‘উনকা স্বর মে খোদা কা তাসির হ্যায়’
অম্লান চক্রবর্তী
(১ জুলাই ১৯৬৮ - ৯ জানুয়ারি ২০২৪)
৯ জানুয়ারি কোনও অজানা কারণেই দিন শুরু করেছিলাম উস্তাদের গলায় 'ভাটিয়ার' শুনে। শীতের সকালে কুয়াশায় মিশে যাওয়া ভাটিয়ারের কোমল ঋষভ তখন সদ্য জেগে ওঠা রূপসীর মেখে যাওয়া সিঁদুরের মতো কামনার জন্ম দিচ্ছে। আর রশিদ খানের গলা যেন গভীর প্রেমে সেই কোমল ঋষভকেই বারবার আদর করে চলেছে। ঠিক যেমন আদর করে মেঘ মল্লারে বিরহিনীর ভাব স্পর্শ করতেন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে স্বর ও সুরের ‘টেকনিকালিটি’র সঙ্গে প্রয়োজন হয় ভাব-আবেগ-আবেশের। নবরসকে আধারিত করতে পারে একমাত্র কন্ঠ। উস্তাদ রশিদ খানের কন্ঠে ছিল সেই আধার।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আমি নিছকই এক শ্রোতা। কলাকৌশলগত শিক্ষা আমার নেই। ফলত আমার পছন্দ শুধুমাত্র শ্রবণের উপর নির্ভরশীল। কর্ণকুহর দিয়ে প্রবেশ করে যে সুর আমার মনকে আনন্দ দেয়, আমার কাছে তা-ই সুন্দর এবং নান্দনিক। সঙ্গীতকে আমি রেকর্ডের থেকে ‘লাইভ’ শুনতে বেশি পছন্দ করি। উস্তাদ আমির খান বা উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান মঞ্চে শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। ডোভার লেন, কলামন্দির বা উত্তরপাড়ায় বসে পুরুষ কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে শুনেছি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত রাজন মিশ্র ও পণ্ডিত সাজন মিশ্রের গান। পণ্ডিত যশরাজের গানও লাইভ শুনেছি। তবে সমসাময়িক গাইয়েদের মধ্যে আমাকে বিহ্বল করতে পেরেছিলেন কেবল উস্তাদ রশিদ খান।
রশিদ খানের গান প্রথম সামনে থেকে শোনার সৌভাগ্য হয় বছর চৌদ্দ আগে। পুরনো নজরুল মঞ্চে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে 'মেঘ মল্লার' দিয়ে শুরু করে 'দেশ' গেয়ে শেষ করেছিলেন। আমাকে মুগ্ধ করেছিল ওঁর গলার আবেশ। সুর এবং স্বর যেন গভীর সংরাগে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। আর তেমন উদাত্ত কন্ঠস্বর! তারপর বহু ডোভার লেন, কলামন্দির পার হয়েছে। বহু অনুষ্ঠানের মন্তাজ স্মৃতিতে রয়েছে। কত অনুষ্ঠানের সাল-তারিখও মনে নেই। কিন্তু গানগুলি মনে আছে।
মনে পড়ছে ২০১৮ সালের ডোভার লেন। শুরুতেই 'গোরখ কল্যাণ' ধরলেন বিলম্বিত লয়ে। সেই রেশ কাটার মধ্যেই শ্রোতাদের অনুরোধে তাঁর বিখ্যাত গান ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গাইলেন। মনে পড়ছে, ২০২১ সালে অতিমারি'র পরবর্তী ডোভার লেনের রাত। শেষ রাতে এলেন তিনি। রাগ 'যোগ' দিয়ে শুরু করলেন। অনুপম কায়দায় দুটি গান্ধার নিয়েই ওস্তাদী করলেন রশিদজী। এই রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই অন্য একটি রাগ (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) ছুঁয়ে তিনি শুরু করলেন সোহিনী। মনে হচ্ছিল, ভোরের শান্ত চরাচরে উস্তাদজীর কন্ঠ জন্ম দিচ্ছে এক নারীমূর্তির। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন সেই অবয়বে। তারপর সেই চিন্ময়ীর মধ্যে যৌবনের উন্মেষ ঘটাচ্ছেন তিনি। সূক্ষ্ম মীড়ের কাজগুলি যেন সেই নারীর অভিমান, মুড়কির কাজগুলি সেই নারীর কামনা। রশিদজী তান করছেন, আমরা শুনছি সেই নারীর শীৎকার। যতদূর মনে পড়ে, একবার শেষ রাতে উস্তাদ রশিদ খান একটি ঠুমরী গাইলেন ‘আজ রাধা বৃজ চলে’। অনুষ্ঠান শেষে আমরা বহু শ্রোতা কেমন যেন অবশ হয়ে গিয়েছিলাম।
