Wednesday, 29 June 2022

শেয়ার বাজারের আমি তুমি

শেয়ার বাজারই কি মুখ্য বাসভূমি হয়ে উঠছে?

ভাস্কর সিংহ রায়


শেয়ার বাজার বহুদিন বাঙালি মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে একটি নিষিদ্ধ জায়গা ছিল। তাঁদের অধিকাংশ ভাবতেন, এখানে জুয়া খেলা হয় এবং সর্বস্বান্ত হয়ে ওঠার একটি জায়গা এটা। অবশ্য কিছু মানুষ শেয়ার নিয়ে চর্চা করতেন, কেউ কেউ বিনিয়োগও করতেন। শেয়ার বাজারের অস্থিরতায় বহু মানুষ যেমন সর্বস্বান্ত হয়েছেন আবার কিছু মানুষ অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। শেয়ার বাজারে বিভিন্ন সময় ধস নেমেছে, কিছুদিনের জন্য কিছু মানুষ শেয়ার বাজার থেকে মুখ ঘুরিয়েছেন আবার নতুন মানুষ এর সাথে যুক্ত হয়েছেন। আজকাল শেয়ার বাজারে বহু মানুষের যুক্ত হওয়ার কারণ অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। এখন সরাসরি শেয়ার কেনাবেচা করা যায় মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটারে বসেই; ব্রোকার বা সাব-ব্রোকারদের উপর কেনাবেচার ক্ষেত্রে নির্ভরতা কমেছে বটে কিন্তু তাদের ছাড়া কেনাবেচা করা যায় না। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশের শেয়ার বাজারকে এখন ধরে রেখেছেন খুচরো বিনিয়োগকারীরা, যাদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শেয়ার বাজারে যারা বিনিয়োগ করেন তাঁদের কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদী বা স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টি থেকে বিচার করেন। আবার কেউ বা ফাটকা খেলার মনোভাব নিয়েও আসরে নামেন। অবশ্য এই মনোভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এ কথা বলে নেওয়া উচিত, প্রসারিত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শেয়ার বাজারকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মানুষ শেয়ার বাজার মারফতই কার্যকরী বিনিয়োগ করে থাকেন। একজন শিল্পপতির কোম্পানির শেয়ারের মূল্য এবং তাঁর কত শেয়ার আছে- তার ওপর নির্ভর করে তাঁর সম্পদের পরিমাণ। শেয়ারের মূল্য বাড়ার হিড়িক দেখে অনেকেই প্রলুব্ধ হন সেখানে বিনিয়োগ করে নিজেকে বিত্তশালী করে তুলতে। আবার শেয়ারের পতন হলে অনেকে ভাবেন, কম দামে যা পাওয়া যাচ্ছে এখনই কিনে রাখা ভালো। কোম্পানির শেয়ারের সঠিক মূল্যায়ন করা ভীষণ কঠিন কাজ। কোন্ দামে শেয়ার কেনা এবং কোন্ দামে বিক্রি- এর উপরেই নির্ভর করে শেয়ার বাজারে সফল ও ব্যর্থ ব্যক্তির উপাখ্যান।

ধরা যাক রিলায়েন্স অথবা টাটা কোম্পানি গত কুড়ি বছরে বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা এমনকি ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত রিটার্ন পেয়েছেন। আবার দেখা গেছে, বর্তমান মূল্যে অনেকে শেয়ার কেনার পর দু-এক মাসের মধ্যেই বাজারে ক্রয়মূল্য থেকে ৩০-৪০ শতাংশ দাম পড়ে গেছে। তাই বলাই বাহুল্য, শেয়ার বাজারে সমস্ত বিনিয়োগ ঝুঁকি সাপেক্ষ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এই ঝুঁকি অব্যাহত থাকবে। বিশ্ব বাজারের বিভিন্ন ঘটনার ওপর শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন  নির্ভর করে। অনেক সময় শেয়ার বাজারে দেশিয় বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ে। আবার ফরেন ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরস (FII) বা ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (FDI) যে সমস্ত কোম্পানি করে তাদের হঠাৎ করে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ায় শেয়ার মার্কেটে ধস নামে। আমরা করোনার সময় শেয়ার বাজারের ঊর্ধ্বগতি দেখেছিলাম যার সঙ্গে সেই কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থানের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। এছাড়াও, High Networth Individual আমাদের দেশে প্রচুর আছেন যারা অনেকটাই শেয়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

ভারতীয়দের মধ্যে সোনা কিনে রাখার প্রবণতা বিশ্বের মধ্যে সর্বোত্তম। সোনা সারা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে বিনিময় করা যায়। সোনার লিকুইডিটি খুব ভালো আর সেটাই ভারতীয়দের মধ্যে সোনা কিনে রাখার প্রাবল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়াও অলংকার হিসেবে সোনার ব্যবহারও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটের বিনিয়োগে গত শতকের নয়ের দশকের পরে প্রচুর বিনিয়োগকারী এসেছিলেন এবং বেশ ভালো লাভ পেয়েছিলেন। এই প্রোমোটার চক্র- হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে যাওয়া কিছু মানুষদের- আমরা গত ২০-৩০ বছরে দেখতে পাচ্ছি; এরা প্রধানত জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোও এদের সঙ্গে আছে। তাদের ব্যাঙ্কের কাছে প্রচুর পরিমাণে দেনা এবং অবস্থা এখন অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা ভারতবর্ষে বর্তমানে অবিক্রিত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বহু। অনেক সাধারণ মানুষও বিনিয়োগকারী হিসেবে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন কিন্তু এখন বিক্রি করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, কারণ, এদের লিকুইডিটি অনেক কমে গেছে। যতটা লাভ করবেন ভেবেছিলেন সেটা সম্ভব হচ্ছে না এবং ব্যাঙ্কের তরফে পুরনো ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে লোন দেওয়া অনেকটাই কমে গেছে। যারা ইএমআই দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তাদের অনেকেই ডিফল্টার হয়েছেন এবং ব্যাঙ্ক এইসব ফ্ল্যাট নিলাম করছে। নব্বইয়ের দশকে বা এই শতাব্দীর প্রথম দশকের মতো ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের প্রবণতা এখন আর আকর্ষণীয় নেই। 

তাহলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার জায়গা কোথায়? ব্যবসায়ীদের স্টকে তাদের ব্যবসার মূলধনের সঙ্গে তাদের বিনিয়োগ হয়ে থাকে কিন্তু সাধারণ মানুষ আজকাল অনেকেই অতএব এই শেয়ার বাজারে ঢুকেছেন বিষয়টি প্রায় কিছু না বুঝেই। চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় এখন সকলেই শেয়ার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন এবং ছুটকো-ছাটকা লাভ করেছেন এরকম লোক দেখা যায় যারা নিজেদের সীমিত জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন অকাতরে।

সম্প্রতি লাইফ ইন্সুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) বাজারে ইনিশিয়াল পাবলিক অফার (IPO) নিয়ে এসেছিল। বহু মানুষ আবেদন করেছিলেন, পেয়েছেন প্রায় সবাই। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই আইপিও কুড়ি শতাংশ পড়ে গেছে লিস্টেড প্রাইস থেকে। এখন ভবিষ্যতে দাম বাড়বে এই আশায় অনেকে বসে আছেন। আবার কিছু মানুষ এই দামে শেয়ার কিনে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন। গত পাঁচ বছরে বহু মানুষ ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলেছেন শেয়ারে কেনাবেচা করার জন্য। ঝুঁকি সাপেক্ষ এই বিনিয়োগের বাইরে আমাদের অন্য কোনও উপায় আছে বলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না, কারণ, ফিক্সড ডিপোজিট'এর ওপরে সুদের হার সরকার কমিয়ে দিচ্ছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড'এর উপরেও সুদ কমে যাচ্ছে। পোস্ট অফিসের সঞ্চয়েও সুদ পড়তির দিকে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে- এই অবস্থায় পুঁজি বিনিয়োগ অথবা টাকা জমানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের পক্ষে। তবুও, সঞ্চয় মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে লোভনীয় রিটার্নের হাতছানি। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত মানুষের কর্মসংস্থানের সুরক্ষা, অবসরের পরে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসার গ্যারান্টি, সর্বোপরি, অর্থনৈতিক সুরক্ষা ভীষণভাবে প্রশ্নের মুখে। প্রশ্নটা শুধু দারিদ্র্যের নয়, প্রশ্নটা নিশ্চয়তা এবং সরকারের ভূমিকা নিয়েও। 

একটি দেশের শেয়ার বাজারের অগ্রগতি নির্ভর করে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার ওপর। অথচ আমরা দেখেছি, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া বা সেবি বহু ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। ইনসাইড ট্রেডিং'এর ঘটনা বহু ঘটেছে। অর্থাৎ, কৃত্রিম ভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তারপরে হঠাৎ করে পতন শুরু করিয়ে দেওয়া হয়। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের প্রধান এবং তাঁর পরিবারের লোকজন এই সমস্ত ইনসাইড ট্রেডিং সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন সম্প্রতি। রেগুলেটরি অথরিটির ওপর মানুষের ভরসা যদি না থাকে তাহলে যে কোনও বিনিয়োগকারী, সে ক্ষুদ্র হোক বা বৃহৎ, ঝুঁকি-সাপেক্ষ বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবেন না। মধ্যবিত্তদের এই সংকটকালে চোখ কান খোলা রেখে আয় এবং বিনিয়োগ করে যেতেই হবে, না হলে মুদ্রাস্ফীতির গ্রাস তাকে অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দেবে। এর সাথে স্বাস্থ্য-শিক্ষার অধিকার ও জীবন বীমার প্রয়োজনীয়তাও সমান গুরুত্বের।

শেয়ার বাজার নিয়ে যে কোনওরকম আলোচনায় দেখতে পাবেন, অনেকেই নিজেদের কাছে কিছু তথ্য থাকাটাকেই যথেষ্ট বলে মনে করেন। এখন ইন্টারনেটের যুগে সারা পৃথিবীর শেয়ার বাজারের খবর, তার উত্থান-পতন ও বিভিন্ন তথ্য পাওয়াটা খুব একটা কষ্টকর বিষয় নয়। অনেকেই মনে করেন, তাঁরা যে তথ্য পাচ্ছেন কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেটাই যথেষ্ট। বারবার এই ধরনের তথ্যের উপর নির্ভর করে, কোম্পানির তথ্য খতিয়ে দেখেও শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ভ্যালুয়েশন ঠিক মনে করে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে উপায় কী? আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ভাগ্যের উপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব নাকি জানার চেষ্টা করব শেয়ার বাজারের রহস্যকে? এর উত্তর অজানা। তথ্য বলছে, কিছু সংখ্যক মানুষ সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদে রিটার্ন'এর কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগ করে যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন। আসলে, একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া যেমন দেখা যায়, দুম করে পড়ে যাওয়াও দেখা যায়। 

আসলে, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শেয়ার বাজারকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। এ বিষয়ে পড়াশোনা ও তথ্য সংগ্রহ করে যেতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি এবং অন্যান্য প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে এই বাজার অর্থনীতির ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই এগিয়ে চলতে হবে। এর বিকল্প এখনও অবধি দেখা যাচ্ছে না। শেয়ার বাজারে সাধারণ ভারতীয়রাও বেশি বেশি করে ঢুকে পড়ছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্থান-পতনকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে নিচ্ছেন, লাভক্ষতির পেন্ডুলামে দোল খাচ্ছেন- এই এখন ঘোরতর বাস্তব চিত্র।


Monday, 27 June 2022

চব্বিশে পাকবে ঘুঁটি?

