Wednesday, 27 November 2024

প্রসাধনী অস্ত্রোপচার?

‘বাম বিকল্প’ কেন এখনও দূরে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ১০-১৫ বছর ধরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে তিন-চারটি শব্দ বা শব্দবন্ধ বার বার করে শোনা যায়: রক্তক্ষরণ, ঘুরে দাঁড়ানো, বাম বিকল্প, পাকা চুল, তরুণ নেতৃত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব শব্দগুচ্ছ কেন্দ্রিক বিবিধ আলোচনা চলতেই থাকে, প্রকৃতির নিয়মে বছরও ঘুরে যায়, কিন্তু উচ্চারণ ও চর্চায় ইতি পড়ে না। এ কি নিছকই মুদ্রাদোষ, নাকি গোড়ায় গলদ?

বঙ্গে এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দলটি নির্বাচনের হিসেবে শূন্যের গেরোয় আটকা পড়েছে! কেউ বলছেন ‘আর্যভট্টের দশা’। চরম আশাবাদীরা বলেন, হবে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে। দিন যায়, রাত যায়, এক ধ্রুবক রাশির মতো ‘০’ লেপ্টে থাকে। অতএব, বিষয়টি রীতিমতো কৌতূহলোদ্দীপক এবং অভিনব।

কে না জানে, সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনও এক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের রাজ্যপাট যায়, বিরোধী আসনে তাদের অধিষ্ঠান হয়, কিন্তু একেবারে শূন্য হয়ে যায় কী? যায়; যখন সমকালীন রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা বা কার্যকলাপের মেয়াদ ক্রমেই বিলীন ও অবসাদগ্রস্ত হতে থাকে। এক সময়ে ‘স্বতন্ত্র পার্টি’ নামে একটি দল এ দেশে বেশ সচল ছিল, রাজাগোপালাচারী, মিনু মাসানি প্রমুখেরা গড়ে তোলেন, আজ সে দলের আর অস্তিত্বই নেই; অথবা ‘মুসলিম লিগ’। কিন্তু তা বলে সিপিএম বা তাদের সহযোগী দলগুলির কি এ রাজ্যে এরকমই করুণ অবস্থা যে তাদের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে? না, তেমনটা বলা অসমীচীন। কারণ, নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের ভোটের অঙ্ক ক্রমেই তলানিতে এসে ঠেকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা মোটেই ফুরিয়ে যায়নি। ‘বাম’ আদর্শ বলে যে নীতিসমূহ এখনও জনমানসে উজ্জ্বল, তার প্রাসঙ্গিকতা বা কার্যকারিতা ফুরোয় তো নিই, বরং তার আরও ব্যাপ্তি ও বহর বেড়েছে। যা ঘটেছে তা হল, হাইজ্যাক। বাম দলগুলির রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কার্যকলাপ বাকী দলগুলির (মূলত শাসক ও প্রধান বিরোধী দল) কাছে গচ্ছিত পড়েছে। অর্থাৎ, তাদের কিছু রসদ (ভাবনা, ইস্যু, কর্মসূচি, প্রোগ্রাম) যেমন গেছে ওদের কাছে, ওদেরও কিছু এসেছে তাদের কাছে। এই লেনদেনের সমীকরণেই আসল গেরো লুকিয়ে!

ফলে, মানুষের কাছে শুধুমাত্র গিয়ে, ভাষণ দিয়ে অথবা তরুণ বয়সীদের নেতৃত্বে এনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় খিল্লি আর হৈচৈ করে প্রসাধনী অস্ত্রোপচারে রক্তক্ষরণ যে বন্ধ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সমস্যাটা মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের নয়, সমস্যাটা অন্তর্বস্তুতেই; অর্থাৎ, কী বিষয় নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়ের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন যাপন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, দেশকাল, রাজনীতি, অর্থনীতির বাস্তবতা সেই সব বিষয় থেকে সমাধানের কোনও আশু পথ পাচ্ছে কিনা— এইগুলিই মুখ্য বিচার্য বা গ্রহণযোগ্যতার চাবিকাঠি। এই সময়ে এ রাজ্যের বামেদের গোড়াতেই গলদ এইখানে যে, তারা শত কসরত করে যে বিষয়গুলিকে মানুষের কাছে উপস্থিত করছে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতাই তৈরি হচ্ছে না। অস্যার্থে, তারা মানুষের কাছে হাজির হতে পারছে না তা নয়, তারা মানুষকে যে কথাগুলি বলছে, তার মধ্যেই একটা ভ্রান্তি ও দূরত্ব থেকে যাচ্ছে!

