বিচারকেরাও যখন সন্ত্রস্ত
অনিন্দ্য শুভ্র দত্ত
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন উমর খালিদ। অর্থাৎ, ঠিক পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি জেলে বন্দী হয়ে আছেন এবং এখনও কোনও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। উমরের এইভাবে জেলবন্দী জীবন কাটানো এক অর্থে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের অভিযোগ যে, উমর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া দিল্লি দাঙ্গার একজন মূল ষড়যন্ত্রকারী। ফলে, তাকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়। এই ষড়যন্ত্রের 'রূপকার' হিসেবে দিল্লি পুলিশ উমরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগনামা দাখিল করে সেখানে উল্লিখিত হয় মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে উমর কৃত একটি বক্তৃতা, 'দিল্লি প্রোটেস্ট সাপোর্ট গ্রুপ' নামক একটি হোয়াটস আপ গ্রুপের সদস্য হওয়া এবং এমন কিছু লোকের সাক্ষী যাদের কোনওভাবে প্রকাশ্যে আনতে দিল্লি পুলিশ নারাজ। এই মুহূর্তে উমর খালিদের মামলাটি শুধু ন্যাশনাল মিডিয়াতে নয়, ইনটারন্যাশনাল মিডিয়াতেও সমান প্রচারিত।
আজ থেকে এক বছর আগে ললিত বাচানী নির্মিত একটি তথ্যচিত্র ‘কয়েদী নং ৬২৬৭১০ হাজির হো’ দেখেছিলাম সুজাতা সদনে। ছড়ানো ছিটানো বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিংস জুড়ে আর বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরলেন ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির যে বৃহৎ ষড়যন্ত্র, তারই এক খণ্ড চিত্র। ২০১৬ সালে জেএনইউ প্রাঙ্গণে আফজল গুরু সম্পর্কিত একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের কিছু ভিডিও ক্লিপিংস এবং শ্লোগানকে বিকৃত করে মিডিয়াতে প্রচার করা হয়। মিডিয়া বিচারে কিছু ছাত্র-যুবকে দেশদ্রোহী বানিয়ে দিয়ে সারা দেশ জুড়ে তার প্রচার শুরু হয়। এই ছাত্র-যুবদের মধ্যে একটি নাম ছিল উমর খালিদ। শুধু তাই নয়, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে উমর'কে গ্রেফতার করে দিল্লী পুলিশ। এভাবেই শুরু হয় উমরের ছাত্র রাজনীতির এক নতুন পর্যায়।
উমর'কে ঘিরে তৈরি হলেও এই তথ্যচিত্রের অন্যতম বিষয় ছিল শাহীনবাগ। কেন্দ্রে আসীন এই সরকারের হিন্দুত্ববাদী এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের (মুসলিম) বিরুদ্ধে নানা ক্রিয়াকলাপের প্রতিবাদের রাস্তা ধরেই উমরের উত্থান। সেই ক্রিয়াকলাপের একটি সুচিন্তিত এবং অত্যন্ত বিভেদকামী পদক্ষেপ ছিল সিএএ আইন প্রণয়ন। এই আইনটি সংবিধানের মূল নীতি থেকে বিচ্যুত। ভারতবর্ষের মানুষের সহজাত মননশীলতা, যার দীর্ঘ ইতিহাস হল বিবিধের মাঝে ঐক্যের খোঁজ, তা এই বিভেদকামী প্রয়াসকে সহজে মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই মেনে না নেওয়া এবং তাকে প্রতিরোধের রূপ দেওয়ার একজন প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন উমর। তাই শাহীনবাগ যখন ঘটল তখন সেখানকার প্রতিবাদী প্রতিটি মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই উমরের আত্মিক সংযুক্তি গড়ে ওঠে।
২০১৪'র পর থেকে আজ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আরএসএস'এর পরিকল্পনায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নির্মাণের একটি পর্ব চলেছে। বিশেষ করে সম্প্রদায়গত ঘৃণা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্রমশ কোণঠাসা করা এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার সংহতিকে নষ্ট করে এক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণের আধিপত্যকারী সমাজ তৈরি করা, এটাই এই সরকারের অন্তর্লীন পরিকল্পনা। এভাবেই আরএসএস চেয়েছিল সংবিধানের মূল ভিত্তিকে আঘাত করতে। এইরকম একটি টালমাটাল সময়েই উমরদের প্রতিবাদের সফর শুরু। এই প্রতিবাদের অভিনবত্ব ছিল আরএসএস'এর নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যেকার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরি করা। খুব স্বাভাবিক ভাবে আরএসএস'এর মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল ভারতের সংবিধান। সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকেই তারা