শিন্ডে থেকে দ্রৌপদী

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 


 

মোদীর পাখির চোখ চব্বিশে। একের পর এক ঘুঁটি সাজিয়ে যাচ্ছেন সেই লক্ষ্যে। মাতশ্রী থেকে রায়সিনা- বিজেপি প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলছে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে কণ্টকশূন্য করতে। মাঝখানে রয়েছে দেড় বছরের মধ্যে ১০ লাখ লোকের চাকরির ললিপপ। রয়েছে 'অগ্নিবীর' বানানোর সংকল্প। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, বড় ধরনের কিছু না ঘটে গেলে নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবু একটি প্রকৃত ফ্যাসিস্ট দল চায়, দেশের কোনও প্রান্তেই কোনও ভিন্ন স্বর থাকবে না। থাকবে না অন্য রঙ। তারই ছবি ফুটে উঠেছে মরাঠা মুল্লুকে। 

আরব সাগরে ঢেউ উঠেছে, ভেঙে গিয়েছে সেনার শৃঙ্খল। একনাথের দাবি অনুযায়ী, বিক্ষুব্ধ বিধায়কের সংখ্যা যা তাতে সরল পাটিগণিতের হিসেবেই মহাবিকাশ আগাড়ি সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাজনীতি এক মহাগণিতশালা। সেখানে কখন যে পাটিগণিতের সঙ্গে বীজগণিত মিশে যায়, কখন যে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অ্যালজেব্রা খেলে দেবে তা বোঝা মুশকিল। এই যে সুরাতের থেকে গুয়াহাটি বেশি সুরক্ষিত ভেবে বিজেপি একনাথ ও তাঁর বাহিনীকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, তারপরেও কিন্তু শিন্ডে বলছেন, বিজেপিতে যোগ দেবেন না। যদিও সুরাতের হোটেলে এই বিধায়কদের জন্য ৩৫টি ঘর কে ফোনে বুক করেছিলেন তা এখনও স্পষ্ট নয়, উপরন্তু, হোটেলের ভাড়া ও খরচ না মিটিয়েই বিধায়কেরা গুয়াহাটি পালিয়েছেন বলে অভিযোগ। এই যথেচ্ছাচার করার সাহস এ দেশে কার আছে তা সকলেই জানেন! বালাসাহেবের ব্র্যান্ড ভ্যালু ভাঙাতে চাইছেন বিজেপি মদতপুষ্ট বিদ্রোহী শিবসৈনিকরা। গুয়াহাটি বিমানবন্দরে নেমেই তাই একনাথ শিন্ডেকে বলতে হয়, ‘আমার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের আরও ৪০ জন বিধায়ক রয়েছেন। আমরা বালাসাহেব ঠাকরের শিবসেনা ছাড়িনি, ছাড়বও না।’ এই যে নাম্বার থ্রো- তা পার্টনারের হাতে কী কী তাস আছে অনুমান করে কল দেওয়ার মতো। রিয়েলিটি এখানে অনেক দূরের ব্যাপার। 

তবে লক্ষণীয়, শিন্ডে বিজেপিতে যোগ দেবেন না বলছেন। এর প্রধান কারণ, বালাসাহেব ঠাকরের উত্তরাধিকার ছাড়লে একনাথও একা হয়ে যেতে পারেন। মরাঠা অস্মিতা ত্যাগ করার শামিল হবে বিজেপির পতাকা হাতে নিলে। শোনা কথা, মঙ্গলবার বিদ্রোহী দলপতি একনাথ শিন্ডের সঙ্গে ফোনালাপ হয় উদ্ধব ঠাকরের। সেই  ফোনালাপে শিন্ডে বিজেপির সঙ্গেই জোট বাঁধার দাবি জানিয়েছেন। জবাবে নাকি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এর আগে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার মূল্য চোকাতে হয়েছে শিবসেনাকে। ফের কী করে বিজেপির ওপর ভরসা রাখা সম্ভব! এটাও ঠিক, একনাথও প্রকাশ্যে বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার কথা না বললেও, মঙ্গলবার তিনি বালাসাহেব ঠাকরের হিন্দুত্ববাদের যে শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছিলেন ট্যুইটে, তাতে পরবর্তী ধাপে হিন্দুত্ববাদকে বাঁচিয়ে রাখতে বিজেপির সঙ্গেই হাত মেলাতে আগ্রহী। এখন তো বলাই যায়, শিন্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। 

গুয়াহাটিতে ঘাঁটি গেড়েও বিধায়কদের জন্য লাগছে ওয়াই ক্যাটেগরির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা। কেন? ওঁরা কি ফের পালটি খেতে পারেন? এটা ঠিক, জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী হিসেবে শিবসেনার যে পরিচয় ছিল, গত আড়াই বছরে উদ্ধবের হাতে তা জাত খুইয়েছে। বিজেপি এটাকে ক্যাশ করে দান ফেলছে মোদীয় মডেলে। যেমন, নরেন্দ্র মোদীর মাস্টারস্ট্রোক দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করা। বিরোধী শিবিরের ডিফেন্স চিরে থ্রু। ২০২৪-এ যদি উনিশের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসতে পারে, তবে মোদী সরকার আরএসএস'এর সবকটা অ্যাজেন্ডা পূরণ করে দেবে। সেই দিক থেকে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ মোদী-শাহদের কাছে। রামনাথ কোবিন্দর মতোই তাঁদের একজন পুতুল রাষ্ট্রপতি চাই। যদিও অ-পুতুল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মোদী সরকারকে কোনও বাগড়া দেননি। কিন্তু এবারের বিরোধীদের প্রার্থী যশবন্ত সিনহা, যিনি আবার গত পাঁচ-ছ' বছর ধরে মোদীর তুমুল সমালোচক। ফলে, কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ মোদী। তবে এরপরেও মনে করি, এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের লড়াইটা এক কথায় নরম হিন্দুত্ববাদী বনাম চরম হিন্দুত্ববাদীর লড়াই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বাজপেয়ীপন্থী বিজেপির সঙ্গে মোদীপন্থী বিজেপির লড়াই। রায়সিনায় পৌঁছে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরের গোষ্ঠী কোন্দলের আঁচ। 

এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার আগে নবীন পাঠকদের জানিয়ে রাখি, যেদিন ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদকে মেনে নিয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সেদিনই রায়সিনা হিলসে প্রবেশ করেছিল হিন্দুত্ববাদী কর্তৃত্ব; ১৯৫২ সালেই সোমনাথ মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার শিলান্যাসে রাজেন্দ্র প্রসাদের যোগ দেওয়া নিয়ে যা প্রকাশ্যে এল। নেহরুর মত ছিল, একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার দেশে সরকার কোনও একটি বিশেষ মন্দির নির্মাণে টাকা ঢালবে না। পাশাপাশি, সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের প্রাচীন ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসে নেহরু সাম্প্রদায়িক আবেগে উসকানি দিতে চাননি। দক্ষিণপন্থী ঐতিহাসিক কানহাইয়া লাল মুন্সির ‘পিলগ্রিমেজ টু ফ্রিডম’ বইটিকে উদ্ধৃত করে নেহরু সম্পর্কে আরএসএস নেতাদের আক্রমণ, তিনি সোমনাথ মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘিরে হওয়া উৎসবকে ‘হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণ’ হিসেবে উল্লেখ করে সমালোচনা করেছিলেন। দুই, নেহরুর আপত্তি তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ওই শিলান্যাসের পুজোয় উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তৃতাও দেন। সংঘের দাবি, সেই বক্তৃতাকেও নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন নেহরু। নাগপুরের তৃতীয় অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মন্দির নির্মাণে কোনও অর্থ দিতে চাননি নেহরু। আলবাৎ চাননি। নেহরু বিশ্বাস করতেন, আধুনিক ভারতের মন্দির হচ্ছে নদী বাঁধ। ঠিক যেমন ২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বেঙ্গালুরুতে একটি আইটি পার্ক উদ্বোধনে গিয়ে নেহরুর সুরেই বলেছিলেন, 'আমার মতে, আধুনিক অর্থনীতিতে আধুনিক ভারতের মন্দির হল আইটি পার্ক ও সফটওয়্যার সংস্থার ক্যাম্পাস।' দেখুন, দুই লিবারেল হিন্দুর কী অসাধারণ মিল! 

