহিলাকে। তাই, তিনি কিছু বলতেও পারবেন না নিজের সপক্ষে। আদালতে ফাঁসির আসামীকেও বলবার সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি সে সুযোগেরও যোগ্য নন। যিনি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, তাঁকেও জেরা করা যাবে না অভিযোগের সত্যাসত্য নিয়ে। বাকী সাংসদরা লগিন-পাসওয়ার্ড শেয়ার করলেও তিনি তা করতে পারবেন না।

আধঘন্টায় সব মিটেছে তো? কথা দেওয়া ছিল যে! 

এবার মহুয়া'র বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি লেলিয়ে দাও। ওকে জেলে পোরো, যাতে রাস্তাঘাটে গলা তুলে আর কথা না বলতে পারে। জীবন একেবারে নরক করে দাও। কারণ, ও বড্ড বেয়াড়া প্রশ্ন তোলে। সুযোগ পেলে আবারও তুলবে। ওকে নিকেশ করো। বলির বাজনা বাজাও। যে ভাবে সতীদাহ'র সময় তুমুল বাদ্যির ডাকে চাপা পড়ে যেত জ্বলন্ত 'সতীদের' তীব্র আর্তনাদ।

 

Monday, 4 December 2023

ক্ষীণদৃষ্টির পরাজয়

আঞ্চলিক দলগুলিকে মর্যাদা না দিলে বিপদ

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 



২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধনের পর হিন্দি বলয়ে আর কোনও আসন কি বিজেপি-বিরোধী শক্তি জিততে পারবে? বিশেষ করে নরম হিন্দুত্বে আস্থা রাখা কংগ্রেস? বিন্ধ্য পর্বতের ওপারে যেমন বিজেপি খাপ খুলতে পারছে না, তেমনই উত্তর ও পশ্চিম ভারতে কংগ্রেসও আর কলকে পাচ্ছে না। যদিও হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপির এই বিপুল জয়কে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির সাফল্য না বলে কংগ্রেসের ব্যর্থতা বলতে চাইছে। প্রায় একই ভাষায় কথা বলেছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা কিরণময় নন্দ। তাঁর বক্তব্য, 'কংগ্রেসের অহমিকা ও ব্যর্থতার কারণেই আজ বিজেপির এই উত্থান।' বলবেই বা না কেন? মধ্যপ্রদেশে মাত্র ছ’টি আসন চেয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়া’র শরিক সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দিতে রাজি হননি রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়্গেরা। তাঁদের মধ্যপ্রদেশ সংস্করণ কমলনাথের উক্তি, 'অখিলেশ-টখিলেশ আবার কে?' এই তাচ্ছিল্য যে কতটা ভুল মানসিকতা থেকে, তা হয়তো রবিবার ফল বেরবার পর হাড়ে হাড়ে মালুম হচ্ছে কমলনাথের। 

কংগ্রেসের উপেক্ষার পর, ৭১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ও আরও ৯টি আসনে ছোট দলগুলিকে সমর্থন করে অখিলেশ ঘোষণা করেছিলেন, কংগ্রেসের ‘বেইমানির’ জবাব তিনি দেবেন। ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া বুন্দেলখণ্ড-বাঘেলখণ্ডের পাশাপাশি বিন্ধ্য অঞ্চলেও কংগ্রেসের ভোট কেটেছেন সমাজবাদী প্রার্থীরা। ইন্ডিয়া জোটের স্বঘোষিত ক্যাপটেন কংগ্রেস এই ভোটে জাত ভিত্তিক জনগণনার সওয়াল করে গেল সবচেয়ে বেশি, কিন্তু তারা হিসেবেই আনেনি যে ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র একটি আসনে জিতলেও মধ্যপ্রদেশে ৪ শতাংশের বেশি যাদব ভোটার। সামগ্রিক ভাবে ওবিসি জনগোষ্ঠীগুলির ভোট ৫০ শতাংশের বেশি। এই জাত ভিত্তিক সমীকরণটি কংগ্রেস নেতৃত্ব কার্যত মাথায় না রেখে উলটে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন। 

শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, হিন্দি বলয়ের অন্য দুই রাজ্য ছত্তিশগড় ও রাজস্থানেও কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের পাত্তা দেয়নি। যে সিপিআই(এম) রাজস্থানে গতবারের নির্বাচনে দু'টি আসন জিতেছিল, তাকেও আসন ছাড়তে রাজি হয়নি। রাজস্থানে 'একলা চলো' করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিএসপি এবং সিপিআই(এম) সহ অন্যান্য ছোট ছোট দল যেখানে গতবার মোট ২৭টা আসন পেয়েছিল, সেখানে এবার তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৪'তে। ফলে, বাকি ১৩টি আসন গিয়েছে বিজেপির দখলে। ছত্তিশগড়েও অন্যান্যরা যেখানে ৬টি আসন পেয়েছিল এবার সে সংখ্যাটি ১। 'একলা চলো’র প্রবণতার পাশাপাশি রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের ভরাডুবির ‘কারণ’ হিসাবেও উঠে আসছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তবে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে আমার স্পষ্ট কথা, ওটা কংগ্রেসের কনজেনিটাল প্রবলেম। কংগ্রেসের বয়স যত, গোষ্ঠদ্বন্দ্বেরও বয়স তত। ফলে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে এলে আসল ত্রুটিটা আড়ালে চলে যায়। আড়ালে চলে যায় সাংগঠনিক দুর্বলতা, প্রচারে দিশাহীনতা। 

