Sunday, 28 January 2024

পালটুরামের এত গুরুত্ব কেন!

‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

২০২২ সালের মাঝামাঝি যখন খ্যাতমান ‘পালটুরাম’ এনডিএ ছেড়ে মহাগঠবন্ধনে সামিল হয়েছিলেন, তখন তাঁকে যারা নিয়েছিলেন তাঁদের দিক থেকে কেউ প্রশ্ন তোলেননি যে, পালটুরাম আবারও যে সঙ্গ ও সঙ্গী ত্যাগ করবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে কী? অবশ্য, উল্টোদিকে দিকে সে সময় অমিত শাহ, পালটুরামের আবারও ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা আঁচ করে সদম্ভে বলেছিলেন, পালটুরামের জন্য তাঁদের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ; আবার পালটুরামও হেসে হেসে জানিয়েছিলেন, মাটিতে মিশে যাব, তবু বিজেপি’র কাছে আর যাব না। বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক নেতাদের কথা যে এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিতে হয়, তা দেশের অধিকাংশ মানুষ ভালই জানেন।

কিন্তু কথাটা ঠিক সেখানে নয়। প্রশ্নটা, যে রাম মন্দিরের হুজুগ তুলে সরকারি প্রশাসন ও গোদি মিডিয়ার ব্যান্ড সহযোগে দেশ জুড়ে তুমুল শোরগোল তৈরি করা হল এই ভেবে যে, রামচন্দ্র’ই মোদিজীকে নিশ্চিন্তে ২০২৪ পার করিয়ে দেবেন, তারপরেও এত সংশয় কেন? ঘোষণা মতে তাদের তো ‘অবকী বার ৪০০ পার’ হওয়ার কথা। কিন্তু মনে সোয়াস্তি বা বিশ্বাস এত টলায়মান যে নীতিশকুমারের মতো ফুরিয়ে আসা এক অকিঞ্চিৎকর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পিছনে তারা ঝুলে পড়লেন! ২০২০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনেই বোঝা গিয়েছিল, নীতিশকুমারের দল ৪৫টি আসন জোটাতেই পারত না যদি না বিজেপি’র সঙ্গে হাত মেলাত। অর্থাৎ, অন্য কোনও দলের সাহায্য ছাড়া পালটুরামের জেডি(ইউ) বর্তমান বিহার রাজনীতিতে যে একটি প্রান্তিক শক্তি, তা বুঝেও মোদি-শাহ’রা কেন তাঁকে এত গুরুত্ব দিলেন? এই জিজ্ঞাসা থেকেই শুরু হতে পারে, ২০২৪’এর মহারণের কিছু চমকপ্রদ ইতিকথা।

তার আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত, আমরা যতই নির্বাচনী রাজনীতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি না কেন, অথবা, আমজনতাকে ‘ভেড়ুয়া’ ভেবে নিজ নিজ কুযুক্তিগুলিকে প্রশ্রয় দিই, আদপে আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র তার হাজারও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিন্তু দিনে দিনে রাজনৈতিক দলগুলির মুখের ওপর এক সপাটে চপেটাঘাতের মতো পরিপক্ক হয়ে উঠেছে এবং নেতা-মন্ত্রী-রাজনৈতিক দলসমূহের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রেখেছে। ২০১৮ সালে দেশে মোদি হাওয়া যখন আরও বেশি পাকছে, তখনই কিন্তু রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় আরোহন করেছিল। ২০১৯’এ লোকসভায় বিজেপি’র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরেও কিন্তু ২০২০ সালে বিহারে কোনওরকমে সামান্য দুটি আসন বেশি পেয়ে এনডিএ ক্ষমতা লাভ করে এবং দিল্লি বিধানসভা ও সেখানকার তিনটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ ভালমতোই পরাজিত হয়। কিছুকাল আগে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র শোচনীয় পরাজয় আরও একবার জানান দেয় যে, ইভিএমের গালগপ্পো নয়, মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-প্রতিক্রিয়াতেই এক পক্ষ জিতছে, অপর পক্ষ হারছে।

