Monday, 17 February 2025

'গোটা লোকটাই তো একটা গান'

মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ

প্রবুদ্ধ বাগচী


(২৫ জুন ১৯৪২ - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত প্রতুলদার অনেকদিনের বন্ধু সেটা বোধহয় গত শতকের নব্বইয়ের গোড়ার দিক তিনি তখন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বিপরীতে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সদর দফতরের সব থেকে উঁচুতলায় একটা বড় মাপের ঘরে বসতেন অতবড় অফিস-চেম্বারে অমন ছোটখাটো মানুষটি যেন প্রকাণ্ড আয়তক্ষেত্রের মধ্যে একটা বিন্দু কিন্ত সেই বিন্দুবৎ মানুষটি যে চাইলেই এক বিরাট বৃত্তের পরিধি হয়ে যেতে পারেন সেটা সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমুগ্ধ বিস্ময়েপারিব না' এ কথাটি বলিও না আর,/ কেন পারিবে না তাহা ভাব একবারএই চেনা ছড়াটি তিনি আমাদের সামনে বারবার উচ্চারণ করছিলেন, আর অল্পে অল্পে আমরা দেখলাম এক আবেশময় সুরের আবরণে ছেয়ে যাচ্ছে এই উচ্চারণ পরিচিত ছড়া আমাদের দু' জোড়া চোখের সামনে একটা গানের পাখনা মেলে উড়ে গেল এইভাবে কলকাতার মধ্য দুপুরের অফিসপাড়ায় ছড়িয়ে যেতে লাগল সেই আশ্চর্য সঙ্গীতের আবেশ প্রতুলদা এমনই ছড়াকে, কবিতাকে ভাসিয়ে দিতে পারেন সুতীব্র সুরের উড়ালে ম্যাজিশিয়ানের মতো হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে তুলে আনতে পারেন সুরের পুষ্পস্তবক

এই মানুষটার লেখা গান প্রথম শুনি আশির দশকের মাঝামাঝি যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা দলেবলে গাইতমুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি,/ সেদিন সুদূর নয় আর--/ দ্যাখো লাল সূর্যের আলোয় লাল/ পূর্ব সমুদ্রের পার’— তখনও সেই অবেলার দিনযাপনে লাল সূর্য আর পূব দিগন্তের একটা অনিবার্য সংযোগ এতটা মর্মান্তিকভাবে ফিকে হয়ে যায়নি খ্যাত গানের দলগণবিষাণ’ তাদের সংকলিত গানের বইয়ের নাম রেখেছিল ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’। সেই বইয়েই পড়েছি এই গান, তবে গানের গীতিকারকে চেনার কোনও সুযোগ ছিল না এই একই কথা কিন্তু বলেন অনেকেই সত্তর দশকের আগুনে সময়ে তাঁর গান মুখে মুখে ফিরেছে গণসংগ্রামের ঢেউয়ের চুড়োয়, কারখানার গেটে— রাজনৈতিক সমাবেশে গাওয়া হচ্ছে তাঁর সব বিখ্যাত গান কিন্তু মানুষটাকে কেউই চেনেন না কোভিড কালেরেডিও কোয়ারান্টাইনতাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে তিনি নিজেও জানিয়েছিলেন এই অভিজ্ঞতা বজবজের শিল্পাঞ্চলে গান করতে গেছেন, ধরেছেন তাঁর চেনা গান আর স্থানীয় মানুষ এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন, এ গান আপনার বাঁধা? আমরা তো আপনাকে চিনিই না! শুনেছি,চুঁচড়োর ভূমিপুত্রপ্রতুলের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল চুঁচুড়া-চন্দননগরে— তাঁর নামেই হল ভর্তি হয়ে যেত একসময় তবু দীর্ঘদিন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান বলে কোনও ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি সেটা আমাদের জাতির অসভ্যতা

এ হেন মানুষটাকে যেদিন প্রথম মঞ্চে গান গাইতে দেখি সেদিন আমার অভিজ্ঞতা ভাল হয়নি বাংলা আকাদেমির হল সেই অর্থে গানের প্রেক্ষাগৃহ নয় তবু এমনই এক অনুষ্ঠানে সেদিন মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি, আগে-পরে ছিলেন অজিত পান্ডে, ঋষিণ মিত্র সদ্যপ্রয়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরযেতে পারি কিন্তু কেন যাবকবিতার একটা কদর্য সুর করে অজিত সেদিন নিরাশ করেছিলেন আমাদের পাশাপাশি, প্রতুলকে সেই মঞ্চে শুনে আমার তৃপ্তি হয়নি একটুও গান চলাকালীন আরেক গান-পাগল বন্ধু আমায় বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলল, এটা কী হচ্ছে! এমনভাবে হাত-পা নেড়ে কি গান হয় নাকিসত্যি বলতে কি, ওই মুহূর্তে তাঁর বিরাগের সুরে সুর না মিলিয়ে পারিনি তাহলে কি গানের পারফরম্যান্সের থেকে কথাকার ও সুরকার হিসেবেই তাঁর পরিচয় প্রধান?