সমস্ত রকম অতীত তিক্ততা ভুলে ২৮টি বিজেপি-বিরোধী দল মুম্বইয়ে জোটের বৈঠকে হাজির হল, তা কাউন্টই করল না রাহুল গান্ধীর দল। যে বলিষ্ঠতা নিয়ে এই সেমিফাইনালে ইন্ডিয়া'র নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল কংগ্রেসের, গোটা দেশের কাছে চব্বিশের আগে জোটকে তুলে ধরা দরকার ছিল, তা করল না তারা। উলটে, সাধারণ মানুষের কাছে জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা রইল না। সব দলই চায় নিজের শক্তি বাড়াতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। রাহুল গান্ধীও তা চাইছেন। কিন্তু এটাও বাস্তব, গত চার দশক ধরে একার জোরে সারা দেশে বিরাজ করার মুরদ কংগ্রেসের নেই। এমনকী, গত প্রায় ২০ বছর ধরে রাহুল গান্ধী চেষ্টা করেও সফল হচ্ছেন না। কেউ যদি বলেন, কর্নাটক ও সদ্য জেতা তেলেঙ্গানাতে তো কংগ্রেস দেখিয়েছে! আমি বলব, সেটা যতটা কংগ্রেসের সাংগঠনিক কৃতিত্ব, তার চেয়ে অনেক বেশি রামের। হ্যাঁ, রামের। রামায়ণকারের পুরুষোত্তম রামের প্রভাব কোনওদিনই বিন্ধ্য পর্বত ডিঙোতে পারেনি। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। ২০১৯-এ বিজেপি একা ৩০৩টি আসন পেলেও দক্ষিণ ভারতের ১৩০টি লোকসভা আসনের মধ্যে মাত্র ২০টি জিতেছিল মোদী ম্যাজিকে। তাই তেলেঙ্গানা বিজয় দিয়ে কংগ্রেসের তেমন করে লাফানোর কিছু নেই। আর মনে রাখতে হবে, পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরিতে সনিয়া গান্ধীর একটা বড় ভূমিকা আছে। অন্ধ্রের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গিয়েই সনিয়া এ কাজটি করেছিলেন। ওই রাজ্যের মানুষ সনিয়াকে 'আম্মা' বলেই মনে করেন। এছাড়া, কেসিআর'এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী টিডিপি এবারের নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি, ফলে সেই ভোটটা কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছে। দক্ষিণের এই রাজ্যেও কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেনি। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তেলঙ্গানার মানুষ। তিনিও কংগ্রেসের দাদাগিরিতে ক্ষুদ্ধ হয়ে আলাদা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দেশের বৃহত্তম বামপন্থী দলটি সে রাজ্যের ১১৯টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি চেয়েছিল, তা দিতেও রাজি হয়নি রাহুল অ্যান্ড কোম্পানি। 

এই প্রেক্ষিতেই সোমবার দুপুরে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও মুখ খুলেছেন। ইন্ডিয়া জোটের সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য কংগ্রেসের সরাসরি সমালোচনা না করে পরোক্ষে তাদের 'একলা চলো’ নীতিকে দুষে ভুল সংশোধনের বার্তা দিলেন। তিনি বলেন, 'যাঁরা জয়ী, তাঁদের শুভেচ্ছা। পরাজিতদের বলব, ভুল শুধরে নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও শক্তিশালী হয়ে লড়াই করতে হবে। আমাদের হাতে সময় অনেক কম। সময় অপচয় না করে সকলের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। প্রথম দিন থেকে বলছি, যে যেখানে শক্তিশালী তাকে সেখানে লড়তে দেওয়া হোক। সেটা করলেই হয়তো এই বিপর্যয় হত না।' তবে ইন্ডিয়া জোটের শরিক হিসেবে তৃণমূল যে এই জয়কে সেমিফাইনাল বলতে নারাজ, তা অভিষেকের কথায় উঠে এসেছে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে তাই মনে করি। সেমিফাইনাল ব্র্যান্ড দেওয়াটা হয়তো পলিটিকাল চর্চার অঙ্গ কিন্তু ফলিত রাজনীতি তা বলে না। 

