শেয়ার বাজারই কি মুখ্য বাসভূমি হয়ে উঠছে?
ভাস্কর সিংহ রায়
শেয়ার বাজার বহুদিন বাঙালি মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে একটি নিষিদ্ধ জায়গা ছিল। তাঁদের অধিকাংশ ভাবতেন, এখানে জুয়া খেলা হয় এবং সর্বস্বান্ত হয়ে ওঠার একটি জায়গা এটা। অবশ্য কিছু মানুষ শেয়ার নিয়ে চর্চা করতেন, কেউ কেউ বিনিয়োগও করতেন। শেয়ার বাজারের অস্থিরতায় বহু মানুষ যেমন সর্বস্বান্ত হয়েছেন আবার কিছু মানুষ অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। শেয়ার বাজারে বিভিন্ন সময় ধস নেমেছে, কিছুদিনের জন্য কিছু মানুষ শেয়ার বাজার থেকে মুখ ঘুরিয়েছেন আবার নতুন মানুষ এর সাথে যুক্ত হয়েছেন। আজকাল শেয়ার বাজারে বহু মানুষের যুক্ত হওয়ার কারণ অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। এখন সরাসরি শেয়ার কেনাবেচা করা যায় মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটারে বসেই; ব্রোকার বা সাব-ব্রোকারদের উপর কেনাবেচার ক্ষেত্রে নির্ভরতা কমেছে বটে কিন্তু তাদের ছাড়া কেনাবেচা করা যায় না। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশের শেয়ার বাজারকে এখন ধরে রেখেছেন খুচরো বিনিয়োগকারীরা, যাদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শেয়ার বাজারে যারা বিনিয়োগ করেন তাঁদের কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদী বা স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টি থেকে বিচার করেন। আবার কেউ বা ফাটকা খেলার মনোভাব নিয়েও আসরে নামেন। অবশ্য এই মনোভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এ কথা বলে নেওয়া উচিত, প্রসারিত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শেয়ার বাজারকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মানুষ শেয়ার বাজার মারফতই কার্যকরী বিনিয়োগ করে থাকেন। একজন শিল্পপতির কোম্পানির শেয়ারের মূল্য এবং তাঁর কত শেয়ার আছে- তার ওপর নির্ভর করে তাঁর সম্পদের পরিমাণ। শেয়ারের মূল্য বাড়ার হিড়িক দেখে অনেকেই প্রলুব্ধ হন সেখানে বিনিয়োগ করে নিজেকে বিত্তশালী করে তুলতে। আবার শেয়ারের পতন হলে অনেকে ভাবেন, কম দামে যা পাওয়া যাচ্ছে এখনই কিনে রাখা ভালো। কোম্পানির শেয়ারের সঠিক মূল্যায়ন করা ভীষণ কঠিন কাজ। কোন্ দামে শেয়ার কেনা এবং কোন্ দামে বিক্রি- এর উপরেই নির্ভর করে শেয়ার বাজারে সফল ও ব্যর্থ ব্যক্তির উপাখ্যান।
ধরা যাক রিলায়েন্স অথবা টাটা কোম্পানি গত কুড়ি বছরে বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা এমনকি ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত রিটার্ন পেয়েছেন। আবার দেখা গেছে, বর্তমান মূল্যে অনেকে শেয়ার কেনার পর দু-এক মাসের মধ্যেই বাজারে ক্রয়মূল্য থেকে ৩০-৪০ শতাংশ দাম পড়ে গেছে। তাই বলাই বাহুল্য, শেয়ার বাজারে সমস্ত বিনিয়োগ ঝুঁকি সাপেক্ষ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এই ঝুঁকি অব্যাহত থাকবে। বিশ্ব বাজারের বিভিন্ন ঘটনার ওপর শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন নির্ভর করে। অনেক সময় শেয়ার বাজারে দেশিয় বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ে। আবার ফরেন ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরস (FII) বা ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (FDI) যে সমস্ত কোম্পানি করে তাদের হঠাৎ করে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ায় শেয়ার মার্কেটে ধস নামে। আমরা করোনার সময় শেয়ার বাজারের ঊর্ধ্বগতি দেখেছিলাম যার সঙ্গে সেই কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থানের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। এছাড়াও, High Networth Individual আমাদের দেশে প্রচুর আছেন যারা অনেকটাই শেয়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
ভারতীয়দের মধ্যে সোনা কিনে রাখার প্রবণতা বিশ্বের মধ্যে সর্বোত্তম। সোনা সারা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে বিনিময় করা যায়। সোনার লিকুইডিটি খুব ভালো আর সেটাই ভারতীয়দের মধ্যে সোনা কিনে রাখার প্রাবল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়াও অলংকার হিসেবে সোনার ব্যবহারও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটের বিনিয়োগে গত শতকের নয়ের দশকের পরে প্রচুর বিনিয়োগকারী এসেছিলেন এবং বেশ ভালো লাভ পেয়েছিলেন। এই প্রোমোটার চক্র- হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে যাওয়া কিছু মানুষদের- আমরা গত ২০-৩০ বছরে দেখতে পাচ্ছি; এরা প্রধানত জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোও এদের সঙ্গে আছে। তাদের ব্যাঙ্কের কাছে প্রচুর পরিমাণে দেনা এবং অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা ভারতবর্ষে বর্তমানে অবিক্রিত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বহু। অনেক সাধারণ মানুষও বিনিয়োগকারী হিসেবে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন কিন্তু এখন বিক্রি করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, কারণ, এদের লিকুইডিটি অনেক কমে গেছে। যতটা লাভ করবেন ভেবেছিলেন সেটা সম্ভব হচ্ছে না এবং ব্যাঙ্কের তরফে পুরনো ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে লোন দেওয়া অনেকটাই কমে গেছে। যারা ইএমআই দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তাদের অনেকেই ডিফল্টার হয়েছেন এবং ব্যাঙ্ক এইসব ফ্ল্যাট নিলাম করছে। নব্বইয়ের দশকে বা এই শতাব্দীর প্রথম দশকের মতো ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের প্রবণতা এখন আর আকর্ষণীয় নেই।
তাহলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার জায়গা কোথায়? ব্যবসায়ীদের স্টকে তাদের ব্যবসার মূলধনের সঙ্গে তাদের বিনিয়োগ হয়ে থাকে কিন্তু সাধারণ মানুষ আজকাল অনেকেই অতএব এই শেয়ার বাজারে ঢুকেছেন বিষয়টি প্রায় কিছু না বুঝেই। চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় এখন সকলেই শেয়ার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন এবং ছুটকো-ছাটকা লাভ করেছেন এরকম লোক দেখা যায় যারা নিজেদের সীমিত জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন অকাতরে।
সম্প্রতি লাইফ ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) বাজারে ইনিশিয়াল পাবলিক অফার (IPO) নিয়ে এসেছিল। বহু মানুষ আবেদন করেছিলেন, পেয়েছেন প্রায় সবাই। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই আইপিও কুড়ি শতাংশ পড়ে গেছে লিস্টেড প্রাইস থেকে। এখন ভবিষ্যতে দাম বাড়বে এই আশায় অনেকে বসে আছেন। আবার কিছু মানুষ এই দামে শেয়ার কিনে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন। গত পাঁচ বছরে বহু মানুষ ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলেছেন শেয়ারে কেনাবেচা করার জন্য। ঝুঁকি সাপেক্ষ এই বিনিয়োগের বাইরে আমাদের অন্য কোনও উপায় আছে বলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না, কারণ, ফিক্সড ডিপোজিট'এর ওপরে সুদের হার সরকার কমিয়ে দিচ্ছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড'এর উপরেও সুদ কমে যাচ্ছে। পোস্ট অফিসের সঞ্চয়েও সুদ পড়তির দিকে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে- এই অবস্থায় পুঁজি বিনিয়োগ অথবা টাকা জমানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের পক্ষে। তবুও, সঞ্চয় মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে লোভনীয় রিটার্নের হাতছানি। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত মানুষের কর্মসংস্থানের সুরক্ষা, অবসরের পরে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসার গ্যারান্টি, সর্বোপরি, অর্থনৈতিক সুরক্ষা ভীষণভাবে প্রশ্নের মুখে। প্রশ্নটা শুধু দারিদ্র্যের নয়, প্রশ্নটা নিশ্চয়তা এবং সরকারের ভূমিকা নিয়েও।
একটি দেশের শেয়ার বাজারের অগ্রগতি নির্ভর করে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার ওপর। অথচ আমরা দেখেছি, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া বা সেবি বহু ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। ইনসাইড ট্রেডিং'এর ঘটনা বহু ঘটেছে। অর্থাৎ, কৃত্রিম ভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তারপরে হঠাৎ করে পতন শুরু করিয়ে দেওয়া হয়। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের প্রধান এবং তাঁর পরিবারের লোকজন এই সমস্ত ইনসাইড ট্রেডিং সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি। রেগুলেটরি অথরিটির ওপর মানুষের ভরসা যদি না থাকে তাহলে যে কোনও বিনিয়োগকারী, সে ক্ষুদ্র হোক বা বৃহৎ, ঝুঁকি-সাপেক্ষ বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবেন না। মধ্যবিত্তদের এই সংকটকালে চোখ কান খোলা রেখে আয় এবং বিনিয়োগ করে যেতেই হবে, না হলে মুদ্রাস্ফীতির গ্রাস তাকে অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দেবে। এর সাথে স্বাস্থ্য-শিক্ষার অধিকার ও জীবন বীমার প্রয়োজনীয়তাও সমান গুরুত্বের।
শেয়ার বাজার নিয়ে যে কোনওরকম আলোচনায় দেখতে পাবেন, অনেকেই নিজেদের কাছে কিছু তথ্য থাকাটাকেই যথেষ্ট বলে মনে করেন। এখন ইন্টারনেটের যুগে সারা পৃথিবীর শেয়ার বাজারের খবর, তার উত্থান-পতন ও বিভিন্ন তথ্য পাওয়াটা খুব একটা কষ্টকর বিষয় নয়। অনেকেই মনে করেন, তাঁরা যে তথ্য পাচ্ছেন কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেটাই যথেষ্ট। বারবার এই ধরনের তথ্যের উপর নির্ভর করে, কোম্পানির তথ্য খতিয়ে দেখেও শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ভ্যালুয়েশন ঠিক মনে করে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে উপায় কী? আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যের উপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব নাকি জানার চেষ্টা করব শেয়ার বাজারের রহস্যকে? এর উত্তর অজানা। তথ্য বলছে, কিছু সংখ্যক মানুষ সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদে রিটার্ন'এর কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগ করে যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন। আসলে, একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া যেমন দেখা যায়, দুম করে পড়ে যাওয়াও দেখা যায়।
আসলে, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শেয়ার বাজারকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। এ বিষয়ে পড়াশোনা ও তথ্য সংগ্রহ করে যেতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি এবং অন্যান্য প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে এই বাজার অর্থনীতির ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই এগিয়ে চলতে হবে। এর বিকল্প এখনও অবধি দেখা যাচ্ছে না। শেয়ার বাজারে সাধারণ ভারতীয়রাও বেশি বেশি করে ঢুকে পড়ছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্থান-পতনকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে নিচ্ছেন, লাভক্ষতির পেন্ডুলামে দোল খাচ্ছেন- এই এখন ঘোরতর বাস্তব চিত্র।