বাংলায় সন্ত্রাসমুক্ত ভোটপর্ব চাই
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘন্ট প্রকাশিত। অনেক মানুষের মনে হয়েছিল, বুঝি শাসক দল তথা মুখ্যমন্ত্রী পঞ্চায়েত নির্বাচন চান না।
কেন এমন মনে হয়েছিল? বহুবিধ কারণে।
যেমন, মুখ্যমন্ত্রীর দল সমস্যায়। কেমন সমস্যা সে তো সকলে জানেন বা দেখছেন। আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে রাজ্যে। একদিকে নিয়োগ-দুর্নীতি, অন্যদিকে ডিএ নিয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন। অনুমান, যদি শিক্ষক আর সরকারি কর্মচারী বিপক্ষে যায় তো দল বিপদে পড়ে। তার ওপর একে একে ছোট-বড় নেতাদের সিবিআই-ইডি'র হাতে গ্রেফতারি।
এমন সময়ে দলে নেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে তিনি কারান্তরালে। সংগঠন ও দলের পরম বিশ্বস্ত এক সৈনিক ছিলেন তিনি। কেউ কেউ কটাক্ষ করছেন, দলের জন্য কী না করেছেন, সে কিনা অর্পিতা নামে কে এক মেয়ের পাল্লায় পড়ে টাকা তোলায় ব্যস্ত হল! দলেরও টাকার প্রয়োজন আছে। তা বলে এত টাকা! বুঝলাম, এই রাজ্যে শিল্প নেই, তা বলে শিল্পপতিও নেই নাকি। আছেন তো আমলা, পুলিশরা। তার পরও!
ওদিকে পাশে নেই কেষ্ট মণ্ডলও। সে তো প্রায় একার বাহুবলেই বীরভূমের মাটি থেকে সব সরকার-বিরোধী দলকে কার্যত দূর করে দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কয়লা-গরু আর বালি পাচারের। সেও তিহারে, কারান্তরালে। অর্থলোভ।
অর্থলোভ- এমন দোষ নেই কার? শুভেন্দুর নেই নাকি? তবে সে যে বিজেপি দলে নাম লিখিয়েছে। তাদের হাতেই তো ইডি, সিবিআই, আইটি দফতর। তারা দিনে রাতে কেবল ভয় দেখায়! ডাবল এঞ্জিন! অথচ, দুর্নীতি হয় না কোন রাজ্যে? পূর্বতন কর্নাটক সরকারের মন্ত্রীরা যে কোনও কাজে কমিশনই নিতেন ৪০ শতাংশ। এক ঠিকাদার এই কমিশন জোগাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। তা নিয়ে গোটা রাজ্য তোলপাড় হয়েছিল। আর যদি বলেন সুশাসন নেই এই রাজ্যে, তবে প্লিজ একবার যান মণিপুরে বা যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে; অথবা গুজরাতেও যেতে পারেন দেখতে কোন নিয়মে ছাড়া পেল বিলকিস বানোকে ধর্ষণের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত সেই সব অপরাধীরা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অতএব, এ রাজ্যের অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলি ছাড় পেয়ে যাবে।
বিরোধী দলগুলির প্রচার তুঙ্গে- শাসক দল নাকি পঞ্চায়েত ভোট চায় না। কারণ, এই সব গোলমেলে কেসে জড়িয়ে গেছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন, বিরোধীরা সব আসনে প্রার্থী দিতে পারবেন তো? গোলমাল নতুন নাকি? নেহাত এমন শক্তিশালী মিডিয়া ছিল না। ছিল না এত নানাবিধ সামাজিক মাধ্যম। মধ্যবিত্তরাও দলের সাথে ছিল। থাকবেই তো, পুরনো সাথী তারা। তারা যে তখনও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কথা ভোলেনি।
