এক ভিন্নমুখি জগতের অধিবাসী
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
(২০ জুন ১৯২৩ - ১৫ ডিসেম্বর ২০০০)
নিজের বিয়েতে আমন্ত্রিতদের দু' টাকার কুপন কেটে খাবার খেতে হয়েছিল। শোনা যায়, ওঁর এই বিচিত্র সিদ্ধান্তের সহযোগী ছিলেন ওঁর বন্ধুরা। ১৯৫৬ সালে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে কলেজ স্ট্রিটে রেজিস্ট্রি সেরে বন্ধু কবি অরুণ সরকারের বাড়িতে ফুলশয্যা। সেটা বড় কথা নয়। কথা হল, দু' টাকার কুপন কেটে নিমন্ত্রণ রক্ষা! মনে রাখতে হবে, ওঁর বিয়ের সময় দু' টাকা কিন্তু কম নয়। তবে এই ব্যবস্থাপনায় ওঁর এক কাকা বেজায় ক্ষেপে গিয়েছিলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে গৌরকিশোর তড়িঘড়ি নিজে একটা কুপন কিনে কাকার হাতে গুঁজে দেন।
এই কাহিনি দিয়ে শুরু করার একটাই কারণ। আমার মনে হয়, গৌরকিশোর ঘোষ ছিলেন আজন্ম অ্যাডভেঞ্চারিস্ট। নইলে ওইভাবে আচমকা পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পর্বত অভিযানে, গাড়োয়ালের ২১,০০০ ফুট উচ্চতার নন্দাঘুন্টির উদ্দেশে অন্যান্য অভিযাত্রীদের সঙ্গী হতে পারেন ৩৭ বছরের গৌরকিশোর! একবার ভেবে দেখুন মানুষটার ওই নাদুস-নুদুস চেহারাটা! ওটা কি পাহাড়ে পাহাড়ে চড়ে বেড়াবার চেহারা। তবু যাবেন। যাবেন ডরপুক নন বলে। শুনেছি, পাহাড়ে চড়ার বিশেষ জুতো পরা রপ্ত করতে তিনি নাকি ক্লাইম্বিং বুট পরে কলকাতার রাস্তায় হাঁটা অভ্যাস করতেন। অভিযানের সময় নিজের ভারী রুকস্যাক নিজে বয়ে শেরপাদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, এই অভিযানপ্রিয় মনটা নন্দাঘুন্টির দিনলিপি এবং সেই শৃঙ্গ জয় লিখে পেটরোগা ঘরকুনো বাঙালির চিত্তে পাহাড়কে জয় করবার ক্ষুধা জাগিয়ে দিয়েছিলেন। আর গৌরকিশোর যেন তাঁর বন্ধু কবি অরুণ সরকারের 'যাও উত্তরের হাওয়া' কবিতার সেই পঙক্তি বাস্তবে রূপ দিলেন- 'প্রবল আক্ষেপে যার পঙ্গুও পাহাড়ি পথে চলে।'
এই অভিযানপ্রিয়তা থেকেই তিনি অক্লেশে রাষ্ট্রের রাঙানো চোখ উপেক্ষা করে জেলে যান। দাঙ্গা বিধ্বস্ত অলিগলি রাজপথে হেঁটে যান ভ্রাতৃত্ববোধে; প্রসন্ন হৃদয়ের অধিবাসী হয়ে। মহামানবের ওঙ্কারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী থাকতে গৌরকিশোর ছুটে যান চুয়াডাঙায়।
সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ কত বড় এলেমদার ছিলেন, সাহিত্যিক গৌরকিশোর কতখানি মৌলিক ছিলেন- এসব বিচারের জন্য অনেক জজ সাহেব আছেন, আমার সেখানে কলকে জুটবে না। তথাপি গৌরকিশোর নিয়ে আমার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে। মানুষটাকে ঠিক আড়েদিঘে ফেলে মূল্যায়ন করা হয়নি। আসলে 'সুটারকিনের' অমোঘ টানে কখনই ততটা টলেননি। তোষামুদেদের ভিড়ে ছিলেন স্বরাট। ডান-বাম কোনও শিবিরের হলমার্ক জোটেনি। তবে আমি যখন গৌরকিশোরের কথা জানতে শুরু করেছি, সেই স্কুল বয়সে, তখন ওঁকে আমার সামাজিক বৃত্তের লোকেরা বলতেন সিআইএ'র চর। গৌরকিশোর সম্পর্কে বিশেষ করে সিপি়আইএমের শিবির থেকেই এই প্রচারটা ছিল। বলা হত, পাক্কা প্রতিক্রিয়াশীল। ওঁর সৃষ্ট শ্রমিক নেতা সাগিনা মাহাতোকে সরকারি কমিউনিস্টদের বেজায় অপছন্দ। সাগিনা ইনডিভিজুয়ালিস্ট। ট্রেড ইউনিয়নে সে পার্টি ম্যান্ডেট তোয়াক্কা করে না, স্বেচ্ছাচারী। তবে এসব প্রচারে সিলমোহর পড়েছিল, মার্কিন মুলুকের কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী একবার তাঁর বাসায় কনসার্ট করার পর। শোনা যায়, বিষয়টা এত দূর গড়ায় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তিনজন ছাত্র-প্রতিনিধি তাঁর চুনিবাবুর বাজারের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, আঁখে দেখো হাল করতে। তাঁরা শুনেছিলেন, সিয়া'র এজেন্ট গৌরকিশোর ঘোষ অতি বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দামি আসবাব, আগাগোড়া কার্পেটে মোড়া বাতানুকুল ফ্ল্যাটে থাকেন। ঢুঁড়ে এসে তাঁদের ভুল ভাঙল। দেখলেন, বিবেকবান সাংবাদিকের দিনযাপন ছোট্ট ঘরে তক্তাপোষে।