ঠিক এই প্রশ্নটাই তোলার সুযোগ পেলাম কবীর সুমনের সামনে এই ঘটনার কিছু পরেই কবীর ভুল ভাঙালেন বললেন, আরে ওই গোটা লোকটাই তো একটা গান! প্রতুলদার গান শুধু শোনার নয়, দেখার শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গ আর অঙ্গচালনা দিয়ে একেকটা গানকে ধরতে চান তিনি তাঁর গানে প্রিল্যুড-ইন্টারল্যুড সবই তিনি, তাঁর গানে যন্ত্রের কোনও অনুষঙ্গ নিতান্তই অবান্তর এই শারীরিক উপস্থিতি দিয়ে কীভাবে এক খোলা আকাশের নীচে মানুষকে উদ্দীপ্ত করা যায় তার একটা জ্যান্ত প্রদর্শনী দেখার সুযোগ ঘটে গেল বেশ কিছুদিন পরে 

তখন লালগড়ে পুলিশি জুলুম নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে, সেখানে তৈরি হয়েছেপুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটি কলকাতার মিডিয়া আর 'সুশীল সমাজ' প্রায়ই যাতায়াত করছেন জঙ্গলমহলে, যাঁদের অনেকেই কোনওকালে সেখানে যাননি বা সেখানকার মানুষের জীবনধারণ নিয়ে আদৌ চিন্তিত হননি ২০০৮-এর মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে লালগড় তথা জঙ্গলমহলের আদিবাসী সংগঠনগুলি কলকাতায় সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় সেই দুপুরে মেট্রো চ্যানেলে জমজমাট ভিড়, রাস্তায় চেয়ার পেতে বসে আছেন সমাবেশের দুই প্রধান সংগঠক অপর্ণা সেন ও শাঁওলি মিত্র আছেন মহাশ্বেতা দেবীতরুণ সান্যাল সহ নানা পরিচিত মুখ যারা সেই সময় সরকার-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত আছেন জঙ্গলমহলের পরিচিত যোদ্ধা ছত্রধর মাহাতো, শিবু সরেন ও আরও কেউ কেউ, রয়েছেন রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রতুলদা থাকবেন আর গান হবে না তা কি হয়গান হল তাঁর নতুন বাঁধা গান, লালগড়ের আন্দোলনকে কেন্দ্রে রেখে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে খোলা রাস্তার ওপর মাইক ব্যবহার হবে কী করে? গোটা শরীর দিয়ে গান ধরলেন তিনি আর এই অধম ছোট্ট একটা ডিজিট্যাল ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডিং করছিল সেই পারফরম্যান্স সমবেত জনতার শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই সুরের আগুন দুলছিলেন লালমাটির যোদ্ধারা, রিচার্জড হচ্ছিলেন তখনও মেট্রো চ্যানেলে সমাবেশ করার জন্য ছুটে ছুটে আদালতে যেতে হত না আয়োজকদের অনুমতি পেলেও পুলিশ এসে চেন আর গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে দিত না সমাবেশস্থল বা সময়সারণি হাতে ধরিয়ে মুচলেকা নিত না, এই সময়সীমায় অনুষ্ঠান শেষ না করলে পানীয় জল বা শৌচাগার বন্ধ করে দেওয়া হবে পথচলতি লোকজন কেউ কেউ নিশ্চয়ই চিত্রাভিনেত্রীর মুখ দেখতে এসেছিলেন সেদিনকিন্তু সবাই তাই নন— তাঁরা গলা মেলাচ্ছিলেন সেই সহজ সুরেরশয়তানিতে প্রতুল এতটাই পারতেন এই ঘটনার অল্প কয়েক মাস পরে সেদিনের মঞ্চে উপস্থিত এক যোদ্ধাকে ঘুমন্ত অবস্থায় যৌথবাহিনী গুলি করে মারে ও লাশ বাঁশে ঝুলিয়ে সাংবাদিকদের সামনে ফটোসেশন করে অকালনিহত সেই তরুণের ঘুমের ভিতরেও কি চারিয়ে গিয়েছিল প্রতুলের গান?