সমস্যা হল, জনতার আঙুলের এই ক্ষমতার তাৎপর্যকে বিজেপি-আরএসএস’এর পাকা মাথা যতটা অনুধাবন করেছে, বিরোধী পক্ষ সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আর সে জন্যই ‘নিভে আসা’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পালটুরাম’কে খাতির করতে বিজেপি কসুরের কোনও বাকী রাখেনি। কারণ, তারা জানে, রামের লহর তৈরি করা গেলেও ভোটের বাক্সে তা রাশি রাশি ‘পদ্ম’ চিহ্ন হয়ে জমা পড়বে না, কারণ, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মাশ্রয়ী হলেও ধর্ম-পুজোপাঠ-বিশ্বাস থেকে রাজনীতি-অর্থনীতিকে আলাদা করতে জানেন। তাঁদের একটা অংশ মোদি বা বিজেপি’কে বেশি ভোট দিচ্ছেন রামের নামে নয়, দেশের বিকাশের পক্ষে মোদি ভাল কাজ করছেন, এটা ভেবে। এটা আবার বিরোধীদের একটা অংশ, যারা নিজেদের ভুলত্রুটি দেখতে পায় না, বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু ঘটনা হল, বিজেপি’র এখন পাখির চোখ মূলত ছ’টি রাজ্য (বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, দিল্লি ও পঞ্জাব) যেখানে লোকসভা নির্বাচনে তাদের অন্তত ৬০-৭০টি আসন কমে যেতে পারে বলে তারাও আশঙ্কিত এবং যদি তা হয়, তা হলে বিজেপি’র মোট আসন ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচনে ২৪০’এর নিচে নেমে যাবে। মধ্য ভারত, উত্তর ভারত ও গুজরাতে বিজেপি ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ আসন পাওয়ার স্তরে চলে গিয়েছে- গতবারের থেকে আর বেশি কিছু পাওয়ার নেই, বরং হারালে বাড়তি ক্ষতি; উপরন্তু, দক্ষিণ ভারতে তাদের প্রায়-শূন্য হাতেই ফিরতে হবে ও উত্তর-পূর্ব ভারতেও (মোট ২৫টি আসন) প্রবল ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা, অতএব, ওই ছ’টি রাজ্যেই (মোট আসন ১৭৬) বিজেপিকে কামাল করতে হবে, নয়তো ফক্কা। আর এখানেই যত ঘোঁটের উৎস।

এই ছ’টি রাজ্যের মধ্যে বিহারের গুরুত্ব সব থেকে বেশি, কারণ, ২০১৯ সালে ৪০টি আসনের মধ্যে এনডিএ ৩৯টি পেয়েছিল। তা সম্ভব হয়েছিল বিজেপি ও জেডি(ইউ) একসঙ্গে লড়ার জন্য যেখানে বিরোধী তিন শক্তি- আরজেডি-কংগ্রেস-বাম আলাদা আলাদা লড়েছিল। এবারে যেহেতু বিরোধীদের মহাগঠবন্ধন হয়েছে- যার অনেকটা সুফল বিধানসভা নির্বাচন থেকেও পাওয়া গেছে- সেখানে যদি পালটুরামের দলও ভিড়ে থাকে, তাহলে বিজেপি’র পক্ষে তা সমূহ বিপদ এবং গতবারের ৩৯টি আসন নেমে ১০’এর নিচে চলে যেতে পারে বলে প্রাথমিক অনুমান। ফলে, তড়িঘড়ি ‘অপারেশন লোটাস’এর আয়োজন। যেহেতু বিহারের সমাজ-রাজনীতিতে ছোটবড় বহু দলের ১-২ শতাংশ ভোটও নির্বাচনী ফলাফলকে এদিক-ওদিক করে দিতে পারে, তাই অকিঞ্চিৎকর ও নিভন্ত শক্তি হলেও বিজেপি পাল্টুরামকে সঙ্গে নিয়েই লড়াইয়ে ফিরে আসতে চেয়েছে। তারপর জঞ্জালের মাল জঞ্জালে ফেলে বিজেপি’ও তার হাত ধুয়ে ফেলবে কিন্তু নিজ শক্তিকে কীভাবে প্রসারিত করা যায় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই।