উল্লেখ্য, ২০১৯'এর লোকসভা ভোটের আগে ২০১৮ সালে এই ৩ রাজ্যেই হেরেছিল বিজেপি। ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের ভোটে কংগ্রেস জিতেছিল। তখন তো বিজেপি নেতারা বলেননি এটা মোদীর হার। বরং তখন বলা হয়েছিল, রাজ্যের ভোটের সঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই। আবার যদি ২০০৪-এ ফিরে যাই দেখব আরেক ন্যারেটিভ। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ২০০৩-এ হিন্দি বলয়ের এই ৩ রাজ্যে ভোটে জিতেছিল বিজেপি। কিন্তু লোকসভা ভোটে দেখা যায় ডাহা হেরে যায় গেরুয়া দল। ভরাডুবি হয় এনডিএ জোটেরও। রবিবার তিন রাজ্যে গেরুয়া ঝড় উঠতেই বিজেপি একটা ধারণা তৈরি করতে চাইছে যে নরেন্দ্র মোদী অপ্রতিরোধ্য। গোটা দেশে তাঁর সমর্থনে হাওয়া বইছে। রাজনীতি আসলে পার্সেপশনের খেলা। কে কী গ্রহণযোগ্য আখ্যান তৈরি করতে পারছে, তার ওপরেই নির্ভর করে অনেক কিছু। বিজেপির এই আখ্যানের পালটা আখ্যান নিয়েই ইন্ডিয়া জোটকে দ্রুত কৌশল তৈরি করতে হবে। 

পাঁচ রাজ্যের ভোটের মধ্যেই নীতীশ কুমার প্রশ্ন তুলেছিলেন, নেতৃত্বের ব্যাটন হাতে নিয়েও কংগ্রেস নেতারা কেন গুটিয়ে গেলেন। জেডিইউ প্রধানের বক্তব্য ছিল, এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে চার রাজ্যের বিধানসভা ভোট কংগ্রেসের কাছে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছে দিল্লির মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। ভারতের সংহতি ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে রক্ষা করাই জোটের আসল লক্ষ্য। কংগ্রেস বিধানসভা ভোটের জন্য লোকসভার লড়াইকে সাইড লাইনে বসিয়ে রাখতে পারে না।

নীতীশ কুমারের ওই বক্তব্যের জবাবে কংগ্রেস নেতৃত্ব হিরণ্ময় নীরবতা রক্ষা করেছে।  এখন মহাবিপর্যয়ের পর কংগ্রেস হাই কমান্ডের টনক নড়েছে। নিজেদের জয় নিশ্চিত ভেবে নিয়ে হাত শিবিরের প্রাদেশিক নেতারা জোটধর্ম বিসর্জন দিয়ে ভোটে প্রার্থী দেওয়া ও প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন। ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলোকে একটা-দুটো আসন ছেড়ে দিয়ে, আগামী দিনের জন্য বড় বার্তা দেওয়া যেত, তা ভেবে দেখেননি। উলটে, বিজেপিকে যে ভাষায় আক্রমণ করেছে, শরিক দলগুলোকেও তেমন ভাষায় আক্রমণ করেছে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেস ধরতেই পারেনি, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল যত লড়াইয়ের মাঠটাকে বড় করে জাতীয় রাজনীতির অংশ করে নিচ্ছে, কংগ্রেস ততই প্রাদেশিক করে তুলেছে ভোটযুদ্ধকে। অথচ কংগ্রেস খেয়াল রাখেনি, ২০১২ সাল থেকে হিন্দি বলয়ে ক্রমেই গেরুয়া শিবির বড় হয়েছে আর কংগ্রেস জমি হারিয়েছে৷ আর এই জমি হারিয়েছে নরম হিন্দুত্ব করতে গিয়ে। রাম লালা বনাম রাম গমন পথ করতে গিয়ে এবার জমি হারালো মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে। রামই পথ- এই যদি কট্টর হিন্দুত্ব হয়, তবে সেই মাঠে রামের গমন পথ নিয়ে কত দূর লড়তে পারে কমলনাথ-মার্কা কংগ্রেস-হিন্দু নেতারা! 

অথচ মধ্যপ্রদেশে বিজেপির মসনদ ধরে রাখার লড়াই সহজ ছিল না। রাজ্যে ২০ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সেখানে নরেন্দ্র মোদী শিবরাজ সিং চৌহানকে সামনে ঠেলে না দিয়ে নিজেই এগিয়ে গেলেন। নিজেকে মধ্যপ্রদেশবাসীর কাছে গ্যারান্টার করে তুলে ধরলেন। পাশে ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রীর জনকল্যাণমুখি প্রকল্পের জনপ্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ করতে না পেরে সামনে নিয়ে আসা হল 'মহাদেব' অ্যাপ কেলেঙ্কারি। আরেক রাজ্যে কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তিই তার জয়ের যেমন কাণ্ডারী হতে পারত, তেমন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও ছিঁড়ে খেল কংগ্রেসকে। জাদুকরের ভূমিকা হল, পথে বসা। তিন রাজ্যে এই  আলাদা আলাদা চ্যালেঞ্জ ছিল বিজেপির সামনে। তিন চ্যালেঞ্জেই একেবারে দাপটের সঙ্গে উতরে গেল বিজেপি। সৌজন্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা মোদী ম্যাজিক। কার্যত 'ব্র্যান্ড মোদী' বনাম 'ব্র্যান্ড রাহুল' খেলায় কংগ্রেস কুপোকাত। 

