Wednesday, 5 November 2025

Condominium হিন্দুত্ব

‘অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



আপামর বাঙালি এখন মূলত দু’ ভাগে বিভক্ত: একদিকে condominium (ইস্টার্ন বাইপাস জুড়ে, কলকাতা ও শহরতলি এবং মফস্বলেরও বহু জায়গায় গড়ে ওঠা বিস্তৃত উদ্যান সম্বলিত ছ-আট টাওয়ারের উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত অধ্যুষিত আবাসিক ঘেটো) প্রসূত বিষাক্ত বিদ্বেষ-বিষ, অন্যদিকে সাধারণ আপামর শ্রমজীবী বাঙালি সমাজের মিলেমিশে বেঁচে থাকার পরম্পরা ও আকুল বাসনা। অবশ্য প্রথমোক্তের বিদ্বেষ-বিষ যে দ্বিতীয় গোত্রকেও কমবেশি প্রভাবিত করে তা যেমন সত্য, তেমনই condominium’এর ভয়ঙ্কর বাতায়নে ‘দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের’ মতো যে দু-চারজন স্থিতপ্রাজ্ঞ কেউ নেই, তাও বলা যায় না।

আসলে প্রশ্নটা হল, আজকের বিভাজন ও হিংসার রাজনীতির উৎসস্থলটা কোথায়! বলাই বাহুল্য, আজ উগ্র হিন্দুয়ানি দলের যে বাড়বাড়ন্ত, তা এমন এক উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত লালিত বর্ণাশ্রম ভিত্তিক মতাদর্শ থেকে নির্গত, বাংলায় যার সূত্রপাত দ্বাদশ শতকে বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে সেই ভয়ঙ্কর প্রথা (প্রায় দাস ব্যবস্থার মতো) চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলন ও ইসলামি সুফিতন্ত্রের উদার আবহে এবং লালন-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শে ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসে। পাশাপাশি, বাংলার দীর্ঘকালীন বাম ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবও হিন্দু বর্ণাশ্রমবাদী চিন্তা-ভাবনাকে মাথা তুলতে দেয়নি। এ ক্ষেত্রে স্মর্তব্য, ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কৃত ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’, যা ছিল হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ দূর করে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। তৎসত্ত্বেও, এক অংশের হিন্দু উচ্চবর্ণের চিন্তা-চেতনায় কৌলিন্য প্রথা সদা প্রবহমান ছিল এবং সেই সব পরিবারে কান পাতলে নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান-খ্রিস্টানদের প্রতি তাদের সর্বাত্মক ঘৃণা বেশ উচ্চনিনাদে শোনা যেত। আজ সেই সংখ্যালঘু প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু উচ্চবর্ণ গোষ্ঠীগুলিই পরিবর্তিত আবহ ও নিজ নিজ আর্থিক কৌলিন্যের পরিস্থিতিতে শহরের আনাচেকানাচে ও উদরেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো গড়ে ওঠা condominium ঘেটোগুলিতে আশ্রয় নিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষের একেকটি দূর্গ নির্মাণ করেছে। এদের whatsapp গ্রুপগুলিতে সেই ঘৃণা ও হিংসার নিত্য চাষ চলে, নির্মিত হয় ভয়ঙ্কর সব গুজব ও মিথ্যাচার। এরাই হল আরএসএস-বিজেপি’র মতাদর্শগত রসদের জোগানদার, দাঙ্গার কারিগর। আজ এদেরই স্বঘোষিত পাণ্ডা তিলোত্তমা মজুমদার, নারায়ণ ব্যানার্জি’র মতো উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তরা, যারা whatsapp গ্রুপের ফুসুর-ফুসুর ছেড়ে প্রকাশ্যে নেমে পড়েছেন বিদ্বেষের ওকালতি করতে। এদের মূল টার্গেট নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান, যারা নাকি বেশ মাথায় উঠে পড়েছে; এবং মূল উদ্দেশ্য, সেই অতি-পুরাতন, জীর্ণ ও কঠোর বর্ণাশ্রমবাদী সমাজকে আবারও ফিরিয়ে আনা যেখানে অতি সহজে ও সস্তায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও বাড়ির যাবতীয় কাজের জন্য নিম্নবর্ণের ঝি-চাকর মিলবে, যারা সদা অবনত হয়ে থাকার মন্ত্র শিখে নেবে।