এই আবহের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় জেলে গেলেন। বিশ্বজোড়া ঠান্ডাযুদ্ধের আবহে ইন্দিরা তখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু। তাই প্রথমে ভেবে নিয়েছিলাম, 'সিয়ার এজেন্টকে তো জেলে পুরবেই'। অর্থাৎ, জাস্টিফাই হয়েছিল সিপিএমের লাইন। শুধু তাই নয়, ততদিনে আমি জেনে গিয়েছি, এই লোকটাকে একবার নকশালরা কড়কে দিতে চেয়েছিল। উনি তখন বরানগরে থাকতেন। বরানগর বাজারের ঠিক উলটোদিকে একটা ব্যাঙ্কের ওপরতলায়। সেই সময় ১৯৭০ সালে 'রেড বুক'এর পর্বে নকশালদের কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। নকশালরা তখন শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন প্র্যাকটিস করছে। এখানে ওখানে লাশ হয়ে যাচ্ছে অনেকে। আদর্শের দোহাই দিয়ে এই ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি মেনে নিতে পারেনি গৌরকিশোরের সংবেদী মন ও কলম। তাঁর লেখনি তীক্ষ্ণ আক্রমণ করেছিল ওই হঠকারিতার বিরুদ্ধে। নকশালরা ডাক দিল, ‘গৌরকিশোর ঘোষের মুন্ডু চাই।’ শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন বরাহনগরের মতো ‘উপদ্রুত’ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। অকুতোভয় স্বভাব অ্যাডভেঞ্চারিস্ট গৌরকিশোর রাজি হননি। লেখাও থামাননি। বরং রাতবিরেতে কাজকর্ম সেরে একাই হেঁটে ঢুকতেন পাড়ার রাস্তায়। গৌরকিশোরের ছোট মেয়ে সোহিনী ঘোষের এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, ‘বাবাকে কীভাবে মারা যেতে পারে তাই নিয়ে তিনি নিজেই প্রেসিডেন্সি কলেজের লাগোয়া ভবানী দত্ত লেনে নকশাল কর্মীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বসেন।’ এমন আলোচনা যে শেষতক ভেস্তে যাবে এটাই স্বাভাবিক। গৌরকিশোরের বেশবাস, চেহারা, ভঙ্গি ও ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে মর্মভেদী দৃষ্টির মধ্যেই ছিল ছেলেভোলানো অভিঘাত। তাই এই মানুষটিই আবার নকশালদের বিরুদ্ধে পুলিশের নির্বিচার দমন নীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। ‘রূপদর্শী’র কলমে বারবার লিখেছিলেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ যেভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক। কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা চলতে পারে না।
এই গৌরকিশোরকে আমার আবিষ্কার ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার শেষ লগ্নে। তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরনো হয়নি। তিনি জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৭৬-এর অক্টোবরে। তার কয়েক মাস বাদেই জরুরি অবস্থা কিছুটা শিথিল হল, ইন্দিরা গান্ধী সাধারণ নির্বাচনের পথে হাঁটলেন। 'আমাকে বলতে দাও' শিরোনামে গৌরকিশোর ঘোষের একটা বই তখন আমাদের হাতে হাতে ঘুরছে। আমি ওঁকে তখনই প্রথম চাক্ষুষ দেখি। এর আগে স্বদেশি করা, জেলখাটা, আন্দামান ফেরত জ্যাঠা, দাদুকে দেখেছি। কিন্তু লেখার জন্য, মতপ্রকাশের জন্য জেল খেটেছেন, এমন মানুষ সেই আমার প্রথম দেখা। তখন জেনে গিয়েছি কী লেখার কারণে জেলে গিয়েছিলেন।
