SIR'এর আতঙ্ক ও মৃত্যু মিছিল
আবু সঈদ আহমেদ
পশ্চিমবঙ্গে আজ এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এসআইআর নামের আতঙ্ক প্রক্রিয়াটি যেন সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। 'অনুপ্রবেশ'এর নামে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, তা আসলে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার এক পরিকল্পিত কৌশল। নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় ভোটার তালিকায় কারচুপি করার বিজেপির যে গ্র্যান্ড ডিজাইন, তা কি সত্যিই এই রাজ্যে সফল হবে? ইতিহাস সাক্ষী, বাংলার মানুষ বারবার অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
আমরা দেখলাম, সেই চর্বিতচর্বণ 'লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা' ঘুসপেটিয়া মিথ্যাচারটিকে ফানুস বানাতে সীমান্তের হাকিমপুর অঞ্চলে জমায়েত হওয়া বড়জোর শ' দুয়েক হিন্দু-মুসলমান বাংলাদেশিদের ওপর অমিত মালব্য'র আইটি সেল থেকে শুরু করে ধেড়ে আনন্দ সহ সমস্ত গোদি মিডিয়া ও রাজ্যপাল কীভাবে রে রে করে হামলে পড়ে এখন শুনশান চম্পট দিয়েছে অন্য গপ্পের খোঁজে।
বিহার থেকে শুরু। বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (Special Intensive Revision - SIR) নামে এক চূড়ান্ত হট্টগোল! বিভিন্ন বিশিষ্টজন সহ প্রাক্তন আমলা জহর সরকার জানিয়েছেন, SIR বলে কোনও প্রভিশন কখনও কোথাও ছিল না। ছিল IR। এবার এই বিশেষ নামকরণ। সে উদ্দেশ্যের কোনও ব্যাখ্যা নেই। সুজাত ভদ্র, যোগেন্দ্র যাদব, প্রভাকর পালাকর (বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের স্বামী) সহ বহু মানুষজন এই একই কথা বলেছেন।
তবে পঃবঙ্গের সঙ্গে বিহারের একটি মৌলিক ফারাক হল, এ রাজ্যে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ দেশভাগের কারণে দেশান্তরের বলি। সে ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি একটি বাস্তব সমস্যা। কমিশন এই নাগরিকত্ব বিচারের কোনও অথরিটি নয়, অথচ সেই কাজটিই তাদের করতে বলা হচ্ছে। ফলে, এক চরম বিভ্রান্তির উদয় হয়েছে। বিরোধীরা বার বার বলেছেন আর এখন বোঝাও যাচ্ছে, বিহারে নাগরিকত্বের সমস্যার থেকেও আসল উদ্দেশ্য ছিল বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সমাজকর্মীদের তরফে নির্বাচন কমিশনের কাছে বারংবার দাবি করা হয়েছে, ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ ও নাগরিক অধিকারসম্মত হয়। নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্নও তোলা হয়েছিল, ২০০২ সালের ভোটার তালিকার নামগুলো কেন সন্দেহজনক ধরা হচ্ছে? কোন যুক্তি ও নীতির ভিত্তিতে নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে, ভুলবশত বাদ পড়া নাম কীভাবে সংশোধন করা যাবে এবং কেন নাগরিকদের বারবার ভোটার হিসেবে প্রমাণ দিতে হচ্ছে? পাশাপাশি দাবি ছিল, ২০০২-০৩ সালের IR'এর পদ্ধতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তারও স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে।
বিভিন্ন সমাজকর্মীরা সাংবাদিক সম্মেলনে বেশ কিছু ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরেন। যেমন, ২০০২ সালে যে সময়ের ভোটার তালিকা নির্বাচন কমিশনের তরফে চাওয়া হচ্ছে সেই একই সময়ে মালদা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ গঙ্গার ভয়ানক ভাঙনের শিকার হয়েছিল। এমনকি, যে বুথে ভোট হওয়ার কথা তা গঙ্গায় সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ার ফলে ভোট হয়েছিল তার পাশের বুথে। ফলে, সেই সময়কার ভোটার তালিকার ১৬৮০ জনের মধ্যে মাত্র ৮৮০ জনের নাম খুঁজে পাওয়া গেছে। মালদার তৎকালীন কালিয়াচক ২ ব্লকের প্রায় ৩৫ হাজার ভোটারের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা হচ্ছে। তার পাশাপাশি এও উল্লেখ করার মতো, ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় হয়। কিন্তু ভারতে আসা এই ছিটমহলগুলোতে নাগরিক অধিকার সেইভাবে মানুষের কাছে পৌঁছেছে বলা যাবে না। তাহলে এইসব অঞ্চলের মানুষদের ক্ষেত্রে কী হতে চলেছে?