এখনও সময় আছে। আমার বিবেচনায়, জোটধর্ম যথাযথ পালন হলে লোকসভা ভোটে এই তথাকথিত সেমিফাইনালের প্রভাব পড়বে না। INDIA জোটের প্রভাব থাকবে। দেশে বিজেপিকে হারানোর লড়াইতে নেতৃত্ব শুধু কংগ্রেসের একার দেওয়ার কম্মো নয়, আঞ্চলিক দলগুলিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সামনে রেখে কংগ্রেসকে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করতে হবে।


Saturday, 2 December 2023

আসুন, একটু সলজ্জ হই

চারধামের রাজনীতি বনাম জীবন সংশয়

মালবিকা মিত্র



সতেরো/ আঠারো দিনের টানটান উত্তেজনার অবসান হল। আমরা দেশের জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে কামনা করেছি, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছি একচল্লিশ জন শ্রমিকের উদ্ধারের আশায়। একটা করে উদ্যোগ একটা নতুন আশা জাগিয়েছে। তারপর সেই উদ্যোগের ব্যর্থতা, আমেরিকান মেশিনের বিকল হওয়া, উল্লম্ব খনন প্রক্রিয়া, একটির পর একটি আশা ও হতাশা অতিক্রম করেছি। অবশেষে হাতুড়ি ছেনি গাঁইতিতে ভরসা করে, সাবেক প্রাচীন পদ্ধতির কায়িক শ্রমে সাফল্য এল।

টানটান উত্তেজনার ঘোর কাটার পরেই এবার আমাদের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠবে, অন্তত ওঠা উচিত। এ তো রেল লাইনের নিচ দিয়ে দশ/ বারো গজ লম্বা সাবওয়ে তৈরি করা নয়, সাড়ে চার কিলোমিটার সুড়ঙ্গ। সেই ১০/১২ গজের অনুমতিও রেল দফতর ৩০ বছরে দেয় না। তাহলে? 

∆ সংবাদে প্রকাশ, গোড়ার দিকে সুড়ঙ্গে হিউম পাইপের ব্যবহার ছিল। ওই হিউম পাইপ দিয়ে ভেতরের বিষাক্ত বাতাস বাইরে বের করা হয়। আর বাইরের মুক্ত বাতাস ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। কোনও ধস নামলে শ্রমিকরা আপৎকালীন অবলম্বন হিসেবে ওই পাইপে আশ্রয় নিতে পারেন ও তারপর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেন। জানা গেল, দীপাবলীর কিছুদিন আগে ওই হিউম পাইপ সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনা হয়েছিল। পাইপটি থাকলে এত বড় বিপদ ঘটত না। 

∆ প্রশ্ন উঠছে, শ্রমিকদের বাঁচাতে ট্রেঞ্চ কেজ ব্যবহার হয়ে থাকে। ধস নামার সম্ভাবনা দেখলেই শ্রমিকরা কংক্রিটের ওই কেজ বা খাঁচাগুলিতে আশ্রয় নিতে পারেন। সুড়ঙ্গে এমন কোনও ট্রেঞ্চ কেজ ছিল না। সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য মোটামুটি সাড়ে চার কিলোমিটার। সাধারণত দেড় কিলোমিটারের বেশি সুড়ঙ্গ হলেই সেখানে আপৎকালীন বাইরে আসার রাস্তা বা এসকেপ প্যাসেজ থাকার কথা। সুড়ঙ্গের নকশায় সেই প্যাসেজ দেখানো হলেও বাস্তবে সেটা ছিল না। নির্মাণকর্তারা তবে কি খরচ বা সময় বাঁচাতে এটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন? 

∆ প্রশ্ন উঠছে খোদ সুড়ঙ্গ বানানোর যৌক্তিকতা নিয়ে। কারণ, ওই অঞ্চলের ভূমির চরিত্র নিয়ে বলা হয়েছে এটি ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চল। ১৯৯১ সালে উত্তর কাশিতে ভূমিকম্পে ২০০০'এর বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। রিক্টার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৬.৮। বলা হয়, কতকগুলি টেকটনিক প্লেটের উপর সমগ্র পৃথিবীর অবস্থান। টেকটনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্লেটগুলির সংযোগস্থল ও সেই বরাবর চ্যুতি রেখার নিকটস্থ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকে বেশি।  বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিও প্লেট এই দুইয়ের সংযোগস্থলে যে চ্যুতি রেখা, তার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের লোকেশন এই সংযোগস্থল ও চ্যুতির রেখার খুব কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কেন এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হল? বলাই বাহুল্য, সম্ভাব্য বিপদ, পরিবেশ, বিশেষজ্ঞদের মতামতের থেকেও এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় আবেগ উস্কানির উদ্দেশ্যে চারধাম প্রকল্পটি অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তুলনায় এখানকার পাহাড় চরিত্রগতভাবে অনেক বেশি ভঙ্গুর, মূলত পাললিক শিলা ও স্লেট পাথরের আধিক্য বেশি, যা অনেক নরম ও ভঙ্গুর। এইরকম ক্ষেত্রে সুড়ঙ্গ তৈরির অনুমতি দেওয়া হল কীভাবে? 