বিশিষ্ট লেখক এবং ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে এক ইস্তাহারে স্বাক্ষর দেওয়ার আর্জি নিয়ে গৌরকিশোর ঘোষের কাছে গিয়েছিলেন। গৌরকিশোর সইয়ের পরিবর্তে নিজের লেখা প্রবন্ধ ‘কলকাতা’ পত্রিকাকে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। 'কলকাতা' পত্রিকার বর্ষা সংখ্যায় বেরয় সেই দুটি ঐতিহাসিক লেখা, ‘ইন্দিরা, দেশ, গণতন্ত্র’ এবং ‘পিতার পত্র’। এরপরই মিসা আইনে গ্রেফতার হন গৌরকিশোর। 'কলকাতা' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম লেখাটিতে গৌরকিশোর লেখেন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাওয়ায় তিনি ‘ভয় পেলেন। এবং শেষ পর্যন্ত স্থৈর্য হারিয়ে ফেললেন। ফলে, তিনি দলের উপর নির্ভর না করে চাটুকারদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। এই অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।’ আর দ্বিতীয়টিতে তাঁর স্কুল পড়ুয়া পুত্র ভাস্কর ঘোষকে লিখেছিলেন, ‘তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, বাবা তুমি মাথা মুড়িয়েছ কেন? আমি তোমাকে বলেছিলাম, সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে আমার স্বাধীনভাবে লেখার অধিকার কেড়ে নিয়েছেন।… আমি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবার জন্যই মাথা মুড়িয়ে ফেলেছি।’ চিঠির শেষে তিনি লিখছেন, ‘গণতান্ত্রিক বাতাবরণে তোমরা বড় হয়ে ওঠো, এই কামনা।’
এই চর্চার পর্বেই গৌরকিশোর সম্পর্কে আমার ভাবনায় বদল এল। বুঝলাম, যখন বাংলার বড় বড় আন্দোলনবাজরা ঘরে ঢুকে পড়েছেন তখন গৌরকিশোর ব্যক্তিগতভাবে কলমবাজি করে জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করতে জেলে যান। এ লোক তো তৈরি ছাঁদের নন। তারপরেই জানলাম, জেলের ভেতরেও তিনি চুপসে থাকার জিনিস নন।
মনোবল ধাত্রী করে গণতান্ত্রিক চেতনায় তাঁর এই কারাবাস পর্বে অনেক লিখেছেন। যার অন্যতম দু’টির একটি ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি (ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে গুটিকয়েক কথা)’, অন্যটি ‘দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা’। ‘মিসা’ বন্দি হিসেবে কারাগারে তাঁর ওপর নজরদারি যথেষ্ট ছিল, তা সত্ত্বেও গৌরকিশোরের ওই দুটি সরকার-বিরোধী লেখা বাইরে আসে এবং ‘জরুরি অবস্থা’ চলাকালীন নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়েও পড়ে।
যত জানছি ততই মনে হচ্ছে, লোকটাকে তো কাল্টিভেট করতে হয়। আর সেটা করতে গিয়েই জানলাম, ১৯৩৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে গৌরীপ্রসাদ বসুর প্রভাবে গৌরকিশোর ঘোষ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখায় যোগ দেন। সেই সময়ে ইংরেজ সরকার সিপিআইকে নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময় গৌরকিশোর একটি ধর্মঘট সংগঠিত করেন আর এই আন্দোলনই তাঁকে শাসকের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্বাদ দিয়েছিল, শক্তি দিয়েছিল কর্তৃত্ববাদের মোকাবিলা করার। যখন মতবিরোধের কারণে মানবেন্দ্র রায়কে সিপিআই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, গৌরকিশোর তখন গৌরীপ্রসাদ বসুর সঙ্গে দলত্যাগ করেন এবং এম এন রায়ের র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দেন, যা পরবর্তীকালে 'র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ হিসেবে নামকরণ হয়। তবে দল বা সংগঠনের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ার বান্দা ছিলেন না গৌরকিশোর। তাই কিছুদিন পর প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে যান। তবে রয়িস্টদের সঙ্গে তাঁর আজীবন সম্পর্ক ছিল।
