'ঔর এক ধাক্কা দো,
মোদি সরকার গিরা দো'
শোভনলাল চক্রবর্তী
১৯ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠেই কি প্রধানমন্ত্রীর মনে হল, তিন কৃষি আইন বাতিল করতে হবে! তাঁর নিন্দুকেরা বলছেন, সামনে পাঁচ রাজ্যে ভোট। হাল বুঝেই তাই তিন কৃষি আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত। তাঁরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট আছে, কৃষক আন্দোলনের জেরে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না। তাই দূরদর্শনের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নত মস্তকে ক্ষমা চেয়ে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করলেন।
তবে আমার বিবেচনায় বলে, ভোট বড় বালাই। মানি। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের মানসিক কাঠামোই মোদীকে ব্যাকফুটে যেতে বাধ্য করল। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা আকস্মিক মনে হলেও লক্ষ করুন, দীর্ঘ এক বছর ধরে আন্দোলনকারী কৃষকরা তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক দৃঢ়তায় এ কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন যে, যতই হামলা হোক, মামলা চাপানো হোক, সরকারকে তাঁদের এই গান্ধীবাদী আন্দোলনকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি একদিন মানতেই হবে। আগ্রাসী ক্ষমতা ও দম্ভের ওপর ভিত্তি করে মোদী-শাহ ও তাঁদের বশংবদ কর্পোরেটদের অশুভ শক্তি ভেবেছিল এই কৃষক আন্দোলনের কাছে সরকার কোনওভাবেই মাথা নোয়াবে না। কিন্তু ১৯ নভেম্বর সকালে কার্যত সেটাই তাঁদের করতে হল। এ কথা নিশ্চিত যে, কৃষকদের সত্যাগ্রহের কাছে অদূর ভবিষ্যতে সরকারকে আরও পিছু হটতে হবে।
এই আন্দোলনকে যাঁরা আন্তরিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা জানেন, কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের দাবির মীমাংসার জন্য সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। বার বার আবেদন জানানো সত্ত্বেও ১১ বার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অনড় মনোভাবের জন্য। আমরা দিনের পর দিন দেখেছি, কেন্দ্রীয় সরকার এবং হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের সরকার কৃষকদের সঙ্গে বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ করেছে। বিজেপি পরিচালিত এই সরকারগুলো প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ পথে চালিত কৃষকদের মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও ধর্নাস্থলগুলোর ওপর প্রকাশ্যে ও গোপনে অন্তর্ঘাতমূলক দমন-পীড়ন চালিয়ে গিয়েছে। প্রথমে দিল্লিমুখি কৃষক মিছিলগুলোতে লাঠিচার্জ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অমানবিকভাবে যথেচ্ছ জলকামানের ব্যবহার, প্রধান জাতীয় ও রাজ্য সড়কগুলিতে সরকারি লোক নিযুক্ত করে আড়াআড়ি ভাবে দশ ফুট গভীর ও পাঁচ ফুট চওড়া পরিখার মতো গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি দিল্লির চারটি সীমানায় অদ্ভূত ধরনের ব্যারিকেড যা একই সঙ্গে পরপর সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত নৃশংস কাঁটাতারের বাধা, ভারী ভারী কংক্রিটের আড়াল, ৮ থেকে ১০ সারির লোহার খাঁচার ঝালাই করা দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, সামনের রাস্তায় অজস্র প্রাণঘাতী ছুঁচলো লোহার শলাকা পুঁতে দেওয়া, যাতে কৃষকরা এগোতে না পারে। এর সঙ্গে আছে পানীয় জলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো নির্মম নিষ্ঠুরতা। ছিল ধর্নাস্থলগুলোর লাগোয়া অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আন্দোলনরত কৃষকদের বিভেদ তৈরি করার মতো হীন চক্রান্ত। এসব সত্ত্বেও আমরা লক্ষ করলাম, বহু কৌণিক আক্রমণেও কৃষকরা দিশাহীন হলেন না। বরং এই এক বছরের মধ্যে- আজ ২৬ নভেম্বর এক বছরে পা দিল কৃষক আন্দোলন- দুর্বল হওয়ার বদলে দিন দিন শক্তি সঞ্চয় করে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল, যা শেষ পর্যন্ত মোদী সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।