∆ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, সাড়ে চার কিলোমিটার সুড়ঙ্গ তৈরির আগে তার ভূ-বিশ্লেষণ হয়েছে মাত্র তিনটি নমুনাকে ভিত্তি করে। শ্রমিকদের কথায় জানা যায়, উপরি স্তরে শক্ত অংশ ভেদ করার পর ভেতরে অধিকাংশই মাটি। ফলে, ধস নামা খুব স্বাভাবিক। আমাদের পরিচিত বন্ধুরাও, যারা পর্বতারোহণ করেন নিয়মিত, বলেছিলেন, গঙ্গোত্রী যমুনোত্রীর পথে মাটি ও ছোট নুড়ি পাথরের আধিক্য বেশি। ফলে, ধসের সম্ভাবনা থাকে। অভিযাত্রী বা তীর্থযাত্রীদের নিয়ে সমস্যা নয়, তাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন করতেই যান, তাঁবু অস্থায়ী ছাউনিতে রাত কাটান। নিয়মিত পর্যটন ও বিনোদন হল সমস্যা। যত বেশি দূর অবধি বাস রাস্তা নিয়ে যাওয়া হবে, ততই ব্যবসার রমরমা। অতএব পায়ে চলার রাস্তা নয়, পাকা রাস্তা চাই। মেটাল রোড, চওড়া ফোর লেন রাস্তা চাই। তারকা হোটেল চাই। আরও বিদ্যুৎ চাই, বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই। 

∆ এ তো গেল নেপোদের দই মারার কথা। এই ১৭/ ১৮ দিনের উৎকণ্ঠা কি আরও কিছু শিক্ষা দিল না? যান্ত্রিক শ্রম আর মানবিক শ্রমের তফাত'টা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তাহলে গল্পটা বলি। আমার ইস্যু করা একটা চেক ব্যাঙ্কের সিস্টেম রিফিউজ করেছে। কারণ হিসেবে অটো-জেনারেটেড মেসেজ এল। আমি একই সঙ্গে তিন/ চারটি চেক বই ইউজ করছি। এটা অন্যায়। তাই আমার ইস্যু করা চেক রিফিউজড। একটা অবাস্তব অভিযোগ। ব্যাঙ্কে গেলাম। ব্যাঙ্ক কি একজনকে একাধিক বই ইস্যু করে? ব্যাপারটা হল, একটা লোনের ইএমআই হিসেবে পোস্ট-ডেটেড চেক, একটা এলআইসি'কে ইস্যু করা চেক বইয়ের শেষ চেক, আর একটি নতুন চেক বইয়ের প্রথম চেক। তিনটি একই সঙ্গে ক্লিয়ার হতে গিয়ে কম্পিউটার সিস্টেম দেখছে, তিনটি চেক পৃথক পৃথক সিরিজের। তাই সিস্টেম গ্রহণ করছে না। ম্যানুয়েল কাজে এই সমস্যা ক্লার্কের বোধগম্য হয়। যন্ত্রে হয়নি। আগার মেশিন সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে পাথর, মাটি, লোহা চেনেনি। ফলে, সুড়ঙ্গের ভিতরে লোহায় তার কাটার বা ব্লেড ক্ষতিগ্রস্ত। আর মানবিক কায়িক শ্রম চিনে-জেনে-বুঝে খুঁড়তে জানে। এখানেই তফাত। 

∆ আমেরিকার আগর মেশিন খননকার্যের জন্য আনা হয়েছিল। জানা নেই সেই মেশিনের জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু মানবিক ও কায়িক শ্রমের মজুররা জানিয়েছেন, আমরাও শ্রমিক। ৪১টি শ্রমিক পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এর জন্য কোনও অর্থ নেব না। এই মজুররা শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদ জানেন না, 'দুনিয়ার মজুর এক হও' শ্লোগানের মর্মার্থ বোঝেন না। এরা রাষ্ট্রের চোখে খনি এলাকার বেআইনি খননকারী। শ্রমিক শ্রেণির দর্শন থাকলেই হয় না। গতরে মগজে শ্রমিক হতে হয়। অন্যথায় হাঁসজারু বকচ্ছপ। 

∆ এই ১৭/১৮ দিনের আরও কিছু মূল্যবান শিক্ষা আমরা পেয়েছি। না আমি বলব না, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে জয়ী হলে বা পরাজিত হলে যেমন ভিন্ন ভিন্ন চিত্রনাট্য অগ্রিম তৈরি থাকে, তেমনি উদ্ধারকার্য সফল বা ব্যর্থ হলে কোন নাটকের অবতারণা হবে, সে সব কথা বলব না। ৪০ জন জওয়ানের জীবনের দাম নিয়ে যারা রাজনীতি করতে পারে, ৪০/৪১ জন মজুরকে নিয়েও তারা সেটা করবে এতে আশ্চর্য হই না। বিজেপির প্রচার কমিটি 'মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়' প্রচার করবে ও করেছে। এমনকি এই ঘটনাকে পাঠ্যপুস্তকে স্থান করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। 

