তিনি ও সেই সময়
সুমিত ঘোষ
দীপেন্দু চক্রবর্তীর পরিচয় আমার কাছে লেখক, প্রবন্ধকার এবং সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে। তখন ছিল এক প্রবল রাজনৈতিক উত্থানের সময়- সত্তরের দশক। নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন সব তরুণদের মতো ছিল আমারও। কলেজ স্ট্রিট কফি-হাউস ছিল সেইসব রাজনৈতিক বন্ধু ও সাংস্কৃতিক বন্ধুদের মিলনক্ষেত্র। যাকে আমরা অনেকেই রঁদেভ্যু বলি। ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন’- এই ছিল তখনকার রাজনৈতিক শ্লোগান। সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে তখন লেখক শিল্পীরাও তাঁদের মতো করে লেখনি ধরেছিলেন, ছবি এঁকেছিলেন, গান বেঁধেছিলেন।
সেই সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘অনুষ্টুপ’ প্রকাশিত হচ্ছিল। ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় দীপেন্দু চক্রবর্তীর দুটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। একটি ‘পুস্তক সমালোচকের মস্তক বিক্রয়’, আর একটি ‘যাহাই সাংবাদিকতা তাহাই সাহিত্য নহে’। তখনকার সময়ে বিগ কমার্শিয়াল হাউসের পত্র-পত্রিকার দৌলতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা অনেক লেখক ও তাঁদের সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন এবং সাহিত্য বিচারের এক বিশেষ পালাবদল শুরু হল এই দুটি প্রবন্ধের মাধ্যমে। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের যে ধারা বঙ্কিমচন্দ্র, রবি ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু (An Acre of Green Grass), ধূর্জটিপ্রসাদের কলমে উজ্জীবিত হয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে এসেছিল। এই সমালোচনা সাহিত্য প্রাণবন্ত হল আবার; একদিকে সাহিত্যিক অসীম রায় অন্যদিকে দীপেন্দু চক্রবর্তীর সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে। সাহিত্যের সত্য আর বাস্তব সত্যের পার্থক্য নির্ণীত হল এঁদের কলমে। একই সময়ে অপরিচিত কিছু অনিয়মিত লেখক-কবিদেরও সাহিত্য শিল্পের নানা দিক নিয়ে উন্নত মানের কিছু রচনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন কবি শ্যামলকুমার ঘোষ, কবি ও সমালোচক অতনু রেজ যিনি পরে কবি অক্টাভিও পাজের একটি কাব্যগ্রন্থ ‘আদিত্য শিলা’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন বালী থেকে প্রকাশিত 'অয়ন' সাহিত্য পত্রিকায়। এ ছাড়াও লেখক-কবি জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, কবি অমলকান্তি ভট্টাচার্য, ষাটের দশকের কবি ও লেখক মৃণাল দেব সম্পাদিত কবিতা-সাপ্তাহিকীর সম্পাদকের লেখা ‘বীক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সেই সময় আরও একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা 'মধ্যাহ্ন' শৈলেন বসুর সম্পাদনায় প্রায় নিয়মিত প্রকাশ পেত। সেখানে সত্যজিৎ রায়, বিনয় ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবীও লিখেছেন। এই পত্রিকার উদ্যোগে মে-দিবসে প্রতি বছর বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হত সাহিত্য সভা। এমনই এক সাহিত্য সভা কাঁকুরগাছিতে ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক দিলীপ মিত্রের বাড়িতে হয়েছিল। সেখানে দীপেন্দু চক্রবর্তী, অচ্যুত গোস্বামী আমন্ত্রিত ছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল ইয়েনান ফোরামে সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে মাওসেতুঙের বক্তৃতা। ঐ সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে দীপেন্দুদা বলেন, ‘সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিক কোনও ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট নয়। এ দুয়ের মধ্যে আত্মিক মেলবন্ধন থাকে।’ এ কথায় তখনকার সাহিত্যের দিকদর্শন কী হবে তা নিয়ে তরুণ ও প্রবীণদের বিতর্ক অনেকটা প্রশমিত হয়েছিল। সে সময় অনেক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এবং আরও কিছু তরুণ যারা সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব চর্চায় ছিল, তারা দীপেন্দু চক্রবর্তীর নানা লেখাতে বেশ উৎসাহিত আর উজ্জীবিত হত।