এত উচ্চমানের জোরদার গণ আন্দোলন স্বাধীন ভারতে কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে আর নেই। এমনি এমনি প্রধানমন্ত্রী জাতির কাছে ক্ষমা চাননি। ভারতীয় কৃষকদের অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে এই বিজয় এসেছে। প্রজাতান্ত্রিক ভারত গড়ে ওঠার ৭১ বছর বাদে, ২০২১ সালে আমরা জানলাম, সংসদে আইন পাশ হলেও জনগণের দুর্মর প্রতিবাদের মুখে পড়ে সরকার তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য। তার ওপর ভারত যতই ডিজিটাল হয়ে উঠুক, আমাদের এই দেশ শেষ বিচারে কৃষি প্রধান। তাই কৃষকদের উপেক্ষা করা কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির নৃশংসতার পরেও কৃষকরা যে সত্যাগ্রহের পথেই অটল, তাতেই বিজেপি-আরএসএস'এর সব কৌশল ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার সকালে মোদীর আত্মসমর্পণের পরে কৃষকরা এতটাই তাজা হয়ে উঠেছেন, তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, সংসদের উভয় কক্ষে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পাশাপশি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি, বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার, কৃষি উপকরণের দাম কমানো এবং কৃষকদের ওপর থেকে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি আদায় না করে তাঁরা নড়বেন না।
না আঁচালে বিশ্বাস নেই- কৃষক নেতাদের এই মনোভাব উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কেন না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টেলিভাইজড ভাষণ থেকে যদি সরকার সরে যায়, তবে তো কৃষকদের হাতে লাঙল বা ট্রাক্টরের স্টিয়ারিং ধরার অবস্থাও থাকবে না। কৃষি আইন প্রত্যাহারে মোদীর নাটকে অভ্যস্ত পোড়খাওয়া কৃষক আন্দোলনের সচেতন নেতারা তাই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, সংসদের দুই কক্ষে এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না। শীতকালীন অধিবেশনে এই তিন আইন প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে মোদী তাঁর ভাষণে বলেছেন (ইতিমধ্যে ক্যাবিনেট তিন কৃষি আইন বাতিলের প্রস্তাব পাশ করেছে)। তবু কৃষকরা সেটি না হওয়া পর্যন্ত নট নড়নচড়ন।
একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ভেবে দেখুন, প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের 'আন্দোলনজীবীরা' দেশের প্রধানমন্ত্রী কথার ওপর ন্যূনতম আস্থা রাখতে নারাজ। আর সেটা প্রধানমন্ত্রীও বুঝেছেন। তাই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি বলেছেন, এই তিনটি কৃষি আইনের 'উপকারিতা' কৃষকদের একাংশকে বোঝানোর জন্য যে তপস্যা তিনি করেছিলেন, তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আচ্ছা মোদীজী, আপনার মতো বাচস্পতি রাজনৈতিক নেতা কেন ব্যর্থ হলেন 'আনপড়' কৃষকদের বোঝাতে? সবই কি বিরোধীদের ভুল বোঝানো? ঠিক যেমনটা আপনি ১৯ নভেম্বর দুপুরেই বললেন উত্তরপ্রদেশের মাহোবার জনসভায়! ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পরিবারতন্ত্রের দলগুলি কৃষকদের দাবিদাওয়া, চাহিদা পূরণ করতে চায় না। দুর্বিষহ করে রাখতে চায় কৃষকদের জীবন।' মোদী ফের দাবি করেন, কৃষকদের সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করছেন বিরোধীরা। তাঁর ভাষায়, 'সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করে কিছু রাজনৈতিক দল। আমরা সমাধানের রাজনীতি করি। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তারপরই আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি।' তিনি নিজেও যে রাজনীতি করছেন, সেটা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু কৃষকরা ভোলেননি।
এই আন্দোলনরত কৃষকদের কখনও পাকিস্তানি কখনও খলিস্তানি কখনও বা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছেন মোদীর দলের নেতারা। তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা যখন আমাদের অন্নদাতাদের এমন সব অপমানকর আখ্যা দিয়েছেন, তখন রাজধর্ম পালন করে তাঁদের শাসন না করে মোদী স্বয়ং আন্দোলনজীবী বলে কৃষকদের ব্যঙ্গ করেছেন। ফলে, আজ সচেতন কোনও মানুষই প্রধানমন্ত্রীর মুখের ভাষণে বিশ্বাস করবেন না। বিশেষ করে লোকসভা ভোটের আগে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় সহযোগী অমিত শাহ যেভাবে সংবাদমাধ্যমে ওসব 'জুমলা' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে নিপাট ভক্তরা ছাড়া কেউই মোদীর কথায় আস্থা রাখেন না। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?
২৬ নভেম্বর দেশ জুড়ে পালিত হোক কৃষি বিজয় দিবস। দেশ জুড়ে স্লোগান উঠুক 'ঔর এক ধাক্কা দো, মোদি সরকার গিরা দো।'
😈➰
ReplyDeleteআমি কিছু মানুষের মৃত্যু চাই
অসংখ্য কৃষকের মৃত্যুতে দুঃখিত হয়ে উনি👑 যদি নিজে নিজেই ফাঁসিতে ঝুলে পড়তেন তাহলে খুব একটা খারাপ হতো না । 🙃
https://youtu.be/QKcwVdOgaFE