∆ এমনকি সংবাদ মাধ্যমগুলি এই ঘটনাকে নিয়ে কীভাবে স্টোরি তৈরি করবে, গদি মিডিয়া কীভাবে তা পরিবেশন করবে, সবই আমাদের জানা। সংবাদ মাধ্যমের দেউলিয়াপনা প্রকাশ পায় পিটিআইয়ের প্রকাশ করা ওই রাতের একটি ছবি। জাতীয় পতাকা হাতে সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। বিভিন্ন পত্রিকায় সেটা প্রকাশ পেল। আবার পরদিন পিটিআই জানালো ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নির্মিত, অতএব, ছবিটি যেন প্রকাশ করা না হয়। এও বিচিত্র শঠতা- ছবিটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা গেল, তারপর আবার সৎ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে তুলেও নেওয়া হল। ততক্ষণে যা হবার তা হয়েও গেল। 

∆ আরও উল্লেখযোগ্য, শেষ পর্বের উদ্ধারের ১২ জন নায়ক, তাদের মধ্যে সাত জনের নাম মনে রাখার মতো। ওয়াকিল হাসান, নাসির খান, মুন্নাহ কুরেশি, ইরশাদ আনসারি, রশিদ আনসারি, নাসিম মালিক। এরা সবাই দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পীড়িত অঞ্চলের বাসিন্দা । আর যে দেশের প্রধানমন্ত্রী পোশাক দেখে, দাঁড়ি দেখে শনাক্ত করেন জঙ্গি দাঙ্গাবাজ কারা, তিনি নিশ্চয়ই নামগুলি থেকেই এঁদের শনাক্ত করতে পারবেন। কদিন আগে ক্রিকেটে ভারতের পেসার মহম্মদ শামি একবার প্রধানমন্ত্রীর মুখে কালি মাখিয়েছেন। সিল্কিয়ারা আরও একবার। শুধু তো মোদি না, আমরা অনেকেই তো বলে থাকি, যত খুন খারাবি অপরাধ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নামগুলো দেখবেন। আসারাম বাপু, বাবা রামরহিম বা ব্রিজভূষণ নামগুলো আমাদের কানে ঠেকে না। তাই সিল্কিয়ারা আমাদের সামনে প্রকৃত ভারতকে আরও একবার স্পষ্ট করে দিল। আমাদেরও মুখে একটু কি কালি লাগেনি! লুকাবো কোথায়?


Sunday, 26 November 2023

ডিপফেক ও AGI

যাহা পাই তাহা গিলি?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কিছুদিন আগেও বিশ্ব জুড়ে DeepFake বা গভীর ছলনা নিয়ে এক ঝড় বয়ে গেল। ফটোশপ বা সুপার-ইমপোজিশনের যুগ পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি এমন এক নিখুঁত ও নির্ভুল ছলনার জগতে যেখানে সত্য-মিথ্যার সমস্ত সূক্ষ্ম রেখাগুলিও বোধহয় অযাচিত হয়ে পড়েছে। যেন কোনও উপায় নেই, ফাঁকিটুকু বুঝে ওঠার! ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়, তাই ভাবি মনে?’- এ তো আশার ছলনে ভুলি নয়, বাটপাড়ির ষোলআনা। ‘ছিল বেড়াল হয়ে গেল রুমাল’এর মতো হাঁটছিল কলকাতার গলি ধরে, চলে গেল বাকিংহাম প্রাসাদের সদর দরজায়। হামেশাই হচ্ছে।

সোরগোল উঠল, যখন এই মাসের গোড়ায় কন্নড় অভিনেত্রী রশ্মিকা মানদানা’র একটি ফেক ভিডিও ইন্টারনেটে তুমুল ভাইরাল হল এবং অভিনেত্রী স্বয়ং তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ব্রিটিশ অভিনেত্রী জারা প্যাটেলের একটি খোলামেলা ভিডিও’তে রশ্মিকা’কে প্রতিস্থাপন করে নকলটিকে ভাইরাল করা হয়। যতক্ষণ না সেই ভিডিও রশ্মিকা’র দৃষ্টিগোচর হয়েছে ও তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ততক্ষণ অবধি কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতেই পারেননি যে ভিডিও’টি ফেক। এই অবধি না হয় কিছুটা বোঝা গেল। কিন্তু সেই ফেক ভিডিও’টি কে তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেছে, তা আজও জানা যায়নি। কারণ, দিল্লি পুলিশের তদন্তে মেটা জানিয়েছে, ইতিমধ্যে সেই ভিডিওটি হৈচৈ শুরু হওয়ার পরে শুধুমাত্র ডিলিট করা হয়নি, যে অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর অ্যাকাউন্ট’টি যেহেতু বানানো হয়েছিল ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)’এর মাধ্যমে ভুয়ো পরিচয় দিয়ে, তাই তার নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।