গলায় সুর এবং স্বর হয়তো আসে অনুশীলন ও তালিম থেকে। কিন্তু এই আবেগ আসে কোথা থেকে? গায়কের সরলতা? নাকি, বহু বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয় জন্ম দেয় সেই আবেগের? আর এই আবেগের জন্যই তিনি নন্দিত এবং প্রশংসিত। খেয়াল করলে দেখা যায়, উস্তাদ রশিদ খানের অগ্রজরা বরাবর ওঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিশোর বয়সে তাঁর প্রথম দিকের অনুষ্ঠানে শ্রোতা ও সহশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদূষী গিরীজা দেবী, বিদূষী দীপালী নাগ। জহুরিদের চোখ চিনে নিয়েছিল সেই বিস্ময় বালককে। খবরে পড়লাম, উস্তাদ আমজাদ আলি খান ওঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘উনকা স্বর মে খোদা কা তাসির হ্যায়।’ হয়তো সে কারণেই পরমেশ্বর তাঁর জন্য কোল পেতে দিলেন। আমাদের জীবন আরও রিক্ত হল।
আপাতত মাঝবয়সে পৌঁছে আর কান্না পায় না। ‘তাহাদের কথা’ ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী যেমন নির্বিকার হয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উত্তর দেন সশব্দ বাতকর্মে, আমরাও তাই হয়ে গিয়েছি। নিজের মতো বেঁচে থাকার রসদ বলতে বই, গান আর সিনেমা। শীতকালে বিহান বেলার আলো এসে পড়ত রশিদজীর বোলতানে। কখনও বা কালবৈশাখীর মতো সপাট তান উড়িয়ে নিয়ে যেত আমাদের। বিকেলে যখন খবর পেলাম হোয়াট্সঅ্যাপে, সূর্য তখন পশ্চিম পাড়ায়। এমন সময়েই তো কলামন্দির বা সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে স্টেজে উঠবেন রশিদ খান। ইমন বা শুদ্ধ সারং দিয়ে শুরু করবেন। তারপর একটা কিরওয়ানি বা মূলতানী গাইবেন। শেষ পাতে থাকবে খানদানি দরবার-ই-কানাড়া।
হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের জগতে পুরুষ কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে শেষ ‘মোহিকান’দের একজন ছিলেন উস্তাদ রশিদ খান। ছাপ্পান্ন কি যাওয়ার বয়স হল? পরমেশ্বর, তোমার কাছে তো উস্তাদ আমির খান, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, পণ্ডিত কুমার গন্ধর্ব সহ সঙ্গীতের রথী-মহারথীরা আছেন, রশিদ খানকে আর কিছুদিন এই মরা সময়ে আমাদের বাঁচার জন্য রাখা যেত না?
ওনার যখন ২২ - ২৩ বছর বয়স তখন উনি ওনার দাদুর পিছনে বসে তানপুরায় তাল দিতেন মাঝে মাঝে দাদু গাইতে বললে একটু গাইতেন, সেই রকম সময়ে উনি সুরদাস সঙ্গীত সম্মেলনের পক্ষ থেকে একটা আর্থিক সম্মান পান। সেই টাকাটা ওনার প্রথম উপার্জিত টাকা, সেই কথাটা মনে রেখেছিলেন চিরকাল। তখন ওনাকে কেউ চিনত না।
ReplyDeleteতবে একটা কথা সবিনয়ে জানাতে চাই যে “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে” ঠুংরিটি কোনোমতেই তাঁর (অর্থাৎ রশিদ খানের) নয়। এটিকে originally গেয়ে অমর করে গেছেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান বহুদিন আগে। সেইজন্য ওটির আসল মালিক বলা যায় বড়ে গোলাম আলিকেই। যদি না শুনে থাকেন তাহলে শুনে নেবেন প্লীজ।ওনার পুরো একটা LP রেকর্ডই আছে শুধুমাত্র অসাধারণ সব ঠুংরির, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় “কা করু সজনী আয়ে না বালম” ও “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে”। ইউটিউবেও আছে। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে অনেক পরে এটি রশিদ খানও খুবই ভালো গেয়েছেন ও জনপ্রিয় হয়েছে।
ReplyDeleteহুম ঐ গানটি উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের। বিখ্যাত ঠুমরী। ঐ বাক্যটির কনস্ট্রাকশান ভুল হয়েছে আমার তরফেই। তাই মানেও বদলে গেছে। ঠিক করে নিচ্ছি। ধন্যবাদ বন্ধু - অম্লান (পোস্টের কনট্রিবিউটর)
Deleteঅসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে এই উদারতার জন্য।🙏
Deleteসুন্দর।
ReplyDelete2021 এর ডোভার লেন অতিমারীর কারণে দুপুর বেলা হয়েছিল।শেষ দিনের শেষ শিল্পী ছিলেন সপুত্র রশিদ খান।
ReplyDelete