বাক স্বাধীনতা বলে আর কিছু আছে?
শোভনলাল চক্রবর্তী
২০২১ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেন। বস্তুত, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে এই একই দাবি নিয়ে দিল্লি সীমানায় পথ অবরুদ্ধ করে ধর্না আন্দোলনে বসেছিলেন কৃষকরা। আন্দোলন শুরুর এক বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী তিনটি বিতর্কিত আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করে কৃষকদের আন্দোলন শেষ করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেয় মোদী সরকার।
এবার সেই আন্দোলন নিয়েই বিস্ফোরক দাবি করলেন প্রাক্তন টুইটার কর্তা জ্যাক ডরসি। ব্রেকিং পয়েন্ট’ নামে এক ইউটিউব চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে জ্যাককে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কোনও বিদেশি সরকার কি তাঁর উপর কোনও ভাবে চাপ সৃষ্টি করত?’ জবাবে, গত বছরই টুইটারের পরিচালন পর্ষদ থেকে ইস্তফা দেওয়া জ্যাক বলেন, 'উদাহরণ হিসাবে ভারতের কথা ধরুন। ভারত এমন একটি দেশ, যে দেশ থেকে অনেক অনুরোধ পেতাম কৃষক আন্দোলন নিয়ে, সরকারের সমালোচক সাংবাদিকদের নিয়ে... এবং এর পরিণতি হিসাবে আমাদের হুমকি দেওয়া হত, ‘আমরা ভারতে টুইটার বন্ধ করে দেব’, ‘আমরা তোমাদের কর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালাব’, ‘যদি নিয়ম না মানো, তাহলে আমরা বন্ধ করে দেব’... এটাই ভারত, একটি গণতান্ত্রিক দেশ!' এবং তিনি স্বৈরাচারের নিরিখে ভারতের সঙ্গে তুরস্ক ও নাইজিরিয়াকে একাসনে বসিয়ে কথাগুলি নির্দ্বিধায় বলেছেন।
ডরসির এই সাক্ষাৎকারের পর তোলপাড় পড়ে গিয়েছে দেশে। তাঁর দাবি, তিনি যখন টুইটারে ছিলেন তখন ভারত সরকারের উপর থেকে নিয়মিত চাপ আসত। কৃষক আন্দোলনের সময় যে সমস্ত হ্যান্ডল থেকে ওই আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হচ্ছিল, সেই অ্যাকাউন্টগুলি বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হত। এ ছাড়া সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদেরও অ্যাকাউন্ট বন্ধের জন্য চাপ আসত। যদিও ডরসির কোনও অভিযোগকেই মান্যতা দেয়নি ভারত সরকার। কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর ডরসির অভিযোগের জবাব দিতে বেছে নিয়েছেন সেই টুইটারকেই! ডরসির মন্তব্যকে ‘আদ্যন্ত মিথ্যা’ বলে অভিহিত করে লম্বা টুইট করেছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন কেন্দ্রীয় সরকার টুইটারকে প্রায় ১২০০ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে বলেছিল। কেন্দ্রের দাবি ছিল, ওই হ্যান্ডলগুলির সঙ্গে খালিস্তান আন্দোলনের সম্পর্ক রয়েছে। তারও আগে কেন্দ্র টুইটারকে ২৫০-এর বেশি অ্যাকাউন্ট নামিয়ে দিতে বলেছিল। ডরসির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংযুক্ত কৃষক মোর্চার অন্যতম নেতা রাকেশ টিকায়েত সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, 'আমরা তো বারবারই বলেছি যে আমাদের স্বর বন্ধ করতে সব চেষ্টা সরকার করেছে। টুইটারের ওপর চাপ থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সংস্থার প্রাক্তন প্রধানের অভিযোগ শুনে আশ্চর্য হচ্ছি না।' আন্তর্জাতিক অধিকার মঞ্চগুলির অভিযোগ, করোনা-কালে এবং কৃষক আন্দোলনের সময় সরকারের বিরুদ্ধে করা একাধিক টুইট ব্লক করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল গেরুয়া সরকার। টুইটারের অফিসে রেড করা হয়েছে। জ্যাকের সাক্ষাৎকারেও সেই কথাগুলিই উঠে এসেছে বারবার।
ভারতে টুইটারের বিরাট বাজার আছে। টুইটারের জন্য ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বাজার- জাপান, রাশিয়া এবং তুরস্কের পরেই। ভারতে থাকতে গেলে বনিবনা করে থাকতে হবে, এটাই মোদ্দা কথা। বর্তমান টুইটার পরিচলন পর্ষদে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা যেমনটি করছেন। আসলে গোয়াল একটাই- যার নাম গোদি মিডিয়া। মোদিকে সামনে রেখে এদের পথ চলা। মোদি যা বলেন তার দশ গুণ এরা বলে। যেমন, কৃষক আন্দোলন চলার সময়ে এরা অম্লান বদনে বলে দিল যে কৃষকরা সব ভুয়ো, আসলে এরা খালিস্তানি। সেই নিয়ে দিনের পর দিন টেলিভিশনে প্রচার চলল। যাবতীয় দমন-পীড়নের সামনে অকুতোভয় কৃষকরা যখন ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তখন নকল ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পিছু হটলেন। টেলিভিশন চ্যানেলের তখন অন্যতম কাজ ছিল, কৃষকদের কথা শুনে বিল প্রত্যাহার করে মোদি কী প্রচণ্ড মহানুভবতার পরিচয় দিলেন, তার প্রচার করা।
