Friday, 15 November 2024

বুলডোজার শাসন নিষিদ্ধ

নিকৃষ্টতম শাসনের ইতি

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



বুলডোজার শাসনকে নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ আদালত আপাতত আমাদের স্বস্তি দিয়েছে; বিশেষত বিরোধী দলের সদস্য, সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে। বেআইনি দখল করা জমিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে যদি বুলডোজার ব্যবহার করতে হয় তবে আগে থেকে পোর্টালে সেই নোটিশ আপলোড করতে হবে, নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাছাড়া প্রক্রিয়া না মেনে বুলডোজার চালালে সরকারি আধিকারিককে আদালত অবমাননার দায়ে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতে পারে। নোটিশ পেয়ে পনেরো দিনের মধ্যে প্রশাসনের তরফে হিয়ারিং হবে। সেই হিয়ারিংয়ে যদি শেষ পর্যন্ত সেই বাড়ি বা দোকান ভাঙ্গা স্থির হয় তার পরে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে যাতে সেই ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।

দলিত বনাম মুসলিম সমীকরণে এই বুলডোজার সন্ত্রাস ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সেটা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা যারা করেন তাদের খোঁজ নিতে অনুরোধ করব। আদিবাসী, দলিত, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে আর এসএস এবং বিজেপি এটাই ফিসফিসিয়ে বোঝায় যে মুসলিমদের জমি-দোকান-ব্যবসা-পুকুর-ক্ষেত দখল করে তাদের দেওয়া হবে। ফলে, তদন্ত করলে হয়তো দেখা যাবে, ৬৭,০০০ একর বুলডোজারের ব্যবহারে পাওয়া জমির একাংশ আদিবাসী, দলিত বিজেপি সদস্যদের দেওয়া হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেই আশ্বাস কতটা বাস্তবে কার্যকর হবে সেটা অবশ্যই বিচার্য নয়। মেরুকরণই লক্ষ্য। 

আমাদের দেশে শহর, আধা-শহরের বাড়িঘরের মধ্যে একটা বড় অংশেরই সব কাগজপত্র ঠিক নেই। সরকার, পৌরসভা সেটা জানে। কিন্তু সব বাড়ির সব কাগজ ঘাঁটতে বসলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবে, সেটাও জানে প্রশাসন। ফলে, যে সরকার বা মুখ্যমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ জমি পুনরুদ্ধার করতে নামে, বুঝতে হবে তা আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর সন্ত্রাস চালিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করার ছল মাত্র। সেখানে বিন্দুমাত্র দখলদারি বন্ধ করার উদ্দেশ্য নেই। মুসলিম বস্তি উজাড় করে সেখানে তাদের পোষ্যদের বেআইনি ভাবেই ব্যবসা করার আশ্বাস দেওয়া হয়। বেআইনি দখল তুলতে হলে বিজেপির দলীয় অফিসগুলো আগে ভাঙতে হবে, এমনটা বলেছিলেন আপ দলের এক নেতা। কৃষক আন্দোলনের নেতা টিকায়েত বলেছিলেন যে বুলডোজার নিয়ে এমন আক্রমণ হলে ট্র্যাক্টর দিয়ে প্রতিরোধ করা হবে। 

বুলডোজারের ব্যবহারে এক নির্লজ্জ মুসলিম আক্রমণের নজির গড়ে তুলেছিল বিজেপি। একজন গরু খেয়েছে বলে অভিযোগ এল, তাকে মৃত বা অর্ধমৃত করা তো হলই, উপরন্তু তার বাড়িও ভেঙে দেওয়া হল। পরে প্রশাসন একটা ব্যাক ডেটেড নোটিশ দেখিয়ে বলল যে ওই বাড়ি নাকি বেআইনি ছিল! এখন আদালতে সে যাবে, হয়তো জিতেও যাবে, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল! আবার এমন উদাহরণও আছে যে একটা গোটা বস্তি উদ্বাস্তু কলোনি। কিন্তু তার মধ্যে একজন বিরোধী দলের সমর্থকের বাড়ি ভাঙা হল দখলিকৃত অভিযোগ এনে, অথচ সেই সংজ্ঞায় গোটা বস্তিটা বেআইনি!

মাফিয়া গোষ্ঠীদের মধ্যেও অলিখিত আইন আছে যে শত্রু গ্যাং'এর পরিবারদের বিরক্ত করা হবে না, খুন করা তো দূরের কথা। সেরকম কোনও অঘটন হলে সেটাকে যুদ্ধ বলে ধরা হয়। আদিত্যনাথ যোগী যে নিকৃষ্টতম মাফিয়া বস সেটা তার বুলডোজার শাসন থেকেই প্রমাণিত। সমগোত্রীয় নরেন্দ্র মোদিও ভোটের প্রচারে বুলডোজার ব্যবহার করতে স্পষ্ট ভাষায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরাও পিছিয়ে নেই। রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারও মোদী, যোগী অনুপ্রাণিত ছিল এমন অভিযোগ আছে। 

রাজনীতি মানেই বিপদ। সরকারি দল করলে লাভ আর বিরোধী দল করলে 'হাজতবাস, আহত, নিহত হতে পারি' এটা জেনেই মানুষ রাজনীতি করতে আসে। কিন্তু বিরোধী জনের পরিবারও ছাদহীন হবে এই আশঙ্কা থাকলে, মেহনতি জনতার ক্ষেত্রে না হলেও, আমাদের মতো শহুরে আরবান নকশাল, আন্দোলনজীবীদের সংখ্যা যে অনেক কমে যেত তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।


No comments:

Post a Comment