১৯৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাম দলগুলি যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে, তার তীব্র অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এক কটূ প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন বিরোধী দল নেতা জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ভাড়া তো মাত্র এক পয়সা বেড়েছে— কিন্তু প্রশ্নটা সেখানে নয়, প্রশ্নটা কার পকেটের পয়সা কার পকেটে যাচ্ছে (তখনও ট্রাম কোম্পানি ব্রিটিশ মালিকানাধীন একটি বেসরকারি সংস্থা)। সে সময়ের এই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিটাই আজ বামেরা খুইয়েছে। এখনও তারা সিঙ্গুরে টাটা’র ন্যানো প্রকল্প নিয়ে হা-হুতাশ করে, বিশ্বাস করে যে উন্নততর প্রযুক্তির এই আধুনিক সময়েও বৃহৎ শিল্প হলেই যথেষ্ট কর্মসংস্থান হবে, এমনকি উর্বর কৃষি অঞ্চলেও, যেখানে ইতিমধ্যেই হাজারও মানুষ কৃষিকর্মে নিয়োজিত (সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গুর মামলায় প্রশ্ন তুলেছিল, ১৯,০০০ কৃষিজীবীকে উৎখাত করে ১২০০ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসৃষ্টি কি আদপে কর্মসংস্থানের প্রসার না হরণ?)। অর্থাৎ, কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্প স্থাপনের যে স্বপ্ন শিল্পপতি বা কর্পোরেট হাউজ দেখে এবং তাকেই ‘উন্নয়নের’ সোপান হিসেবে মনে করে, সেই পথকে সাবেক বামেরাও শিরোধার্য করেছে। সে আতান্তর থেকে তারা আজও বেরতে পারেনি।

ফলে, লগ্নি ও কর্মসংস্থানের আন্তঃসম্পর্ক ও সমবৃদ্ধির তত্ত্ব ও তথ্য আজ যে আধুনিক প্রযুক্তি-যুগে, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই আগ্রাসী সময়ে একেবারেই অচল, সে পাঠ তাদের এখনও মেলেনি। আর সেই সূত্রেই তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না যে, আধুনিক কালে নিয়মিত চাকরির তেমন কোনও সুযোগও নেই, কারণ, কাজের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। কাজের যে সুযোগ মিলছে তা অনিয়মিত, স্বল্পস্থায়ী ও বহু ক্ষেত্রে পার্টনার মডেলে। তাহলে মানুষের দিন চলবে কেমনে? এই প্রশ্নের মোকাবিলায় বামেদের কাছে গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে যে উত্তরটি মজুত আছে তা হল: বিপ্লব। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চালকেরা এর মধ্যেই বুঝে ফেলেছেন কালের অন্তর্নিহিত গতি: যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে জগতের ভার চলে যায়, মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলে humanoid robot, ফলত সমাজে আরও বেশি উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই উদ্বৃত্তের একটা অংশ প্রত্যক নাগরিকের হাতে তুলেই দেওয়া যেতে পারে। একেই কেউ কেউ বলেন ‘Universal Basic Income’ বা ‘Citizens’ Dividend’, যার আংশিক রূপ আজ আমরা দেশ জুড়ে দেখছি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, লাডলি বহিন, মাইয়া সম্মান, কৃষক বন্ধু প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে যেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নাগরিকদের কাছে নগদ হস্তান্তরের নীতি রাজনৈতিক অর্থনীতির এক প্রধান প্রবাহ হয়ে উঠেছে। অথচ, এই নগদ হস্তান্তরকে সাবেক বামেরা ‘ভিক্ষাবৃত্তি’, ‘ডোলের রাজনীতি’, ‘পাইয়ে দেওয়া’ ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দিয়ে কালের নিদানকেই বুঝতে অস্বীকার করেছে। তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি লুপ্ত হওয়ায় তারা ধরতেই পারেনি যে সমাজের নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষেরা সাধারণ ভাবে স্বল্প বা প্রায় বিনা মজুরিতেই কাজ করে থাকেন। সেই বিচারে এই অর্থ প্রাপ্তি তাদের ন্যায্য হক (citizens’ dividend)। বরং বামেদের উচিত ছিল, নগদ হস্তান্তরের এই প্রবণতাকে universal basic income প্রবর্তনের অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলা এবং মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষকে সামিল করা। সেটা না করার অর্থ, বাম রসদকে হাইজ্যাক হতে দেওয়া!

এ ব্যতীত, বিচিত্র হলেও সত্য যে, এ রাজ্যে সাবেক বামেদের এক বড় অংশ হিন্দুত্ববাদী প্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান বিদ্বেষকেই জাতীয় মুক্তির পথ ধরে নিয়ে দলে দলে বিজেপির ভোট বাক্সে সমবেত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলেন, এর মধ্যে আসলে লুকিয়ে ছিল তীব্র মমতা-বিদ্বেষ। কিন্তু খানিক গভীরে গিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই উগ্র হিন্দুবাদের প্রতি তাদের আকর্ষণ কর্পোরেট পুঁজির প্রতি আস্থার মনোভাব এবং পুঁজি-লগ্নির পথ ধরে অর্থনৈতিক বিকাশের ভাবনার মধ্যেই সুপ্ত। বিশেষ করে সাবেক বাম নেতৃত্বে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য থাকায় তারা খুব সহজেই কর্পোরেট পুঁজির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং ততদিনে কেন্দ্রে বিজেপিও এই পুঁজির সহজাত তল্পিবাহক হয়ে ওঠায় তারা বিজেপির সঙ্গে মানসিক ভাবে যে আত্মীয়তাবোধ অনুভব করে সেখানে হিন্দুত্ববাদী বয়ান ও মুসলমান বিদ্বেষ এবং মমতা-অসূয়া পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত নির্মাণ করে। এই পরিসর থেকে বেরিয়ে আসাটা সাবেক বামেদের পক্ষে দুরূহ, যদি না তারা নিজেদের ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয়! সে ক্ষেত্রে তাদের বহু আচরণ ও কার্যক্রম তৃণমূল দলের মতো দেখাতে পারে, এই আশঙ্কাও প্রবল। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে স্বাগত জানালে অথবা তীব্র ভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করলে, নিন্দুকেরা তাদের ‘চটিচাটা’ বলে দেগে দিতে পারে (যেমন তারা নিজেরা অন্যদের প্রতি হামেশাই করে থাকে)। এই ঝুঁকি নিতে পারার রাজনৈতিক সাহস তাদের এখনও হয়নি। ফলে, কর্মসংস্থানের গালগল্পে ভরা বৃহৎ পুঁজি অনুসৃত ‘শিল্প গড়ে ওঠা’র একমাত্রিক আবর্তেই তারা এখনও বদ্ধ।