বাকী রইল মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, পশ্চিমবাংলা, দিল্লি ও পঞ্জাব। ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে শিবসেনা ও বিজেপি মিলে মহারাষ্ট্রে ৪৮’টার মধ্যে ৪১’টা আসনে (বিজেপি: ২৩ ও শিবসেনা: ১৮) জয়লাভ করে। এবারে শিবসেনার মূল বা আদি অংশ বিজেপি’র সঙ্গে নেই। তারা বরং কংগ্রেস-এনসিপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ। ফলে, এবারে বিজেপি’র আসন ২০’র নিচে আটকে যাবে বলে অনুমান। কর্নাটকে ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে ২৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ২৬টি এবং কংগ্রেস ও জেডি(এস) ১টি করে। তখন রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপি সরকার- সেই চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার যার বিরুদ্ধে গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘৪০% কমিশন কা সরকার’ বলে আওয়াজ ওঠে এবং ফলত শোচনীয় পরাজয়। এবার নিশ্চিত, গতবারের আসন বিজেপি তো পাবেই না, বরং ১০’এর কোটা পেরতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। পশ্চিমবঙ্গে অন্তঃকলহে দীর্ণ, সাংগঠনিক ভাবে ছন্নছাড়া ও অর্ধ-পাগল বিরোধী দলনেতা (যিনি চোখ পাকিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত শত্রুতা ভিন্ন আর কিছুই প্রকাশ করতে পারেন না) সহযোগে বিজেপি কি আদৌ ৪২টি আসনের মধ্যে ৪-৫টির বেশি পাবে? পঞ্জাবে ১৩টি আসনের মধ্যে ২০১৯’এর লোকসভা নির্বাচনে অকালি দল ও বিজেপি পেয়েছিল ২টি করে আসন, যেখানে কংগ্রেসের ছিল ৮টি ও আপ’এর ১টি। অকালি দল আর বিজেপি’র সঙ্গে নেই এবং রাজ্য নির্বাচনে আপ’এর বিপুল জয় আগামী ফলাফলকে বিরোধীদের দিকেই ঠেলবে বলে অনুমান। দিল্লিতেও ২০১৯’এ ৭’এর মধ্যে বিজেপি’র জেতা ৭টি আসন যে আর ধরে রাখা যাবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। ফলে, উল্লিখিত এই প্রতিটি রাজ্যে বিজেপি-আরএসএস’কে নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হবে, যার শুরুয়াত তারা বিহার থেকে করল। এই ঝুঁকিপূর্ণ খেলা আত্মঘাতী হবে কিনা তা সময়ই বলতে পারবে।

কিন্তু এরপরেও আরও একটি কথা থাকে।

‘ইন্ডিয়া’ নামক যে জোটটি সর্বভারতীয় স্তরে তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে তার শরিকেরা কে কতটা আন্তরিক ও দায়বদ্ধ যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের ভূমিকা বড়ই অদ্ভুত। তাদের শীর্ষ নেতা কে? মল্লিকার্জুন খাড়্গে না রাহুল গান্ধী- এ নিয়ে কোনও পরিষ্কার অবস্থান নেই। রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে একপ্রকার অবজ্ঞা করে একা লড়তে গিয়ে নিজেদের মুখ পুড়িয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলি যারা একেকটি রাজ্যে ক্ষমতায় তাদের অনেকেই নিজেদের ‘শাহেনশাহ’ বলে মনে করে। এইগুলি যে জনতার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তার ফল যে অনেক সময়ে উলটো হয়ে যায়, তা আমরা বহুবার দেখেছি। গত লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে বিজেপি’র ১৮টা আসন পাওয়া যতটা না তাদের নিজেদের কৃতিত্ব তার থেকেও বেশি ছিল রাজ্যের শাসকের প্রতি মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া।  

তবুও আশঙ্কার কথা এই, এক চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের দিকে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে ‘এক দেবতা, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক রাজা’ শাসিত দেশ হবে আমাদের ‘রামরাজ্য’। যদি সেই দিকনির্দেশকে বদলাতে হয়, তাহলে যারা বিরোধী শিবিরে দাঁড়িয়ে আপাতদৃষ্টিতে এই আগত ভয়ঙ্কর সময়কে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন, তাঁদেরও সমান ভাবে নিজেদের আচার-আচরণে, কার্যসূচিতে, জনতার সঙ্গে দৈনন্দিন সংযোগসূত্রে গণতন্ত্র, পরিষেবা, ন্যায়বিচার ও আলাপচারিতার প্রসঙ্গকে যথাসম্ভব সুনিশ্চিত করতে হবে, যার ভিত্তিতে মানুষের আস্থা তৈরি হতে পারে; তবেই অন্ধ-বিশ্বাসকে রোখা যাবে। কথায় বলে, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’। আগামী প্রতিটি দিনই তাই নিজেদের রূপান্তর ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার কঠিন লড়াই। নিছক অবিরাম তীর বর্ষণে মতান্ধতা (বা ধর্মান্ধতা) বিদ্ধ হবে না।

               

3 comments:

  1. আসন লাভের দৌড়ে নিশ্চিতভাবে বি জে পি এগিয়ে আছে। ইন্ডিয়া জোটের প্রবল অনৈক্য ও দিশাহীনতা সাধারণ মানুষকে ঐ জোট সম্পর্কে অনাগ্রহী করে তুলছে

    ReplyDelete
  2. মাননীয়া আছেন ইণ্ডিয়া ঘেঁটে দিতে।

    ReplyDelete