আন্দোলনই এখন পথ
সুমন সেনগুপ্ত
বিহারের নির্বাচনের পরে আবার নতুন করে নির্বাচন কমিশনের দিকে আঙুল ওঠা শুরু হয়েছে। অভূতপূর্ব ফলাফল যা এসেছে, তাতে এই অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিহারে যে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচন কমিশনার দফতর থেকে জানানো হয় যে বিহারে মোট ভোটার ৭.৪২ কোটি। কিন্তু ফলাফল ঘোষণা হবার দিনে জানা যায় যে ঐ ভোটারের সংখ্যা ৭.৪৫ কোটি, অর্থাৎ ৩ লক্ষ বেশি। এই ৩ লক্ষ ভোটার কারা? তাঁদের নাম তালিকায় যে উঠল, তাঁদের মধ্যে কতজন আছেন যাঁদের নাম প্রাথমিকভাবে বাদ পড়েছিল? তাঁরাই কি এই ৩ লক্ষের মধ্যে আছেন, না এই সংখ্যাটাই ভূতুড়ে-- সেই প্রশ্নও উঠছে। 'অল্ট নিউজ'এর মহম্মদ জুবেইর যে ভুয়ো ভোটারদের ভোট দেওয়ার কিছু প্রামাণ্য ছবি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে দিয়েছেন, যার মধ্যে আরএসএস'এর রাকেশ সিনহা’র ছবিও আছে, এরাই কি মূলত এই ৩ লক্ষ ভোটারদের অধিকাংশ?
রাজ্যসভার সাংসদ কপিল সিব্বল ভোটের পরে আরও মারাত্মক অভিযোগ করেছিলেন যে, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে যে ভোটারদের বিহারে ভোট দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁরা সবাই কি তাহলে ঐ ভূতুড়ে এবং ভুয়ো ভোটার, যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যেই বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী প্রক্রিয়া চালানো হয়েছিল? নাকি আরও কোনও রহস্য আছে?
'রিপোর্টার্স কালেক্টিভ' কিংবা অজিত আঞ্জুমের মতো বহু সাংবাদিক বারংবার দেখাচ্ছিলেন যে বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে একের পর এক অনিয়ম হচ্ছে। দেখাচ্ছিলেন, টোলার পর টোলা ধরে ধরে বিহারের বিরোধীদের জেতা আসনে বেছে বেছে বাদ দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। অজিত আঞ্জুমের বহু ভিডিও আছে যাতে দেখা গেছে বুথ লেভেল অফিসাররা বাড়িতে বসে নাম তোলার চেষ্টা করেছে; যার ফলেই বাদ গেছেন প্রাথমিকভাবে ৬৭ লক্ষ মানুষ। পরে অবশ্য দেখা গিয়েছিল, ৪৭ লক্ষ মানুষকে বাদ রেখেই বিহার বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে।
ভোটের ফলাফলের পরে যে তথ্য আসছে তাতে আরও চমকে দেওয়ার মতো বিষয় আছে, যা নিয়ে কথা বলাটা এখন সময়ের দাবি। দেখা যাচ্ছে, যে বিভিন্ন বিধানসভায় যত মানুষ বাদ পড়েছেন, তার যে হিসেব তা সরাসরি বিজেপি এবং এনডিএ জোটের জেতায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয়, বিজেপি জেডিইউ'র থেকেও বেশি আসন পেয়েছে। তথ্য বলছে, বিহারে এনডিএ যে ২০২টি আসন জিতেছে তার মধ্যে ১২৮টিতে জয়ের ব্যবধান ওইসব আসনের ভোটারদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া ভোটারের সংখ্যার তুলনায় কম। তবুও অনেকে ভাবছে যে রাহুল গান্ধীর অকর্মণ্যতা এবং আরজেডি'র অতীতের দুঃশাসনের স্মৃতির কারণে বিরোধী দল হেরেছে। সেটা ভাবতেই পারেন, তথ্য কিন্তু তা বলছে না। বিহারে পোস্টাল ব্যালটেও কিন্তু বিরোধী মহাগঠবন্ধন এনডিএকে টেক্কা দিয়েছে। পোস্টাল ব্যালটে মহাগঠবন্ধনের ১৪২'এর তুলনায় এনডিএ পেয়েছে ৯৮টি আসন। তার মানে সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদেরও ক্ষোভ ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই সমস্ত তথ্যকে সরিয়ে রেখে যারা বিহার নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্লেষণ করবেন তা একপেশে হতে বাধ্য।
অবশ্যই বিহারে মহাগঠবন্ধনের অন্তর্গত কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল, যা বেশ কিছু আসনে বিভিন্ন শরিকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ফলে নিশ্চিতভাবে ভোটারদের মধ্যে ভুল বার্তা দেয়। বলতে হবে আসন বন্টন নিয়ে আলোচনায় রাহুল গান্ধীর অনুপস্থিতির কথাও। জিজ্ঞেস করতে হবে, তাহলে কি ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়' শ্লোগান পরোক্ষে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনকেই বৈধতা দিল? কোনও কোনও সাংবাদিকের বিশ্লেষণ এই যে, ভোটের আগে মহিলাদের দেওয়া নীতিশকুমারের ১০ হাজার টাকার ঘুষ কাজ করে গেছে শেষ মূহুর্তে, তাই এই ফলাফল। কেউ কেউ বলছেন, এবারের ভোট ছিল মেরুকরণের এবং বিরোধীরা নীতিশকুমারের এই চালে কুপোকাত হয়েছেন। আবার কেউ বলছেন, বিরোধীরা এই বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ না হওয়ায় এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা উল্লঙ্ঘন করেই সবার চোখের সামনে মহিলাদের ভোট কেনা, সেই জন্যেই এই ফলাফল। অনেকে এও বলছেন, তেজস্বী যাদবের নাম মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য ঘোষণা করার জন্যেই বিজেপি’র সুবিধা হয়েছে বিহারের জঙ্গলরাজের স্মৃতিকে আবার সামনে নিয়ে আসতে। অনেকে বলছেন, গত নির্বাচনে নীতিশকুমারের মদ বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মহিলারা এবারও সমর্থন করেছেন বলেই তাঁরা দু’ হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন এনডিএ জোটকে।