তাই, স্থিতাবস্থা বজায় রয়। প্রসাধনী অস্ত্রোপচারের গুরুত্ব বাড়ে। ডিজিটাল কুশীলব ভাড়া করার তোড়জোড় চলে, কিন্তু content বা অন্তর্বস্তুতে পরিবর্তন কই? বিজেপির প্রচারগুলিকে একপ্রকার ছড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যকে ক্রমেই বিসর্জন দেওয়া চলতে থাকে! বিদেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশে চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করলে তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা উঠেপড়ে যে ভাবে বিজেপির প্রচারগুলিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার এক কণা রা’ও কাড়তে দেখি না উত্তরপ্রদেশের সম্বলে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এইভাবেই কি পোক্ত হচ্ছে নিজেদের কবরখানা আর উর্বর হচ্ছে বিদ্বেষ বিষ? পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক পরিসরে। ‘বাম বিকল্প’ কি আপাতত এক মরীচিকা?

      

3 comments:

  1. অত্যন্ত বিশ্লেষণ মূলক , গবেষণামূলক তাত্বিক লেখা। এভাবে ভাবনা চিন্তা করার অভ্যাস টা অন্তত শুরু হোক। বিজেপি বা আর এস এস এর বদলে উল্টোদিকে বিরোধীরা আর এস এস এর পথই নিয়ে বোঝাতে চায় তারাও কম হিন্দু নয়। রাহুল , প্রিয়ঙ্কারা মন্দিরে যাচ্ছেন , ক্যামেরায় ধরা পড়ছে , কপালে ভষ্ম। আর এস এস তো এই লাইনটাই চায় ! তৃণমূলও এই পূজো , ওই পূজো , পুরীতে মন্দির
    , ওখানে মন্দির , রামনবমী তে পাল্টা মিছিল , গণেশ পূজোর রমরমা - এ কি রে ভাই ! কিন্তু বামশক্তি বাস্তবিক রাজনৈতিক অধ্যয়ন টা কীভাবে করতে হবে সেটাই বুঝতেই পারছে না।

    ReplyDelete
  2. বেশ ভাল একটা প্রবন্ধ অধ্যয়ন করলাম। লেখক কে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  3. অমিত লাহিড়ী28 November 2024 at 10:09

    খুবই নিখুঁত আর সুন্দর বিশ্লেষণ। একথা অনস্বীকার্য যে আজকের বাংলার বামপন্থীরা নিজেদের শ্রেণীগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ে, বর্তমানের রাজনীতির দিশা খুঁজতে, শিল্প, অর্থনীতি, জীবিকা ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে কার কোথায় কোন ভূমিকা, বা পারস্পরিক সম্পর্কই বা কীরকম দাঁড়াবে — এই সব প্রশ্নে নিতান্তই দিশেহারা। বিধানসভা ভোটের প্রচারে মীনাক্ষীকে সিঙ্গুরের কারখানা আবার হবে বলে দাবি করতে শুনেছি। অনিচ্ছুক কৃষকের জমি জোর করে নেওয়া, কোনো একটা বড় শিল্পের পিছু পিছু তার অ্যানসিলিয়ারি দিয়ে এই গভীর কর্মহীনতার ফাঁক বোজানো কতদূর সম্ভব বা এমনকী কাম্য, পরিবেশ সংক্রান্ত আশংকা ইত্যাদি নিয়ে দলের ভেতরেই ওরা এখনও অমীমাংসিত। একটা দুটো বড় শিল্প দিয়ে যে এই সংকট মেটার নয়, বিশ্ব অর্থনীতির খোলনলচে যে অনলাইন ট্রেডিং, বিটকয়েন, এফডিআই ইত্যাদির হাত ধরে আপাদমস্তক বদলে গেছে, এর মোকাবিলা করতে হলে যে অনেক বেশি জ্ঞানের চর্চা আর সমাজবীক্ষার বদল দরকার, তা এখনও এদের গলা দিয়ে নামেনি।

    ReplyDelete