আপন আলো
শ্রেয়া ঘোষ
বাংলার লেখকদের মোটামুটি দুটি শ্রেণি বিভাগ আছে-- নামী লেখক ও অনামী লেখক। ফলত, বাংলা ভাষায় যে সব লেখাপত্র হচ্ছে তারও শ্রেণি বিভাগ অনুরূপ; অর্থাৎ, সে লেখা নামী লেখকের কলম জাত না অনামী লেখকের! তার মানে, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার গুণগত মানের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে লেখকের আভিজাত্য। এর ফলে আতান্তরে পড়েছি আমরা, যারা জাত ধর্ম বিচার না করে শুধু সৎ, উচ্চমানের ও চিত্তাকর্ষক সাহিত্যের সন্ধানী।
বাংলায় প্রকাশিত বইপত্রকেও দু' ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। প্রথমত, কোনও পত্রিকা বা কাগজে ইতিমধ্যে প্রকাশিত লেখা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত বা অপ্রকাশিত লেখার সরাসরি বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এবার, পত্রিকাগুলিও অভিজাত ও অনভিজাত এই দু' ভাগে বিভক্ত। কুলীন পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ঠাঁই পাওয়া উপন্যাস বা ধারাবাহিক প্রকাশের অব্যবহিত পরেই-- পুজো থেকে বইমেলা-- এই মাস তিনেকের মধ্যেই বই হয়ে স্টলে স্টলে আসে। অপরদিকে অনামী পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা কফিনবন্দী মৃতদেহ সদৃশ-- না, অতিরিক্ত সম্মান দেওয়া হয়ে গেল বোধহয়-- বরং হিমঘরে বস্তাবন্দী পচা-ধসা আলুর সঙ্গে তুলনা করাই সঠিক হবে।
নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ছোটবেলা থেকে আমাদের বই পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়েছে একটা ধারাবাহিকতা মেনে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পেরিয়ে সতীনাথ, জরাসন্ধ, বুদ্ধদেব বসু, আশাপূর্ণা, লীলা মজুমদার, জ্যোতিরিন্দ্র, নরেন্দ্র মিত্র। ক্রমশ সমরেশ বসু, বিমল কর, সুনীল, শীর্ষেন্দু, কবিতা সিংহ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, রমাপদ চৌধুরী, মতি নন্দী, নবনীতা দেবসেন, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু। বিশুদ্ধ পারিবারিক তথাকথিত মূলধারা বা বাণিজ্যিক লেখা অথবা ভিন্ন ধারার সাহিত্য সবই বুভুক্ষুর মতো খেয়ে পরিপাক করার সুস্থ অভ্যেস ছোট থেকেই তৈরি হয়েছে। বছর চল্লিশেক আগে আমাদের কম বয়সে ঝড়ের মতো এলেন সমরেশ মজুমদার, আবুল বাশার, জয় গোস্বামী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, জয়া মিত্র। ক্রমশ আত্মপ্রকাশিত তিলোত্তমা মজুমদার, বিপুল দাশ। প্রথম রচনা থেকেই চমকে দিয়েছেন, সাগ্রহে অপেক্ষা করেছি পরের লেখাটির জন্য। শুরু থেকে এঁদের প্রতিটি প্রকাশিত লেখা পড়ে গিয়েছি। বই নির্বাচনের দায়িত্ব কালক্রমে অভিভাবকদের থেকে নিজের হাতে নিয়ে জীবনানন্দ, সন্দীপন, কমল চক্রবর্তী, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, নবারুণ, সুবিমল মিশ্র সকলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজস্ব রুচি তৈরি করে ফেলেছি।