আজ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে ৭০ ও ২০ বছর আগের ঘটনা টেনে এনে অ্যানালজি টানছি কেন? কারণ, দেশটা এখন দক্ষিণপন্থীদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা চালিত হচ্ছে। তাঁরাই আদিবাসী তাস খেলছেন দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করে। মধ্য-দক্ষিণ ও মধ্য-বামদের ট্র্যাজেডি হল, এই খেলায় তাঁরা বাজপেয়ীপন্থী এক হিন্দুত্ববাদী নেতাকে সামনে নিয়ে এলেন। হয়তো বাধ্য হয়েই এনেছেন, কেন না, শরদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লাহ বা গোপালকৃষ্ণ গান্ধী- কেউই লড়াইয়ে নামতে রাজি নন। যশবন্ত সিনহার ঘরানা যেহেতু মূলত বিজেপি তাই মোদী-শাহদের ঘর ভাঙার একটা আশঙ্কা আছে। বাজপেয়ী ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত যশবন্ত সিনহা দলের গোষ্ঠী রাজনীতির শিকার। নরেন্দ্র মোদীর লার্জার দ্যান পার্টি ইমেজ নিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই যশবন্তের দুর্দিন শুরু হল। যদিও এই যশবন্ত সিনহাই কিন্তু গুজরাত দাঙ্গার সময় লালকৃষ্ণ আদবানির মতো মোদীর হয়ে ব্যাট করেছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহকে সঙ্গে নিয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ কব্জা করতে গিয়ে প্রথমেই 'খরচার খাতায়' রাখলেন তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক লালকৃষ্ণ আদবানিকে। তারপর ডানা ছাঁটলেন আরেক আদবানি ঘনিষ্ঠ রাজনাথ সিংয়ের। একইসঙ্গে একজন স্বৈরাচারী নেতার মতো অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ ও লেখাপড়া জানা, প্রশাসন চালানোয় দড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যাক বেঞ্চে পাঠালেন। মোদী-শাহ শিবিরের চাপে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ২০১৮ সালে যশবন্ত দলত্যাগে কার্যত বাধ্য হন। তারপর থেকেই মোদী ক্যাম্পকেই তিনি চাঁদমারি বানিয়েছেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। ২০২১ সালে তৃণমূলে যোগ দেন যশবন্ত। আজ যশবন্ত সিনহা বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল-সহ বিরোধী দলগুলোর প্রার্থী হলেও মোদী শিবিরের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে লড়াই আসলে যশবন্তের সঙ্গে মোদী শিবিরের লড়াই। 

প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকা ক্ষতবিক্ষত এক প্রাক্তন বিজেপি নেতা মরিয়া চেষ্টা করছেন দলের বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে ধাক্কা দেওয়ার। গেরুয়া শিবিরের অন্দরের লড়াইকে সুকৌশলে রায়সিনা হিলস পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছেন যশবন্ত। বিরোধী শিবিরকে কাছে টেনে এই লড়াই জেতার জন্যই নিজেকে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্যাকেজিং-এ পেশ করেছেন। আর বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে সিপিআইএম-কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলোকে প্রাক্তন বিজেপি সহ-সভাপতি ও তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সহ-সভাপতিকে সমর্থন করতে রাজি হতে হয়েছে। এটাই সম্ভবত এই সময়ের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। 

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, এর ফলে বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের বাতাবরণ আরও জোরালো হবে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। কিন্তু এসবই ঘোলাজলে মাছ ধরার ব্যাপার। আমার বিশ্বাস, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী জোটের ছবি লোকসভা ভোটের দামামা বাজলেই ধাক্কা খাবে। যে ধাক্কা ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্রে দিয়ে দিয়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্রের সাফল্যের পরই দীনদয়াল মার্গের ম্যানেজারদের নজরে রাজস্থান। সেখানেও ইডি-সিবিআই সক্রিয় আর শচিন পাইলটের মতো বিক্ষুব্ধরা তো আছেনই। ভোটে না জিতে সরকার করার রাজনৈতিক আর্ট নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ রপ্ত করে নিয়েছেন। ফলে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো ছেলে-ভোলানো নির্বাচন নিয়ে মোদীর তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু লড়াইটা যখন গেরুয়া শিবিরের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ তখন যশবন্ত কিছুটা হলেও মোদী-শাহকে চিন্তিত করেছে। নইলে মনোনয়ন জমা দিয়েই দ্রৌপদী সনিয়া গান্ধী-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করতেন না। শুধু মমতা আর সনিয়াকে ফোন করলেও না হয় বুঝতাম যে, মহিলা হিসেবে দেশের দুই প্রধান মহিলা রাজনীতিককে ফোন করেছেন। কিন্তু দ্রৌপদী মুর্মু এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারকেও ফোন করেছেন। অনেকের মতে এটা প্রথা হলেও, আমার স্থির বিশ্বাস, মোদীর ইঙ্গিত না পেলে 'আদিবাসী' দ্রৌপদীর হিম্মত হত না এই ফোন করার। আসলে মোদীও মেনে নিয়েছেন, দ্রৌপদী-যশবন্তের লড়াই মূলত বিজেপির নরমপন্থী বনাম চরমপন্থীর লড়াই। এ লড়াইয়ে মোদী যত সাফল্য পাবেন, বিরোধী শিবির ততই ছত্রখান হবে আর ২০২৪ -এর লোকসভা ভোটে বিজেপির আসন সংখ্যা হয়তো জেনিথ পয়েন্টে পৌঁছে যাবে।


Wednesday, 22 June 2022

একটি ব্যতিক্রমী আলোচনা

শরীরের অধিকার ও অন্যান্য

শোভনলাল চক্রবর্তী


বাংলা প্রবন্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আলোচনাসভায় স্বপ্নময় চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, 'কেবল ভগবদ্গীতা মেড-ইজ়ির আলুসেদ্ধ খেলে হবে না, নব্যন্যায়ের সজনে ডাঁটা-ও বাঙালির পাতে পড়া চাই।' অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় 'শরীরের স্বত্ব ও স্বরূপ' বইটি পড়তে বসে বার বার এই কথাগুলো মনে পড়ছিল।

বইটিতে রয়েছে দুটি বড় প্রবন্ধ। প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম 'শরীরের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্র'। এখানে প্রশ্নটা গোলমেলে- ‘আমি’ আর ‘আমার শরীর’ দুটো কি এক? বিজ্ঞান তাই বলে, অথচ বিজ্ঞান-অনুগতরাও প্রিয়জনের মৃত্যুতে টলে যায়। অকালমৃত বান্ধবীর উদ্দেশে লেখা হয় কবিতা- 'তোকে দাহ করে ফিরতে কত রাত হল/ তুই এক বার ফোন করে খবর নিলি না।' অভিমানী প্রশ্ন, আবার গুরুতরও বটে। শরীর চলে গেলেই কি কর্তব্যের অবসান? প্রশ্নগুলো বাঙালি পাঠকের কাছে তুলেছেন অর্ধেন্দু। দিগ্দর্শীদের চিন্তার সন্ধান দিয়ে উস্কে দিতে চেয়েছেন শরীর-চিন্তা। ব্যক্তি, চেতনা, রাষ্ট্র ও শরীর—  এরা কোথায় আলাদা, কেনই বা রক্ত-মাংসের শরীরকে ঘিরে ঘৃণা-তাচ্ছিল্য-মুগ্ধতার ভাবোচ্ছ্বাস। লেখক দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞানের নানা গলিতে তার খোঁজ করেছেন। চিন্তা চিবিয়ে যাদের সুখ, তেমন উৎসুকচিত্ত পাঠকের কাছে বইটির এই প্রবন্ধটি একটি মূল্যবান সম্পদ।

মস্তিষ্ক, চেতনা, আমিত্ববোধ— আলাদা না কি অভিন্ন? ‘মস্তিষ্কই আমি’- এ দাবি কি মানা যায়? স্নায়ুবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব, মনের দর্শন- এ সব পরতে পরতে খুলে মেলে ধরে বলতে হয়, ঠিক যেমন বইয়ের বিদ্যা-বিজ্ঞানকে কাগজ-আঠা-সুতোয় পর্যবসিত করা চলে না, তেমনই মগজ-স্নায়ু-রক্ত দিয়ে চেতনা তৈরি হলেও, প্রেম বা কল্পনাকে মগজে পর্যবসিত করা চলে না। মস্তিষ্ক আর চেতনা, এই দুইয়ের মধ্যে ‘দ্বন্দ্বসহিষ্ণু’ সম্পর্ক। অসুস্থ শরীর নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা শুরু করেছেন লেখক, তা নিয়েও একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। অসুখজনিত ব্যথার অনুভূতি হয় কেবল রোগীর, অথচ, অসুখের কারণ ও প্রতিকার জানেন শুধু ডাক্তার। মাঝে রয়েছেন সেবাকর্মী, যিনি বার বার ‘কেমন লাগছে’ প্রশ্ন করে জেনে নেন অনুভূতি-নির্ভর বর্ণনা। সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে ডাক্তার ফের চিকিৎসা নির্ধারণ করেন। অসুখের জ্ঞানতত্ত্ব (এপিস্টেমোলজি) তাই সেবা-পরিচর্যার নৈতিকতার (এথিকস) সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। নৈতিকতা শুধু নিরাময়ে নয়, রোগীর ডাকে সাড়া দেওয়াতে— ‘শুশ্রূষা’ মানেই তো শোনার ইচ্ছা। এখানে মনে হয়, অসুখ যেন শরীরের একটা ডাক, একটা চাহিদা, একটা দাবি।... অসুখের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার শারীরিক-সামাজিক অন্য নির্ভরতা, ক্ষত-যোগ্যতা, দরদ-উৎকণ্ঠার দরকারের জানান দেয়। রোগীর শিয়রে চুপ করে বসে থাকা কমলালেবুটিরও যেন সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার একটা দায়িত্ব জন্মে যায়।

শরীরের এই দাবি মানলে বলা যায় যে, আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগীকে একা ফেলে রাখা শুধু ক্লেশকর নয়, অনৈতিক। বিচ্ছিন্নতাই এক অ-সুখ। ভাল থাকা কী, কাকে বলে অসুখ, পরিচর্যা বা নিরাময়কে কী ভাবে দেখব, তার অনুসন্ধানকে বলা চলে ‘ব্যাধির দর্শন’। দর্শন চর্চার একটি নতুন আঙ্গিক। লেখক অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টি থেকে মানবদেহ নিয়ে বিচার করেছেন। এ দেহ ঘর নাকি খাঁচা, চির-আশ্রয় নাকি ক্ষণিকের বিশ্রামস্থল, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও 'মাই বডি, মাই রুলস' ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত তা সামনে এনেছেন।

দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম 'ধর্ষণের অপরাধতত্ত্ব' বিতর্কিত এবং সময়োপযোগী বিষয় সন্দেহ নেই। ১৯৭৬ সালে স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান পত্রিকায় একটি অদ্ভুত বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন: 'আপনি কি ধর্ষক? গবেষক আপনার সাক্ষাৎকার নিতে ইচ্ছুক। পরিচয় ‍লুকিয়ে বেনামে আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। কল করুন …. নম্বরে।' তিনি ভাবেননি কোনও ফোন কল পাবেন। কিন্তু একের পর এক বেজে উঠল ফোন। ২০০টি ফোন কলে কথা বললেন তিনি। বিচিত্র সব ঘটনার মুখোমুখি হলেন। টেলিফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী যিনি তাঁর বান্ধবীকে ধর্ষণ করেছেন; একজন চিত্রশিল্পী, যিনি তাঁর পরিচিত একজনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন। একজন স্কুল অভিভাবক যিনি ১০-১৫টি ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা করেছেন। স্মিথ ৫০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর গবেষণার ভিত্তি: The Undetected Rapist। স্মিথিম্যানের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল এই যে, কত স্বাভাবিক ছিল তাদের কণ্ঠস্বর, আর কত বিচিত্র তাদের ভিত্তিমূল।

স্মিথিম্যান ছিলেন একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। 'সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স' গবেষণা-পত্রিকার সম্পাদক শেরি হ্যাম্বি মনে করেন, ‘আপনি যদি অপরাধীকে বুঝতে না চান, আপনি যৌন-আগ্রাসনকেও বুঝতে পারবেন না।' এ লক্ষ্যে অনেক গবেষক ধর্ষণকে গবেষণায় বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেমন, মার্টিন এল লালুমিয়েরে, গ্র্যান্ট টি হ্যারিস, ভারনন এল কোয়েনসি, মারনি ই রাইস, আন্তোনিয়া অ্যাবি। ধর্ষণ বিষয়ে সবার মত অভিন্ন নয়। শেরি যেমন মনে করেন, 'যৌন আগ্রহ থেকে যৌন নির্যাতন ঘটে না, বরং মানুষকে দমিত বা নিয়ন্ত্রণে রাখাই ধর্ষণের উদ্দেশ্য।' কিন্তু অনেকেই মনে করেন, যৌন আগ্রহ থেকেই ধর্ষণের জন্ম। ধর্ষণের নানা ধরনের ব্যাখ্যা আছে: সমাজতাত্ত্বিক, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক, আইনতাত্ত্বিক ইত্যাদি। কোনওটিই পরস্পর সম্পর্কবিহীন নয়। তাই বলে এ মীমাংসা কেউ মেনে নেননি যে, ধর্ষণ মূলত মনস্তাত্ত্বিক রোগ। কোনও কোনও ধর্ষকের ক্ষেত্রে মনোরোগ প্রভাব ফেললেও ধর্ষণ মূলত একটি যৌন অপরাধ। অন্য সব অপরাধের মতো ধর্ষণও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ধর্ষক কী ভাবে? তার মনের জগতের ভাবনা কী? আচরণিক মনোবিজ্ঞান, যৌন মনোবিজ্ঞান, সমাজ-মনস্তত্ত্ব নানাভাবে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেগুলোর সরলীকৃত রূপ কেমন তা নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে প্রবন্ধটিতে। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ধর্ষকের মনোরোগ নেই; সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউ কেউ অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা ধর্ষণ করে থাকলেও ধর্ষণ করার সঙ্গে মনোরোগের সম্পর্ক অনিবার্য নয়। ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব কোনও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আদলে গড়ে ওঠে না। একেক ধর্ষক একেক রকম মনোভঙ্গি প্রকাশ করে থাকে। প্রত্যেকের শ্রেণি, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান এক নয়। এ কারণে ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব একটি মাত্র প্রবণতা দ্বারা গঠিত নয়। তবে সব ধর্ষকই নারীকে যৌনবস্তু মনে করে থাকে; নারীর সম্মতি ধর্ষকের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।

সামগ্রিকভাবে মনে হয়, ধর্ষণকে শুধু ঘটনা হিসেবে না দেখে ধর্ষকের মনস্তত্ত্বের পাঠ নেওয়াও জরুরি। একজন ধর্ষকের ধর্ষক হয়ে ওঠার কার্যকারণ ‍অনেক ধরনের। শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা, ধর্ষণ ও ধর্ষকের ব্যাখ্যা, ধর্ষণের অনেক ঘটনাকেই ব্যাখ্যা করতে পারে না। যেমন ধরা যাক, বিবাহিত পুরুষ কর্তৃক ছেলে বা শিশু ধর্ষণ, পঞ্চাশোর্ধ্ব বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষ কর্তৃক ছেলে বা মেয়ে শিশু ধর্ষণ। সমাজের নিম্ন শ্রেণিরাই ধর্ষণ করে এই ধারণাও ব্যাখ্যা করতে পারে না পুরুষতন্ত্র বিষয়ক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আসলে কে ধর্ষক নয়? এটিই একটি গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন; কারণ যে কোনও পেশা, শ্রেণি, বয়সের মানুষ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত কিংবা ধর্ষকামী মনোবৃত্তি পোষণ করে। আমাদের দেশে এই বিষয়ক গবেষণা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে অর্ধেন্দু এমন একটি কাজ রেখে গেলেন, যার পরিসর অপরিসীম। সম্ভাব্য ধর্ষক নির্মূল করতে গবেষণাফল সহায়তা করতে সক্ষম হতে পারে। 

বইটির প্রচ্ছদ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। যেমন দাবি রাখে প্রকাশনার মান, নির্ভুল বানান, ছাপার ভুল বর্জিত একটি বই, যা আজ প্রায় বিরল। সব শেষে অর্ধেন্দুকে প্রশংসা করব তাঁর লেখক পরিচিতির জন্য। তিনি লিখেছেন, 'লেখক কতখানি চিন্তাক্ষম তা বহন করে তাঁর লেখা। আর সেটাই লেখকের একমাত্র পরিচয়।' হক কথা।


Saturday, 18 June 2022

‘অগ্নিপথ’এর দাবানল

ধারাবাহিক অনাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুব বিদ্রোহ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

‘অগ্নিপথ’এ দাউ দাউ দাবানল। উত্তরপ্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানা, বিহার থেকে রাজস্থান, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এই দাবানলের দাবদাহে পুড়ছে বিভেদ-জঞ্জালের স্তূপ। এই মুহূর্তে উত্তাল দেশের অন্তত ১৩টি রাজ্য। গত কয়েক বছর ধরে ধর্মের রাজনীতি দিয়ে যে তীব্র বিভাজন, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল, তা যেন নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বিহারে উপ-মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত এই রোষানল পৌঁছে গেছে, সাসারামে ভস্মীভূত হয়েছে ধর্মীয় বিষবাষ্পের জনকদের দলীয় কার্যালয়। এতদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন কোভিড-উত্তর পরিস্থিতির খোলা হাওয়ায় সজোরে আছড়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পর আবারও এক জন-জাগরণ।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান- যার একমাত্র সুরাহা হতে পারে অর্থবহ কর্মসংস্থানে, সেই পরিসরটিকেই সংকুচিত করতে করতে দেশের সরকার এমন এক খাদের কিনারায় এনে আমাদের সকলকে দাঁড় করিয়েছে যে নিস্তারের পথ খুঁজতে মানুষের বেপরোয়া হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। অন্তত সেনাবাহিনীতে নিয়োগ ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের যে সুযোগ এতদিন ছিল, তাকেও অকেজো করে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার যখন ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের ঘোষণা করল, তখন বিপর্যস্ত যুব সমাজের সামনে বিদ্রোহে ফেটে পড়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা অবশিষ্ট ছিল কী?

বলা হল, চলতি বছর থেকে ১৭.৫ থেকে ২১ বছর বয়সী যুবকেরা যারা সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাবে তা হবে অস্থায়ী চরিত্রের এবং চার বছর পর তাদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশকে স্থায়ী ভাবে বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে; বাকী ৭৫ শতাংশকে ফিরে যেতে হবে। ফেরত যাওয়ার সময় তাদের হাতে ১১ লক্ষ টাকার কিছু বেশি এককালীন ভাতা দেওয়া হবে শুধু, কোনওরকম অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা তারা পাবে না। সরকারের এই একতরফা উদ্ধত ঘোষণা কর্মহীনতার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।

গত দু’ বছর কোভিডের কারণে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ ছিল। ইতিমধ্যে অনেকেই সেনাবাহিনীর লিখিত পরীক্ষা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ইত্যাদি বিবিধ স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে রয়েছে; বছরে গড়ে ৫০,০০০ মতো নিয়োগ-প্রাপ্তির তালিকায় তারা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশায় দিন গুনছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সরকারের ‘অগ্নিপথ’ ঘোষণা যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এবার যারা নিয়োগপত্র হাতে পাবে, তাদের অধিকাংশেরই (৭৫ শতাংশ) চার বছর পর চাকরির আর কোনও নিশ্চয়তা থাকছে না। এই ৭৫ শতাংশ কারা হবে- এ নিয়ে চার বছর ধরে তাদের মনে থাকবে উদ্বেগ ও শঙ্কা। তারপর যারা বাতিলের দলে চিহ্নিত হবে, তারা এবার যাবে কোথায়? অর্থাৎ, ১৮ বছর বয়সে যে ছেলে সেনায় নিয়োগপত্র পেল, ২২ বছরে পৌঁছে সে আবার কর্মহীন হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াবে, ‘অগ্নিবীর’ শিরোপা নিয়ে। অথচ, এই চাকরিতে যোগ দেবার জন্য সে তার উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের ধাপগুলিকে পরিত্যাগ করেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক অন্যতর কর্মজগতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ ও শত্রু বেষ্টিত অঞ্চলে নিজের জীবনকে বাজি রাখতে রাজী হয়েছে। এরপরেও এইভাবে তাদের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার অর্থ, সমাজের সর্বত্র জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার রসদগুলিকে আরও অনিশ্চিত ও বিপন্নতর করে তোলা। এই সার্বিক অধঃপতনের রচনাকারদের বিরুদ্ধেই তাই আজ ছাত্র-যুব ও চাকরিপ্রার্থীদের সর্বাত্মক রোষ।

সামগ্রিক ভাবে স্থায়ী কর্মের বাজার যখন সংকুচিত হয়ে আসছে, সরকারি, আধা-সরকারি চাকরির বাজারও যখন প্রায়-শুনশান, তখন শেষ পিদিমের সলতে এই সেনাবাহিনীর চাকরিতেই অল্পবয়সী কর্মপ্রার্থীরা আশার আলো দেখত। বিশেষ করে সেই সব রাজ্যের কিষাণ ঘরের যুবকেরা, যারা উজ্জ্বল চাকরি বলতে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তিকেই বুঝত- তার স্থায়িত্ব, সময়মতো বেতন, নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও অবসরকালীন পেনশনের জন্য। আর এই বিশ্বাসও খুব প্রচলিত ছিল যে, সেনাবাহিনীতে কখনই নিয়োগ বন্ধ হয় না- দেশের সুরক্ষার সঙ্গে বাহিনী জড়িত, অতএব, এখানে অর্থ, প্রযুক্তি ও নিয়োগে কোনও কার্পণ্য নেই- এমনতর বিশ্বাসের ওপরে শুধু তরুণ সমাজই নয়, দেশের এক বড় অংশও ভরসা রাখত। সরকারের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প এই বিশ্বাসের ওপর এক প্রবল আঘাত হানল।    

