কেউ শব্দ কোরো না
অমৃতা ঘোষাল
সাজানো বাগানে বেশ কিছু রঙিন আর সাদা-কালো ছবির মতো ফুল ছিল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো! আর গভীরভাবে দেখলেই দ্রষ্টার বুকের মধ্যে স্বর্গসুখকে ছাপিয়ে প্রকট হবে গুলজার এক নরক। বাস্তববাদী নাট্যকার যে অপার নাট্যজগতে প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা, তার সার্থক উপমা মনোজ মিত্র।
ব্রিটিশ-ভারতের খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে জন্ম নেওয়া মনোজ শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশভাগের ফলাফল। খুলনা তাঁর জন্মভূমি হলেও আর ভারতভূমি হিসেবে রইল না! কাঁচা বয়সেই সৃজনশীল রচনায় দক্ষ মনোজকে যথেষ্ট ভাবিয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের স্বাধিকারপ্রমত্ত রাজনীতি। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে নাটকের অভিনয় দিয়েই তাঁর নাট্যজগতে পদার্পণ, বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই 'imitation of an action'-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক 'রোগের চিকিৎসা'-র অভিনয়ে, হাঁস-চুরি-করা বালকটির ভূমিকায় তিনি এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কোনও অনুকৃতি নয়! জামার ভেতর গোটা হাঁস লুকিয়ে শিশু-মনোজ স্টেজে এসে অভিনয় করল। তবে হাঁসের আঁচড়ে-কামড়ে পেট-বুক রক্তাক্ত হয়ে তাঁর সহ্যসীমাও সহজেই অতিক্রান্ত হয়েছিল। দর্শক অনুভব করেছিল, নাটককে সাধারণ দর্শকের বিশ্বাসযোগ্য তথা 'universalized' করে তোলার জন্য তাঁর প্রতিটি সত্তা চূড়ান্তভাবে উন্মুখ। সেই যন্ত্রণায় মাখা কৌতুক-স্মৃতি সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারেও আমরা খুঁজে পাব।
দেশভাগের প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্তর-মর্যাদার বহু মানুষ। মাতৃভূমি ছেড়ে ১৯৫০ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন এই বাংলায়। বেলেঘাটার ভাড়াবাড়ি, বসিরহাটের বাড়ি পেরিয়ে তরুণ মনোজ মিত্র থাকতে শুরু করলেন বেলগাছিয়ার বাড়িতে। এরপর স্কটিশচার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে। আর তখন থেকেই একটা নাটক রচনার প্রতিবেশ নিজের চারিপাশে আবিষ্কার করে ফেলেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী আর দীপার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) মতো বন্ধুদের সান্নিধ্যে থিয়েটারের সঙ্গে একেবারে গভীর সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। সেই পার্থর অফুরান উৎসাহেই ১৯৫৬ সালে গড়ে ওঠে নাটকের দল 'সুন্দরম'। চলচ্চিত্র-সংরূপের সঙ্গে জড়িয়ে নাটকের এক অভিনব দিশা সন্ধান করেছিল সেই দল। তাই 'পথের পাঁচালী'র নাট্যরূপ মঞ্চে উপস্থাপিত করার পরিকল্পনা করেছিল সেই দল, যদিও মনোজ প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন সমকালীন বাস্তবতার জ্বলন্ত পাবককেই। সম্ভবত প্রদর্শনধর্মী উন্মাদনা আর যুগীয় প্রবণতার কিছুটা বিপরীতে হাঁটতেন তিনি।
দর্শন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়াকালীন ১৯৫৯ সালে লিখলেন প্রথম নাটক 'মৃত্যুর চোখে জল'। ২১ বছরের যুবার কলমে সেই একাঙ্কের পরতে পরতে দীপ্ত হয়ে উঠল এক বার্ধক্য-আক্রান্ত প্লট। শৈশব থেকেই বৃদ্ধ পিতামহকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করা মনোজ উপলব্ধি করেছিলেন জীবনসায়াহ্ন-জনিত ক্রাইসিস। অথচ তাঁর সেই ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্র কিন্তু ছিলেন থিয়েটার-বিরোধী। তবে অন্নদাচরণের কর্তৃত্বে তাঁদের গ্রামের বাড়িতেই থিয়েটারের উপকরণ-সরঞ্জাম রাখা হত। মাত্র একুশ বছর বয়সেই তিনি অভিনয় করলেন 'মৃত্যুর চোখে জল'-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধটির ভূমিকায়। আর্টিস্ট অনন্ত দাসের অসামান্য সাজানো, গলায় বার্ধক্যের ভঙ্গিমা, হাঁটার কায়দায় অবসন্ন ভাব কিংবা বয়সজনিত জরা-- এ সমস্ত কিছুকে আয়ত্ত করে সদ্য যুবক মনোজ একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন দর্শককে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ অবধি 'সুন্দরম'-এ কাটিয়ে শ্যামল ঘোষের দল 'গন্ধর্ব'-এর সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হলেন। সেই দলের নাট্যপত্রিকায় ছাপা হল তাঁর 'মোরগের ডাক' ও 'নীলকণ্ঠের বিষ'।