এর মাঝেই SIR নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে সামাজিক মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছে বিপ্লব ভট্টাচার্য, কমল শূর, শর্মিষ্ঠা রায়, প্রবীর দাস, সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস প্রমুখ বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের ওপর। SIR আতঙ্কে শুরু হয়েছে মানুষের মৃত্যু মিছিল। আতঙ্কে বেশ কিছু মানুষের আত্মহত্যার খবর এসেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বহু। এমনকি বিএলও'রা পর্যন্ত আত্মহত্যা করছেন, শুধুমাত্র আমাদের রাজ্যেই নয়, গুজরাত, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশেও।
বিহারের SIR প্রক্রিয়ায় আমরা কী পেয়েছিলাম? ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন ফর্ম-৬ জমা পড়েছিল ১৬.৯৩ লক্ষ, অথচ চূড়ান্ত তালিকায় যুক্ত হয়েছে ২১.৫৩ লাখ ভোটার— অর্থাৎ, অতিরিক্ত ৪.৬ লাখ ভোটার কোথা থেকে এল তা স্পষ্ট নয়। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশন ৬৯ লাখ ভোটার বাদ দিয়েছে এবং আরও ২১ লাখ যুক্ত করেছে, ফলে মোট ৯০ লাখ ভোটারের পরিবর্তন (বাদ বা যুক্ত) ঘটেছে। কিন্তু কমিশন নতুন সংযোজন বনাম SIR-এ বাদ পড়া ভোটারদের পুনর্ভুক্তির আলাদা তথ্য প্রকাশ করেনি। এতে বিরোধীরা অভিযোগ করছে যে এত বিপুল সংযোজন-বিয়োজন যাচাই করার মতো সময় কোনও দলের হাতে নেই, আর এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন কার্যত বিরোধীদের কাছ থেকে নির্বাচন কেড়ে নিয়েছে। বিহারে বিজেপি ও নীতিশ জোটের তথাকথিত বিপুল জয়ের পর এই কথাগুলোই বিরোধী শিবির থেকে ঘুরে ফিরে উঠছে। তার থেকেও বড় যে প্রশ্নটি উঠেছে, নির্বাচন কমিশন ৩০ সেপ্টেম্বর বলেছিল এসআইআর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে প্রায় ৭.৪২ কোটি ভোটারের সংখ্যা আমরা পাই যা পরের প্রেস নোটেই পরিবর্তিত হয়, তারপর আবার ভোটদানের পরেও পরিবর্তন করা হয়। যেমন, ভোটদানের আগে মোট ভোটার: ৭,৪৩,৫৫,৯৭৬, অথচ ভোটদানের পর হঠাৎ করে তা হয়ে দাঁড়াল ৭,৪৫,২৬,৮৫৮। প্রশ্ন, ভোটদান শেষ হয়ে যাওয়ার পর কি নতুন ভোটার সংযোজিত হয়েছিল? এর কোনও ব্যাখ্যাই এখনও পর্যন্ত আসেনি।
আরও আছে। ১১ নভেম্বর কমিশন বলেছিল, ৬৬.৯১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ১২ নভেম্বর তা পরিবর্তন করে বলা হল ৬৭.১৩ শতাংশ। মাত্র ২৪ ঘন্টায় ০.২২ শতাংশ বৃদ্ধি— সংখ্যাটি ছোট কিন্তু এর পিছনের গণিত ১.৬ লক্ষ ভোটকে প্রভাবিত করে। কোন ভিত্তিতে এই সংশোধন করা হয়? কোন মেশিন, কোন তথ্য, কোন রিপোর্ট এই আকস্মিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী ছিল? কমিশন আজ পর্যন্ত 'রা কাড়েনি।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? News24 চ্যানেলের রাজীব রঞ্জনের পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পশ্চিমবঙ্গের ভোট প্রস্তুতিতে বুথ স্তরে তৃণমূল কর্মীদের বাহ্যিক সক্রিয়তা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিহারের ২৭টি জেলা ঘুরে তিনি এমন দৃশ্য দেখেননি, অথচ কলকাতা, হাওড়া ও উত্তর ২৪-পরগণায় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তৃণমূলের কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি। কোথাও সরাসরি তৃণমূল দলের নামে আবার কোথাও 'বাংলার ভোট রক্ষা শিবির' নামে কার্যক্রম চলছে। একইসঙ্গে কিছু জায়গায় বিজেপিও সক্রিয়, বিশেষত বিহার ভোটের ফলাফলের পর তাদের স্টলে ভিড় বেড়েছে। এই প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ভোটারদের কাছে পৌঁছনোর লড়াই আরও তীব্র হয়ে উঠছে। তৃণমূল ও বিজেপির পাশাপাশি সিপিএমও মাঠে নেমেছে 'রেড ভলান্টিয়ার' সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে। যদিও উপচে পড়া ভিড় নেই, তবুও কিছু জায়গায় যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ তাদের উদ্যোগে অংশ নিচ্ছেন। মানুষের সুবিধার্থে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা দেওয়ালে টাঙানো সিপিএমের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে কংগ্রেস, এসইউসিআই এবং অন্যান্য বাম শরিক দলও কিছু এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, যারা ভোটার তালিকায় বৈধ নাম বাদ পড়ার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে দেখছে। নদীয়ার কিছু গ্রামে আসাদুদ্দীন ওয়াইসির মিম কর্মীদেরও দেখা গেছে।
