‘উলঙ্গ সম্রাট’দের বাগাড়ম্বর
সোমনাথ গুহ
গ্লাসগো শহরে বিস্ফোরণ। কয়েকদিন আগে থেকেই সেখানকার বৃষ্টিস্নাত পথেঘাটে লাখো যুবক যুবতীর ঢল নেমেছে। তাঁদের হাতে নানা রঙের পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার; তাঁদের অনেকে ভেঁপুতে ফুঁ দিচ্ছেন, ড্রাম বাজাচ্ছেন, উচ্চস্বরে শ্লোগান দিচ্ছেন- তাঁরা সবাই কপ২৬ (COP-Conference of the Parties)'এর কনফারেন্সে মিলিত হওয়া রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, নেতারা লিমুজিনে এসে ঠান্ডা ঘরে জলবায়ু নিয়ে যা সব আলোচনা করছেন তা বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু না। বহু বছর ধরে তাঁরা এটাই করে এসেছেন, বারবার একই আলোচনা করেছেন, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন, কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরেই।
তাঁরা বলছেন, ভিতরে যাঁরা গুরুগম্ভীর ভাষণ দিচ্ছেন তাঁরা সবাই প্রবীণ, আমরা প্রতিবাদকারীরা সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ, আমাদের সামনে রঙিন জীবন অপেক্ষা করে আছে; জলবায়ু বিপর্যয় আমাদের জীবনকেই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গ্রিনহাউজ গ্যাস কমানোর জন্য নেতারা সব ২০৬০-২০৭০ টার্গেট করছেন, তখন তো আমরা বুড়ো হয়ে যাব; যা করার সেটা এখনই করতে হবে, এখনই সময়, গতকালও সময় ছিল: বিক্ষোভকারীরা গর্জে ওঠেন; অন্তহীন সময়ের জন্য পরিকল্পনা করে আমাদের ভাঁওতা দেওয়া চলবে না।
প্রতিবাদীদের মধ্যে সোনালি চুলের সেই যুবতীকে অবশ্যই চিনে নেওয়া যায় যে কিশোর বয়স থেকেই একজন ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট এবং স্কুল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ গড়ে তুলে বিশ্ব জুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এই কপ২৬ ব্যর্থ, এটা একটা ‘গ্লোবাল গ্রিনওয়াশিং উৎসব’ ছাড়া আর কিছু নয়- গ্রেটা থুনবার্গ দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন। আমাদের নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, আসল নেতা তো এঁরা- তিনি সামনের টগবগে, উদ্বেল জনতার দিকে হাত দেখিয়ে বলেন। অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন, এই নেতারা কবে জাগবেন? নিশ্চিন্ত থাকুন এঁরা জেগেই আছেন। এঁরা খুব ভালো করে জানেন এঁরা কী করছেন। এঁরা জানেন এদের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের জন্য কী মহার্ঘ মূল্য বলি দিতে হচ্ছে। তিনি অবিলম্বে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার দাবি করেন কিন্তু একই সাথে বলেন, এঁরা এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যা নানা ছিদ্রে ভরা, যার ফলে আমরা জানি এই সব সিদ্ধান্তের খুব কমই কার্যকর হবে। উত্তাল জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, আমরা জানি আমাদের সম্রাটরা উলঙ্গ।
গত অগস্ট মাসে বৈজ্ঞানিকেরা আইপিসিসি (IPCC- Intergovernmental Panel On Climate Change) রিপোর্টে তাঁদের যে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। তাঁরা বলছেন, জলবায়ুতে এমন সব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যা অভূতপূর্ব, যা গত হাজার হাজার বছরে দেখা যায়নি। আর কিছু পরিবর্তন যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, যেমন সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি, তা লাখো বছরেও পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। গত কয়েক মাসে বিশ্বের নানা অঞ্চলে এমন সব প্রলয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা গেছে যা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। যেমন বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জার্মানির মতো দেশে শতাব্দীর সর্বাধিক বৃষ্টি হয়েছে যাতে ১৮৮ জন মারা গেছেন। একই সময়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলি তাপপ্রবাহে দগ্ধ হয়েছে; ফিনল্যান্ডের মতো দেশে এক মাসের ওপর তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, যা ঐ দেশে প্রবল দাবদাহ বলে গণ্য করা হয়। ৯ জুলাই আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় তাপমাত্রা হয় ৫৪.৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, যা নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী এ যাবৎ বিশ্বের সর্বাধিক উষ্ণতা। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২০০ বছরে ঐ অঞ্চলে সবচেয়ে মারাত্মক খরা হয়ে গেছে। প্রবল দাবদাহের ফলে আমেরিকার বনাঞ্চলে আগুন গত এক বছরে ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আমাদের দেশে ২০১৩ সালে কেদারনাথে প্রাকৃতিক তাণ্ডব স্মরণ করা যেতে পারে। বিপুল ধস এবং তৎজনিত প্রবল বন্যার কারণে ৪৫৫০টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৫৭৪৮ জন মারা যান। সেই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে জলবায়ুর পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর সাথে উন্নয়ন ও পর্যটন বৃদ্ধির নামে লাগামছাড়া বাঁধ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাস্তা হিমালয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিপন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু ঐ ঘটনার থেকে কোনও শিক্ষা না নিয়ে তথাকথিত উন্নয়নের নানা প্রকল্প সরকার চালিয়ে গেছে। হরিদ্বারের সাধুরা পর্যন্ত এইসব প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে অনশন করেছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন, তবুও সরকার নির্লিপ্ত; হিমালয়ের ভঙ্গুর ভারসাম্যকে তুচ্ছ করে তারা নির্মাণযজ্ঞ চালিয়ে গেছে। ফলত, প্রায় প্রতি বছরই হিমালয়ের পাদদেশে ছোট-বড় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে চলেছে। এই বছরের প্রথম সাত মাসে পরপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে সেখানে জনজীবন প্রবল সংকটে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাহাড়ের এক ধ্বংসাত্মক মেঘভাঙ্গা বান উপত্যকায় আছড়ে পড়ে এবং একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ বহু গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অনুমান, অন্তত ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও মাত্র ৬০ জনের শবদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি বিপুল হিমবাহ গলে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের মতে, গ্রহের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ে অন্তত ১০,০০০ হিমবাহ প্রতি দশ বছরে ৩০ থেকে ৬০ মিটার গলে যাচ্ছে যা প্রবল বন্যার আকার ধারণ করে পাহাড়ের পাদদেশের জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। হিমাচল প্রদেশে জুন থেকে জুলাই মাসে পাহাড়ে ৩৫টি ধস নেমেছে, ক্লাউডবার্স্ট, ঝটিকা বন্যা আগের চেয়ে বহু গুণ বেড়ে গেছে। অগস্ট মাসের মধ্যে অন্তত ২৫০ জন মারা গেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, গত শতাব্দীতে রাজ্যের সমতলে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বেড়েছে অথচ পাহাড়ে বৃদ্ধি ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাঁরা বলছেন, এই হারে ২১০০ সালের মধ্যে তাপ ৩-৫ ডিগ্রি বেড়ে যাবে যখন রাজ্যে বসবাস করাই কঠিন হয়ে যাবে।
জলবায়ুর অবনতির ফলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। গত দু' বছরে পরপর কয়েকটি সাইক্লোন হয়েছে যা ইতিপূর্বে বিরল। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এখন আগে থেকে ঝড়ের সতর্কবার্তা পাওয়া যায়, সাইক্লোন শেল্টারও কিছু হয়েছে, যার ফলে এইসব দুর্যোগে মৃত্যু কম হয়। কিন্তু ধারাবাহিক প্রলয়ের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ২০৫০'এর মধ্যে সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। মুম্বাই বা চেন্নাইয়ে ইদানীং যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে তা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। আগামী তিরিশ বছরে এই দুটি শহর ও কলকাতা জলমগ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গ্লাসগোতে জলবায়ু রক্ষা করার জন্য লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়েছেন। অথচ তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দিশা রবির মতো তরুণী পরিবেশ কর্মীকে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’এর সাথে যুক্ত থাকার জন্য গ্রেফতার করে কারাবন্দী করে চরম হেনস্থা করেছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে সম্মেলনে উপস্থিত কেউ তাঁকে এই কুকীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেননি। তিনি সূর্যোপনিষদের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সূর্যই নাকি সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। সৌরশক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন। অথচ আমাদের দেশে, যে কয়লা মূল পরিবেশ দূষণকারী, সেটাকেই প্রধান জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নিজে ৪০টি কয়লা ব্লকের নিলাম ডাকার হুকুম দিয়ে বসে আছেন। আমরা জানি, এর মধ্যে কয়েকটি ব্লক গভীর গহন জঙ্গলে অবস্থিত যেখানে মানুষ কদাচিৎ পদার্পণ করেছে এবং যেগুলি বন্য পশুর যাতায়াতের পথ। কপ২৬ যে কত অন্তঃসারশূন্য সেটা বোঝা যায় যখন, যে চল্লিশটি দেশ কয়লা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মধ্যে প্রধান চারটি দেশ যারা কয়লা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে তাদের নাম নেই। এরা হচ্ছে চীন, ভারত, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া।
ভারত বৃক্ষচ্ছেদন না করার অঙ্গীকারে সই করেনি; যুক্তি দিয়েছে, তাতে কাঠ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতে পারে। শুধু তাই নয়, দেশের সরকার অরণ্য নষ্ট করার জন্য আদিবাসী সম্প্রদায়কে দায়ী করে কিন্তু গ্লাসগোতে বলেছে, আমরা এমন কিছু করতে পারি না যা জঙ্গলের ওপর নির্ভর করেন যাঁরা, তাঁদের স্বার্থহানি হয়! এই দ্বিচারিতা বিরল। ভারত ২০৭০'এর মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণে পৌঁছনোর অঙ্গীকার করেছে। চীন ২০৬০'এর মধ্যে শূন্য কার্বনে পৌঁছবে বলেছে, কিন্তু একই সাথে তা সম্ভব হবে কিনা সে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া গ্রহের তাপমাত্রা যাতে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উর্ধ্বে না বাড়ে সম্মেলন সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গরিব দেশগুলিকে সাহায্য করার জন্য তহবিল করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত হল, কোনও সিদ্ধান্তই মানতে হবে এরকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, সবটাই রাষ্ট্রনেতাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
জলবায়ু বিপর্যয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তথাকথিত উন্নয়ন, উচ্ছেদ, অরণ্যছেদনের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হচ্ছেন; পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, মানুষ সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন, নতুন জীবিকার খোঁজে দেশ থেকে দেশান্তরে চলে যাচ্ছেন, দেশের মধ্যেই স্থানান্তরিত হচ্ছেন এবং পরজীবী, উদভ্রান্ত হয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান করছেন। এত বড় সম্মেলনে এই জলবায়ু উদ্বাস্তু বা Climate Refugees'দের সম্পর্কে কিন্তু একটা কথাও নেই। এরপরেও কি সন্দেহ থাকতে পারে যে কপ২৬ শুধুমাত্র একটা দেখনদারি, গ্রেটার কথায়: ব্লা, ব্লা, ব্লা…।
খুব ভালো লেখা
ReplyDelete।গোটা বিষয়টা চমৎকার ভাবে সামনে এসেছে।
খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন সোমনাথদা । 🌹💓
ReplyDelete