কিন্তু কেন এই পথে সরকার অগ্রসর হল? তা কি শুধুমাত্র সামরিক খাতে বর্ধিত ব্যয় হ্রাসের উদ্দেশ্যে? অথচ তথ্য বলছে, ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা বাজেট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু বৃদ্ধি পায়নি, দ্বিগুন হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা খাতে সার্বিক ব্যয় কমানোটা সরকারের উদ্দেশ্য নয়! তাহলে কোন ব্যয়কে হ্রাস করতে চাইছে সরকার? কেনই বা? দেখা যাচ্ছে, ২০১৩-১৪ সালে যেখানে প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের ৪২.২ শতাংশ খরচ হত বেতন ও পেনশনে, সেখানে ২০২২-২৩ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৪ শতাংশে (প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি)। সরকার এই ব্যয়টাকেই হ্রাস করে অন্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে চাইছে। এর দু-তিনটে উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আছে।

প্রথমত, এটা বোঝা খুব জরুরি যে, আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি পুরনোকালের ভূ-পরিসর থেকে ডিজিটাল ও সাইবার পরিসরে প্রবেশ করেছে, যেখানে ভৌগোলিক অঞ্চলকে দখলে আনার প্রয়োজনীয়তা আর বিশেষ থাকছে না। অর্থাৎ, সামরিক যুদ্ধের উপযোগিতা আর সেভাবে নেই। হয়তো, রুশ-ইউক্রেন জাতীয় কিছু আঞ্চলিক সংঘাত থেকে যাবে সাবেক মেজাজী শাসকদের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কারণে, কিন্তু সে প্রবণতাও ক্রমেই বিলীয়মান। বরং, ডিজিটাল ও তথ্যের দুনিয়ার ওপর দখল নেওয়াটাই এখন আধিপত্যের মূল কথা, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অফ থিংকস ও মেটা দুনিয়াই হবে যুদ্ধের সম্ভার। ফলে, রাষ্ট্রের তরফে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সেনা নিয়োগের দায় ও দায়িত্বও ক্রমশ কমে আসারই কথা। সে অর্থে প্রতিরক্ষা বাজেটে বেতন-পেনশনের ব্যয় কমিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে দর হয়ে ওঠাটাই আজকাল সাব্যস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, সেনা নিয়োগ কমিয়ে আধুনিকতম প্রযুক্তিতে ব্যয় বাড়ানো- যা গোয়েন্দাগিরি ও ‘বাধ্যত’ যুদ্ধে সর্বোৎকৃষ্ট দক্ষতা এনে দিতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, সেনাবাহিনীতে লোকবল কমানোর প্রশ্নটি জুড়ে আছে আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের প্রশ্নের সঙ্গে। অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ হ্রাসের ফলে তা আরও প্রাসঙ্গিক ও কার্যকরী হয়ে উঠেছে। যুবকদের প্রশ্ন তাই যথার্থ: এই যে সরকার সমস্ত উপায়গুলোকে ধীরে ধীরে অবরুদ্ধ করে দিল, এবার আমরা যাব কোথায়?

দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে সরকার যখন একের পর এক দায় ঝেড়ে ফেলে গোটা ব্যবস্থাটাকে কর্পোরেট ও বাজারের হাতে সঁপে দিতে চাইছে, বিপদে-আপদে কিছু অনুদান দেওয়া ব্যতিরেকে তারা যখন আর কোনও দায়িত্ব নিজের হাতে রাখতে চাইছে না, তখন স্বাভাবিক যে, মানুষের অসহায়তা ও বিপন্নতা অবশেষে একদিন এক সার্বিক বিদ্রোহের চেহারা নেবে। যখন দেখা গেল, প্রায়-সর্বত্র স্থায়ী কর্মসংস্থানের দরজা বন্ধ, মানুষের ক্ষোভ আঁচ করে ভোটের আগে ১০ লক্ষ সরকারি চাকরি দেওয়ার ঘোষণা (এইসব চাকরি ‘অগ্নিপথ’এর মতোই কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে), তখন সেনাবাহিনীতেও নিয়োগ-দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে আসায় মানুষের বেদনা যে আর কোনও বাধা মানবে না, তা কিছুটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল। এখন বিপদে পড়ে সরকার কিছুটা তাপ্পি দেওয়ার চেষ্টা করছে (অন্তত মুখে বলে)- চাকরিপ্রার্থীদের বয়সসীমা বাড়িয়ে, আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশে ‘অগ্নিবীর’দের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু মোদ্দা কথায়, স্থায়ী কর্মসংস্থান প্রদানের ব্যবস্থাপনাটি যে আর আগের মতো থাকছে না, সেনাবাহিনীতেও নিয়োগের পরিমাণ যে আরও বহুল পরিমাণে কমে আসছে- এই সত্যটি এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আর তা বুঝেই মরীয়া হয়ে দেশের যুব সমাজ এক সর্বাত্মক আন্দোলনে পথে নেমেছে। মুছে যাচ্ছে ধর্মের ভেদাভেদ, ভেঙে পড়ছে বিভেদ-হিংসার পাঁচিল।

এতদিন নির্দিষ্ট এক সম্প্রদায়ের প্রতিবাদীদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে ধর্মের কারবারি-শাসকেরা যে বিভেদ-হিংসার আগুন জ্বেলেছে, আজ সেই আগুন লেলিহান হয়ে উঠেছে জনতার সম্মিলিত রোষানলে। আগুনের তো কোনও দেশ নেই, নির্দিষ্ট পরিচয়ও নেই। বর্বরতা, তীব্র জেদাজেদি ও নানারকম টালবাহানার পর তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে সরকার নিজের মুখ পুড়িয়েছিল। তবুও নির্লজ্জ এরা। এরপরেও চেষ্টা চালিয়ে গেছে, কীভাবে ধর্মের আগুন জ্বালিয়ে এ দেশকে ক্ষতবিক্ষত করা যায়। কিন্তু আধুনিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির গতিপথ তো বরাবর শ্রেণির ভিত্তিতেই এগোতে থেকেছে, যেখানে কর্মসংস্থান, গড় মজুরি, জীবনের মান ও সর্বোপরি প্রযুক্তির উল্লম্ফন নির্ধারণ করে এসেছে আগামীর পথ। ‘অগ্নিপথ’এর আগুন সেই মৌলিক যাপনের প্রশ্নটিকেই আবার সজোরে উত্থাপন করেছে, শ্রমজীবী মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে রাজনীতির সম্মুখ-সমরে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে।

Monday, 13 June 2022

চাই সবল ইউ-টার্ন

আন্দোলনের মাঠ হ্যাঁচকা টানে বদলাতে হবে

সুখেন্দু সরকার



ভারতবর্ষ  কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? প্রহর গণনা শেষ। শেষ অবধি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য মাফিয়া শক্তিতে গুড়িয়ে দেওয়া হল আফরিন ফাতিমা'র বাড়ি। উদাসীনতার শামুক-খোলের ভিতর ঢুকে যাব? নাকি তিল তিল করে না মরে মরীয়া সংগ্রামে নামব? পুতুল-নাচের পুতুলই রয়ে যাব? নাকি সমস্ত অক্ষমের অজুহাত ছুঁড়ে ফেলে বুকের সব হিম্মত জড়ো করে সাহসের সাথে ঘুরে দাঁড়াব? 

কিন্তু কোথাও আমরা বারবার আটকে যাচ্ছি পরিস্থিতির মূল্যায়নে অস্বচ্ছতার কারণে। আমরা গল্পের  হবু রাজার ঢোলকের আওয়াজে একবার হাট বসাচ্ছি, পর মুহূর্তে পরবর্তী ঢোলবাদ্যের আওয়াজে হাট ভেঙ্গে দিচ্ছি। ক্লান্ত হয়ে পড়ছি ঘাতকদের মাঠে খেলতে খেলতে। এটাই ওদের কৌশল এবং এই কৌশলকে ব্যর্থ করার প্রতি-কৌশল আমাদের হাতে ইতিহাস তুলে দিতে চাইলেও আমরা, বলা ভাল, বিভ্রান্ত, আমরা তা ব্যবহার করতে চাইছি না। 'সাময়িকতা' আমাদের দৃষ্টি-সীমাকে খণ্ডিত করে ফেলেছে। 

স্পষ্ট করে বলা যাক: শ্রেণি সংগ্রামই হল প্রধান যোগসূত্র; এই ইতিহাস-সিদ্ধ উপলব্ধি মোটেই তামাদি হয়ে যায়নি। মেরুকরণের রাজনীতির কার্যকরী মোকাবিলার জন্য আমাদের শ্রেণি সংগ্রামের ঝোড়ো হাওয়াকেই আহ্বান করতে হবে। শাসকরা যখন বুনিয়াদি জনগণের ঐক্য ভেঙ্গে তছনছ করে ফেলার উপক্রম করেছে, তখন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে শ্রেণি সংগ্রাম বিকশিত করার পথেই শ্রমজীবী-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগণের শ্রেণি-ঐক্য মেরামত করার কাজ হাতে নিতে হবে। কোনও মতাদর্শগত পক্ষপাত থেকে এই উচ্চারণ নয়। মার্কস বলেছিলেন: 'শ্রেণি সংগ্রাম মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ সত্য।' বাস্তবেও একজন পূর্ণাঙ্গ বস্তুবাদী দেখেন, 'আগুন' সত্যি হলে যেমন তার 'দহন' সত্যি, 'শ্রেণি-বিভাজন' সত্যি হলে তার যৌক্তিক পরিণতি 'শ্রেণি সংগ্রাম'ও সত্যি। মার্কসবাদ শুধু মার্কসবাদীদের একচেটিয়া নয়, মার্কসবাদ শেষ বিচারে সমগ্র শোষিত জনগণের সম্পদ। 