এরপর দেখা গেল, বিনোদন জগতে ক্যাটরিনা কাইফ, কাজল প্রমুখদের ছাপিয়ে ডিপফেক ভিডিও তৈরি হল এমনকি রতন টাটা’র নামেও, যেখানে একটি অনলাইন বেটিং’এ অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে সকলকে আহ্বান জানাতে দেখা গেল। সাম্প্রতিক ইজরায়েল-হামাস সংঘাতের আবহেও দেখা দিল এমনতর নানাবিধ ফেক ভিডিও’র রমরমা যা দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করার প্রবল চেষ্টা। অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় অসত্য প্রচার এখন এমন গভীরতা পেয়েছে যাকে সাদা চোখে সত্য বলে মেনে নেওয়া অতীব সহজতর হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে এখন এসে পৌঁছেছে ‘generative AI’এর স্তরে; যেখানে তার তথ্য ভাণ্ডার আরও স্ফীত হয়েছে এবং গণনা সক্ষমতা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে সে নিত্য নতুন ‘সৃষ্টিশীল’ নির্মাণেও সক্ষম। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হ্যানি ফারিদ জানাচ্ছেন, ‘প্রতি ১২ মাসে প্রযুক্তি দ্বিগুনতর সক্ষম ও দ্রুততর হয়ে উঠছে।’ এই প্রবণতা আমাদের কোন ভবিষ্যৎ পানে নিয়ে চলেছে, আমরা জানি না, কিন্তু চ্যাটজিপিটি’র উদ্গাতা ওপেনএআই’এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান’কে নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে যা হয়ে গেল, তাও এক আশ্চর্যজনক ঘটনা বৈকি! ডিপফেক’এর সঙ্গে এই ঘটনার কি কোনও সংযোগসূত্র আছে?

আচম্বিতে দেখা গেল, স্যাম অল্টম্যানকে ‘ওপেনএআই’এর পরিচালন বোর্ড বরখাস্ত করেছে এই অভিযোগে যে, তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাণিজ্যিক লাভালাভের বাসনায় এমন এক পর্যায়ে নিয়ে চলেছেন যেখানে সমগ্র মানবজাতির সামনে এক সমূহ বিপদ উপস্থিত। সেই বিপদ কী, তা নিয়ে ততটা বিস্তৃত না হলেও বলা হল, Project Q* নামক এমন এক অ্যালগরিদমের উদ্ভাবন করা হয়েছে যার দরুণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনও প্রশিক্ষণমূলক তথ্য ব্যতিরেকেই নিজের সক্ষমতাতে প্রাথমিক গণনার সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারে। তা যদি পারে, তাহলে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পৌঁছে যাবে Artificial General Intelligence (AGI)’এর এমন এক স্তরে যা তাকে মানব মস্তিষ্কের সমকক্ষ করে তুলতে পারে। এই AGI হল মানুষের যুক্তি-তর্ক সমতুল্য এক পরিণত সক্ষমতা। তেমন হলে, মনুষ্যজাতির পক্ষে তা এক চরম বিপদের কারণ হতে পারে- এই অনুমানে ওপেনএআই’এর একদল গবেষক বোর্ডের কাছে চিঠি দিলে ভীত-চকিত বোর্ড তাদের কর্ণধার স্যাম অল্টম্যানকে সংস্থা থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর আমরা জানি, জল অনেক দূর অবধি গড়ায়। মাইক্রোসফট বরখাস্ত হওয়া স্যাম অল্টম্যানকে তাদের কোম্পানিতে নিয়োগ করে এবং পাশাপাশি, ওপেনএআই’এর প্রায় ৭০০ কর্মচারী স্যামকে নিজেদের কোম্পানিতে পুনর্বহালের জন্য পরিচালন বোর্ডের কাছে আবেদন জানায়। স্যাম ফিরে আসেন এবং যে বোর্ড তাকে বরখাস্ত করেছিল, তা তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে দেন। আপাতত স্যাম আবার ওপেনএআই’এর সিইও হিসেবে পুনর্নিয়োজিত হয়েছেন। তাহলে কি AGI সম্পর্কিত যে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিল তা অমূলক ছিল, নাকি, সেই লক্ষ্যেই আবার নতুন করে ওপেনএআই তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগোতে থাকবে?

