প্রলম্বিত এক ছায়াপথ
প্রবুদ্ধ বাগচী
আরও পাঁচটা না-পাওয়ার মতোই ঋত্বিকের ছবিকে তাঁর প্রকৃত চেহারায় খুঁজে পেতে আমাদের অনেকদিন লেগে গিয়েছে। আমরা মানে, যারা আশির দশকে বেড়ে উঠেছিলাম কলকাতার আবহাওয়া থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে। ১৯৮৭'র শহরে ‘নন্দন’ নামের এক অত্যাশ্চর্য প্রেক্ষাগৃহের স্থাপনার পর সেখানে ওই বছরের নভেম্বর মাসে সরকারি উদ্যোগে করা হয়েছিল ‘ঋত্বিক ঘটক রেট্রোস্পেক্টিভ’। মাত্র পাঁচ টাকার টিকিট কেটে সেবার দুটো ছবি দেখি। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ও 'কোমল গান্ধার'। নন্দনের বিশাল স্ক্রিনে নীলকণ্ঠ বাগচীর পাশ-করা মুখের ফ্রেমে এসে দাঁড়ায় বঙ্গবালা, আর গোটা প্রেক্ষাগৃহে বিদ্যুতের শকের মতো বেজে ওঠে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’— এই দৃশ্য আসলে একটা জন্মান্তর। আমাদের ভিন্ন জন্ম হয়। আগামী সময়ে আমরা কেবল তার মধ্যেই বেড়ে উঠব অবিরাম।
প্রায় একইরকম গায়ে-কাঁটা-দেওয়া 'কোমল গান্ধার'এর সেই লংশট— ট্রলির ওপর ক্যামেরা চলতে চলতে আচমকা লাইন থেমে যায় দুটো অনিবার্য বাফারে। এপার বাংলা ওপার বাংলা, মধ্যিখানে চর— চর নয় চরাচর। একটা প্রজন্মের বিধিলিপি লেখা হয়ে গেল ওই শটে। তুলনায় তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হিট ছবি। আটের দশকে নিঃসঙ্গ দূরদর্শন-জমানায় সেই ছবি প্রায়ই দেখানো হত রবিবার। সে ছবিতে নীতার জীবন নিংড়ে-নেওয়া বাঁচতে চাওয়ার আর্তি বাড়ির মা-মাসিমাদের কাছেও এক প্রবল শোকের ভ্রূণায়ন বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ গানটির অমন সুতীব্র অভিঘাত ও ব্যঞ্জনা ছিল প্রায় অলৌকিক। আর এই সূচিমুখ তীব্রতার মধ্যেই আমরা খেয়াল করতে ভুলে যেতাম আজাদগড় কলোনির পরিবার-বঞ্চিত এক রিফিউজি যুবতী কোথাও যেন মিশে যায় কুমারসম্ভবের পার্বতীর অনুষঙ্গে, ভুলে যেতাম বাগেশ্রীর ওই স্বরলিপির মধ্যে কীভাবে আছড়ে পড়ছে চাবুকের আওয়াজ! গান না আর্তনাদ ?
এত দূর মুগ্ধতার আগে কিন্তু আমরা সত্যজিৎ মৃণালের ছবি কিছু কিছু দেখে ফেলেছি। তাই এটা বলার কথা যে, আসক্ত মুগ্ধতা থেকে ঋত্বিকের পরের ছবিগুলি খুঁজে পেতে দেখতে গিয়ে তেমন বড় কিছু লাভ করেছি এটা বলা ঠিক হবে না। বাংলার দিকপাল তিন চলচ্চিত্র পরিচালকের মধ্যে ঋত্বিক সব থেকে ছোট, তাঁর তৈরি করা ছবির পরিমাণও কম। অনেকে মনে করেন, সুযোগ পেলে তিনি অন্যদের থেকে নিজেকে আরও ভাল ছবি করার কাজে নিয়োজিত করে মহত্তর হতে পারতেন। এই আপ্তবাক্যে আমাদের তেমন আস্থা নেই। এটা ঠিক, তাঁর প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ কার্যত ‘পথের পাঁচালী’র আগে রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘নাগরিক’ বা ‘কোমল গান্ধার’ সময়ান্তরে দেখে তাঁর নির্মাণের মধ্যে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা নাকি ‘পথের পাঁচালী’কে অবান্তর করে দিতে পারে। তবে তাঁর শতবর্ষের সীমানায় এসে তাঁকে কোনও ‘বনাম’ এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়াটা সমুচিত নয় বলেই আমাদের ধারণা। বাংলার প্রবাদ হল, ‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর/ অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর’— ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে এই ধারণাটা কিছুটা ব্যবহার করা চলে। হ্যাঁ কিছুটা, অবশ্যই পুরোটা নয়। সিনেমা ব্যাপারটাই তো এরকম, তার জন্য পুঁজি, লোকলস্কর, প্রযুক্তি লাগে, লাগে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রের বিপণন। মুঠো মুঠো সদিচ্ছা আর বিপুল মেধা ও জ্ঞান থাকলেই যে তাতে সিদ্ধিলাভ ঘটবে এমন মোটেও নয়। যদিও প্রখর পাণ্ডিত্য ও ফিল্ম-বিষয়ক ভাবনায় ঋত্বিক নিজে সত্যিই একজন পথিকৃৎ। পুনার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে তাঁর কিছু কৃতবিদ্য প্রাক্তন ছাত্ররা বলেছেন, লিখেছেন সেই ঋত্বিক-সংসর্গের কথা। জীবনের শেষ দিন অবধি ঋত্বিককে কাছ থেকে পেয়েছেন নবারুণ ভট্টাচার্য, তিনিও বলেছেন এই বিরল ব্যক্তিত্বের নানা কথা। প্রতিটিই প্রণিধানযোগ্য।
