ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশিকা...
শ্রেয়া ঘোষ
'তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ-
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস।'
(গীতাঞ্জলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।)
২২শে জানুয়ারির মতো একেবারে সাদামাটা একটা তারিখও যে এমত হৈ
চৈ লাগিয়ে দিতে পারে, ভাবিনি কদাপি। জানুয়ারির তেইশ তারিখের আগের দিন বাইশে সচরাচর
তেমনই হয়ে থাকে। তাই তেইশের কিছু প্রস্তুতি কয়েকদিন আগে থেকেই - কদম কদম বঢ়ায়ে যা, পরদিন দুপুর বারোটায় বাজাবার
জন্যে শাঁখ-টাখ গুছিয়ে রাখা, স্কুলের বিশেষ দিনের পোশাক সাদা জামা, লাল বেল্ট। তেইশে
জানুয়ারি বরাবরই বিশেষ। মৃত্যুহীন বীর, নেতাজীর শুধু জন্মদিন - তেইশে জানুয়ারি।
ব্যাপারটা পাল্টে গেল। ২২শে জানুয়ারি ফুলে ফেঁপে সর্বত্র বিরাজমান ভয়ঙ্কর একটা অনুশাসনের
মতো আমাদের চেপে ধরল। রাম, মানে রামচন্দ্র আমাদের জীবনে ওতপ্রোত। এস ওয়াজেদ আলির সেই
ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। 'রামায়ণ' আমাদের অতি
প্রিয় গ্রন্থ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, যেমন বলা আছে মাধ্যমিকের 'ভারতবর্ষ' প্রবন্ধের
বারবার আন্ডারলাইন করা অংশে। যুগ যুগ ধরে আমরা সেই বাক্যের ব্যাখ্যা লিখে আসছি। আমাকে ধরলে চারটি প্রজন্ম ধরে বহমান ট্র্যাডিশন তো
নিজের চোখেই দেখা। প্রায় অক্ষর পরিচিতিহীন আমার পিতামহী কোন যাদুবলে পাতার পর পাতা রামায়ণ
পড়েই যেতেন। তবে আমরা বাঙালিরা এই গ্রন্থকে সাহিত্য হিসেবেই দেখেছি বেশি। রামচন্দ্র
এক মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আমরা ঝেড়ে সমালোচনা করেছি সেই চরিত্রের। অন্তঃস্বত্ত্বা
সীতার দুঃখে যত কাতর হয়েছি, এই চরিত্রের কাপুরুষতা তত আমাদের ক্রুদ্ধ করেছে। 'মেঘনাদবধ
কাব্য'কে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ। আমরা রামায়ণ ফেলে পড়তে বসেছি সীতায়ন।
রামায়ণের নানা রকমফের
আছে দেশে বিদেশে; যেমন বহু রূপকথার, বহু লোককথার।
কিন্তু রামায়ণের এই একটি রূপকেই কালে কালে
প্রতিষ্ঠিত করা হল। পৌরাণিক এই গল্পের অন্যতর পাঠগুলিকে অদৃশ্য করার প্রক্রিয়া সক্রিয় বহু যুগ ধরে। হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস আহত হবার মারাত্মক ভাইরাসের দাপটে পৌরাণিক এই গল্পের অন্য
রূপগুলি প্রায় লুপ্ত হল। উত্তর ভারতের
হিন্দি বলয় বিশেষ করে এই একটি ফর্মের প্রতি
অত্যধিক পক্ষপাত লালন করতে করতে কল্পনাকে ইতিহাসে পর্যবসিত করে ফেলল। আর তার ফল কী হল দেখতেও পেলাম।
অথচ আমরা
মনের সুখেই ছিলাম নিজেদের মতো। কৃত্তিবাস বিরচিত রামায়ণে লক্ষ্মীমূর্তি
হেন সীতাদেবীকে বাম দিকে বসিয়ে, সোনার ছাতা, চামর, যোড়হাতে (কৃত্তিবাসী বানান বিধিমতে)
পবননন্দন সহ রামচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয়ের বহু আগেই আলাপ হয়েছে বেশ মাই-ডিয়ার টাইপের রামের,
যে বলছে - কাল রাত্তিরে আমি একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখেছি। দেখলুম কি, রাবণ ব্যাটা একটা
লম্বা তালগাছে চড়ছে। চড়তে চড়তে হঠাৎ পা পিছলে একেবারে পপাত চ, মমাত চ।
ববাবর জেনে এসেছি রাম
না হতেই রামায়ণ। লোক ঠকানো ধাঁধাঁয় জব্দ করতে ছিল- রামেরা চার ভাই'এর ইংরেজি অনুবাদ জিগ্যেস করা। কাজেই এমত ধারণাই মাথায় মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসেছিল যে মহাকাব্য থেকে বেরিয়ে
এসে চরিত্রটি একা খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না। আমাদের মাতৃভাষায় 'রামচন্দ্র' তেমন
একটা সম্মানের সম্বোধনও নয়। রামশালিক মানে বক জাতীয় পক্ষীবিশেষ। রামছাগল, রামধোলাই,
রামধাক্কা, আর... আর... রামগরুড়ের ছানা।
তবে রামকে ভূতেরা ভয় পায়। তাই রাম নাম জপলে ভূতেরা পালায় - আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে
গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি!