এই উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের গোষ্ঠীতে যারা নিজেদের খানিক ‘প্রগতিশীল’ বলে দাবি করে, তাদের আবার দুটি স্পষ্ট বর্গ আছে: এক) বামপন্থী হিন্দুত্ববাদী অথবা হিন্দুত্ববাদী বাম-- যারা মনে করে মুসলমান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বাংলা ভরে উঠেছে (অথচ সে সবের কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই), অতএব, তাদের ঠেঙ্গিয়ে বার করে দিতে হবে। এই গোষ্ঠীর অন্যতম মুখ হলেন নারায়ণ ব্যানার্জি, যিনি ফেসবুক লাইভ করে এইসব কথা বলেছেন এবং এই গোষ্ঠীর লোকজনেরাই ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচন থেকে পরের পর নির্বাচনগুলিতে দলে দলে বিজেপি’র ভোটবাক্স উজাড় করে ভোট দিয়ে চলেছেন; দুই) ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদী— যারা মনে করে বাঙালি মুসলমানেরা কেউ বাঙালি নয়, তারা সব ‘মুজাহিদ’ (শব্দটির অর্থই তারা অবগত নয়) এবং সকলেই ‘দুশমন’। তারা প্রকারান্তরে মুসলমান (ethnic) cleansing’এর পক্ষে, দখলিকৃত নিজেদের whatsapp গ্রুপগুলিতে খুব সোচ্চারে সেইসব কথা আওড়ায়, জনপরিসরে খানিক ‘মার্জিত’ হয়ে হরেদরে মুসলমান নিধনের কথাই বলে, যেমন তিলোত্তমা মজুমদার।

পরিহাসের হলেও, আজ বাংলার বাস্তব চিত্র কতকটা এমনতরই। গত এক দশকে বিজেপি’র উত্থানে condominium-প্রসূত হিন্দুয়ানার যে নখদন্ত-যুক্ত ঘৃণ্য প্রসার ঘটেছে, তার প্রভাব বহু সচেতন ও উদার মনের মানুষকেও বিভ্রান্ত করেছে। ফেক হিন্দুয়ানার মায়ামোহে এ রাজ্যের মতুয়া ও রাজবংশী মানুষেরাও কম বোকা বনেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে, SIR’এর জুজুতেই সেই মোহ এবার কেটে যাবার পালা। কারণ, যে তথাকথিত হিন্দুয়ানাকে রক্ষা করতে এতসব ফন্দিফিকির, সেই হিন্দুরাই এবার পড়েছে সবচেয়ে বেশি বিপদে। বাংলাদেশ থেকে চলে আসা এইসব হিন্দুরা ইতিমধ্যেই ভারতে সমস্তরকম পরিচয়পত্র ও জনকল্যাণ প্রকল্পের কার্ড ইত্যাদি বানিয়ে একজন পুরোদস্তুর নাগরিক হিসেবে যখন এখানে স্থিত রয়েছেন, তখনই SIR’এর অজুহাতে তাঁদের বলা হচ্ছে সিএএ মারফত নাগরিকত্বের আবেদন করতে, যা আবারও ছিন্নমূল হয়ে পড়ার সমতুল। কারণ, নাগরিকত্বের আবেদন দেওয়া মানেই তৎক্ষণাৎ তিনি বিদেশি হিসেবে সাব্যস্ত হবেন, ডিটেনশন সেন্টারে যাবেন এবং কতদিনে তাঁর বয়ান পরীক্ষিত হয়ে তিনি নাগরিকত্ব পাবেন তার কোনও নিশ্চিতি নেই। ঠিক এই কাণ্ডটিই অসমে হয়েছে যেখানে লক্ষ লক্ষ অসমবাসী বাঙালি বেঘর হয়ে ডিটেনশন সেন্টারে দিন কাটাচ্ছেন। 

অবশেষে, মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ এই বিভেদের রাজনীতি ও উচ্চবর্ণীয় সনাতনী ফাঁকিবাজিটা ধরে ফেলেছেন। SIR’এর জুমলাবাজির বিরুদ্ধে গত ৪ নভেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে কলকাতায় গণ মিছিলে আমজনতার বিপুল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

উল্টোদিকে, মূলত যে উদ্দেশ্যে এই SIR’এর উদ্যোগ— তথাকথিত বিদেশি তকমা দিয়ে মুসলমানদের ভিটেমাটি ছাড়া করা— তা গুড়ে বালি। কারণ, কোনও সেনসাস বা কোনও ধরনের তথ্য থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না যে বিদেশ থেকে, বিশেষত বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে, লাখে লাখে নিদেনপক্ষে হাজারে হাজারে বাঙালি মুসলমান ও রোহিঙ্গারা এ দেশে ঢুকে জমি-জিরেত দখল করে সব বসে আছে। বিহারের SIR’এও গোটা পঞ্চাশের বেশি ‘বাংলাদেশি’ পাওয়া যায়নি। যে কোনও দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বৈধ-অবৈধ লেনদেনের কারণে কিছু মানুষের এদিক-ওদিক যাতায়াত থাকে, তা বড়জোর কয়েক’শো হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। ‘মুসলমান অনুপ্রবেশের’ তত্ত্বটি আরএসএস-বিজেপি’র একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক গুজব, যাকে তা’ দিয়ে condominium-বাসী উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত হিন্দুরা একটি অ্যাটম বোমা তৈরি করেছে-- চূড়ান্ত নিক্ষেপের আগেই যাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়াটা আমাদের দেশপ্রেমিক কর্তব্য।    

