Wednesday 17 November 2021

দাও ফিরে শৈশব

করোনাকালে লেখাপড়া

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


করোনাকালে লেখাপড়া গোল্লায় গেছে বলে অনেকে মনে করছেন। লেখাপড়া গোল্লায় যাবার জন্য দায়ী যে করোনা তাণ্ডব তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে চাই যে অনলাইন পড়াশোনার ব্যবস্থা ভালো নয়। অনলাইন ব্যবস্থায় শিশুদের ক্ষতি সর্বাধিক। অফলাইন ব্যবস্থারও অনেক ত্রুটি। তবে তাকে বলতে পারি মন্দের ভালো। কেন অনলাইন ব্যবস্থা ভালো নয় তার আলোচনা অনেক হয়েছে, তাই থাক সে আলোচনা।  

তবে, খারাপ এই  ব্যবস্থার কোনও ভালো দিক কি নেই? করোনাকালে এই অনলাইন ব্যবস্থার উন্নতিতে আমাদের কি কিছু করণীয় ছিল না? বা সৎ ও স্বল্প প্রয়াসে তার থেকে ভালো কিছু পাবার কোনও পথ কি নেই! আসুন, সেই সংস্কারের আলোচনা করি।

সে আলোচনা শুরুর আগে জেনে রাখি যে তারা, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক স্তরের শিশুরা, প্রথম ভাষা ও গণিত শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। 'শিক্ষা আলোচনা' নামে একটি শিক্ষক সংগঠনের সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, ভাষা শিক্ষায় তাদের ৫৪ শতাংশ, আর গণিত শিক্ষায় তাদের ৫৫.২ শতাংশ আর আগের জায়গায় নেই; যা শিখেছিল তার অনেকটাই তারা ভুলেছে। পরিবেশবিদ্যাতেও শিশুদের হাল বেশ খারাপ। অন্য বেশ কিছু সমীক্ষার ফলও অনুরূপ। দোষ কি শিশুদের? তা নয়, দোষ ব্যবস্থার। স্কুল বন্ধ, অনলাইন ব্যবস্থার ঘাটতি- তারা যাবে কোথায়? ওই সংগঠন কিছু সুপারিশ করেছে ঘাটতি পূরণে, যা আমার যথেষ্ট মনে হয়নি৷ তাই, অন্য আরও কিছু  ভাবনা ভাবতে বলি সকলকে। 

আমার কাছে প্রায় নিয়মিত আসে পাশের ফ্ল্যাটের একটি ৪-৫ বছরের শিশু। স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে কিন্তু এ যাবৎ সে দেখেনি স্কুল৷ জানেই না স্কুল বস্তুটি কেমন। মাঝে মাঝে তার মা এসে তাড়া দেয় হোমটাস্কের জন্য। তার কোনও কোনও দিদিমণি নাকি হোমটাস্ক দিয়ে রেখেছেন যা করার কোনও আগ্রহই তার নেই। যখন দিদিমণিরা কেউ নেটে পড়ান, ও নাকি তখন জানালার গ্রিলে ঝোলে! 

আমি  আজও তার দোষটা ধরতে পারিনি। উল্টে তার দিদিমণিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জাগে যে, আপনারা কি কিছু শেখাতে ব্যস্ত না ব্যস্ত চাকরি রক্ষায়? তার মা একদিন চোখ কপালে তুলে বলেন, আপনাদের প্রশ্রয়ে ও বাঁদর তৈরি হচ্ছে।

- হয়তো ঠিক, হয়তো নয়।

- নয় কেন? তিনি প্রশ্ন করেন। 

তাকে বলি, স্কুলটা খোলা থাকলে তুমি ওকে পেতে নাকি এত কাছে সারাদিন? এতটুকু বাচ্চার ঘাড়ে হোমটাস্কের বোঝা যারা চাপান...