এই সমস্ত কিছু নিয়ে কথা হতেই পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিহারে যে সব 'চাঙ্গাসি হ্যায়' তা অতি বড় বিজেপি সমর্থকও স্বীকার করছেন না। ২০১০'এর পরে ২০২৫-- এই কুড়ি বছরে কি নীতিশকুমারের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে এনডিএ জোটের জেতার স্ট্রাইক রেট প্রায় ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেছে? ২০১০ ছিল নীতিশকুমারের উত্থানের সময়, তার সঙ্গে কি পড়ন্ত বেলার নীতিশকুমারের কোনও মিল পাওয়া যায়? রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক সিরিয়াসনেস নিয়ে আপনি কথা তুলতেই পারেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে বিজেপি'র নিজের কব্জায় নিয়ে আসার পরে ভোট চুরিকেই আইনি বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা না বললে তা অন্যায় হবে। আসলে nothing succeeds like success। সেই জন্যেই হয়তো সমস্ত আলোচনাকে আজ পিছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বিরোধীরা এই মুহূর্তে কী করতে পারে তা নিয়ে নানান তর্ক চলছে নানা মহলে। অনেকে বলছেন, এরপর থেকে সমস্ত নির্বাচন বয়কট করা উচিত। কেউ বলছেন, বিরোধী যে কয়েকজন বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা বিধানসভা বয়কট করুন। তবে যেহেতু সিপিআইএমএল এই মহাগঠবন্ধনের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক এবং তারা বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর সবচেয়ে বেশি বড় সমালোচক ছিল, তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। বিহারে ভোটের দিন দেখা গেছে, বহু প্রান্তিক মহিলারা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পেরেছেন তাঁদের ভোটাধিকার নেই। এই বাদ যাওয়া মানুষদের তালিকা বানিয়ে যদি সিপিআইএমএল নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ তৈরি করে পুনরায় তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তবে সেই লড়াইকে কিন্তু অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
নির্বাচক তালিকা তো শুধু ভোটাধিকার নয়, এটা নাগরিকত্বেরও অন্যতম শর্ত। সেই নাগরিকত্বের লড়াইকে যদি সিপিআইএমএল নেতৃত্ব দেয়, তাহলে তা বাংলার রাজনীতিতেও তাঁদের প্রভাব বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। প্রাথমিকভাবে অন্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনে নামতে না চাইলে তাঁদেরকেও এই লড়াইতে ধীরে ধীরে সামিল করানো যেতে পারে। এই লড়াই কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী, এই লড়াই গরিব খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই। এই লড়াই-ই কিন্তু সিপিআইএমএলকে একদিন বিহার জুড়ে পরিচিতি দিয়েছিল।
নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে। এটাই উপযুক্ত সময় মানুষের আন্দোলন গড়ে তোলার। এছাড়া এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর এই electoral fascism'কে আটকানোর আর কোনও পথ নেই।

সুন্দর! তবে নির্বাচনী পরীক্ষায় বিজেপি নিষ্ঠাবান ছাত্র, সারা বছর লেখা পড়া করে। সেখানে অধিকাংশ বিরোধী দল পরীক্ষা কাছে চাপলে পড়তে বসে, এটাএ বিবেচ্য। আর নির্বাচনের কদিন আগে ভোটার তালিকা সংশোধন করা যাবে, কদিন আগে প্রকল্পে টাকা ঢালা যাবে সেই প্রশ্নে দিন ক্ষণ প্রস্তাব করে দরকারে সংশোধনী আইন নিয়ে আসার চাপ দিতে হবে!
ReplyDeleteপ্রশান্ত ভূষণ বলেছেন যোগ নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে দেড় কোটি মহিলাদের দশ হাজার করে পাবলিক ফান্ডের টাকা দেওয়া হয়েছে এবং সেটাই এই নির্বাচনের রেজাল্ট এর অন্যতম কারণ, এই বিষয়েও কিছু তথ্য দরকার
ReplyDeleteঅবশ্যই কোর্টে কেস করতে হবে।
ReplyDelete