সত্তর দশকের শুরু থেকে শেষ অবধি এবং পরেও, শিল্পসাহিত্য, অঙ্কন, সঙ্গীত ছাড়াও নাট্য-আন্দোলনেও এক সতেজ ও প্রাণবন্ত হাওয়া বহমান ছিল। প্রসেনিয়াম ও প্রসেনিয়াম-বহির্ভূত সব ক্ষেত্রেই চলছিল নতুন বিষয় ও আঙ্গিকের উৎসাহব্যঞ্জক পালাবদল। উৎপল দত্তের রচনা, পরিচালনা ও অভিনয়ে প্রযোজিত ও পরিবেশিত ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘তীর’, ‘ম্যাকবেথ’ তদানীন্তন সময়ে নাটকের ক্ষেত্রটিকে উর্বর করে তুলেছিল। একই সময়ে নবনাট্য আন্দোলনে ব্রেখটের ‘থ্রি পেনিস অপেরা’র বাংলা রূপান্তর ‘তিন পয়সার পালা’, পিরান্দেলোর লেখা নাটক 'Six Characters in the Search of a Dramatist' বাংলা অনুদিত হয়ে 'নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র' এবং চেকভের নাটক 'চেরি অর্চার্ড'এর বাংলা রূপান্তর 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' প্রযোজনা ও পরিচালনা করলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী নির্দেশনা দিলেন মনোজ মিত্র রচিত নাটক চাকভাঙা মধু, মোহিত চট্টোপাধ্যায় রচিত নাটক রাজরক্ত, এছাড়াও অশ্বথামা, নরক গুলজার, মহাকালীর বাচ্চা, ব্রেখট অবলম্বনে পাঁচু ও মাসী নাটকগুলি পরিচালনা করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আর ছিল এক অনবদ্য ব্রেখটিয় আঙ্গিকের মৌলিক স্বরচিত নাটক 'মারীচ সংবাদ' যা অরুণ মুখোপাধ্যায় পরিচালনা করে বাংলা নাটকে এক দিগন্ত খুলে দিলেন। তাঁরই প্রযোজনা, পরিচালনা ও অভিনয়ে রচিত হল লু সুনের ছোট গল্প 'ট্রু স্টোরি অফ আ কিউ' অবলম্বনে 'জগন্নাথ'। এর পাশাপাশি তখন সত্তর দশকের শেষ দিকে প্রসেনিয়াম বর্জনের নাটক 'বাসি খবর' আলোড়ন আনল। নাট্য রচয়িতা ও পরিচালক ছিলেন বাদল সরকার। বীর সেন নামে আরেক পরিচালক একইরকম আঙ্গিকে নাটক করছিলেন। কার্যত এ দুই ধারাই নাট্য জগৎ'কে বেশ সমৃদ্ধ করেছিল। এর অভিঘাত পড়েছিল মফস্বলে। তখন চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জনঅরণ্য, মৃণাল সেনের ইনটারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক, ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো গপ্পো, তপন সিংহের এখনই, হারমোনিয়াম তখন ছিল এক সার্বিক সাংস্কৃতিক তরঙ্গের অভিঘাত, যার ফসল লেখক দীপেন্দু চক্রবর্তী। নকশাল আন্দোলনের প্রাথমিক ব্যর্থতার পর তার নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে অনেক লেখক শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকার সাংবাদিকরা মুখর তখন।
সাহিত্য সংস্কৃতির সমালোচনা বহু দিনের নীরস একমুখি বদ্ধ জলাশয়ের ভাবনা থেকে নির্গত হল, এল এক সতেজ প্রাণবন্ত বাতাস। আলোচ্য প্রয়াত লেখক ও প্রাবন্ধিক এই প্রেক্ষাপট থেকেই উঠে এসেছেন তাঁর স্বকীয় ভাবনা নিয়ে। তাঁর প্রাগুক্ত প্রবন্ধ দুটি সাহিত্য সমালোচনার নব চিন্তনের উদ্বোধন। নিরবচ্ছিন্ন মোসাহেবী ছিল বিগ কমার্শিয়াল হাউসের এতদিনকার সমালোচনার রীতি। তার বিরুদ্ধে দীপেন্দুদা যেমন এক প্রতিস্পর্ধী অভিনব বার্তা আনলেন আবার তা এক সাহিত্যবোধ জনিত প্রজ্ঞা, নান্দনিকতা, মেধা ও সৃজনভাবনার সম্মিলিত উদ্ভাসন। তাঁর ‘সংস্কৃতির ক্ষয়ক্ষতি’ আর 'এঁরা এবং ওঁরা' গ্রন্থ দুটিতে মূল্যায়ন ছিল নকশাল আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অর্জন ও ক্ষয়ক্ষতি, আর উনিশ আর বিংশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কথা এবং কাজের মৌখিক প্রত্যয় আর যাপনের ফারাক জনিত এক নিবেদন। এ ক্ষেত্রে বলা বাহুল্য, তিনি উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের অগ্রগণ্য মনে করলেন সশ্রদ্ধ চিত্তে। বিংশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে বিশেষত বিভিন্ন বর্ণের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা লেখককে হতাশ করেছিল। আর অনেক পর নব্বই’এর দশকে (১৯৯৩ সালে) ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল আর একটি অনন্যসাধারণ রচনা: মানুষ চেনার সহজ পাঠ। তখন ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ও মার্কসবাদী সংগঠনে মানুষকে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি, এসব মিলিয়ে এক অভাবনীয় মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার এক ব্যাপ্ত অঙ্গনে এলেন লেখক।মানুষের সঙ্গে মানুষের সামান্য মেলামেশা থেকেই চটজলদি বা দু-একটা কথা ও বক্তব্যের ভিত্তিতে গোটা মানুষের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন- এ এক অদ্ভুত অভ্যাস মানুষের। তিনি এই রচনাতে বলেন, ‘একটি মানুষের মৃল্যায়নে প্রায়শই দেখা যায় পণ্ডিত চূড়ামণি ও অতি মূর্খজনের কোনও পদ্ধতিগত পার্থক্য নেই।’ বা, ‘কে কতটা আত্মভোলা, কে কতটা ধান্দাবাজ, কে বিনয়ের অবতার, কার দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না, আমরা সব বলে দিতে পারি কয়েক ঘন্টার বাহ্যিক যোগাযোগের ভিত্তিতে।’ একই পদ্ধতি লেখক পর্যবেক্ষণ করেন, ‘এক একটি বৃত্তের প্রতিনিধি হিসেবে টেকনোলজি-নিয়ন্ত্রিত মাস সোসাইটির একটি উপাদান ছাড়া কিছুই নয়।' মারকিউসের ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান’ তারই প্রতিবাদপত্র; আর্থার মিলারের ‘ডেথ অফ এ সেলসম্যান’ তারই দীর্ঘশ্বাস।
মার্কসবাদী পার্টি সংগঠনের ক্রমাগত নিষ্পেষণে, যান্ত্রিক মার্কসবাদের দাপটে মানুষ খণ্ডিত অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচেছিল এমন কথাও লেখক এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেন। ‘ব্যক্তিকে বিচার করার জন্য কয়েকটি কৃত্রিম ছাঁচ বানানোই যথেষ্ট মনে করছিলেন সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতৃবর্গ।’ ‘ব্রেখট তাঁর সেজুয়ানের ভাল মানুষে নাটকে বুর্জোয়া সমাজের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন ভালমানুষ/খারাপ মানুষের ভূমিকায় একই মানুষকে তুলে ধরে। একই রকম অসঙ্গতি কি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করে নি, যেখানে মার্কসীয় তত্ত্বের আশ্বাসটি বারবার বাস্তবে ঘা খেয়ে চুরমার হয়ে যায়।' এইসব উদ্ধৃতি মানুষের মনস্তত্ত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে সব সমাজেই যে খণ্ডিত একপেশে অভ্যাসে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে এসেছে এবং তা এক সময়ে ন্যায়সঙ্গত অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সম্পর্কে লেখকের এই গভীর পর্যবেক্ষণ মানুষ সত্তাটির আপেক্ষিকভাবে এক সামগ্রিক রূপ উন্মোচনে সক্রিয়। এই ধীশক্তি ও হৃদয়ের সমন্বয়ে লেখক বাংলা সাহিত্যেকে যথেষ্ট ঋদ্ধ করেছেন আজ এ কথা অনস্বীকার্য। লেখকের কাছে তাই আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য।
দীপেন্দু চক্রবর্তী ৭৩-৭৪ সালে প্রস্তুতি র সম্পাদক মণ্ডলীতে ছিলেন। পরে নাম হয়েছে প্রস্তুতিপর্ব। একটা ছোট জটলা হতো, ওই প্রস্তুতি, ওপেন থিয়েটার, সংশপ্তক (শেষের দুটো মূলতঃ পথ নাটকের দল)। দীপেন্দুদার সঙ্গে প্রথম হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাড়ি যাই। উনি তখন পার্ক সার্কাসে থাকতেন। পুলক চন্দ, প্রাবৃট দাস মহাপাত্র এঁরা ছিলেন প্রস্তুতি তে।
ReplyDelete‘তিন পয়সার পালা’, 'Six Characters in the Search of a Dramatist' বাংলা অনুদিত হয়ে 'নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র' এবং চেকভের নাটক 'চেরি অর্চার্ড'এর বাংলা রূপান্তর 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' --- এগুলি কি সত্তর দশকের নাটক নাকি ষাটের শেষের দিকে হয়েছিল ? সময়কাল ঠিক আছে কি?
ReplyDelete