১৯৬০-এ রানীগঞ্জ কলেজ, ১৯৬৪'তে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ আর ১৯৬৫'তে নিউ আলিপুর কলেজে দর্শন বিষয়ে অধ্যাপনাও করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগেই অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। রানীগঞ্জ থেকে কলকাতায় ফেরার পর মহানগর দায়িত্ব নিয়েই তাঁর প্যাশনের স্রোতকে সঠিক খাতে বইয়ে দিল। শুরু করেছিলেন যে গবেষণার কাজ, তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। শ্যামল ঘোষের নতুন দল 'গন্ধর্ব' কিংবা পার্থর 'সুন্দরম'-এ তিনি আর ফিরলেন না। কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন এক ক্ষণস্থায়ী দল 'ঋতায়ন'। সেই দলও ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর লেখা নাটক 'চাক ভাঙা মধু' বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সেই নাটকের পরিকল্পনা-রিহার্সাল আরম্ভ হওয়ার পর নতুন গড়ে ওঠা দলটির সামগ্রিক ছন্দে কিছু খুঁত ফুটে ওঠে। অন্যদিকে 'সুন্দরম' দলের দেহেও তখন কিছুটা অকাল-ভাঙন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত 'এক্ষণ' পত্রিকায় এবার প্রকাশিত হল তাঁর 'চাক ভাঙা মধু', আর বিভাস চক্রবর্তীর 'থিয়েটার ওয়ার্কশপ'-এর উদ্যোগে তা মঞ্চে অভিনীত হল।
রানীগঞ্জ কলেজে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নারায়ণ পাণ্ডের লোকসাহিত্য বিষয়ক গবেষণার আঁচ পেয়েছিলেন তিনি। সেই গবেষণার উত্তাপ থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন 'সাজানো বাগান' নাটকের রসদ। ১৯৭৭-এ 'সুন্দরম'-কে উপহার দিলেন 'সাজানো বাগান'-এর মতো মাস্টারপিস। ১৯৮০'তে সেই প্লটের ওপর ভিত্তি করে তপন সিংহ পরিচালিত চলচ্চিত্র 'বাঞ্ছারামের বাগান'এ রুপোলি পর্দায় প্রথম দেখা গেল নাট্যকার মনোজ মিত্রকে। প্রায় ষাটটির মতো বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জায়গা করে নিতে একটুও ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থেকে হরনাথ চক্রবর্তী কিংবা সত্যজিৎ রায় থেকে অঞ্জন চৌধুরী-- সর্বত্রই তাঁর সাবলীল কিন্তু নজরকাড়া উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নিন্দুকেরা আড়ালে তাঁকে বলতে লাগলেন উৎপল দত্তের কপি, সমালোচকেরা বললেন, উত্তরসাধক। বাদল সরকার আর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত'র মতো শিল্পীদের নৈকট্য ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মনোজ লিখেছিলেন 'নরক গুলজার' (১৯৭৪)। রাজনীতি ও অর্থনীতির স্যাটায়ারে ভরা এই নাটকে দর্শক প্রত্যক্ষ করল, কল্পতরু থলিতে স্বর্গরূপসী রম্ভাকে চেয়ে হাত ঢোকালে অনিবার্যভাবেই বেরয় মর্তমান কলা। সেখানে আবার প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মাকে উৎকোচ গ্রহণের সমর্থক হিসেবে দেখিয়ে, সমাজের ভয়াবহ অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করালেন মনোজ।
শেষ জীবনে স্ত্রী আরতি মিত্রকে নিয়ে সল্টলেকে বাস করতেন। তাঁর দুই অনুজ অমর ও উদয়নও তাঁদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন যথাক্রমে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ইতিহাস-গবেষক রূপে। এই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে মনোজ মিত্রের একমাত্র কন্যা ময়ূরী মিত্র জানান পিতার হৃৎযন্ত্র বিকল হওয়ার কথা। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, কিডনির সমস্যা, সিওপিডি আর ডিমেনশিয়ার মতো ব্যাধি তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। ৮৫ বছর বয়সে বটবৃক্ষর মতো এই শিল্পীর জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরপ্রস্থান ঘটে, রয়ে যায় অসীম প্রত্যয়ে ভরা প্লট-চরিত্র-সংলাপের শিকড়-ঝুরি। তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত শুভানুধ্যায়ী আর নিন্দুকদের মুখে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে 'নরক গুলজার' নাটকের সেই অমোঘ পঙক্তি--
'কথা বোলো না কেউ শব্দ কোরো না
ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন
গোলযোগ সইতে পারেন না।'
সহৃদয় সামাজিকের নয়ন সমুখে অভিনেতা কিংবা শিল্পবেত্তা মনোজ আর কোনও দিনও অবতীর্ণ হবেন না। অপেক্ষা ফুরলো, নটে গাছটি মুড়োলো।
খুব ভাল লাগল। সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ এই স্মৃতিচারণ মনোজ মিত্রের বহুমুখী প্রতিভার এক যথার্থ রুপ দিল। শতফুলকে ধন্যবাদ জানাই।
ReplyDeleteঅসাধারণ। মনোজ মিত্র লড়াইয়ের কথা বলেন, সমাজের কথা বলেন, অসাম্যের কথাও বলেন, কিন্তু তার খোড়ো কাঠামোটি গড়ে ওঠে কিছু জলজ্যান্ত মানুষের সুখদুঃখ চাওয়া-পাওয়া শঠতা-ইতরামিকে ঘিরে। তিনি পরলোক গমণ করলেও তাঁর রচিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি চিরদিনই বঙ্গবাসীর হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
Delete