ভারতের সংবিধানকে সরাসরি আক্রমণ করার প্রয়াস নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে তাদের এই প্রচেষ্টা প্রচারের আড়ালে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে অন্তঃসলিলা হয়েছিল। বর্তমানে বিজেপির উত্থানের সুযোগ নিয়ে সেই অন্তঃসলিলা প্রবাহের এক বিধ্বংসী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই বিধ্বংসী প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে উমর এবং তাঁর মতো আরও যারা আছেন, তাঁদের প্রতিবাদ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যে সংবিধান দীর্ঘ সময় ধরে জনমানসের অন্তরালে এক প্রাচীন বিগ্রহের মতো প্রতিষ্ঠিত ছিল, উমররা তাকে জনতার কাছে এক প্রাণবন্ত পাথেয় হিসেবে হাজির করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর আগে এই গ্রন্থটি কখনও এত ব্যাপক ভাবে চর্চিত হয়নি। যে বেগবান জলধারা আরও ধ্বংসাত্মক হওয়ার দিন গুনছিল, তা মুখ থুবড়ে এক বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হতে বাধ্য হয়। তারই মাশুল হয়তো উমর'কে আজও গুনতে হচ্ছে।
তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনের পরে ছিল উমরের সাথী বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথন। সঞ্চালক কস্তুরী বসু। সুজাতা সদন প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি দর্শক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ধরে শুনতে চাইছিলেন সেই কাহিনি, যাতে তাঁর বুকের ভিতর চেপে বসে থাকা হতাশার জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। 'কয়েদী নং ৬২৬৭১০ হাজির হো' দেখে আমরা সবাই ততক্ষণে জেনে গিয়েছি উমরের গ্রেফতার হওয়ার নেপথ্যের খুঁটিনাটি। কিন্তু দর্শক বসেছিলেন এই কথোপকথনে বিচার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত খবর জানতে। খবরের কাগজে যতটুকু সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে উমরের বিচারের জটিলতা খুব একটা পরিষ্কার হয়নি। অথচ বিনা দোষে একজন ব্যক্তিকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রেখে দেওয়া হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব তা সাধারণের কাছে সত্যিই একটা ধোঁয়াশা। বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথনে যেটুকু বোঝা গেল তা কতকটা এইরকম:
এই বিচার প্রক্রিয়ায় যে দুটি বিষয় গুরুত্বপুর্ণ তা হল আইন ও বিচারব্যবস্থা । যে আইনে উমর গ্রেফতার হয়েছেন, অর্থাৎ ইউএপিএ, সেটির উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা পৌঁছে যাব ১৯৬৩ সালে। এই সময় ন্যাশনাল ইন্ট্রিগ্রেশন কাউন্সিল'এর অধীন ন্যাশনাল ইনট্রিগেশন অ্যান্ড রিজিওনালাইজেশন কমিটির সুপারিশে সংবিধানের ১৯ নং পরিচ্ছদে কিছু সংশোধন করা হয়। এই সংশোধন করা হয় দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বকে মাথায় রেখে। সালটা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে, ঠিক এক বছর আগে ১৯৬২ সালে ঘটে গেছে ভারত-চীন যুদ্ধ, যেখানে ভারতের সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব দুইই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে সংবিধানের ১৯ নং পরিচ্ছদের ২ নং ধারায় একটি সংশোধন করা হয়। 'দেশের সুরক্ষার স্বার্থে'র বদলে লেখা হয় 'দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে'। সাধারণ ভাবে দেখলে এটি খুবই সামান্য একটি সংশোধন, যাকে সংশোধন না বলে পরিমার্জনও বলা যেতে পারে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে এর গুঢ়ার্থ। পূর্ববর্তী বাক্যবন্ধটির মধ্যে যে স্পষ্টতা ছিল তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত এই বাক্যবন্ধটির মধ্যে। এক কথায়, 'সুরক্ষা' শব্দটির মধ্যে একটা বস্তুগত অর্থ ছিল। সে ক্ষেত্রে সংহতি এবং সার্বভৌমত্ব অনেকটাই বিষয়িগত প্রকাশ। ফলে, সংহতি এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যার মধ্যে বিভিন্নতা থাকতে বাধ্য। কোনটা গ্রহণযোগ্য হবে তা রাষ্ট্রই ঠিক করবে। এরই ভিত্তিতে ১৯৬৭ সালে তৈরি হল ইউএপিএ আইনটি। এরপরে ক্রমশ এই আইনটি সংশোধিত হতে হতে এসেছে। এই সংশোধনের সময়গুলি ১৯৬৯, ১৯৭২, ১৯৮৬, ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ ও সর্বশেষ ২০১৯।