এই গৌরসন্ধানের সময়ই তাঁর 'প্রেম নেই' পড়তে গিয়ে গ্রন্থে তাঁর যে পরিচয় মুদ্রিত হয়েছিল তাতে তাজ্জব বনে যাই। সেখানে ১৯৪১-৫২ সাল পর্যন্ত তাঁর পেশার উল্লেখ ছিল: ‘প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ফিটার, ও-আর-পি রেস্কিউ সার্ভিসের খালাসি, রেস্তোরাঁর বয়, কাঠের কনট্রাক্টর, রোড সরকার, বিমান জাহাজের ফিটার, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, রেশন দোকানের কেরানি, ইস্কুল মাস্টার, ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট, ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার, সর্বোপরি মোসাহেব।’ এবার যেন গৌরকিশোরকে বোঝাটা সহজ হয়ে গেল। একটা মানুষ তাঁর অন্তরলোকে কতটা স্বাধীন হলে এমন বিচিত্র সব পেশায় নিজেকে বাজিয়ে দেখতে পারেন! বোঝা গেল, বিভিন্ন পেশায় থাকার ফলে খুব কাছ থেকে নানা রঙের নানা বর্ণের মানুষকে দেখেছেন, তাঁদের ভালবাসা পেয়েছেন, ভালবাসা দিয়েছেন।
এ-কারণেই লোকটা আশিরনখ মানবতাবাদী। মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালি ছুটে যাওয়ার মতো ১৯৮৯ সালে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত ভাগলপুরে ছুটে গিয়েছেন গৌরকিশোর। আবার ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হওয়ার পর শান্তি ফেরাতে কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে খালি পায়ে 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' হেঁটেছেন। এই গৌরকিশোর ঘোষ আর দুঁদে সাংবাদিক নন, অ্যাক্টিভিস্ট-সাংবাদিক। আজ যখন আমাদের চারদিকে চকচকে গোদি মিডিয়ার বনসাই আস্ফালন তখন গৌরকিশোর যেন এক দানব, যে বাম আমলের ভরা মরশুমে জ্যোতি বসু সম্পর্কে কটাক্ষ করে লিখতে পারেন, 'শ্রী গদিবল্লভ পুরাগুছাইত'।
শেষ করব 'আজকাল' দিয়ে। আমাদের কলেজ জীবনে একটা আস্ত দৈনিক পত্রিকার জন্ম হল। তখন বাংলা সংবাদপত্র জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে 'আনন্দবাজার' ও 'যুগান্তর'। সেই সময় এল 'আজকাল'। কানাঘুষো শুনতাম, রিটায়ার্ড নকশালদের কাগজ। যাক পরে সে ভ্রম ভাঙল। প্রথম যেটা নজর কাড়ল, কাগজটাতে প্রথম দিন থেকেই, 'কাল কেমন যাবে' বা 'আজকের দিনটি' জাতীয় কোনও ভাগ্যবার্তা নেই। আমাদের মতো অদৃষ্টবাদ বিরোধীদের মহামজা। তারপর লক্ষ করলাম, খবরের বিন্যাস ও ভাষায় কোথায় যেন ভীষণ আলাদা। সেই খবর ছাপা হয় যা অন্য কাগজ গুরুত্ব দেয় না। অধিকার আন্দোলনের খবর দেওয়া, নারীবাদী আন্দোলনকে মর্যাদা দেওয়া, পাতায় জায়গা পায় পরিবেশ সচেতনতা। পাশাপাশি বাংলার মুসলিম সমাজের হাল হকিকত নিয়ে নিয়মিত কলাম। আর মহিলা সাংবাদিকদের বিনোদন বা লাইফস্টাইল ছাড়িয়ে তথাকথিত কঠিন বিটে পাঠানো। এমনকী, খবরের কাগজের অফিসে মেয়েদের নাইট শিফটে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা ছিল গৌরকিশোরের। ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম কোনও কিছু নিয়ে তাঁর যেমন কোনওরকম গোঁড়ামি ছিল না, তেমনই ছিল না মহিলা সাংবাদিক সম্পর্কে বস্তাপচা ধারণা। সংস্কাররহিত, উদারপন্থী, ভিন্নমুখি জগতের অধিবাসী এই মানবতাবাদী গৌরকিশোরের বেদমন্ত্র ছিল, 'I believe in love, for love and only love makes a man human.'।
Bhisan bhalo Gour charon
ReplyDeleteসমৃদ্ধ হলাম। কোন কিছুর কাছে বাঁধা না পরা, নির্ভীক সাংবাদিক, লেখকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
ReplyDelete