কেন এই জলঘোলা?
সজল রায়চৌধুরী
প্রস্তাবটা এসেছে অদ্ভুত ভাবে। সুকান্ত মজুমদার, নিশিকান্ত দুবে, অনন্ত মহারাজ, গৌরী শঙ্কর ঘোষ যেন নিজের নিজের দায়িত্বে উত্তরবঙ্গ ও মালদা-মুর্শিদাবাদের চিকেন নেক'কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার প্রস্তাব দিয়েছেন। শমীক ভট্টাচার্য সহ আরও কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বলেছেন যে এটা বিজেপির লাইন নয়। কেউ যদি মনে করেন, বিজেপির নেতারা নিজেদের চরম হতাশা ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকেই এইসব উল্টোপাল্টা দাবি করছেন, তাহলে ভুল করবেন। শেক্সপিয়ারের ভাষায় বলতে হয়, দেখতে পাচ্ছেন না 'though this be madness, there is method in't.' (Hamlet)। বিজেপির নেতাদের বাংলা ভাঙার খুঁটিনাটি বক্তব্য ও তার খণ্ডনের পাগলামির মধ্যে একটা পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে। যেটা পরিকল্পিত। পশ্চিমবঙ্গকে টুকরো টুকরো করার ভাবনাটা ভাসিয়ে দিয়ে বাজার যাচিয়ে দেখা যাক। কোনও ফল না হলে 'আমাদের লাইন নয়' বলে মুখ মুছে পিছিয়ে আসা যাবে।
ভোটে খারাপ ফল হওয়ার আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির শিরঃপীড়ার কারণ। এখন তো পশ্চিমবঙ্গের নাম শুনলেই তাদের 'মনে জাগে শিরোহীনের স্কন্ধ'। তাদের হাতে মোটে একটাই তাস-- বিভাজন; ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্তা ভিত্তিক বিভাজন। এই বিভাজনকে উসকে দিয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের পতাকার নিচে অতি কেন্দ্রীভূত প্রশাসন গড়ে তোলা। উদ্দেশ্যটা এত স্পষ্ট যে তা নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। কিন্তু এর ফলাফল হয়েছে উল্টো। ভোটের সময় পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল, কংগ্রেস ও সিপিএম একে অপরের বিরুদ্ধে লড়লেও বিজেপির ভাঙার গান শুনে প্রত্যেকে প্রতিবাদ করেছে।
খানিক ইতিহাসে যাওয়া যাক। প্রধানত বাঙালি অধ্যুষিত যে ভূখণ্ডকে আমরা বাংলা বা বঙ্গভূমি বলি, প্রশাসনিক ভূ-ভাগ হিসেবে তা পাঠান সুলতানদের আমলেই প্রথম উল্লিখিত হয়। গৌড়বঙ্গের কথা তার আগেও শোনা যায়। মোগল আমলে সুবে বাংলার মধ্যে বিহারের কিছুটা এবং উড়িষ্যার অংশ ছিল। চণ্ডীমঙ্গলে দেখি,
'ধন্য রাজা মানসিংহ বিষ্ণুপদাম্বুজ-ভৃঙ্গ
গৌড়-বঙ্গ-উৎকল-অধিপ।।'
সে সময় বাঙালি ছাড়াও কোল, মুন্ডা, খেরোয়াল, আদিবাসী, অস্ত্রাল, ভোটচিনি ইত্যাদি মূলবাসীরা ছিল। বাংলা কখনই শুধুমাত্র বাঙালির বাসভূমি ছিল না। ইংরেজ আমলে ভারতে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, বোম্বাই প্রেসিডেন্সি ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি। ১৯১১ পর্যন্ত কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ইংরেজি শিক্ষার দৌলতে 'ভদ্রবিত্ত' বাঙালি ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও শিক্ষালয়ের প্রধান শক্তি হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। পাঞ্জাব থেকে অসম, ডাক্তার, অধ্যাপক, স্কুল-মাস্টার, পোস্ট-মাস্টার, স্টেশন-মাস্টার অনেকেই বাঙালি। আদালত বোঝাই বাঙালি উকিল ব্যারিস্টার। দক্ষিণ ভারতে অবশ্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তামিল ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে মারাঠি, গুজরাটি ও পার্সিদের প্রাধান্য। ভারতে জাতিগুলোর অসম বিকাশ বিভিন্ন অঞ্চলে জাতিসত্তাগুলোর ধাপকাটা সিঁড়ি বা hierarchy গড়ে তুলল। অনেক ক্ষেত্রে সনাতন জাতপাতের সিঁড়ির সঙ্গে এটা প্রায় সমানুপাতিক।