'ধান ভানতে শিবের গীত' মনে হচ্ছে? একটু তবে আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকাই? এ দেশের ১৪.২ শতাংশ মুসলমান জনগণ ১৯৪৭ সালে তাঁদের সামনে বিকল্প থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান ছেড়ে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। আস্থা রেখেছিলেন এ দেশের সমন্বয়ধর্মী যাপনের উপর। কোনও শাসকের বাগাড়ম্বর-পূর্ণ প্রতিশ্রুতির উপর নয়। সংবিধানের শব্দ-চাতুরী নয়, তার ধারা-উপধারা-পাদটিকার উপর নয়, ভরসা ছিল বৃহত্তম সহ-নাগরিকদের উপর। তাই তাঁদের 'মুসলমান' থেকে 'ভারতবাসী' হতে কোনও কষ্ট হয়নি। তাঁরা ভারতবর্ষকে দেখেছেন এক মিশ্র সংস্কৃতি ও যাপনের দেশ হিসেবে। তার মানে এই নয় যে, দেশ সাম্প্রদায়িকতা-জাতপাত-লিঙ্গ বৈষম্য'র পাপ থেকে চিরতরে মুক্ত থেকেছে। রাষ্ট্র বারবার এই জঘন্য তাসগুলি খেলেছে বুনিয়াদি জনগণের ঐক্য ও সংহতি ভাঙ্গার কাজে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিকেন্দ্রিকরণ করে তাকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনে দেওয়ার যে পরিকল্পনা অতি-দক্ষিণপন্থী  আরএসএস-সংঘ পরিবার-বি জে পি ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা থেকে নিতে শুরু করে, তার সমান্তরাল কিন্তু ১৯৪৭-উত্তর ভারতবর্ষে ছিল না। এটি ছিল পর্দার আড়ালের আসল শাসক সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিপতি-সামন্ত শাসকদের হাতিয়ার। হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ এই শাসকদেরই পাইপলাইন প্রজেক্ট। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের জমিতে হিন্দুত্ববাদী সার মিশিয়েই তৈরি আজকের ভারতবর্ষ। এই ব্যবস্থায় পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জনগণ গৌণ নির্বাচক- আসল নির্বাচক সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিপতি-সামন্তবাদী শাসক শ্রেণিগুলি। পালাবদল হল সাময়িক প্রভাবিত জনগণের এবং এই শাসকদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের এক বিস্বাদ মেলবন্ধন। আমরা যদি ২০১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আট বছর মোদি-জমানার চলন ঠিকঠাক লক্ষ করি, তাহলে দেখব যে ওরা টেবিল টেনিস খেলার মতো করে একবার হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা এবং পরের বার পুঁজিবাদী এজেন্ডা, এভাবেই এগোচ্ছে। ওদের কার্যক্রমে কোনওরকম অসংলগ্নতা নেই। একটা তালিকা দিই? 

২০১৪: গো-মাংস-ভক্ষণকারীদের উপর ধারাবাহিক হামলাবাজি যা চলল ২০১৭'র মাঝ পর্যন্ত। এটি একটি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। 

২০১৬: ৮ নভেম্বর নোটবন্দি। একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। 

২০১৭: ১ জুলাই জি এস টি। 'এক দেশ এক বাজার'-মার্কা কর্পোরেট এজেন্ডা। 

২০১৯: ২৫ জুলাই-৩০ জুলাই লোকসভা ও রাজ্যসভায় তিন তালাক বিল পাশ। স্পষ্টতই একটি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ৫ আগস্ট কাশ্মীরে ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিলোপ। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ১২ ডিসেম্বর সিএএ ২০১৯ বিলে রাষ্ট্রপতির সই। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। 

২০২০: ১৪ ফেব্রুয়ারি আমেদাবাদ-মাঙ্গালুরু-লক্ষ্ণৌ- তিন বিমানবন্দর আদানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য AAI'এর সঙ্গে চুক্তি, যা একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ২৩-২৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লি গণহত্যা। অবশ্যই হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ১৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ পাশ। একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ১৭ মে খনি বেসরকারিকরণ। একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ১ জুলাই ১০৯টি রুটে ১৫১টি ট্রেনের বেসরকারিকরণ। এটিও একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। ৫ আগস্ট রামজন্মভূমির ভূমি-পূজা। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনটি শ্রমকোড পাশ। কট্টর কর্পোরেট এজেন্ডা। ২৭ সেপ্টেম্বর তিন কৃষি বিলে রাষ্ট্রপতির সই। এটিও কর্পোরেট এজেন্ডা। ৩০ সেপ্টেম্বর সিবিআই বিশেষ আদালতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মূল চক্রীদের রেহাই। একটি ঘৃণ্য হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। নভেম্বর জুড়ে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে বন্ধ করার লক্ষ্যে একের পর এক বিজেপি-রাজ্যে বিল পাশ। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা।

২০২১: মার্চে বীমা-সংশোধনী বিল ২০২১ পাশ। কর্পোরেট এজেন্ডা। ৯ আগস্ট The Deposit Insurance and Credit Guarantee Corporation Amendment Bill 2021 পাশ, যার বলে ব্যাঙ্ক ফেল করলে কোনও আমানতকারীর ৫ লক্ষ টাকার বেশি অর্থ থাকলে সেই বাড়তি টাকা জলে যাবে। এটি একটি কর্পোরেট এজেন্ডা। 

২০২২: অপরাধী শনাক্তকরণ আইন পাশ, যা ব্রিটিশ আমলের অপরাধী উপজাতি আইনেরই প্রসারিত রূপ। একটি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। 

লক্ষ করুন: ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট ১৯টি প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে ১০টি কর্পোরেট কর্মসূচি এবং ৯টি হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি। ওরা চাইছে আমরা লাগাতার হিন্দু-মুসলমান নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি এবং এই সুযোগে আমেরিকা-রাশিয়া-চীনা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি-আদানি-আম্বানি-বড় জোতদার মিলে দেশটা দখল করে নিক। বস্তুত মন্দির-মসজিদের লড়াই যত বেশি বেশি করে শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের ভিত ভাঙ্গবে ততই সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রাম দুর্বল হবে। 

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বিগত আট বছরে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগণকে ওরা লাগাতার মারতে মারতে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। এত মার খাওয়ার পরেও তাঁরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন, এ কথাও সত্যি। কিন্তু অবরুদ্ধ ক্ষোভ মাঝে মাঝে আন্দোলনের ব্যাকরণ না মেনে ফেটে পড়তে চাইবে, এ কথাও সমান সত্যি (সাম্প্রতিক হাওড়ার ঘটনা-প্রসঙ্গ)। শুধু 'প্ররোচনা' দিয়ে এই ভাঙচুর-অবরোধ-অগ্নিসংযোগকে ব্যাখ্যা করা মোটেই ঠিক হবে না। তা কার্যত হয়ে দাঁড়াবে এক ধরনের 'ভিকটিম-শেমিং'! মনে রাখতে হবে, প্ররোচনা দিয়ে যদি জনগণকে বিশৃঙ্খল দিশাহীন জঙ্গিপনার দিকে ঠেলে দেওয়া যায়, তার গভীরতর কারণ হল এই যে, 'পাথরে তা দিলে বাচ্চা হয় না, ডিমে তা দিলেই হয়।' আজ যদি সংখ্যালঘু জনগণ দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ জমায়েত-আন্দোলন শুরু করেন- কাঁটায় কাঁটায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি-প্রকরণ মেনে পথে নামেন এবং এমন কি হিন্দু জনগণের সচেতন অতি-সংখ্যালঘু অংশটিকে এই লড়াইয়ে পাশে পান, তাতেও কি পরিস্থিতির বড় কোনও পরিবর্তন হবে? এর উত্তরে স্পষ্টই বলা যাক: না। হবে না। সমাজটাকে ইতিমধ্যে এতটাই মেরু-বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে যে, সংখ্যালঘু জনগণের শতকরা একশো ভাগ ন্যায়সঙ্গত এই সংগ্রামকেও ওরা কাজে লাগাবে হিন্দু জনগণের মনে কাল্পনিক ভয়ের চাষ করার জন্য।

পথ এখন একটাই: এক সবল ইউ-টার্ন। আন্দোলনের মাঠ-ধরণ-প্রকরণ-সনদ সবগুলোকেই হ্যাঁচকা টানে বদলাতে হবে। চার  চারটে মূল ইস্যু আমাদের সামনে পড়ে পড়ে মরচে ধরছে: ১) মূল্যবৃদ্ধি ২) বেকারি ৩) বেসরকারিকরণ ৪) আয়-ছাঁটাই। এই চারটি ইস্যুতে আমাদের সমস্ত উদ্যোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে প্রধানত শ্রমিক-কৃষক-অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণ এবং নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনতার গভীরে। গোটা দেশকে এই ইস্যুগুলিতে পথে নামার ডাক দিতে হবে। দেখলেন না, OIC-ভুক্ত ৫৭টা দেশ ভারতীয় পণ্য বয়কটের হুমকি দিতেই কেমন মোদি-কোম্পানি বেমালুম থুতু চেটে রাস্তা সাফ করে দিল? এই আন্দোলনই জনগণের মধ্যে সংগ্রামী শ্রেণি-ঐক্য গড়ে তুলে মেরুকরণের রাজনীতিকে মাটিতে পেড়ে ফেলবে। কোন পথে লড়লে ওদের বুকে কাঁপন ধরানো যায় তার দু-দুটো জ্যান্ত ক্লু কি আমরা পাইনি? 

ক্লু ১: সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন। 

ক্লু ২: নূপুর শর্মা কেস। 

একটা দেশব্যাপী বড় গণ আন্দোলনের ঝড় তুলতে হবে আমাদের। তৈরি করতে হবে জনগণের বিকল্প দাবি সনদ। নাগরিক আন্দোলন-অধিকার আন্দোলনকেও জুড়তে হবে এর সাথে। সোজা কথায় ওদের মাঠে খেলতে সাহস ভরে অস্বীকার করতে হবে। লড়াইটাকে নিজেদের মাঠে নিয়ে আসতে হবে। মাঠটাকে বড়ও করতে হবে। অর্থনৈতিক ইস্যুতে দেশব্যাপী গণসংগ্রামের ঝড় ব্যবস্থা-বদলের লড়াইকে ধাক্কা মেরে সামনের দিকে এগিয়ে দেবে। এই পরিপূরকতার বড় স্বপ্নই হোক আজ-কাল-আগামীর  দিবালোকের বাস্তব।


Friday, 10 June 2022

প্রধানমন্ত্রী এখনও চুপ কেন?

