Sunday 4 June 2023

যাত্রী সুরক্ষাকে কাঁচকলা

রেল দুর্ঘটনা চলছে চলবে 

শোভনলাল চক্রবর্তী 



সমাজ মাধ্যমে ছবিগুলো ঘুরছে। কেউ অভ্যাসবশত হাতবদল করে দিচ্ছেন, কেউ ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাথাটা ভালো করে দেখছেন- না তেমন কোনও পরিতাপ নেই। আমাদের সংবেদনশীলতা কি লোপ পেল? লাশের স্তূপ দেখেও সবাই কেমন যেন নির্বিকার। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শুনেছি, ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ভেঙে পড়ে চল্লিশজন ছাত্রের মৃত্যুর অভিঘাতে সারা বাংলাদেশ জুড়ে অরন্ধন পালিত হয়েছিল। আমাদের এখানে মৃত্যুর সংখ্যা তিনশো ছাড়িয়েছে, সবাই নির্বিকার, যেন কিছুই হয়নি। আসলে দিনের পর দিন ধরে নাগাড়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরে, জ্যান্ত গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলে, চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে, গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যে হিংস্রতার উগ্র রূপে আমাদের অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে, সেই বীভৎস ছবিগুলোর পাশে গত শুক্রবার বালাসোরে হয়ে যাওয়া ভারতের সর্ববৃহৎ রেল দুর্ঘটনার লাশের মিছিলের ছবি বড়ই ফিকে লাগছে কি দেশের মানুষের চোখে? জানি না, তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে।

অথচ এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? একটি লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মালগাড়ি, সেই লাইনে কী করে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল আর একটি ট্রেন? এই ন্যূনতম সুরক্ষাও কি নেই ভারতীয় রেলের? সিগন্যাল কি গিয়েছিল মালগাড়ির  চালক অথবা দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের চালকের কাছে? কে ভুল করলেন? লাইনম্যান না সিগন্যালম্যান? কেউ কোনও উত্তর জানেন না। 

রেলমন্ত্রী পূর্বতন রেল বোর্ডের নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন, তাঁর আমলে মোট ১৬৫টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, এই তথ্য দিচ্ছে স্বয়ং রেল মন্ত্রক। হ্যাঁ, এরপরেও তিনি মন্ত্রী। মন্ত্রীমশাই দুটি জিনিস করেছেন এখনও পর্যন্ত: এক) দুটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন এবং আমরা সবাই প্রায় জানি যে ওই কমিটির রিপোর্ট আসবে আমাদের স্মৃতি থেকে বালাসোর মুছে যাওয়ার পর; দুই) তিনি দুর্ঘটনাস্থলে পা দিয়েই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে প্রতি মৃতের নিকটজনকে দশ লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। তখনও লাশ বেরচ্ছে ট্রেনের বগি থেকে। দশ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো? 

কেন হল এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা? সবার মুখে এখন একটাই প্রশ্ন। রেলের দুর্ঘটনা রোধে কি কোনও ব্যবস্থাই নেই? এদিকে সরকার দাবি করে যে, আছে। কিন্তু কাজে কোথায় দেখতে পাচ্ছি আমরা সেই দাবির সারবত্তা? অথচ সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন খোদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। কেন্দ্রের দাবি ছিল, রেলে দুর্ঘটনা রোধে ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কাজ করবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী প্রযুক্তি ‘কবচ’। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পর এখন এই ‘কবচ’ই কাঠগড়ায়। আদৌ দুর্ঘটনা রুখতে সক্ষম তো রেলের এই আধুনিক প্রযুক্তি? উঠছে প্রশ্ন। যদিও দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনগুলিতে ‘কবচ’ ছিলই না। 

রেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, 'কবচ' হল মূলত একটি সংঘর্ষ বিরোধী প্রযুক্তি। দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এর মাধ্যমে এড়ানো যায়। একই লাইনের উপর দু’টি ট্রেনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকেই বুঝতে পারে ‘কবচ’। সেই অনুযায়ী সে আগেভাগে ট্রেনের চালককে সতর্ক করে দেয়। দু’টি ট্রেন একই লাইনে চলে এলে ইঞ্জিনে বসানো একটি যন্ত্রের মাধ্যমে অনবরত সিগন্যাল দিতে থাকে ‘কবচ’। যা চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, চালককে সতর্ক করার পরও তিনি পদক্ষেপ না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেলের গতিবেগ কমিয়ে দেয়। দুটি ট্রেনের ধাক্কা লাগার আগেই ব্রেক কষে থামিয়ে দেয়। 

