দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে
বিবর্তন ভট্টাচার্য
প্রথম পর্যায়ে ৩.৪ কিমি দীর্ঘ বুড়িগঙ্গা সংস্কারের কাজে (চিঁড়েকল থেকে নতুন পাড়া ক্লাব পর্যন্ত) যে সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছিলাম, তাতে আমাদের মনে হয়েছে, 'নদী সংস্কার হচ্ছে' এই বিষয়টি বেশ মাখো মাখো শোনালেও আগে দরকার নদীর খাত থেকে বেআইনি দখলদারি উচ্ছেদ। পাটকাঠির গাদা, গোয়ালঘর, শৌচাগার, ধানের গোলা, ক্লাবঘর, কালীমন্দির, বাঁশের সাঁকো (এপার থেকে ওপারে যাওয়ার) এইসব উচ্ছেদের পর তবে বুড়িগঙ্গা আজ প্রবহমান। ঠিক এই কারণেই, শান্তিপুরে সুরধ্বনি নদীর সংস্কারে অর্থ অনুমোদিত হয়ে কাজ শুরু হলেও সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা পশ্চাদপসরণ করেছেন নদীখাত থেকে দখলদারি তুলতে না পেরে।
কার্যত, ১৩ জুন ২০২৪ সকালবেলা বুড়িগঙ্গায় ১০০ জন মানুষ নেমে কচুরিপানা অপসারণের কাজ শুরু করেন। এর আগে ২৫ মে গঙ্গাপ্রসাদপুরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক ও মৎস্যজীবীদের যৌথ এই সভা ছাড়াও ৯ কিমি পথ টোটোতে করে প্রচার চালানো হয়। সভায় উপস্থিত ২০০ জন কৃষক ও মৎস্যজীবীরা সিদ্ধান্ত নেন, কোথায় কাটা মাটি রাখা হবে। এও ঠিক হয়, বুড়িগঙ্গার অধিকার বিন্যস্ত থাকবে, কৃষকদের পাট পচানোর জন্য দু' মাস এবং বাকী সময় মৎস্যজীবীদের জন্য বন্টিত করে। মশারি জাল ব্যবহার করা যাবে না। চওড়া এবং গভীর করে বুড়িগঙ্গা সংস্কার করতে হবে। বুড়িগঙ্গায় জলসরবরাহকারী নয়নজুলিগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। পাট পচানোর পর পাটকাঠি বুড়িগঙ্গা থেকে তুলে পরিষ্কার রাখতে হবে। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সবাইকে মেনে চলতে হবে। একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষণীয় যে, কোনও রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি।
এবারে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ নতুন পাড়া ক্লাব থেকে হেড়ের খালের ব্রিজ হয়ে জকপুর পর্যন্ত। Work Order অনুযায়ী, ৫,৬০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সংস্কার চাকদহ পৌরসভা ও চান্দুরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত-১ (থানা চাকদহ) ৩০ শতাংশ কম রেটে ৬০ লক্ষ টাকায় সম্পন্ন হবে ও ১২০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করবে। এলাকার মানুষ আনন্দে আত্মহারা। এত দুর্নীতি, এত চুরি-চামারি, তার মধ্যে এই নদী আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। কাটমানি ছাড়া কোথাও কাজ হয় বলে মনে হয় না। কিন্তু, বুড়িগঙ্গা সংস্কার আন্দোলনের কর্মীরা এজেন্সিকে চা খাওয়াচ্ছে অথচ এজেন্সি তাদের কিছু খাওয়াতে পারছে না।
এর মধ্যে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বুড়িগঙ্গায় প্রাণ সঞ্চার বিষয়টিকে শিক্ষা জগতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। একটা স্লাইড ডকুমেন্ট ও রাইট আপ তৈরি করা হয়েছে যা ভারতের বিভিন্ন আইআইটি ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখানো হবে। গবেষকের বক্তব্য, বিশ্বে একমাত্র হাডসন রিভার ( Hudson)'এ- যেটি নিউ ইয়র্কে প্রবাহিত- ১৯৬০-৭০'এ সংস্কারের কাজ হয়েছিল। মাটির কাছের মানুষদের নিয়ে এইরকম হেজে যাওয়া, মজে যাওয়া নদী যদি প্রাণ ফিরে পায় তা অভূতপূর্ব এক ঘটনা বৈকি; কারণ, ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের কোথাও এমনতর ঘটনা আগে দেখা যায়নি। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই ধরনের নদী সংস্কারের এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আগামী ২০ জুলাই স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে মৎস্যজীবী, কৃষক ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে এই ডকুমেন্টটি প্রদর্শিত হবে।
পাশাপাশি, নদীর খাতে পাটচাষ তোলা সম্পর্কে কৃষকদের যথাযথ বোঝানো মৎস্যজীবীদের নিত্যদিনের কাজ। নিজেদের জীবন-জীবিকার কাজ বজায় রেখে প্রতিদিন পালা করে এই কাজের তত্ত্বাবধান করে চলেছেন মৎস্যজীবীরা। বুড়িগঙ্গা সংস্কার হলেই এই বর্ষায় মাছ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মৎস্য দফতর। ইতিমধ্যে শোল, ল্যাঠা, কালবাউস, মৃগেল, শিঙ্গি, মাগুর মাছ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিদিন ৬টি জেসিবি ১০ ঘন্টা করে নিয়মিত কাজ করে চলেছে। এই বর্ষায় প্রচুর জল প্রবেশ করবে বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গায় জোয়ার-ভাটার জল প্রবাহিত হবে। চাকদহের নিকাশির জল ১৫ এমএলডি করে ফেলা হবে বুড়িগঙ্গায়। গত বছরেই মহালয়ায় এই বুড়িগঙ্গায় পিতৃতর্পণ করেছেন এলাকার বহু মানুষ।
বলাগড়ের মৃতপ্রায় নৌ-শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাবে। নতুন মাটিতে নতুন ফসল-- এবার শীতেই এই সুবিধা পাবেন কৃষকরা।
এ বিষয়ে যারা আরও জানতে চান, বিশেষত কীভাবে বুড়িগঙ্গার প্রথম পর্যায়ের কাজ গত বছরে সম্পন্ন হয়েছে, তাঁরা এই ভিডিওটি দেখতে পারেন:
https://www.youtube.com/watch?v=QB_RYyOnoCU&t=7s
খুব ই আশাব্যাঞ্জক কাজ।
ReplyDelete