পল্লবিত ঘৃণার রাজনীতি

সুমন সেনগুপ্ত


 
 

যেদিন থেকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, সেদিন থেকেই দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর একটা বিরাট ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা চলেছে। সেই চেষ্টার পিছনে শুধু যে গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে এমনটা নয়, কেন্দ্রের শাসক দলের প্রচুর শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দেশের বেশ কিছু মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছনো গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী সব কিছু পারেন। তিনি ইচ্ছে করলে কালো টাকার ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করতে পারেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে পারেন, প্রতিবেশী দেশকে সমুচিত জবাব দিতে পারেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে এতদিনের অবিচার বন্ধ করতে পারেন, রাম মন্দিরও বানাতে পারেন। অর্থাৎ, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি বিশ্বগুরু। তিনি মানবিক, তাই তিনি কোভিডের টিকা অন্যান্য বহু দেশে দান করতেও পিছপা নন। 

এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে তিনি কতটা সফল আর কতটা বিফল, তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্কের দরকার নেই। যে কোনও সুস্থ মানুষকে প্রশ্ন করলেই এর উত্তর মিলবে। কিন্তু তাঁর ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি উনি হতে দেননি। যখনই তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে, তখনই তাঁর পোষা গণমাধ্যম অন্য কিছুতে বিতর্কগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

অনেকেই হয়তো মনে মনে ভাবেন, নরেন্দ্র মোদীর গুজরাট দাঙ্গার ইতিহাস থাকলেও এখন তিনি যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মধ্যে যে মুসলমান বিদ্বেষ আছে তা হয়তো তিনি সামনে আসতে দিতে চান না। তিনি এককালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্য থাকলেও আজ তিনি ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’, অর্থাৎ, সব ধর্ম, জাতি, বর্ণের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে দেশের বিকাশ বা উন্নয়ন ঘটাতে চান। কিন্তু সত্যি কি তাই? তাঁর মধ্যকার মুসলমান বিদ্বেষ কি একেবারে চলে গেছে? যদি যেত, কিছুদিন আগে যখন হরিদ্বারের ধর্ম সংসদ থেকে দেশের মুসলমানদের গণহত্যার হুমকি দেওয়া হল, তখন তো তিনি তার বিরোধিতা করলেন না? যখন দেশের বহু মানুষ ওই গণহত্যার হুমকি দেওয়া মানুষজনদের গ্রেফতারির দাবি তুললেন, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তো একটি কথাও বললেন না। একবারও বললেন না যে, দেশেরই এক শ্রেণির নাগরিকদের শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে গণহত্যায় মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া সংবিধানের পরিপন্থী।

এই কথাগুলো আবারও নতুন করে কেন বলতে হচ্ছে? বলতে হচ্ছে, কারণ, প্রধানমন্ত্রী আবারও চুপ করেই আছেন। কিছুদিন আগে বিজেপির এক কেন্দ্রীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমের বিতর্কসভায় পয়গম্বর হজরত মহম্মদ সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করেন। দেশের বহু মানুষজন যখন তার বিরোধিতা করেন, তাকে আমল দিতে চায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। উত্তরপ্রদেশে যখন এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন সংখ্যালঘু মানুষজন, সেই বিক্ষোভে নির্মম লাঠিচার্জ করা হয়।  

এই অবধি মোটামুটি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গোল বাঁধল, যখন আরব দেশ থেকে হজরত মহম্মদের এই অপমানের বিরুদ্ধে মুসলমান প্রধান দেশগুলোর তরফে আপত্তি করা হল। তাদের তরফ থেকে ভারত সরকারকে প্রশ্ন করা হয়েছে- তারা কী চোখে দেশের মুসলমানদের দেখে। অবস্থা এতটাই জটিল হয়েছে যে ভারত সরকারকে বলতে হয়েছে, যাঁরা মুসলমান বিরোধী কথা বলছেন বা টুইট করছেন তাঁরা বিজেপির কেউ নন। তাঁদের তড়িঘড়ি বহিষ্কার করে জানানো হয়েছে তাঁরা বিজেপির প্রান্তিক লোক। দলের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা সব ধর্মকে সম্মান করে। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কি মুসলমান বিদ্বেষী কথা বলেননি? মুসলমানদের খোলা জায়গায় নামাজ পড়া নিয়ে কি এই দলেরই নানান মুখপাত্ররা নানান কথা বলেননি? মাঝে মধ্যে যখন মসজিদে মাইক লাগিয়ে আজান দেওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়, তখন কি প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের লোকজনদের সাবধান করেছেন? এই প্রধানমন্ত্রী তো নিজে বলেছেন, যাঁরা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে আছেন তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই বোঝা যায় তাঁরা কারা! তাহলে আজ বিজেপির তরফে নূপুর শর্মাকে সাসপেন্ড ও নবীন জিন্দালকে বহিষ্কার করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? 

সরকারের পক্ষ থেকে যে কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু  মুসলমান প্রধান আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই। দেশের মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মানুষজনদের জন্য কিন্তু কোনও বার্তা সরকারের তরফে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, এবারেও কিন্তু নরেন্দ্র মোদী তাঁর সহিষ্ণুতার পরিচয় দেননি। তিনি ধর্মসংসদে গণহত্যার হুমকির সময়েও যেমন মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, এবারও কিন্তু তিনি এবং তাঁর সরকার নিশ্চুপই আছেন। তাঁর সংখ্যালঘু বিরোধী ভাবমূর্তিতে কিন্তু এতটুকু আঁচড় পড়েনি। গুজরাট দাঙ্গায় নিহত হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষের মৃত্যুর জন্য তাঁর যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, তা তিনি নিরন্তর বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ যে সংখ্যাগুরুর জন্য তা তিনি জানেন, আর জানেন বলেই তাঁর মুখোশ খুলে গেলেও তিনি লজ্জিত নন। তাই তিনি চুপ করে আছেন এবং আবারও সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন কখন নিজের বিশ্বগুরুর ভাবমূর্তি সামনে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু তাঁর এই কর্মকাণ্ডের ফলে যে গরিব ভারতীয়রাই ভুগবে, তা কি তিনি জানেন না? অবশ্যই জানেন। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ থেকে উড়োজাহাজে ভারতীয় শ্রমিকদের দেশে ফেরানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফলে, আবারও ভুগতে চলেছেন অসংখ্য গরিব মানুষ। এই প্রক্রিয়া যদি চলতেই থাকে তাহলে নরেন্দ্র মোদীর আরও সুবিধা হবে। তাঁর দলের মেরুকরণের রাজনীতি করতে আরও সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হবে আরব দেশগুলোর এই অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে; তাতে যে বিজেপির দ্বিগুণ লাভ হবে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?

অনেকে হয়তো ভাবছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে বিজেপির মুখ পুড়েছে। কিন্তু সেই ভাবনা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন অনেকেই হয়তো মনে করছেন, আরব দেশগুলোর কাছে ভারত সরকার একটা ভালো শিক্ষা পেল। কিন্তু এই কথাটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এই ঘটনায় বিজেপির এতটুকুও ক্ষতি হবে না উল্টে লাভ হবে। ঠিক যেভাবে এই ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলার ডোমজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে অনাবশ্যক পথ অবরোধ হল, এইরকম নানান গণ্ডগোল সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, ফলে আবারও মেরুকরণ ঘটবে। আমাদের দেশের সংখ্যালঘু মানুষের সম্মানের লড়াইটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংখ্যালঘু মানুষদেরই করতে হবে। কিন্তু অন্যভাবে।

এই নূপুর শর্মা-নবীন জিন্দাল বিতর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি আলোচনায় আসা উচিত ছিল তা কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান মেনে চলা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদেরই তুলে ধরতে হবে। তা হল, এই ঘৃণা ও বিদ্বেষের আবহাওয়া তৈরি করতে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের ভূমিকা। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিদিন যে ভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থাৎ বেকার যুবকদের চাকরি, শিক্ষা, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির বদলে দেশের নানান প্রান্ত থেকে সচেতনভাবে অ-গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বিষয়কে আমাদের বসার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে কি এই পরিস্থিতি খুব অবশ্যম্ভাবী ছিল না? আজ অনেকেই হয়তো নূপুর শর্মাকে দায়ী করছেন, কিন্তু তার আগে কি এই টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো- যাঁরা রোজ বিতর্কের নামে মানুষের মনে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বুনে চলেছে- তাদের দোষী সাব্যস্ত করা উচিত ছিল না? সবার আগে কি বলা উচিত নয়, এই ধরনের বিতর্ক যা মানুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করছে তা বন্ধ করতে হবে। 

বেশ কয়েক বছর আগে দেশের অন্যতম এক সাংবাদিক রভীশ কুমার বলেছিলেন, যদি নিজে বাঁচতে চান, যদি শিশুদের বাঁচাতে চান, তাহলে টেলিভিশন দেখা বন্ধ করতে হবে। অনেকে হয়তো বুঝতে চাননি। কিন্তু সেই কথাটি যে কী পরিমাণে সত্যি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামাজিক মাধ্যম এবং টেলিভিশন যে কীভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তা যদি আজও না বুঝতে পারি তাহলে কবে বুঝব। যে গণমাধ্যমের প্রচার এবং সামাজিক মাধ্যম দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল ২০১৪'র আগে, সেই গণমাধ্যম আজ নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তি নষ্ট হোক, তা কি চাইবে? এই সোজা প্রশ্নটা নিজেকে করলেই অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। কিন্তু সেই সোজা কাজটা কি আমরা করতে চাইছি? গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের এই অনুষ্ঠানগুলো না দেখলেই কিন্তু আমাদের জীবনে অনেক প্রশান্তি থাকবে। কিন্তু এই অত্যন্ত সোজা কাজটা কি আমরা করব? করলে আর কবে করব? পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বিষ প্রবেশ করে যাওয়ার পরে?

 

Sunday, 5 June 2022

কাশ্মীরে বাগাড়ম্বরবাজদের অশ্বডিম্ব!

কানে তুলো পিঠে কুলো

প্রবুদ্ধ বাগচী


 

আমরা চাই বা না-চাই, একেকটা বিষয়ের সঙ্গে আমাদের অজান্তেই অন্য একটা অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে যায় যেমন, বাজেট বিষয়টার সঙ্গে আমরা যুক্ত হলেই মনে মনে একটা ধারণা হয়, বাজেট মানেই বৃদ্ধি অর্থাৎ, বাজেট ঘোষণা মানেই বেশ কিছু জিনিসের দাম বাড়বে, তুলনায় কমার পাল্লা নিতান্তই হাতে গোনা একইভাবে কয়েক দশক আগে থেকে যখনই কাশ্মীরের কথা আলোচনায় আসে, তাতে যে অনুষঙ্গ মনের মধ্যে ছায়া ফেলে যায় তা হল চোখ জুড়নো প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়িয়ে আসা রক্তের দাগ সেই রক্ত কখনও সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত কাশ্মীরের নিরীহ নাগরিক বা শস্ত্রধারী নিরাপত্তা বাহিনীর সেনানীদের, কখনও বা ওইসব নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিরপরাধ কাশ্মীরিদের নির্যাতনের কে বেশি দায়ী তা নিয়ে চুলচেরা বিচার চলে, কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের তাতে কোনও সুরাহা হয় না একের পর এক ব্যর্থ শান্তি চুক্তির খসখসে কাগজের নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে কাশ্মীর আর তার নাগরিকরা