২০১৯'এর আগে এই আইনে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত থাকার সম্ভাবনায় শুধুই অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের উল্লেখ ছিল। ২০১৯'এর সংশোধনে তার সঙ্গে যুক্ত হল, একজন ব্যক্তি যিনি কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন, তিনিও সন্ত্রাসবাদী আখ্যা পেতে পারেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই আইনের আওতায় চলে আসবেন। এক অর্থে, এই সংশোধন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অধিক সম্ভাবনা তৈরি করল। এর সঙ্গে যুক্ত হল ইউএপিএ আইনটির এমন কিছু ধারা, যেমন ৪৩ডি, যার প্রয়োগে একজন ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলস্বরূপ, বহু মানুষ যারা সরকারের নানা নীতি বা পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেছেন এবং জনমত তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছেন, তারা আজ জেলের মধ্যে বন্দী হয়ে রয়েছেন। অনেকের জামিন হতে লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। হয়তো বিচারে তাঁরা প্রত্যেকেই নির্দোষ প্রমাণ হবেন, কিন্তু জীবনের বেশ কিছু অমুল্য সময় তাঁরা আর কোনওদিন ফেরত পাবেন না।
একদিকে গণতন্ত্র নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে নানান কাঁটাছেড়া, যার ফলে তার নানান সুপ্ত দিক প্রকাশ্যে আসছে এবং অধিকারের নানান বেড়াজালকে ভাঙতে ভাঙতে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিসর আরও বিস্তৃত হয়ে চলেছে। উল্টোদিকে, ভারতবর্ষের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে নানা আইনি বিধিনিষেধ তৈরি করে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে বাক্ স্বাধীনতার কন্ঠরোধ করার জন্যে চলছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আজ যে বিরোধী দলটি এই ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে এই মুহূর্তে সতত মুখর, ২০০৮ সালে তারাই যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই ইউএপিএ আইনটিতে জামিন সংক্রান্ত ৪৩ নং ধারাটি যুক্ত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিত সম্ভবত ছিল মুম্বই শহরে ২০০৮ সালে ২৬ নভেম্বর ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হানা। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত যাই থাকুক না কেন, আজকের পরিস্থিতিতে এই আইনের যে প্রয়োগ তাতে বর্তমান সরকারের অভিসন্ধি খুবই স্পষ্ট-- যে কোনও গণআন্দোলনকে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করে আন্দোলনকর্মীদের গ্রেফতার করে দীর্ঘ সময় ধরে বিনা বিচারে জেলে বন্দী করে রাখা। এভাবে শুধু সাধারণ মানুষ নয় বিচারকদেরও সন্ত্রস্ত করে রাখার চেষ্টা চলছে। বিচারকরা বিশেষ করে নিম্ন আদালতের বিচারকরা আজও জামিনের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই নিয়ে নানান মন্তব্য এবং সমালোচনা সত্ত্বেও নিম্ন আদালতের বিচারকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথেষ্ট সাহস অর্জন করে উঠতে পারেননি। ফলে, বিচারপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন।
শুধু গণআন্দোলনকারী নয়, অনেক সময় এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে মূলধারার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এই বিষয়গুলি নিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মূলধারার বিরোধী দলগুলি যদি প্রতিবাদ না জানায় বা জনমত তৈরি করার উদ্যোগ না নেয়, তবে এই সন্ত্রস্ত পরিবেশ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে এবং এক ফ্যাসিস্ট পরিস্থিতির তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রগাঢ়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মুলধারার বিরোধী দলগুলির মধ্যে এসব নিয়ে কোন নড়াচড়া চোখে পড়েনি। কিন্তু যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন সাধারণ মানুষ যারা সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী কর্মসূচির বিরোধিতা করে জনমত গঠনের চেষ্টা করবেন তাদের একটা অংশকে এর মাশুল গুনে যেতে হবে। এটাই ভবিতব্য।

No comments:
Post a Comment