ইতিহাসে ও বাজারে নানারকম মতামত ঘুরে বেড়ায়। তার একটা হল, বিশ্রুত প্রতিভাধরদের নাকি একটু এলোমেলো বিশৃঙ্খল না হলে চলে না। ঠিক ভোট দিয়ে এই বক্তব্যের সার নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে দুনিয়ার সব প্রতিভাকেই যে নৈরাজ্যের উপাসক হতে হবে এটা কোনও নেসেসারি ও সাফিসিয়েন্ট শর্ত নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ, যিনি এমনকি অন্যের কাছে নিজের লেখা চিঠি অবধি কপি করে রেখে দিতেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কতদূর সুশৃঙ্খলভাবে নিজের কাজগুলো করে নেওয়া সম্ভব এর অভিধান তিনি নিজেই রচনা করে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে করেই এই ডিসিপ্লিনের নিরিখে ঋত্বিক-সমকালীন সত্যজিতের কথা তুলছি না, কারণ, তাতে আবার ওই ‘বনাম’ এর বদনাম হবে। কিন্তু সিনেমা এমনই একটা মাধ্যম যা তার স্রষ্টার কাছ থেকে দাবি করে নিখুঁত নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা, কারণ, আদপে সিনেমাটা তৈরি হয় একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া মেনে যার মধ্যে ছেলেমানুষির জায়গা থাকে না। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, যদি তিনি সিনেমার থেকেও জোরালো কোনও মাধ্যম কোনওদিন পান, সিনেমার মুখে লাথি মেরে তিনি সেখানেই চলে যাবেন।
প্রথম জীবনে তিনি নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। এর পরেও সিনেমা নামক মাধ্যমটিকে তিনি খুব সিরিয়াস ভাবে নিতে পেরেছিলেন কি না, এ নিয়ে আজ একটা প্রশ্ন তোলাই যায়। কারণ, সিনেমায় নিজের মতো করে কিছু করে দেখাতে গেলে গোড়ার দিকে তাঁর অবস্থানটা পোক্ত করার কাজটা নিজেকেই করতে হয়। সবাইকেই তা করতে হয়েছে। সম্ভবত এই প্রয়াসটায় তাঁর কিছু ঘাটতি ছিল। আজ এ কথা বলা কতদূর সঙ্গত জানি না, তবু বিনীতভাবেই সপ্রশ্ন হই, নিজেকে ‘জিনিয়াস’ ভাবা এবং কেবল সেই গুণেই প্রযোজকরা আগ বাড়িয়ে এসে কাজ দেবেন, এমন একটা গোপন অহং কি ছেয়েছিল তাঁকে? আবাল্য ছটফটে ঋত্বিক ওরফে ভবা'র প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গেলে এই কথাগুলো ওঠে।
আরেকটা কথা ঝুঁকি নিয়েও বলা দরকার। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের যে বিরাট সাংস্কৃতিক ছায়া একটা সময় প্রগতি শিল্পের মূল ধারা হয়ে উঠেছিল, ঋত্বিক মূলত তারই সন্তান। বাম রাজনীতি নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা, তার সঙ্গে তাঁর বিতর্ক, নানা ভাবনার দোলাচল তাঁকে সারা জীবন ব্যস্ত রেখেছে। জীবনের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে নীলকণ্ঠ বাগচীর চরিত্রে রূপদান বেশ অনেকটাই তাঁর রাজনৈতিক দোলাচলের আত্মকাহিনি। এই যাত্রাও কিন্তু কিছুটা ‘ছটফটে’ চরিত্রের। কোথাও থিতু নন। ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পাকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে কার্যত পথের ভিখারি ঋত্বিক। নবারুণ ভট্টাচার্য একদিন দেখলেন ভবানীপুরের এক ফুটপাথে ছিন্ন পোশাকে শুয়ে রয়েছেন তিনি। পর্যুদস্ত। চরম অ্যালকোহলিক। অসম্ভব মেধা, বিপুল জ্ঞান, সংগীতের রসপিপাসু, ফিল্মের ব্যাকরণকে ফালা ফালা করার পোটেন্সি সব একাকার হয়ে গেল হাহাকারে: 'আমি পুড়ছি! ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে!'