এই প্রসঙ্গের উত্থাপন এই কারণেই যে, ‘ডিপফেক’ প্রবণতা বা AGI- এমন এক সম্ভাবনা ও আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে সত্য-মিথ্যার সমস্ত রসায়ন দ্রবীভূত হয়ে এক আশ্চর্য মায়াজগৎ নির্মাণ করে চলেছে। সাদা চোখে দেখে বোঝার উপায় থাকবে না, কোন তথ্যটা মিথ্যে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাধারণজনের কাছে সেইসব উন্নত টুল’ও নেই যা দিয়ে তারা দুধ থেকে জলকে আলাদা করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোও মিথ্যাচারের উৎস সন্ধানে সদা বাধ্য নয়। তার ওপর, এমন সব প্রযুক্তিরও উদ্ভাবন হয়েছে, যা দিয়ে মেঘনাদের মতো মেঘের আড়াল থেকে তীর বর্ষণ করা যায়, যাদের নাগাল পাওয়া কখনও কখনও নিতান্তই দুষ্কর।

আমরা এসে উপস্থিত হয়েছি এমন এক কঠিন বাতাবরণে যেখানে বহু এলেমদার প্রযুক্তিবিদদেরও মাথার ঘাম ছুটে যাচ্ছে যথাযথ তথ্যের নাগাল পেতে। উল্টোদিকে, ডিপফেক তৈরি করতে এমন সব সহজ টুল এসে গিয়েছে যে তা যে কোনও সামান্য স্মার্ট ফোনে আঙ্গুল চালানো প্রতারকের পক্ষে একেবারেই আয়াসসাধ্য। সেলিব্রিটিদের ভিডিও ও অডিওকে একশো শতাংশ নিখুঁত রেখে যে কোনও পণ্যের প্রমোশনে ডিপফেক বানানো এখন জলভাত। কোনও কোম্পানির কর্ণধার আরেক কোম্পানির কর্ণধারের কাছ থেকে এমন সব ‘বিশ্বাসযোগ্য’ কল পাচ্ছেন যে সেই সুবাদে কোটি কোটি টাকার প্রতারণামূলক ট্রান্সফারের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও এখন আকছার দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকদের কাছে তাদের কচি বাচ্চাদের ‘অপহরণ’ হয়ে যাওয়ার এমন সব কল ও ইমেজারি আসছে যে তারা বিশ্বাস করে ‘মুক্তিপণ’ দিয়ে ফেলছেন। এরপর AGI আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলতে পারে, তা ভাবতে গিয়েও শিউরে উঠছেন কেউ কেউ। আর সে কারণেই স্যাম অল্টম্যানকে নিয়ে এত হাঙ্গামা হয়ে গেল।

তাহলে উপায়? অবশ্য এমনও নয় যে, জামতারার মতো ডিপফেক, প্রতারণা ও রোজগারের এক সর্বজনীন উপায় হয়ে উঠবে অথবা AGI’এর ‘স্বাধীন’ যুক্তি-তর্ক আমাদের সর্বদাই ভুল পথে নিয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতিটা এই যে, এক নতুন লড়াইয়ের জমিতে এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি যেখানে সত্য-মিথ্যার প্রাথমিক বয়ানটুকুও হয়তো হারিয়ে যেতে বসেছে। হ্যানি ফারিদ বলছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূর হঠো। সংবাদ পরিবেশনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নির্মিত হয়নি; তা হয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অবসর যাপনের জন্য। অতএব, আমাদের অলস প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করতে হবে। ‘যাহা পাই তাহা গিলি’ নয়, যা পেলাম তাকে যদি যথার্থই দেখতে-বুঝতে হয় তাহলে চিন্তাশক্তিকে প্রখর করতে হবে, অন্যান্য সমজাতীয় তথ্য ও সংবাদের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নিতে হবে। জগৎ বড়ই জটিল, তাকে ৩০ সেকেন্ডের টিকটক ভিডিও’তে বন্দী করে ফেললে নিজেরই মুশকিল।’

এ এক মহারণ বটে। এতদিন প্রযুক্তি ছিল মানুষের সহায়ক হিসেবে। এখন উলটো পথে বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়ক হিসেবেই মানুষ কাজ করতে পারদর্শী হয়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত অভিঘাত প্রযুক্তির হাতে মহাকালের রথের ঘোড়ার রশিকে অর্পণ করেছে। AGI হয়তো সেই প্যারাডাইম শিফটকে আপাত এক সম্পূর্ণতা দেবে। হয়তো এটাই ভবিতব্য। কিন্তু মানুষের লড়াই তো চৈতন্যের ভূমিতে নির্মিত হয়। একদিন প্রকৃতির খামখেয়ালিকে নিজ চৈতন্যে অধিষ্ঠিত করেই মানুষ তার নিয়ম ও সূত্রকে বুঝে নিজের সভ্যতা নির্মাণ করেছে। আজও সেই চৈতন্যের আলোকেই সে বুঝে নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামগ্রিক সত্তাকে। সেদিনও যেমন উদ্বৃত্তভোগী ও প্রতারকেরা সমকালের প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের বৃহৎ অংশকে বঞ্চিত করেছে, আজও সে প্রক্রিয়া সমভাবেই সক্রিয়। একইভাবে সেই বঞ্চিত বৃহৎ অংশ যেমন প্রতিরোধের লড়াই দিয়েছে, নতুন পথ নির্মাণ করেছে, আজও সে লড়াই অব্যাহত। প্রশ্নটা আদপে তাই প্রযুক্তির নয়, নিজ নিজ চৈতন্যের।