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে যে রুচি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে বিপুল ধাক্কা খাচ্ছে। মনে পড়ে সেই সব লেখকদের কথা যাঁরা নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন শুরুর লেখাটি থেকেই । বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে দেওয়া লেখা সব। এখন কোথায় সেরকম লেখা? তথাকথিত নামী ও অভিজাত পত্রিকার লেখাগুলি শুধুই হতাশ করে। স্পষ্টত কোনও অনুশীলন বা প্রস্তুতি ছাড়াই একেকটি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন লেখক। লেখা শেষ করেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রকাশের জন্য আর তা মনোনীতও হয়ে যাচ্ছে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাময়িক পত্রিকায় বা দৈনিক কাগজের রবিবারের পাতায়। এ হেন পরিস্থিতিতে এই সব লেখকদের আর কোনও চেষ্টাই থাকে না নিজেদের লেখার মান উন্নত করার। এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের মান গুণোত্তর প্রগতিতে নিম্নগামী।
বহুল প্রচারিত ও বিজ্ঞাপিত এই সব লেখা ক্রমাগত পড়তে পড়তে পাঠকের রুচিরও অবনমন হচ্ছে। লেখকরা নিজের লেখার মান উন্নত না করে পাঠককে ভয়ঙ্কর রকম নির্বোধ ভাবছেন। অধিকাংশ লেখাপত্র ছোটগল্প বা উপন্যাসের ন্যূনতম শর্তটুকুও পূরণ করছে না। অকিঞ্চিৎকর ও গতানুগতিক বিষয়-ভাবনা, নিম্নমানের ভাষা আর দুর্বল নির্মাণ ও উপস্থাপনার ফলে আজকের গল্প, উপন্যাসগুলি সাহিত্য পদবাচ্যই হয়ে উঠছে না। বারে বারে ঘুরে ফিরে আসছে সাদামাটা প্লট আর গতানুগতিক বিন্যাস। যেমন,
১) স্কুলের পুনর্মিলন উৎসবে প্রতিষ্ঠিত উচ্চবিত্ত প্রাক্তনীদের ভীড়ে অভাবী বা সামাজিক আভিজাত্যে তুলনায় খানিক নিচুতলার ছাত্রের অস্বস্তি বা অপমান;
২) খুন বা সেরকম কোনও অপরাধ ঘটানো ব্যক্তি নিজের শরীর থেকে নির্গত দুর্গন্ধে মানসিক স্থিতি হারিয়ে মনোবিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন;
৩) পৌরাণিক ঘটনার আদলে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্করহিত কোনও কাহিনি;
৪) ভয়ঙ্কর সব হাসির গল্প। হাসির গল্পের ইলাস্ট্রেশনে চরিত্রদের চেহারা কখনও স্বাভাবিক হবে না আর নামকরণও একঘেয়ে প্যাটার্নে। কতদিন, কতদিন ধরে এই বৃত্তে পাক খাব আমরা পাঠকরা? পরিণত সাহিত্য ক্রমশ দুর্লভ।
প্রতিভার দেউলিয়াপনা?
গত দশ বছরে বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনও লেখক এলেন না যিনি প্রতিভার এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে লিখছেন, এই ঘটনাটি কিন্তু খুবই অস্বাভাবিক। ফলে, স্বাভাবিক যে কথা মনে আসে তা হল, ভালো লেখা রচিত হচ্ছে কিন্তু তা বৃহত্তর পাঠকের সামনে আসছে না। ঘন অন্ধকারে সহস্র ভোল্টের স্পার্ক ঝলসাচ্ছে কদাচিৎ কিন্তু সে ঝলকানি অতি দুর্লভ। একজন লেখকের পক্ষে একটি মাত্র ভালো উপন্যাস বা গল্প লিখে হারিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তাহলে? 'দেশ' পত্রিকাতেই বহু বছর আগে একবার প্রচ্ছদ কাহিনি হয়েছিল মধ্যমেধার জয়জয়কার। মেধাবী লেখাগুলির হারিয়ে যাওয়ার পিছনে কি এটাই কারণ?