বহরমপুরের কলেজ জীবনে তিনি আরএসপি দলের ঘনিষ্ঠ, পরে কলকাতায় পড়তে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সখ্য, সস্তা ষোলো মিলিমিটার ক্যামেরা জোগাড় করে ‘তেভাগার লড়াই’কে নথিবদ্ধ করার তাগিদে বন্ধু সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পথে বেরনো। তথাকথিত ‘রণদিভে লাইন’কে তিনি মানছেন না তার ছাপ পড়ল পঞ্চাশের দশকে পার্টির মধ্যে তাঁর তোলা বিতর্কে। বিস্তর লেখাপড়া করা ঋত্বিককে জ্যোতি বসু সমর্থন করতেন কিন্তু স্বভাবে কিছুটা ‘কুচুটে’ ও শিক্ষিত পার্টি সদস্যদের প্রতি বিদ্বিষ্ট প্রমোদ দাশগুপ্ত কলকাঠি নেড়ে ‘অন কালচারাল ফ্রন্ট’এর প্রস্তাবক ভবা'কে বহিষ্কার করে দেন। ষাটের মধ্যপর্বে নকশাল রাজনীতি তাঁকে কিছুটা টানল তবু ঠিক স্বস্তি দিল না। নকশাল খতমের গুলি বিনিময়ের মধ্যেই নিহত হলেন নীলকণ্ঠ বাগচী ওরফে ঋত্বিক।
কিন্তু এই প্রজ্বলনের তো একটা পরিণতি চাই। আলো। শক্তি। গতি। কেবলমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের চরম ট্র্যাজেডি যে পার্টিশন, তাকে কেন্দ্রে রেখে অথবা তারই অবশেসনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেই কি একজন ফিল্মমেকার পুরো জীবন বেঁচে থাকতে পারেন? ঠিক, বাঙালির জীবনকে নতুন এক ছাঁদে ঢালাই করে নিয়েছে দেশভাগ। শিয়ালদহ রেল স্টেশনের বীভৎসা, বনগাঁ সীমান্ত, যাদবপুর, দমদম, হাবরা, কুপার্স ক্যাম্প, আজাদগড়, বিজয়গড়। একেকটি জনবসতির সঙ্গে একটি ধ্বস্ত জাতির শোক ক্রোধ প্রতিরোধ ক্লেদ যন্ত্রণা সব একাকার। কিন্তু তার পরের অন্তত সিকি শতাব্দী তিনি বেঁচে ছিলেন। এর প্রতিস্পর্ধী যে নানান রঙের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল এই বাংলায় সেখানে কি কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি? চলচ্চিত্র পরিচালককে ফিল্মের বিষয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া লেখককে লেখার বিষয় বাতলে দেওয়ার মতোই অশ্লীল ঠিকই, কিন্তু আমরা বলছি একটা প্রত্যাশার কথা। তাঁর কাছে আসলে অপার প্রত্যাশা ছিল আমাদের। তিনি তাঁর মতো করেই না হয় গড়ে পিটে নিতেন তাঁর বাস্তবকে; আমরা জানি সেইটুকুতেই তিনি তাঁর ফাল্গুনী রচনা করে তাক লাগিয়ে দিতেন আমাদের। ‘পিপাসা, হায় না মিটিল’। ১৯৭৬'এর এক ফাল্গুনী ভোরে পিজি হাসপাতালের ক্লিন্ন বিছানায় ‘জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্ক্ষার বেদনার’ ঋণ চুকিয়ে যেদিন তিনি চলে যাচ্ছেন, সেদিন তাঁর গুটিকয় সুহৃদ ব্যতিরেকে স্তব্ধ হয়েছিল একটা জাতি, রাজধানী-ভরা নাগরিক সমাজ। পড়ে-আসা বেলার দিকে যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদা বক। ছটফটে জীবন। প্রলম্বিত এক ছায়াপথ।
[তথ্যসূত্র: সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (সাক্ষাৎকার), বসু আচার্য (ফেসবুক পোস্ট)]
No comments:
Post a Comment