Monday 1 November 2021

জলবায়ু নিয়ে শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬

শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর 

শোভনলাল চক্রবর্তী


সর্ষের মধ্যেই ভূত। যে কার্বন নিঃসরণ বন্ধের লক্ষ্যে আয়োজন জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৬, সেই সম্মেলনের কেন্দ্রই বছরের পর বছর ভয়াবহ মাত্রায় কার্বন নির্গমন করে আসছে। শুধু তাই নয়, সম্মেলন কেন্দ্রের অদূরেই মিলেছে মিথেন গ্যাসের ব্যাপক উপস্থিতিও। অরক্ষিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে নির্গত হওয়া মিথেনে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বায়ুমণ্ডল। এখানেই শেষ নয়, যাদের অর্থায়নে বিশাল এই সম্মেলন, সেই সব কোম্পানির বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে- প্রতি বছর লাখ লাখ টন কার্বন ছড়িয়ে ধ্বংস করছে প্রকৃতি। এই বিষয়গুলো কার্বন নিঃসরণ বন্ধের প্রতিশ্রুতিকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। 

গতকাল (৩১ অক্টোবর) থেকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হয়েছে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন। এই সম্মেলনকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি-পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, একে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি কমাতে বিশ্ব জুড়ে কার্বন নিঃসরণের সর্বশেষ সুযোগ বলেও মনে করা হচ্ছে। জলবায়ু আলোচনার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে গ্লাসগো শহরের স্কটিশ ইভেন্টস ক্যাম্পাসের বিখ্যাত দুই সম্মেলন কেন্দ্র- এসইসি আর্মাডিল্লো ও এসইসি ওভো হাইড্রো সেন্টার। কিন্তু এই দুই স্থানের বিরুদ্ধেই বেশ আগে থেকেই ব্যাপক মাত্রায় কার্বন ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তা কানেই তোলেনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। 

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম 'দ্য স্কটসম্যান' জানিয়েছে, ২০১২ সালের সরকারের এনার্জি এফিসিয়েন্সি রেটিং'এ এসইসি আর্মাডিল্লো ‘এফ’ গ্রেড পেয়েছে অর্থাৎ পাশ ফেল করেছে। যেখানে সর্বনিম্ন গ্রেড হচ্ছে ‘জি’। কার্বন কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি ও ইনসুলেশনের মতো নিম্ন বা জিরো কার্বন প্রযুক্তি বসানোর পরামর্শ দেওয়া হলেও গত ৯ বছরেও তা মানেনি কর্তৃপক্ষ। সম্মেলনের জায়গার তালিকায় রাখা হয়েছে গ্লাসগো সাইন্স সেন্টারের নামও, যেখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার ৬৫৯ টন কার্বন বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু কার্বনই নয়, কপ-২৬ সম্মেলন কেন্দ্রের কাছেই শহরের বহু স্থানে মিথেন গ্যাস লিকও শনাক্ত হয়েছে। শহরের আইব্রক্স ফুটবল স্টেডিয়ামের নিকটবর্তী একটি গ্যাস পাইপলাইন থেকে এই গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি শনাক্ত করেছেন রয়্যাল হলোওয়ে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, ওই একটি মাত্র পাইপলাইন থেকেই প্রতি বছর প্রায় ৫০ টন মিথেন ছড়াচ্ছে।

জলবায়ু সম্মেলনের জন্য বিতর্কিত এসব স্থান নির্বাচন নিয়ে বেশ আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে পরিবেশ সংগঠনগুলো। সম্প্রতি পরিবেশ আন্দোলন সংস্থা গ্রিনপিস এক বিবৃতিতে বলেছে, এটাই প্রথম কোনও জলবায়ু সম্মেলন যেখানে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’। তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে এসইসি কর্তৃপক্ষ। বলেছে, সেখানে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকেই আসে। সেই সঙ্গে জ্বালানি ও জলের ব্যবহার কমিয়ে এনেছে বলেও দাবি এসইসি কর্তৃপক্ষের। 

এর আগে প্যারিস সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের তুলনায় দুই ডিগ্রির মধ্যে এমনকি সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখার বিষয়ে একমত হন। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি তত ঝুঁকির মুখে পড়ছে। জাতিসংঘ বলছে, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বর্তমানের তুলনায় ৫৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। সেই লক্ষ্য পূরণে গ্লাসগো কপ-২৬ সম্মেলনই শেষ ভরসা, বলছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট'এর ‘ল্যানসেট কাউন্টডাউন’ গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু সংকট খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এর ফলে বিশ্বের ২০০ কোটির বেশি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ২০১৫ সালের পর থেকে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি অঞ্চল তীব্র খরার সম্মুখীন হয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলচক্রেও পরিবর্তন এসেছে। জলবায়ু সংকটে ফসলের ফলনও কমে যাচ্ছে। ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের চেয়ে বর্তমানে ভুট্টার উৎপাদন ৬ শতাংশ, গমের উৎপাদন ৩ শতাংশ ও ধানের উৎপাদন ১.৮ শতাংশ কমেছে। ১৫ বছর আগের চেয়ে বর্তমানে সাগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা সাগরের উষ্ণতা ৭০ শতাংশ বেড়েছে।

গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’কে সামনে রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৮২ পৃষ্ঠার এক রিপোর্টে জলবায়ু পরিবর্তনকে মানবসভ্যতার সবেচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপদাহ, ঝড়, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় আঘাত, রোগ বৃদ্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা বাড়ছে। রিপোর্টে ১০টি সুপারিশও করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ইপরিবহন ও স্বাস্থ্যসম্মত নগরায়ন।  অর্থাৎ, ড্রাইভিং ছেড়ে সাইকেল চালাতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হাঁটার অভ্যাসও গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। এতে কার্বন নিঃসরণ কমবে। রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি কোনওভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। সংস্থাটি বলেছে, বায়ু দূষণের মতো পরিবেশগত ঝুঁকি প্রতি বছর এক কোটি ৩৭ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

ভারতে পরিচালিত বিশ্ব ব্যাঙ্ক'এর এক গবেষণায় বলা হয়, শুষ্ক আবহওয়ায় মানুষের বিষাদ ও উদ্বেগ বাড়ছে। বর্ষাকাল এখানে দীর্ঘ হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি কমছে। কলকাতায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। এ বছর কলকাতায় ভারী বৃষ্টি হল। এরকম বৃষ্টি গত ৪৫ বছরে হয়নি।  বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়া ডেঙ্গুর বাহক মশার বংশ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। ভারতের পাঁচ বড় শহরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে উষ্ণায়নের উচ্চমাত্রার খুব বড় ভূমিকা রয়েছে। ইউনিসেফ বলেছে, ভারতের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি শিশু অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ৩৩টি দেশে বসবাস করে। এর মধ্যে ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ রয়েছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে ভারতেরও ভূমিকা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষ অন্যতম। বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণে শিল্পোন্নত দেশগুলোই দায়ী। গবেষণায় উঠে এসেছে, বড় দুই অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মিলে ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করছে বায়ুমণ্ডলে। এর মধ্যে চীন করছে ২৮ শতাংশ। দেশটি প্রতি বছর ১১ হাজার ২৫৬ মেগা টন (প্রতি মেগা টনে ১০ লাখ টন) কার্বন নিঃসরণ করছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ৫ হাজার ৪৫৭ মেগা টন। ইউরোপিয় ইউনিয়ন মিলিতভাবে ৩ হাজার ৪০৭, ভারত ২ হাজার ৬২২, রাশিয়া ১ হাজার ৪৭৮, জাপান ১ হাজার ১৯৯, রাশিয়া ১ হাজার ৪৭৮, জাপান ১ হাজার ১৯১, জার্মানি ৭৫৩, ইরান ৭২৮, সৌদি আরব ৬২৫, কানাডা ৫৯৪ ও ইন্দোনেশিয়া ৫৫৮ মেগা টন কার্বন নিঃসরণ করে চলেছে।

জাতিসংঘের উদ্যোগে কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ (কপ)'এর প্রথম সম্মেলন অর্থাৎ কপ-১ হয় ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিতে কপের জলবায়ু সম্মেলনটি প্রথম বিশ্বকে জলবায়ু নিয়ে ভাবতে সাড়া জাগিয়েছিল। ২০১৩ সালে বিশ্বের তাপমাত্রা কমাতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে ‘প্যারিস চুক্তি’ হয়। প্রথমবারের মতো সব দেশ এ চুক্তিতে একমত হয় যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শিল্প বিপ্লব পূর্ব সময়ের দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা হবে। সম্ভব হলে তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা হবে। প্যারিস সম্মেলনে ১৯৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। প্রতি বছর উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। 

এবার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সম্মেলনে নেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা অর্থাৎ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যাতে রাখা যায়, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো তাদের গৃহীত পরিকল্পনাও তুলে ধরবে। গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন কতটা সফল হবে এ নিয়ে এরই মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। চীন কপ-২৬ সম্মেলনে কী কী প্রতিশ্রুতি দেয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ মুহূর্তে চীনই বিশ্বের এক নম্বর কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানিয়েছেন, তিনি সম্মেলনে অংশ নেবেন না। এটি হতাশার সৃষ্টি করেছে। তবে চীন ইতোমধ্যে বলেছে, দেশের বাইরে তারা আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাবে না। শুধুমাত্র নিজের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছেন, করোনা মহামারীর কারণে তিনি গ্লাসগো সম্মেলনে যাবেন না। তবে কার্বন নিঃসরণ বন্ধে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করে জানিয়েছেন, তিনি সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।

সুইডেনের জলবায়ু বিষয়ক আন্দোলনের সাড়া জাগানো অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেন, গ্লাসগো সম্মেলন নিয়ে তিনি আশাবাদী হতে পারছেন না। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলায় এ সম্মেলন শেষ সুযোগ বলেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমাদের চাপ দিয়ে যেতে হবে। ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, নেতারা শুধু বড় বড় কথা বলে যাচ্ছেন, কাজ করছেন কম; কার্যকর কিছু করতে হবে। পরিবেশবিদরা বলছেন, আমরা ঢুকে পড়েছি পরিবেশ পরিবর্তনের মধ্যে, হাতে সময় নেই এবং শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর।


No comments:

Post a Comment