বাঙালির এই আধিপত্য জায়মান অন্য জাতির উত্থানের পথে প্রায়ই প্রতিবন্ধকতার কাজ করেছে। এই সংঘাত বিশেষ ভাবে ওড়িয়া ও অসমীয়াদের ক্ষেত্রে প্রবল হয়। (দ্রঃ-- ফকিরমোহন সেনাপতি ও লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার আত্মজীবনী)। ১৯০৫ সালে তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশ ভেঙে পূর্ববঙ্গ ও অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ করা হয়। বলা হয়, প্রশাসনিক কারণেই এই বঙ্গভঙ্গ। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই এর পেছনে কাজ করেছিল। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পুনরাবৃত্তি করছি না।
১৯২০ সালে কংগ্রেসের কাজকর্ম নিজ নিজ ভাষায় চালানোর জন্য কংগ্রেসকে কুড়িটা প্রদেশে ভাগ করা হয়। প্রশাসনিক প্রদেশ যেমনই হোক কংগ্রেস এই প্রথম ভাষাভিত্তিক প্রদেশের পথে এগোয়। অবদমিত জাতিসত্তার আন্দোলন তীব্র হয়। সাইমন কমিশনের কাছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রদেশ দাবি করে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। বাংলা থেকে ওড়িশা ও বিহার আলাদা হয়। এই বঙ্গভঙ্গ অবশ্য সঠিক ছিল। ১৯৪৭ সালে ৬০০'র মতো দেশীয় রাজ্য সহ বিভক্ত ভারত স্বাধীন হয়। কিন্তু, এবার যে বাংলা ভাগ, তা অতীব শোচনীয়।
ভারতে ১৯৫২ সালে মাদ্রাজ থেকে তেলুগু ভাষী অঞ্চলকে আলাদা রাজ্যে পরিণত করার দাবিতে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা রামুলু অনশন করে প্রাণত্যাগ করেন। পৃথক অন্ধ্র রাজ্য গঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়। যে রাজ্যগুলি গঠিত হয় সেগুলিও বিভিন্ন সময়ে পুনর্গঠিত হয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রায় সর্বত্রই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠিত হয়েছে। অতএব, বিজেপির কোনও কোনও নেতার পশ্চিমবঙ্গ ভাগের এই আওয়াজ ভারতে রাজ্য পুনর্গঠনের মূল নীতির বিরোধী। মালদহ, মুর্শিদাবাদ বাংলাভাষী। সুতরাং, বাংলা থেকে আলাদা করার কোনও কারণ নেই। উত্তরবঙ্গে যেমন বিভিন্ন পাহাড়ি জনজাতি অবদমিত অবস্থায় আছে, তেমন বহু জনজাতির ভাষা ও সংস্কৃতি এবং জল, জঙ্গল, জমি থেকে তারা ২০০ বছর ধরে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে বিলুপ্তির পথে। কেন্দ্রকামী বিজেপি তাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি দিতেই পারে না।
বাঙালির কাছে এখন একদিকে যেমন বিজেপির খপ্পর থেকে নিজেদের ভূখণ্ডকে মুক্ত রাখতে হবে, অন্যদিকে ওই আদিবাসী 'মানহারা' মানবগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, মর্যাদা ও অধিকার বাংলায় অক্ষুন্ন রেখে যেতে হবে। অবাঙালি-বিরোধী কোনও বিদ্বেষমূলক স্লোগান নয়। হাতে হাত রেখে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
যে দলের কাছ থেকেই এ প্রস্তাব আসুক তা গ্রহণীয় হতে পারে না।আমাদের এমন বিরোধিতা ইতিহাসে উজ্জ্বল।লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রচেষ্টার বিরূদ্ধে ১৯০৫ সালে বাংলা প্রতিবাদে উত্তাল ছিল।রবি ঠাকুরের হিন্দু মুসলমানকে রাখী পরানোর ঘটনা কারুর অবিদিত নয়।তাই এ প্রতিবেদনে উত্থাপিত বক্তব্য আর সমগ্র
ReplyDeleteবিশ্লেষণকে আমি সাধুবাদ জানাই। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর এ এক নতুন বিভাজনের রাজনীতি।
বি জে পি'র কয়েকজন ভুঁইফোড় নেতা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশ নিয়ে জুয়াখেলা শুরু করেছে।
ReplyDelete