বাইশ বছরের মরণপণ লড়াই
সোমা ঘোষ বিশ্বাস
প্রায় ২২ বছর পর ন্যায়বিচার পেলেন বিলকিস বানো। ২০২২ সালের ১৫ অগস্ট বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ জনের সবাইকে শাস্তির মেয়াদ ফুরনোর আগে মুক্তি দেয় গুজরাত সরকার। দোষীদের এই মুক্তিকে সুপ্রিম কোর্টে বিলকিস চ্যালেঞ্জ জানান। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, গুজরাত সরকারের এই সিদ্ধান্ত বেআইনি। এই অপরাধীদের আবার জেলে যেতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, গুজরাত সরকারের এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ারই নেই। মাননীয় বিচারপতি বি ভি নাগরত্না ও উজ্জ্বল ভূঁইয়ার সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে।
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বিলকিস বানো তার আইনজীবীর মাধ্যমে গণমাধ্যমে এক বিবৃতি প্রকাশ করে জানান, 'আজ সত্যিই আমার জন্য একটি নতুন বছর। আমার চোখে আজ আনন্দের অশ্রু। দেড় বছর পর আজ প্রথমবারের মতো হেসেছি, আমি এখন স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারি। আমি আমার সন্তানদের জড়িয়ে ধরেছি। যেন পাহাড় সম পাথরের বোঝা আমার বুক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আমি আবার নিঃশ্বাস নিতে পারছি। দেখে মনে হচ্ছে আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানাই, আমার সন্তান এবং সর্বত্র নারীদের জন্য সমান ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারার জন্য।'
সকলেই আজ অবহিত, ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার সময় বিলকিস বানোর পরিবারের ওপর সশস্ত্র দাঙ্গাবাজরা হামলা চালিয়ে বিলকিসের তিন বছরের মেয়ে সহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা এবং পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২১ বছর বয়সী বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করে। এই ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশ অফিসাররা তাঁর মামলা নথিভুক্ত করতে বারবার অস্বীকার করে, প্রমাণের অভাবের অজুহাত দেখায় এবং যদি তিনি বিষয়টি নিয়ে চাপাচাপি করেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। বিধ্বস্ত বিলকিস এরপরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে যান এবং ২০০৩ সালে ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই'কে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়।
জানা যায়, ঘটনার বেশ কয়েক দিন পরে বিলকিসের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সমূহ হারিয়ে গিয়েছিল। কোনও এফআইআর দায়ের করা হয়নি, পুলিশ প্রাথমিক ভাবে এফআইআর দায়ের করতে অস্বীকার করে এবং যখন তা করেছিল তখন ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ বাদ দিয়েছিল। এর মধ্যেও সিবিআই তদন্ত সম্পূর্ণ করে পুলিশ অফিসার ও ডাক্তার সহ ১৯ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে, যাদের মধ্যে যারা অপরাধটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারাও ছিল। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের একটি আদালতে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৭ সালে মুম্বাইয়ের আদালত ১১ জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে।
এই উত্তাল সময়ে বিলকিস বানো অভিযুক্তদের থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার বীভৎস বাস্তবতার মুখোমুখি হন। প্রাণসংশয়ের আশঙ্কায় তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। পরিস্থিতির গুরুত্ব স্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটিকে গুজরাতের আদালত থেকে মহারাষ্ট্রের আদালতে স্থানান্তরিত করে। এই স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তকে নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু, এত সবকিছুর পরেও গত বছরের ১৫ অগস্ট গুজরাত সরকার যখন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ওই অপরাধীদের শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে তাদের মুক্তির কথা ঘোষণা করে, তখন সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, জেলের প্রাচীরের বাইরে ওই অপরাধীরা যখন মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসে, তাদের ফুলের মালা পরিয়ে ও কপালে তিলক কেটে হিন্দুত্ববাদীরা যে জয়ল্লোস প্রকাশ করেছিল, তা দেখে কেঁপে উঠেছিল হৃদয়ের অন্তঃস্থল। কথায় কথায় যিনি সব বিষয়ে ট্যুইট করেন, সেই প্রধানমন্ত্রী মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। গোদি মিডিয়াও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। গোদি মিডিয়া ও প্রধানমন্ত্রীর সেই একই আচরণ আবারও দেখা গেল সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের ক্ষেত্রেও। এই ঐতিহাসিক রায়ের পরে গোদি মিডিয়াকে দেখা গেল এ বিষয়ে কোনও 'রা না কেটে ক্যামেরার ফোকাসকে রাম মন্দিরের উপর স্থানান্তরিত করতে ও প্রধানমন্ত্রী আবারও মৌনব্রত নিলেন।
কিন্তু শেষে একটা কথা বলার থাকে। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি আছেন যারা 'অনুকূল রায়' না পেলে বিচারব্যবস্থাকে দুষতে থাকেন ও গালি পাড়েন। আবার 'অনুকূল রায়' এসে গেলে দু' হাত তুলে প্রশস্তি গাইতে থাকেন। যে কোনও মামলায় তথ্য, আইনের ধারা ও সওয়ালের ওপর যেহেতু মামলার গতিবিধি নির্ভর করে, তাই সাধারণ বুদ্ধিতে যা মনে হয় তা মামলার রায়ের সঙ্গে সবসময় নাও মিলতে পারে। আর না মিললেই বিচারপতিদের ব্যক্তিগত আক্রমণ ও 'আমাদের বিচারব্যবস্থা বিক্রি হয়ে গেছে' এমন হাল্কা মন্তব্য করা হয় যা কোনও কাজের কথা নয়। এই দোষ শাসক ও বিরোধী, দু' পক্ষেরই আছে। মনে হয়, সার্বিক ভাবে আমাদের দেশের উচ্চন্যায়ালয়ের প্রতি আস্থা রাখার এখনও যথেষ্ট কারণ আছে। কোনও ব্যবস্থাপনাই একশো শতাংশ নির্ভুল বা যথাযথ হয় না।
সুন্দর লেখা
ReplyDeleteধন্যবাদ
DeleteKhub sundor lekha 👍👍
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteআপনার লেখা পড়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার মতই সুখানুভূতি হল!
ReplyDeleteসুপ্রীম কোর্টের এই রায় আমাদের স্বস্তি দিল।
ReplyDeleteকিন্তু পূর্বতন রায়দান, যার ফলে এই জঘন্যতম অপরাধ করেও ধর্ষক ও খুনিরা মুক্তি পেয়েছিল তার ভয় ও লজ্জার।ন্যায় বিচারের পথ এত বন্ধুর কেন?