এটা ঠিক, বাংলা আধুনিক গানের যে চলনবলন ছিল তাতে কিছুগণসঙ্গীতজাতীয় গান ছাড়া আলাদা অভিজ্ঞান তৈরিই হয়নি, যতদিন না কবীর সুমন নামক এক ভগীরথ বাংলা গানেসুনামি’ ঘটান প্রতুলের গানের শুরু তার অনেক আগেই তাঁরবোকাবুড়োর পাঁচালিবাদাবানল, জ্বলুক দাবানলকিংবাআমাদের যেতে হবেবাসব মরণ নয় সমানগানগুলো একসময় প্রচুর গীত হয়েছে নানা গানের দলে কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া বা অভিঘাত সীমাবদ্ধ ছিল একটা ছোট রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে এই আবহের বদল ঘটে সুমন-উত্তর জমানায়, কেননা তখন মানুষের মধ্যে একটা নতুন গান শোনার চাহিদা তৈরি হয়েছে এতে অভিমান করার কিছু আছে বলে মনে হয় না, একেক যুগ মুহূর্তে এমন ঘটেই থাকে সেদিক দিয়ে প্রতুলের বৃহত্তর পরিচিতি ঘটতে সময় লেগেছে বেশ কিছু বছর ঠিক সেই সময়টায়, উত্তর-বিশ্বায়ন জমানায়, আলাদা করেগণসঙ্গীতঘরানার গানের আর তেমন প্রাসঙ্গিকতা নেই সম্ভবত প্রতুল সেটা বুঝেছিলেন। তাই শঙ্খ ঘোষ, অরুণ মিত্র বা ব্রেশটের কবিতায় সুরারোপের মধ্যে দিয়ে তিনি খুলে দিতে চাইছিলেন অন্য একটা দিগন্ত বাংলা আধুনিক গান যা ঠিক ততটা আর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উত্তাপে হাত-সেঁকা নয়, এই পর্বে আবার আমি প্রেমে পড়ি প্রতুলের যার উপলক্ষ ছিলবাবরের প্রার্থনা এই গানে কী যে অসামান্য এক কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি, তা একমাত্র তিনিই জানেন একই জাদু পেয়েছি অরুণ মিত্রেরআমি এই বয়সে বলছিকবিতায় সুরারোপের দুঃসাহসে আমাদের স্বরলিপিতে কোমল সুরগুলির মধ্যে একটা পরিব্যাপ্ত হাহাকার আছে— সেই শূন্যতাকে কবিতার বিভাসে ও গানের ললিতে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া সন্দেহ নেই, এক গভীর মনীষার কাজ কিন্তু যত লোকে তাঁরআমি বাংলায় গান গাইশুনে শুনে হিট করিয়েছেন তাঁরা প্রতুলের অন্য নানা কাজ একটু খুঁজে-পেতে দেখবেন

প্রতুলদার গান শেষ সামনাসামনি শুনেছিলাম ২০১৮'এ, প্রয়াত সন্দীপ দত্ত-র লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির বার্ষিক অনুষ্ঠানে। ওঁকে অনুরোধ করেছিলাম, ‘আমাদের যেতে হবেআরও একবার মঞ্চে গাইতে কথা রেখেছিলেন কিন্তু এটাও ঠিক, একেবারে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি ঠিক কথা রাখেননি আজীবন যে গভীর আদর্শ ও অবনত জীবনের কথা তিনি বলেছেন গানে, বজায় রেখেছেন নিজের এক স্বতন্ত্র সঞ্চারপথ, কোথাও যেন তাঁর সাম্প্রতিক অবস্থান তাঁকে একটু অচেনা আর ঘোলাটে করে দিচ্ছিল আমাদের কাছে সরকারি খেতাব নেওয়া বা সরকারি মঞ্চে গান গাওয়া শিল্পীর নিজস্ব চয়েস— আসল কথা হল তাঁর অবস্থান, তাঁর প্রতিক্রিয়া এটা আমরা সকলের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করি না কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই করি; প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন লালগড়ের আমলে যেমন রাজ্যের সবকিছু ঠিকঠিক চলছিল না বলেই তিনি নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছিলেন, ২০১১-উত্তর সময়কালেও কি সব কিছু খুব অনায়াস, স্বাভাবিক, ছন্দোময়? গানে যিনি লিখেছিলেনসেই আলোভরা দিন আনতে হবে’, সেই আলোকের কোন ঝর্নাধারা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এই গ্রস্ত সময়ের ভিতর?

আসলে এসবই একটা মস্ত ফাঁদ প্রতুল গান-স্যালুট পেলেন কিন্তু তাঁর গানের কোনও স্বরলিপি আজও তৈরি হল না তাহলে এর পরে কে তাঁর গান গাইবেন? কেমনভাবে গাইবেন? গানের মানুষের জন্য যারাগান স্যালুটবরাদ্দ করেন এগুলো তাঁরা ভাবেন না, ভাবার কথাও নয় তবে কি এইখানেই ফুরিয়ে গেল তাঁর গানের স্বতন্ত্র ধারাদেখেশুনে মনে পড়ে যায় আরেক মুখুজ্যের কথা জোর করে তাঁরদান-করা দেহ’ ছিনতাই করে চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল না!


1 comment:

  1. খুব ভালো আলোচনা। নির্মোহ বিশ্লেষণ।

    ReplyDelete