এসব কিন্তু একান্ত আমার ছ্যাবলামি নয় একেবারেই। সংসদ বাঙ্গালা অভিধান অনুসারে
রামায়ণ হল বাল্মীকি কর্তৃক রচিত দশরথপুত্র রামের জীবনী বিষয়ক মহাকাব্য। আর রাম শব্দের
পাশে ড্যাশ দিয়ে লেখা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। দ্বিতীয় স্থানে রামঃ। আরে রামঃ রামঃ, কি
অনাসৃষ্টি। ওদিকে আরেক কবি সুকুমার রায় লিখে বসলেন, 'আরে ছি ছি! রাম রাম! ব'লো না হে ব'লো না-/ চলেছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা।' ভাগ্যিস মরণোত্তর শাস্তি বিধানের উপায়
নাই।
ক্রমে
আদি কবি বাল্মীকি রচিত কাব্যের নায়ক ও তার বন্ধু স্বজনকে দেবত্বে মহিমান্বিত করা হল। রামচন্দ্রের
একটি বার্থডে'ও সূচিত হল ও জাঁকজমকে সেদিনটি পালনের ধারা তৈরি হল। আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, এই ধারা বাংলার জল হাওয়ায় সুবিধে করতে পারবে না। তাই তেমন মাথা ঘামাইনি। যে যার মতো উৎসব পালন করুক আমাদের এই নানা সংস্কৃতির
ভূখণ্ডে। কিন্তু হিসেব অত সোজা রইল না। রামের নামের আগে 'শ্রী' যুক্ত হল আর জয়ধ্বনি দ্রুত
হুঙ্কার আর আক্রমণে বদলে গেল।
এসব আমাদের জানা। অসংখ্য বার আলোচিত। সহজিয়া আনন্দের রেশটুকু
উধাও হয়ে গেল। আমাদের খোলামেলা যাপনের দরজা
জানলা বন্ধ হয়ে দম আটকানোর মতো একটা অবস্থা। উৎসব, পুজোপালার মূল সুরটাই গেল কেটে।
আমাদের পুজো মানে বাসন্তী শাড়িতে সেজে ভুলভাল মন্ত্রে সরস্বতী পুজো। কালীপুজোয় নিরামিষ
পাঁঠার মাংসের সাংঘাতিক স্বাদ, আমাদের দেবী মায়ের নিরামিষ রোচে না, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মদ্যপান ও মাতলামি নিয়ে দুর্দান্ত
সব রসিকতা। আমাদের লোকগানে শিব আর্শির সম্মুখে গিয়া অ্যালবার্ট কাটিবে। একটা হাল্কা
মজার সুর আমাদের পুজোপাঠে সব সময়ে। যুগাবতার
মহাপুরুষ ভক্তের মদ্যপানে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমাদের কবি অক্লেশে বলেন, 'এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।' আমাদের ধর্মাচরণ আমাদের নিজস্ব
রুচি আর সংস্কৃতি মেনে। কিন্তু সেই আবহ পাল্টে যাচ্ছে বিপজ্জনক ভাবে। চিত্ত হেথা ভয়শূন্য থাকছে না, জ্ঞান মুক্ত রাখার উপায় সব হারিয়ে
যাচ্ছে, হৃদয়ের উৎসমুখ হতে কোনও বাক্য আর উচ্ছ্বসিয়া ওঠে না।
আমাদের এই অজস্র মন্দির, মসজিদ, মঠ, গির্জা, সিনাগগের দেশে
কেন একটা মন্দির তৈরির জন্যে এত উন্মাদনা? আমরা গাছকে পুজো করি, কোনও পাথরে দেবত্ব আরোপ
করি, নদীর জলে ভেসে আসা কাঠের খণ্ডকে নানা উপচারে সাজিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করি। সেখানে আক্রোশের এত জগঝম্প কেন?