আমাকে থামিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দোষ খোঁজার পুরনো অভ্যেস ছাড়ুন। বলুন তো, এভাবে যদি না হয় তো কীভাবে হবে? হোমটাস্ক করবে না? সে তো সব সময় ছিল। ও পড়তে, লিখতে শিখবে কবে? কোন বয়সে? করোনা যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না।

শিশুটির মা তেজী মহিলা, ভাবনাচিন্তাও করেন। জানতাম, আরও একবার জানলাম। তাঁর কথা অকাট্য নিশ্চয়। করোনা খুব শীঘ্র যাবে না। হয়তো, যাবেই না। আর তেমন চাপে পড়লে সরকার একদিন আচমকা স্কুলের নীচু ক্লাসও চালু করে দেবে। তারপর? 

এবার আমার প্রশ্ন তাঁর কাছে: বাচ্চাটা সুশিক্ষা পাবে তো তখন?

না। দৃঢ় কন্ঠে তিনি বললেন। আরও বললেন, যারা শিক্ষার আয়োজক তাঁরা কি চান শিশুরা সুশিক্ষা পাক? তাঁরা কি জানেন যে, সুশিক্ষা দিতে হলে প্রতিটি শিশুর উপযোগী পরিবেশ চাই। 

- যদি না জানে, যতদিন তাঁরা না বোঝে- কিছু করার নেই? 

- আছে তো। যেভাবে ও শিখছে।

আমার কিছু বলার ছিল। বলার ছিল: All Work No Play- একে সুশিক্ষা বলব নাকি? বলতে তিনি দিলেন না। ইশারায় থামালেন। বললেন, তর্ক করার সময় নেই যে! আমার তো কাজ আছে। আমি চললাম আমার কাজে, ওকে আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। আপনি সামলান। 

রাগ দেখিয়ে তিনি বিদায় নিলেও আমি আরও কিছু ভাবার বিষয় পেলাম তাঁর কথায়। যেমন, শিশুর উপযোগী পরিবেশ যে তার পছন্দের পরিবেশ তা আরও একবার স্পষ্ট জানলাম। এখন প্রশ্ন: প্রতিটি শিশুকে তার পছন্দের বা উপযোগী পরিবেশ ফেরত দেবে কে, কীভাবে! একমাত্র উপায় তার শৈশব ফিরিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করা। এতটুকু বাচ্চার ঘাড়ে হোমটাস্কের বোঝা চাপানোর চেষ্টা কোনও ব্যবস্থাতেই মঙ্গলদায়ী নয়। শিশুটি কিছু যে শিখছে তার স্বীকৃতি দিতেই তো সে জানালার গ্রিলে ঝোলে এবং তিনি তাকে আমার জিম্মায় রেখে নিশ্চিত হয়ে যেতে পারেন।  

আমি যে নিশ্চিন্ত হতে পারি না। শিশুটি আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়লে বা আলুকাবলি খাবার বায়না ধরলে! তবু এভাবেই শিশুটি যে অল্প হলেও কিছু শিখছে এবং তা তার স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিচ্ছে, এতে বৃহত্তর যৌথ পরিবার তথা পাড়ার একটা ভূমিকা থাকছেই- আমি নিশ্চিত। পাড়াই তো শিশুটির দেখভাল করে তাকে আপন করে নিয়েছে, এই কথা তার মা বোঝেন না, বা বুঝতে চান না; কারণ, তিনি পাড়া বিষয়টি বোঝেন না। তাঁর শিক্ষা তাঁকে তা বুঝতে সাহায্য করে না। শিশুটি যে কিছু শিখেছে তার প্রমাণ তার রেলিং-এ ঝোলা। শিশু ফিরে পেয়েছে তার আনন্দ, তার শৈশব।

আমিও কিছু শিখলাম।  শিশুকে তার শৈশব ফিরিয়ে দিতে হবে শিখলাম। আরও যা শিখলাম তা এরকম:

 ১) অনলাইনে শিক্ষার প্রতি শিশুদের অনাগ্রহ; 

 ২) যৌথ পরিবারের গুরুত্ব; 

৩) পাড়া ও পাড়ার দাদু-দিদাদের গুরুত্ব ইত্যাদি  কম নয়! 