২০১২ সালে ইউপিএ জমানা থেকেই ‘কবচ’-এর নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৪ সালে প্রথম এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। ‘কবচ’ প্রযুক্তিতে রয়েছে মাইক্রোপ্রসেসর, জিপিএস এবং রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ বহু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ‘কবচ’এর চূড়ান্ত ট্রায়াল হয়। খোদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব একটি ট্রেনের লোকোতে বসে তা পরীক্ষা করেছিলেন। সেই পরীক্ষার সময় দু’টি লোকো একই লাইনে পরস্পরের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু ধাক্কা লাগার আগেই একটি ইঞ্জিন অপরটির চেয়ে ৩৮০ মিটার দূরত্বে থেমে গিয়েছিল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তার ভিডিও টুইটারে পোস্ট করে রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব জানান, পরীক্ষা ১০০ শতাংশ সফল। 

তবে বালেশ্বরের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরও 'কবচ' নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনও কারণ নেই। কারণ, যে ট্রেনগুলিতে দুর্ঘটনা হয়েছে, তার কোনওটিতেই 'কবচ' প্রক্রিয়ার ব্যবহার শুরুই হয়নি! এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, এ হেন গুরুত্বপূর্ণ রুটের ট্রেনে এখনও কেন 'কবচ'এর ব্যবহার শুরু করা গেল না? দুর্ভাগ্যবশত, ভারতের মোট রেলপথের ৯৮ শতাংশ পথে এই রক্ষা'কবচ' নেই। এখন রেলের বড়বাবুরা গল্প শোনাচ্ছেন যে 'কবচ' নয়, তাঁরা আরও আধুনিক প্রযুক্তি TCAS (Train Collision Avoidance System) নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সমগ্র প্রকল্পের খরচ এক লাখ কোটি টাকা যার মধ্যে নাকি ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। কেউ কি জানেন কোথায় সেই টাকা, ঠিক কোন রেল লাইনে খরচ হয়েছে? 

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, রেলপথের সুরক্ষা না বাড়িয়ে কেন ভারতীয় রেল আরও দ্রুতগামী ট্রেন চালাবার কথা ভাবছে? এ তো জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনার সামিল। এর আগে আমাদের বুলেট ট্রেনের গল্প শোনানো হয়েছিল, কিন্তু সেই গল্পে চিঁড়ে না ভেজায় তড়িঘড়ি মাঠে নামানো হল বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। এখন পর্যন্ত প্রত্যেকটি বন্দে ভারতের উদ্বোধন করেছেন, না রেলমন্ত্রী নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বন্দে ভারতের মাধ্যমে ভারতীয় রেলের অসামান্য সাফল্য প্রমাণের তাগিদে আট বগির বন্দে ভারতও উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী, যে ট্রেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে সোজা ঢুকে গেছে রেলশেডে। বাকি বগি তৈরি হলে চলবে ষোল বগির সেই ট্রেন।

বন্দে ভারত যে বেগে চলে বলে দাবি করা হয়, করমন্ডল এক্সপ্রেস শুক্রবার দুর্ঘটনার সময় চলছিল তার কাছাকাছি বেগে। যে লাইনে লাইনম্যানের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাচ্ছে না, সেই লাইনে ট্রেন চালিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছে ভারতীয় রেল। শনিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, 

প্রথমত, আপতকালীন ভিত্তিতে উদ্ধারকার্য চলবে। জানিয়ে রাখা ভালো যে, উদ্ধারকার্য বেশির ভাগটাই করে চলেছেন সাধারণ মানুষ, আশেপাশের গ্রামের মানুষ। উদ্ধারকার্যে সরকারি লোকজন সংখ্যায় অপ্রতুল। 

দ্বিতীয়ত, দোষীরা কেউ ছাড়া পাবে না। এটা ভাবতেই শিহরণ হচ্ছে। ধর্ষক ব্রিজভূষণকে জেলে পুরতে যাদের হাত পা কাঁপছে, তাদের মুখে এমন বাণী! সত্যিই স্বর্গীয়! 

তৃতীয়ত, এই দুর্ঘটনা থেকে আমাদের ভবিষ্যতে শিক্ষা নিতে হবে। এখনও হবে হচ্ছে চলছে।

দেশের সর্ববৃহৎ রেল দুর্ঘটনার দায়িত্ব কি শেষ পর্যন্ত বর্তাবে ওই অলীক লাইনম্যানের উপর? যে পদ আছে, কিন্তু ব্যক্তি নেই। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির কাছে আমরা এই দুর্ঘটনার দায়িত্ব নেওয়ার মতো সাহস আশা করি না। বর্তমান রেলমন্ত্রীর সঙ্গে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রেল দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করার তুলনা টেনে শাস্ত্রীজীকে ছোট করব না। এই লেখার শিরোনামটি যেন আমাদের রেল মন্ত্রকের তরফে স্লোগান। 

শেষ কথা, অনেক বাঙালি মারা গেছেন এই দুর্ঘটনায়। আমাদের কি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে শোক পালনের যথেষ্ট কারণ আছে। অনুপ্রেরণা ছাড়া কি কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না?


No comments:

Post a Comment