বাইশ তারিখে
ঘর বারান্দায় প্রদীপ
(রামজ্যোতি) জ্বালতে হবে, দীপাবলী উদযাপন করতে হবে, আরও কী কী সব... একটি ধর্মীয়
অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশিকা এল আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। হিন্দি বলয়ের
সদৃশ ধর্মপালন গোটা দেশে প্রচলনের এই তৎপরতা আজ অবধি আমাদের দেখা ছিল না। ধর্ম পালন করা বা না করা,
পালন করলেও তার আয়োজন-বিধি, উপচার, মূর্তি পুজোয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাস সব একটি এবং
কেবলমাত্র একটি নিয়ম মতেই হতে হবে! দূরে তাকিও নাকো,
ঘাড় বাঁকিও নাকো। সব নিজস্বতা জলাঞ্জলি দিয়ে এক ছাঁচ থেকে বেরিয়ে আসবে যত মানুষ।
রামলালা বিরাজমান
শিশু রামচন্দ্র এই মন্দিরের বিগ্রহাসনে অধিষ্ঠিত হবেন। ছোট্ট রামলালা সুপ্রিম কোর্টে মামলা জিতে গিয়ে এই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন। তাই মন্দির। তাই দেশসুদ্ধ মানুষকে এই আনন্দানুষ্ঠানে সামিল হতে হবে।
আর তখনই অন্য কোনও শহরে রাস্তায় রঙিন চক দিয়ে প্রায় উলঙ্গ কোনও রামলালা কোনও বিগ্রহের ছবি আঁকবে। দুর্বাদলশ্যম তার গায়ের রং, নীল পদ্মের
মতো চোখ, রাঙা চরণ। আঁকবে তীরধনুক, রথ, লম্বা লেজওয়ালা হনুমান। সেদিন হয়তো দু' চারটে
টাকা, কয়েন বেশিই পড়বে ছবির পাশে রাখা টিনের কৌটোটায়। জিগ্যেস কর যদি, এই, কোথায় রে
তোর ঘর? থাকিস কোথায় তুই? সে বলবে, এই তো, এই রাস্তাতেই থাকি।
কেউ কোনওদিন যেন আমাদের বলেনি,
'অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে
দেবতা নাই ঘরে।'
আমাদের মনের কথাগুলো ভাষা পেল তোর লেখনীতে। অভিনন্দন।
ReplyDeleteআজকের ভারতবর্ষে ধর্ম নিয়ে যে ভয়ঙ্কর অমানবিক কার্যকলাপ চলছে তা একদিকে যেমন এক অভূতপূর্ব অগণতান্ত্রিক আর স্বৈরাচারী পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে অন্যদিকে এনেছে এক অন্তঃসারশূন্য ধর্মের বাতাবরণ।এই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক শুধু নয় প্রকৃত মানবিকতার উৎকর্ষ আর ধর্মের আসল উপজীব্যকেও তুলে ধরেছেন পাঠকের সম্মুখে রবি ঠাকুরের এক সঙ্গতিপূর্ণ কবিতার উল্লেখে। নিঃসন্দেহে এই লেখা অভিনন্দনযোগ্য।
ReplyDeleteঅসামান্য।
ReplyDeleteরামলালার মুখে কথা থাকলে বলে উঠতেন 'যা কচ্ছিস কর বাট নট ইন মাই নেম !' (অসাধারণ লেখা)
ReplyDeleteখুব ভাল লিখেছেন। কিন্তু এত ভাল লেখার পরিণাম কী, তাই ভেবেই নিরাশ হয়ে যাই। আমরা কোনো কিছুই আর আটকাতে পারব না। এই লেখা তো রামভক্তদের পথে আনবে না। আমরাই কয়েকজন পড়ব ও বাহবা দেব। তবু লেখাটা ভাল, সন্দেহ নেই।
ReplyDeleteভালো লেখা। সরল ভাষায় মনের কথা।
ReplyDeleteতবে, ভারতীয় সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক। আমাদের অ-বিশ্বাসের অধিকার আছে।
আবার বেছে নিয়ে, রাম বা কৃষ্ণ, শিব বা কালী, নানক বা বুদ্ধদেব, চৈতন্য বা হরিচাঁদ যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারি। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি রং সৌন্দর্য । এটাই যেন থাকে, এবং যাতে থাকে সেটা চেষ্টা করতে হবে।
পিতৃ পরিচয় পালিত পিতার।
ReplyDeleteকার ঔরসে জন্ম তার কেউ লেখে না। দরকার ছিল না। কিন্তু ধর্ম যখন মাথায় বুদ্ধিতে শান দিতেই হয়।
নপুংষক দশরথ কেমন করে তিন রানিকে গর্ভবতী করালো এখানে লুকিয়ে রামায়ণ ও কাপুরুষত্ব।
সত্যি খুবই ভাল লেখা। এই কথন আর কিছু করতে পারুক আর না পারুক আমাদের মনের কথাটাতো বললো। লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ 🙏🙏
ReplyDeleteঅসাধারণ বিশ্লেষণ। যদি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আদালত রায় দিয়ে মন্দির তৈরির সুযোগ করে দিতে পারেন, তাহলে সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই সীতা দেবীর উপর যে নির্যাতন অযোধ্যাপতি করেছিলেন, তাতে জনকপুরে বসবাসকারী সীতাদেবির বংশধররা তো crpc 498a ধারায় বধূ নির্যাতনের মামলা করতেই পারেন।
ReplyDelete