শুধু কি টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যমের অনেকটাই এখনও এই মোদি ভক্তদের হাতে। এই ব্লগেই একটি লেখায় লিখেছিলাম সেই সময়ে যে কীভাবে পুলিশ প্রশাসন রাস্তা খুঁড়ে, সিমেন্টের পাকা ব্যারিকেড বসিয়ে, রাস্তায় পেরেক পুঁতে কৃষকদের দিল্লি অভিযান বানচাল করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। মার্কণ্ডেয় নামে এক অন্ধ ভক্ত বিরাট এক মন্তব্য করেছিলেন সেই লেখার কমেন্ট বক্সে। বক্তব্য ছিল, পুলিশ সন্ত্রাসবাদীদের আটকাতে ঠিক পদক্ষেপই নিচ্ছে। এরাই টুইটারেও আছে, এদের নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা তাদের নিয়ে যারা জাল ছবি, জাল প্রচার, জাল বক্তব্যের বিপক্ষে বলছেন। কুস্তিগীরদের নিয়ে গোদি মিডিয়া কি প্রচার চালালো? এরা নাকি কংগ্রেসের দালাল। শুনলাম, ডরসিকেও কংগ্রেসের দালাল বলেছেন বিজেপির এক প্রগলভ মুখপাত্র! এরা নাকি টুলকিট প্রতিবাদী। এরা নাকি কৃষকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন ইত্যাদি। কিন্তু কোনওটাতেই কাজ হল না। শেষমেশ সরকার বাধ্য হলেন কুস্তিগীরদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে।
কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া বালেশ্বর'এর রেল দুর্ঘটনায় এই টুইটারেই মন্দিরকে মসজিদ বানিয়ে চলল নির্লজ্জ মিথ্যাচার। বর্তমান টুইটার কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ওই ভুয়ো ছবিটি তুলে দেওয়া। তাঁরা সেটি করলেন না। শেষে ওড়িশা পুলিশ টুইট করে গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে জানায়। সেই সময় গোটা ভারতের গোদি মিডিয়ার টেলিভিশন জুড়ে চলছিল হিন্দু-মুসলমান বাইনারির আলোচনা। কেউ হিন্দুত্ববাদীদের বিপদে ফেলতে চাইছে, তাই চক্রান্ত করে এই দুর্ঘটনা- এই ছিল মোটের উপর মতামত। যে কোনও মাধ্যমের উপর হিন্দুত্ববাদীদের চাপ আছে এই সন্দেহ আমাদের ছিল, এখন ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার। ডরসির বক্তব্য আসলে আমাদের সন্দেহটাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করল। এই দেশের এখন এমন হাল যে একজন সাংবাদিক স্রেফ প্রশ্ন করতে চাইলে, মন্ত্রী তার মালিককে ফোন করে তার চাকরি খেয়ে নিচ্ছেন। মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে একটি প্রশ্ন করতে চাওয়ার অপরাধে চাকরি গেছে 'দৈনিক ভাস্কর'এর সাংবাদিকের। স্মৃতির সন্দেহ ছিল যে সাংবাদিক হয়তো কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে বসবে।
যত ২০২৪'এর ভোট এগিয়ে আসছে ততই কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের নার্ভাস মনে হচ্ছে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই 'এই গেল গেল সব ভেসে গেল' করে মন্ত্রী, সান্ত্রী, চাটুকার মিডিয়া সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ডরসি ইস্যুতে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী যে বিশাল টুইট করেছেন, তা পড়লেই ঘাবড়ানোর মাত্রাটা বোঝা যায়। এবার কি তবে উপরতলার নেতৃত্ব মণিপুরে ঘোল খেয়ে বুঝেছেন যে দাঙ্গা বড় বিপজ্জনক ব্যাপার! তাই দল কি আগ্রাসন ছেড়ে আবার সেই পুরনো 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়', অর্থাৎ সর্বত্র কেবল চক্রান্তের গন্ধ শুঁকে বেড়ানোর তত্ত্বে ফেরত যাবে? নাকি দল দিশেহারা। বুক ফুলিয়ে মাঠে নেমে কাশ্মীর এবং মণিপুরে সব প্ল্যান কেঁচে গণ্ডুষ হয়ে যাওয়াতে হিন্দুত্ববাদীরা ঠিক কোন পথে গেলে জনগণেশের কৃপাদৃষ্টি পাওয়া যাবে তার হদিস পেতে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ। লালমোহনবাবু বেঁচে থাকলে এমন পরিস্থিতি বোঝাতে নিশ্চয় বলতেন, হাইলি সাসপিশাস।
No comments:
Post a Comment