একটা সময় পঞ্জাবে যে কথা বলা হত, সেখানকার বাসিন্দারা আসলে ছিলেন দুই বন্দুকের মাঝখানে- একদিকে খালিস্তানি জঙ্গিদের অস্ত্র অন্যদিকে ভারতীয় সেনার অস্ত্র ছত্তিসগড়েও একটা সময় এরকম অবস্থা তৈরি হয়েছিল আপাতত সেগুলো অতীত কিন্তু কাশ্মীরের অবস্থা বহু বছর ধরে একইরকম ইসলামি মৌলবাদের গর্ভজাত জিহাদিরা নির্বিচারে কাশ্মীরের মানুষকে হত্যা করে এসেছে একদিকে, অন্যদিকে কাশ্মীরের সব নাগরিককেই জিহাদি বিবেচনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যা খুশি তাই করে এসেছে তাদের সরকারি অস্ত্রের গোলাবারুদ দিয়ে সারা দেশের মধ্যে একমাত্র কাশ্মীরেই তৈরি হয়েছিল ‘নিখোঁজ’ পুরুষ নাগরিকদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি সংগঠন যারা প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেছে তাদের পরিবারের ‘নিখোঁজ’ সদস্যদের সন্ধানে- কোথাও সুরাহা হয়নি মানবিকতার এমন নির্মম প্রহসন আমরা খুব কমই দেখেছি।

কিন্তু আজ যে নতুন করে এইসব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হচ্ছে তার এক এবং একমাত্র কারণ, গত মাসখানেকের মধ্যে কাশ্মীরের নিরীহ নাগরিকরা আবার এক নতুন সন্ত্রাস-অধ্যায়ের মুখোমুখি প্রায় নিত্যদিন সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিরা আঘাত করছে কাশ্মীরে আর তাদের নরম টার্গেট নিরীহ নাগরিকরা গত কয়েক দিনে অন্তত ১২জন সাধারণ কাশ্মীরবাসী তাদের হাতে নিহত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার থেকে স্কুল শিক্ষিকা- সকলেই রয়েছে এই তালিকায় এইসব সাধারণ জীবিকার মানুষের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের বিরোধ কোথায়? নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে তাদের কোন উদ্দেশ্য পূরণ হবে বোঝা যায় না যেন নরহত্যা এদের কাছে এক ধরনের খেলা! বেশ বোঝা যায়, এবারেও হিসেব করে মেপেজুপেই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে কিন্তু তারা এমন অকুতোভয় হল কীভাবে? এখন তো কাশ্মীর সরাসরি কেন্দ্রের শাসনে, কোনও ‘কুচক্রী’  নির্বাচিত সরকার তো এই মুহূর্তে সেখানে নেই যে কেন্দ্রকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য তারা তলায় তলায় সন্ত্রাসকে মদত দেবে! তাহলে?

এইসব প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে আমাদের আরও একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে ‘সুবিবেচক’ প্রধানমন্ত্রী যখন নোটবন্দির কথা আচমকা ঘোষণা করে বলেছিলেন, দেশের ভালোর জন্যই নাকি এই সিদ্ধান্ত, তাঁর অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিদের শায়েস্তা করা যাবে- আচমকা টাকার জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অস্ত্র কেনাবেচার পথ বেবাক বন্ধ হয়ে গেলে দেশ জুড়ে শুধু শান্তি আর শান্তি সত্যি কথা বলতে কি, অনেক মানুষ তাঁর এই আপ্তবাক্যে ভরসা রেখেছিলেন কারণ, দেশের সাধারণ মানুষ- কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা- আদপে শান্তিপ্রিয়, নিজেদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে গুলি বারুদ হত্যার সশব্দ দাপাদাপি তাদের বিড়ম্বিত করে, বিধ্বস্ত করে সেই মানুষগুলি ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ছকভাঙা পদক্ষেপ যদি তাঁদের জীবনে শান্তি আর নিরাপত্তার বাতাস বয়ে আনে, সে তো খুব সুখের সময়- একেই কি বলে ‘আচ্ছে দিন’! কিন্তু এই বুক-বাজানো ঐতিহাসিক ঘোষণার অল্প পরেই দেখা গেল, যা প্রচার করা হয়েছিল আসলে তার সঙ্গে বাস্তবের যোগ নেহাতই ক্ষীণ জাল নোট যেমন আশানুরূপ ঘরে ফিরল না, ঠিক তেমনই জঙ্গিদের কোমরের জোর এতে এমন কিছু কমল না অন্তত যা নিয়ে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারেন নভেম্বর ২০১৭ থেকে আজ অবধি দেশে কি সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত কমেছে? অন্তত আজকের কাশ্মীর তো এই জ্বলন্ত প্রশ্নটা সামনে আনছেই

এর পরে ভেবে দেখতে হবে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রসঙ্গটাও দেশবাসীকে চমকে দিয়ে ২০১৯-এ সরকারে ফিরে যা অত্যন্ত তড়িঘড়ির সঙ্গে রূপায়ন করে দেওয়া হল– দেশের সংবিধানের সামান্য একটি আইনি ছিদ্র খুজে বের করে লাগু হয়ে গেল আইন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হোক বা নাই হোক, আসলে তো বলা হয়েছিল এতে কাশ্মীরের উন্নয়ন হবে, রাজ্যে শান্তি ফিরবে যদিও এই বিলোপের মাধ্যমে কাশ্মীর রাজ্যটাকে দুটুকরো করে দেওয়া হল, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে শাসন চালানোর বদলে কাশ্মীরকে নিয়ে আসা হল কেন্দ্রীয় শাসনে একতরফা এই সিদ্ধান্তে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মতামতের তোয়াক্কা করা হল না যাতে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারেন সেইজন্য কণ্ঠরোধ করা হল মিডিয়ার, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে রাখা হল সবই নাকি শান্তির জন্য! বলা হয়েছিল, এই ব্যবস্থা চালু হওয়া মাত্র কাশ্মীরে প্রচুর শিল্প বিনিয়োগ হবে, মানুষের কাজ তৈরি হবে আর সেই সঙ্গে কাশ্মীরি সুন্দরীদের অনায়াসে বিবাহ বন্ধনে বেঁধে নেওয়ার নাকি ঢালাও সুযোগ মিলবে বাকি দেশবাসীর কিন্তু গত তিন বছরে কাশ্মীর যে তিমিরে সেই তিমিরেই রইল। বিনিয়োগের বান সেখানে ডাকেনি, মানুষের কাজের সুযোগ বাড়েনি দারিদ্র, কর্মহীনতার সঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বুনিয়াদি ব্যবস্থা এখনও কাশ্মীরে অধরা এর সবগুলিই সন্ত্রাসবাদের চাষবাসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আর ঘটছেও তাই হাতে তালি দিয়ে বা থালা বাজিয়ে যেমন কোভিডের যুদ্ধ জয় করা যায়নি, ঠিক তেমনই ৩৭০ ধারার বিলোপ করে কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত সজীব উপত্যকায় রূপ দেওয়া গেল না এমনকি তিন বছরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও করে ওঠা গেল না- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশে এত বড় একটা রাজ্য আজও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে! কেন্দ্রের ‘প্রচারসর্বস্ব’ সরকার যখন আজ তাদের অষ্টম বার্ষিকী ঘটা করে পালনের আয়োজন করছে, যখন দেশ জুড়ে স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ পালন নিয়ে সাজো সাজো রব- তখন এই অসহায় মৃত্যু আর হত্যার দায় তারা নেবে না?

কিন্তু ‘কানে তুলো পিঠে কুলো’ বলে একটা বাংলা প্রবাদ আছে সেই প্রবাদের জ্যান্ত উদাহরণ আজকের দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার এইসব কূট প্রশ্ন এড়িয়ে তারা বরং মন দিয়েছে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় পছন্দের চিত্র পরিচালককে বরাত দিয়ে এরই মধ্যে বানানো হল ‘কাশ্মীর ফাইলস’- কাশ্মীরে হিন্দু পণ্ডিতদের প্রতি কীরকম নৃশংস অত্যাচার হয়েছে, সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে তার এক রসঘন চিত্র পরিবেশিত হল সেই মোড়কে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলবল সচরাচর ফিল্ম দেখেন কি না তার কোনও খবরাখবর এত বছরে আমরা পাইনি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন ফিল্মটিকে, বেশি বেশি মানুষকে দেখানোর জন্য তাদের ‘ইয়েস ম্যান’ রাজ্য সরকারগুলি ফিল্মের ওপর প্রমোদকর মকুব করে দিল শোনা যায়, ফিল্ম ভাষ্যের দিক থেকে এই ফিল্ম নাকি তেমন সরেস কিছু নয়, তবে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে নিশানা করার জন্য অব্যর্থ- কার্যত সেই লক্ষ্যেই ছবিটি নির্মিত আর তাছাড়া ভাল হোক কি মন্দ, ছবি বানিয়ে তো আর একটা উপদ্রুত রাজ্যের জনজীবন স্বাভাবিক করে দেওয়া যায় না, তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগে ছবি উচ্চমানের হল বা নিচুমানের, সত্যি কি তাতে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে? তাঁরা আদপে চান শান্তি, রোজগারের নিশ্চয়তা, পরিবারের ছেলেমেয়েদের চাকরি, নিরুপদ্রবে ব্যবসা-বাণিজ্য করার আবহ আর তার জন্য একটা পোক্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো লাগে, যোগ্য প্রশাসন লাগে ব্যাপার হল, যে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে এতদিন কেন্দ্রীয় সরকারি দলটি রাজনৈতিক কুম্ভীরাশ্রু ফেলে এসেছে, আজ সেই পণ্ডিতেরা এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত কিন্তু কেন্দ্রের সরকার কেন যেন এই প্রতীতিতে এসে পৌঁছেছে- সন্ত্রাসবাদকে তারা সেনানীদের বুটের ডগায় অথবা বন্দুকের নলের সামনেই স্তব্ধ করবে বহু বছর ধরে এই একই পরীক্ষা তারা করে চলেছে আসলে যা মরুভূমিতে ধান চাষের মতোই অলীক ক্রমশ কাশ্মীর কেন্দ্রীয় সরকারের এলোমেলো ভাবনার গবেষণাগার হয়ে উঠছে আর এই নাগপাশে নিষ্পেষিত হচ্ছেন নিরীহ কাশ্মীরি নাগরিকরা বাকসর্বস্ব সরকারের অপদার্থতা যত বাড়ছে ততই তাঁদের প্রাণের মূল্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে

সেনা দিয়ে যদি সব অন্ধকারকে আলো করা যেত, তাহলে আর গণতন্ত্রের কী প্রয়োজন? হিংসা আর প্রতিহিংসার মাঝখানে দমবন্ধ, স্থবির কাশ্মীরের বিপন্ন আমজনতা আজ নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে যেন এই প্রশ্নই করতে চাইছেন তাঁদের নিয়ামক সরকার বাহাদুরকে উত্তর আসবে বলে ভরসা হয় না