নিজস্ব অভিজ্ঞতায় দীর্ঘ সময় ধরে পরিচিত বৃত্তে শুনেছি/ পড়েছি কোনও কবি বা লেখকের একের পর অসাধারণ কবিতা বা কাহিনি। কোনও নামী পত্রিকায় সেগুলি মুদ্রিত হতে দেখিনি। কদাচিৎ হয়তো ছাপা হয়েছে একখানি লেখা যেটি নিতান্তই সাধারণ। তার মানে কি অভিজ্ঞ সম্পাদক পাঠকের রুচি বা মেধা সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন আর সেই অনুসারে জনপ্রিয়তার স্বার্থে লেখার মানের সঙ্গে আপস করছেন? অথচ অতীতে বাংলা সাহিত্যে প্রাতঃস্মরণীয় সম্পাদকেরা পাঠকের রুচি নির্মাণে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে, ক্রমাগত স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে সৎ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন।
আমি জানি না কী কারণে আধুনিক সাহিত্যের সেরা সম্ভারে ক্রমাগত পৌরাণিক আখ্যান! জানি না কেন সাম্প্রতিক সাহিত্যে প্রেত পিশাচের বাড়বাড়ন্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় লেখা পাঠানোর নিয়মাবলীতে সাতটি শর্ত থাকত। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, 'নবীনরা যদৃচ্ছা পাগলামিও পাঠাতে পারেন কিন্তু বানান ও ব্যাকরণ ভুল থাকলে পড়ে দেখা হবে না।' আজ সত্যি বাংলা সাহিত্য অভিভাবকহীন। তাই, 'কুলীন' গোত্রীয় পত্রিকার বার্ষিক গল্প সংখ্যায় একই ব্যক্তির সম্পর্কে 'করত', 'পেত' ইত্যাদি হীনতর ক্রিয়া পদের পাশে নির্দ্বিধায় সর্বনাম 'তিনি'র সহাবস্থান। অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দের ব্যবহার-- 'অথচ এই ট্র্যাডিশন ফলো করতে গিয়ে'-- এই ধারা অনুসরণ করতে গিয়ে কি এতটাই অপ্রচলিত বাক্যাংশ? গল্পের মুখ্য চরিত্র, পৌরাণিক কাহিনির ইন্দ্রদ্যুম্ন দিব্যি য-ফলা উড়িয়ে 'ইন্দ্রদুম্ন' হয়ে বিরাজমান। প্রাজ্ঞ সাহিত্যিকের গল্পের চরিত্র অক্লেশে বলে দেন– 'অতিরিক্ত মেধার কারণেই কি না কে জানে এক মেয়ের চেহারা রসকষহীন রুঠা'। একই নির্মিতিতে একের পর এক গল্প লিখে চলেছেন তো চলেছেন নামী গল্পকার, আর সম্পাদকও প্রকাশ করে চলেছেন ক্লান্তিহীন। পাঠকও অক্লান্তভাবে সে গল্প পড়ে চলেছেন তো চলেছেন। এ কি প্রতিভার দেউলিয়াপনা নাকি আকাশছোঁয়া আত্মম্ভরিতা-- পাঠকরা এর বেশি কিছুর যোগ্য নয়।
নোংরা প্লাস্টিকের মতো
লেখা ছাপা না হোক, নবীন লেখকরা সাহিত্য সভাগুলিতে ডাক পেলেই যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। বিশেষত যে সভাগুলিতে ঘটে নক্ষত্রের সমাবেশ। বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কথা শোনা আর নিজের লেখা তাঁদের শোনানো-- দুটো বিষয় নিয়েই অসম্ভব প্রাণিত থাকেন। প্রথম পর্ব অর্থাৎ শ্রোতার ভূমিকা তাঁরা যথাযথ পালন করেন। কিন্তু নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নবীনদের প্রতি যথাযথ উপদেশ দেবার পরই তাঁদের অন্যত্র অধিকতর প্রয়োজনীয় কাজের তাগিদে বিদায় নিতে হয়। তাঁদের বিদায় সম্বর্ধনা নিয়ে উদ্যোক্তারা অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাকি সভা