অতএব, আমরা আপামর বাঙালি এক তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি। এ লড়াই সারা দেশ জুড়ে বিস্তৃত। কারণ, মৌলবাদী সনাতনীরা জানে যে উদার হিন্দুত্বের মর্মবাণী বাংলার আকাশে বাতাসে চিরপ্রবহমান। সেই চিরন্তনকে ধ্বংস করে আদিম বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে বাঙালিদের (বিশেষত নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমান) ওপর ঘরে-বাইরে সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়ে আনতে হবে। সেই লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের উপর রাষ্ট্র কর্তৃক নৃশংস আক্রমণ শুরু হয়েছে। আর তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে একযোগে উপভোগ করছে condominium-বাসী উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত বাঙালি ও অবাঙালি, উভয়েই। আর ‘হাসি হাসি গন্ধে’ এই কর্মকাণ্ডকে হাওয়া দিয়ে চলেছে গোদি মিডিয়ার কুল শিরোমণি ‘এবিপি আনন্দ’, যেখানে condominium-হিন্দুদের গল্পদাদুর সান্ধ্য আসরে ছড়ানো হয় বিষাক্ত বিষ। পাশাপাশি, সোশ্যাল মিডিয়াতেও সারাদিন এইসব অলস কূপমণ্ডুকেরা বুনে চলেছে বিভেদের গরল জালিকা।

এই বিষ এতদূর ছড়ানো হয়েছে যে, অসমের এক স্কুল শিক্ষককে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করেছেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা; কারণ, তিনি রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি স্কুলের ছাত্রদের দিয়ে গাইয়েছেন। এই ঘৃণা এতদূর অবধি বিস্তৃত যে, দিল্লির পুলিশ ২৬ বছরের অন্তঃসত্ত্বা ভারতীয় বাঙালি সোনালি বিবি’কে তাঁর সন্তান সহ জোরজবরদস্তি বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছে শুধু তাই নয়, শীর্ষ আদালতের নির্দেশের পরেও তাঁদের ফিরিয়ে আনার কোনও নামগন্ধও নেই। এই অসহনীয় একবগ্‌গা পরিস্থিতিতে, অতএব, আমাদের সকলের এখন পক্ষ নেওয়ার পালা। যে বহুল চেনা-পরিচিত স্কুল বা কলেজের সহপাঠী, অফিস কলিগ, আত্মীয়-পরিজন, পাড়ার বাল্যবন্ধু, কিংবা দেখতে ভিজে-বিড়াল (কিন্তু অন্তরে লেলিহান জিঘাংসা) উচ্চবর্ণীয় ভদ্দরলোক জোর গলায় মুসলমান নিধনের সোরগোল তুলছে, অথবা, গরিব-নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের তামাশা করছে, কিংবা, বুলডোজার-রাজ ও হিন্দু-ফ্যাসিবাদী শাসনের ওকালতি করছে, বাঙালিয়ানার আদ্যশ্রাদ্ধ করছে, তাদের আজ আস্তাকুঁড়ে’তে ছুঁড়ে ফেলার সময় হয়েছে।

প্রশ্ন উঠে গেছে, আমরা কি মৌলবাদ-লালিত হিংস্র condominium-হিন্দুত্বের দিকে থাকব, নাকি, চৈতন্য-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-চিত্তরঞ্জন-নেতাজীর প্রদর্শিত পথে সকল সম্প্রদায় ও সর্বস্তরের মানুষদের নিয়ে এক উদার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের বাসিন্দা হব! তাহলে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’র সেই অমোঘ কথাগুলিকে: ‘হিন্দু মহাসভা ত্রিশূল হাতে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ভোট ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছে। গেরুয়া পোশাকে ত্রিশূল দেখলেই হিন্দুরা শ্রদ্ধায় নত হয়। হিন্দু মহাসভা ধর্মের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে প্রবেশ করে ধর্মকে কলুষিত করেছে। প্রতিটি হিন্দুর উচিত এর নিন্দা করা। এই বিশ্বাসঘাতকদের জাতীয় জীবন থেকে বিতাড়িত করো। এদের কথা শুনো না।’ (ঝাড়গ্রামের জনসভা, ১২ মে, ১৯৪০)।

আসুন, মাঠ বাড়িয়ে খেলি।


3 comments:

  1. লেখাটির উদ্দেশ্য ভালো, কিন্তু উদ্দেশ্য সফল কি? জনসংখ্যার নিবিড় পরিসংখ্যান চাই, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যুক্তিতর্ক চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তরুণ লালা9 November 2025 at 07:16

      একদম তাই। জনগণনা হচ্ছে না কেন?

      Delete
  2. সময়োচিত প্রতিবেদন। ব্যপক প্রচার দরকার।

    ReplyDelete