অনেকেই মন্তব্য করছেন, যদি বিহারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তরফে এমন উদ্যোগ থাকত তবে ভোটার তালিকায় কারচুপি করা সম্ভব হত না। বিহারে সিপিআই-এমএল (লিবারেশন) ভোট প্রস্তুতির সময় তৃণমূল স্তরে সক্রিয়ভাবে SIR ফর্ম পূরণের কাজে নেমেছিল। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, ফর্ম বিতরণ করেছে এবং বাদ পড়া নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সচেতনতা তৈরি করেছে। তবে এই উদ্যোগ সারা রাজ্যে বিস্তৃত হয়নি, কয়েকটি নির্বাচনী জেলায় মূলত সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে, লিবারেশনের প্রচেষ্টা স্থানীয়ভাবে প্রভাব ফেললেও বৃহত্তর পরিসরে তা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বা অন্যান্য বড় দলের মতো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, তাদের অংশগ্রহণ দেখিয়েছে যে ছোট দলও ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে BLO'দের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রশিক্ষণ ও ফর্ম বিতরণ করতে গিয়ে তাঁরা প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। ইতিমধ্যেই একজন BLO রিঙ্কু তরফদার আত্মহননে প্রাণ দিয়েছেন, কিছু জায়গায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। ২৪ নভেম্বর তাঁরা 'বিএলও অধিকার রক্ষা কমিটি' ব্যানারের তলায় জমায়েত হয়ে এক বিশাল মিছিল করে নির্বাচন কমিশনের দফতরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। জনগণ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এবং বিভিন্ন দলের কর্মীরাও সহযোগিতা করছেন। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত ও নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে মূলধারার কিছু সংবাদমাধ্যম, যারা ইতিমধ্যেই গোদি মিডিয়া হিসেবে চিহ্নিত। বহু BLO ও সাধারণ মানুষকে বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী বলে মিথ্যা সন্দেহে হেনস্থা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল, বাম এবং অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি নিগৃহীতদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে, যা রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে সামাজিক সংহতির এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। এখানেই হেরে যায় ঘৃণা আর ভয়। এটাই বারবার আশা জোগায় আমাদের।
তবে, এখনও যেহেতু আমরা SIR প্রক্রিয়ার মাঝপথে আছি, যতক্ষণ না খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ পাচ্ছে, সর্বোপরি, চূড়ান্ত তালিকার প্রকাশ হচ্ছে, ততদিন মানুষ কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে এই ভেবে যে, আমরা তো এ দেশের নাগরিক, আমাদের অসুবিধা কীসে! কিন্তু ভোটার তালিকা প্রকাশ পেলে সে নিশ্চিন্তি কেটেও যেতে পারে যদি দেখা যায় যে ভারতীয় নাগরিকেরও নাম দলে দলে বাদ পড়েছে। বিহারে তো তেমনই হয়েছে। আর 'ঘুসপেটিয়া'? সে তো বিহারেও পাওয়া যায়নি। অথচ, এই কথাটির রোল তুলেই আজ ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদ একটি হিংস্র রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যত।

খুব সুন্দর আর নিরপেক্ষ লেখা, বড় ছোট নির্বিশেষে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ই আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট এটা লেখায় উঠে এসেছে, এটাই ভাল লাগল, এটা জনগনের কাছে আশার কথা ,, সাহস সঞ্চয় করে একযোগে এই SIR নামে বাদ দেয়ার অসাধু প্রচেষ্টার বিরোধীতা করতে হবে, এটাই বড় কথা
ReplyDeleteনিরপেক্ষ প্রতিবেদন মনে হলো না। 'ঘুষপেটিয়া' - আপত্তিকর কথা ।
ReplyDelete