ভাঙা হাটের মতো এলোমেলো হয়ে যায়। সম্প্রতি অপূর্ব একটি ছোট গল্প পড়লাম এই বিষয়ে-- পূর্ণ প্রস্তুতি আর উদ্দীপনা নিয়ে নতুন লেখা গল্প পড়তে সভায় গিয়েছিল যে তরুণ, বিশিষ্ট সাহিত্যিককে গল্প শুনিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে, শেষ অবধি সে গল্প শোনানোর সময়টুকু আর পায় না। সভা ভেঙে যায়। কিন্তু সে গল্প যার নাম 'জগদীশ ও শ্রীদেবী', তার শ্রোতা সে খুঁজে পায় ওই দমচাপা সভাঘরের বাইরে।
শেষ অবধি আশাটুকু কিন্তু রয়ে যায় বুকে আমাদের, আমরা যারা বাংলা সাহিত্যে বাঁচি। সকাল থেকে রাত অবধি দৈনন্দিনের ব্যস্ততায়, সময়ের সঙ্গে রেস লাগিয়ে হারতে হারতেও, বেদম হয়েও ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে ফেলি। সেই মুহূর্তে কেন্নোর মতো গুটিয়ে এতটুকু হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে যায় যত অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য--
-- গল্প না দিয়ে একটা অণুগল্প দিতে পারেন, এই ধরুন দুশো শব্দের মধ্যে;
-- পাঠিয়ে দেবেন দশটা গল্প, আমাদের নির্বাচকমণ্ডলী যদি প্রকাশের উপযুক্ত মনে করেন...
-- মোটামুটি কত ফর্মা হবে? তিরিশ মতো লাগবে ধরে রাখুন। বুঝতেই তো পারছেন, এ সব বই তো কাটবে না।
শেষ বিকেলে ঘনিয়ে আসা ঝড়ের দাপটে উড়ে যাওয়া নোংরা প্লাস্টিকের মতো টুকরো টুকরো শব্দগুলো ছিটকে যায়। আর সেই সময়ে কী করি আমি? নিজের ঘরে, নিজের বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়াই। কোন বইটা টেনে নিই সে কথা কেউ জানবে না। মোবাইলে পাইকারাকে অর্ডার দিয়ে কোন বইটার দাম GPay'তে পাঠাব সেটা নির্বাচন করব শুধুই আমি।
বাহবা লেখককে। সোজা কথাটা সহজ করে বলেছেন। অভিবাদন!
ReplyDeleteঅনেক দিন পর একটা সুন্দর সমালোচনা পড়লাম। ঠিক যেন শান দেওয়া ছুরি। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে সঠিক এবং উপযুক্ত। আরও বৃহত্তর পরিসরে এটির প্রচার হলে, বাংলা সাহিত্যের অগনিত পাঠক খুশী হবেন।
ReplyDeleteএকেবারে সঠিক ও অনেকের মনের কথা
ReplyDeleteসময়োপযোগী ও যথাযথ
ReplyDeleteচমৎকার লেখা! আর সেই কারণেই আরও বিস্তৃত আলোচনার প্রত্যাশা ছিল।
ReplyDeleteএই প্রতিবেদনে আজকের সাহিত্যের বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক চিত্র এসেছে।এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েও বলি অনেক উৎকৃষ্ট লেখা ,বলা যায় মিডিয়া- হাইপের বাইরে,হারিয়ে যায় আমাদের ব্যাপক অনুসন্ধানের অভাবে।এ কারণে এই বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা সম্ভব হলে ছোট করে আলোচনাসভা হলে পারস্পরিক সশ্রদ্ধ মতবিনিময় হলে এখানে বলা কথাগুলো আরো ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা আর সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক ও লেখকদের অন্তরঙ্গতা হবার সম্ভাবনা বাড়বে বই কমবে না।আবার এই প্রতিবেদনের সাধু উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ReplyDelete