স্কুল নামের প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এই পথে এগোনো যায় না? ভেবে দেখুন প্রিয় পাঠক। ভাবুন তাঁরা যারা এখনও কেন স্কুল বন্ধ বলে কান্না জুড়েছেন বা প্রতিবাদে আকাশ ফাটাচ্ছেন। 

এ দেশের শিশুদের অন্য প্রধান সমস্যা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি। আমাদের এই দরিদ্র দেশের কথা বিবেচনায় রেখে ভাবা প্রয়োজন কী করলে শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয় নিয়ে আমরা যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে পারি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সম্প্রতি এক সমীক্ষায়  জানা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা প্রায় সকলে লকডাউন পর্বে নিয়মিত  মিড-ডে মিল পেয়েছে, তাদের পরিবার সে সব সামগ্রী বাজারে বেচে দেয়নি (যদিও অনেক পরিবারের সদস্যরা তাতে ভাগ বসিয়েছে, মূলত দারিদ্রের কারণে)। সারা দেশের শিশুরা তা পায়নি, রাজ্য সরকারগুলির উদাসীনতা ও অদক্ষতার কারণে।

সরকার একদা চালু করেছিল স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম- যে কাজে রাজ্যে রাজ্যে স্বাস্থ্য দফতরগুলির প্রয়োজনীয় সমর্থন মেলেনি। ফলে, সে উদ্যোগ কার্যত আয়রন ঘাটতি আর কৃমির আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্যোগে পরিণত হয়। বলতে পারেন কেউ, তাই বা কম কী? তবে কি মানবো যে শিশুদের অন্য সব ভিটামিন ঘাটতি মিটে গেছে? জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (NFHS) কিন্তু সে কথা সমর্থন করে না। এ কথা সত্য যে দেশে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, কিন্তু তা কমানোর উদ্যোগ তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়; বাংলাদেশের সাফল্যের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। নবজাতক বা প্রসূতি চিকিৎসায় অবহেলা এ দেশে আজও অব্যাহত (ব্যতিক্রমী রাজ্য কিছুটা হলেও পশ্চিমবঙ্গ)। এও সত্য যে অন্তত এশিয়ার দেশগুলিতে মানুষের ভিটামিন-ডি ঘাটতি উদ্বেগজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। 

দারিদ্র নিশ্চয় বড় সমস্যা (উপরের সব সমীক্ষাতেই তা ধরা দিয়েছে), কিন্তু সরকারি উদাসীনতা বা উদ্যমহীনতাও যে বেশ বড় সমস্যা তা ভুলতে পারি না। এই অতিমারি পর্বে সে সমস্যা আরও স্পষ্ট হয়েছে। অতিমারি পর্ব এইসব ত্রুটিগুলো মেরামত করার সুযোগও এনে দিয়েছে যা আমরা গ্রহণ করিনি। এর দায় কার? নিশ্চয় রাষ্ট্র এ দায় অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু কেবল রাষ্ট্রই দায়ী নাকি? আমাদেরও কিছু দায় নিশ্চয় থাকে বা আছে। দায় এড়িয়ে যেতে আমরাই কি রাষ্ট্র বা তার বিবিধ (তথাকথিত) স্তম্ভগুলিকে সাহায্য করিনি? এই অবহেলার দায় আমাদের, এর মূল্য দিতে হবে আমাদের।


3 comments:

  1. সহজ সরল আন্তরিক রচনা

    ReplyDelete
  2. কিন্তু এত পড়াশুনা করে হবে কি? চাকরি তো নেই। চাকরির সংখ্যা আরো কমছে। যত পড়বে চাকরির সম্ভাবনা exponentially কমবে। ক্যাপিটালিস্ট শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যতটা avoid করা যাবে ততই ভালো।

    ReplyDelete
  3. Pre Covid পরিস্থিতিতে লেখা-পড়ার হাল যে মোটেই ভালো ছিল না, একাধিক সমীক্ষাতে তা ধরা পড়েছে |উদাহরণস্বরূপ PROTHAM এর ASER | Poor Economics e অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী উল্লেখ করেছেন যে, শিক্ষককুলের দায়বদ্ধতার অভাব লেখা-পড়ার এই করুন অবস্থার জন্য দায়ী |

    ReplyDelete