এই যে কর্নাটকে নির্বাচন হল, মারামারি-খুনোখুনি তো হয়নি। বিজেপি ক্ষমতা হারাল, তা সত্ত্বেও। মারামারি-খুনোখুনি আর বিহারেও হয় না। বিহার কেন, ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও হয় না। শেখালে কে? সিপিএম! 'তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে'! তারপর যারাই ক্ষমতায় এসেছে, এই রাজনৈতিক হিংসাকে পাখি পড়ার মতো রপ্ত করেছে। তৃণমূলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এবারের নির্বাচন হবে সংঘাতহীন। তাই তো হবার কথা। গণতন্ত্রে হিংসার কোনও স্থান নেই, এই কথা সকলেই মানি, অন্তত অন্য রাজ্যে। এই রাজ্যে হিংসা ছাড়া নির্বাচন- ভাবতে পারি না। কারণ, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্মৃতি এখনও দগদগে ঘায়ের মতো মনে লেপ্টে আছে। অভিষেক বলেছেন, অভিযোগ জানাতে হবে তাঁকে বা তাঁর দলকে। নির্বাচন কমিশনকেই বা নয় কেন? কিন্তু, হিংসাহীন রাজনীতি শুধু শাসক দলকে মানলেই হবে না, সবাইকেই মানতে হবে। তবে শাসক দলের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ, তাদের হাতে প্রশাসন ও পুলিশ।অভিষেক নির্বাচনে হিংসা বর্জনের কথা বারবার বলছেন কেন? রাজনীতিতে নতুন বলে? নাকি, শাসকের শক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তাই খানিক আশঙ্কায় আছেন হয়তো। অথবা, স্মৃতিতে আছে ২০১৮ সালের পর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজ দলের বিধ্বংসী ফলাফল। হয়তো, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এবারের পঞ্চায়েত ভোটের কোনও নেতিবাচক আঁচ যাতে না পড়ে তার জন্য সতর্কতা। কিংবা, সত্যি সত্যিই তিনি হয়তো অন্যান্য রাজ্যগুলির মতো এ রাজ্যেও হিংসা বর্জিত নির্বাচনী সংস্কৃতির গোড়াপত্তন করতে চাইছেন। তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
এই লেখাটি প্রকাশের সময় অবধি মুর্শিদাবাদে একজন রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছেন ও কিছু কিছু অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সার্বিক ভাবে, বিরোধীরা মনোনয়নপত্র তুলছেন ও জমা করছেন। বরং, তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার হার শাসক দলের থেকে এখনও বেশি। গতবারের সেই তীব্রতর সন্ত্রাস এখনও দেখা যায়নি। তবে কাল কী হবে, অথবা ভোটের দিন, তা আমরা এখনও জানি না। মহামান্য আদালতও বিচার করে দেখছেন পরিস্থিতি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশাবাদী।
এই যে পরপর বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটল! মাঠেঘাটে মিলছে বস্তাবন্দী বোমা। আমরা জানি, সরকারের যিনি প্রধান তিনিই দল চালান, তিনিই পুলিশ দেখেন। তাতে কী? জেনে বুঝেই প্রশ্ন করব, পুলিশ কিছু করে না কেন? অবশ্য পুলিশ তো এখন নির্বাচন কমিশনের কথায় চলবে। আমাদের ভরসা মানুষ।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তা ১৫ জুলাইয়ের পরই জানা যাবে। কিন্তু এই নির্বাচনেও রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠছে, উঠবেও। বিজেপি এক প্রধান বিরোধী প্রতিপক্ষ। আমরা সকলে জানি, ওরা গণতন্ত্র, সংবিধান মানে না। আনতে চায় স্বৈরতন্ত্র। আমরা কেন ওদের পাতা ফাঁদে পা দেব? আমরা জোট বাঁধছি সারা দেশে ওদের হারাতে। তাই তো ভোট ভাগাভাগি রুখতে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই রাজ্যে প্রার্থী দিচ্ছে না আম আদমি পার্টি।
প্রশ্ন করতেই পারেন, তবে ভোটটা দেব কাকে? উত্তর আপনার কাছেই আছে। বিজেপি নয় এমন যে কোনও প্রার্থীকে বেছে নিন।
বিজেপি কখনোই বাংলায় আসবে না, স্যার। বাঙালী, দরকার হলে, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে কলাগাছ বসিয়ে দেবে। এখানে বেশকিছু জায়গায় হিন্দু-মুসলমান সমান সমান, এটা পশ্চিম ভারত নয়। আর রইলো পড়ে বাঙালী হিন্দু? তাদের খাদ্য তালিকা থেকেই তো তারা সম্পূর্ণ হিন্দু নয়, হাফ গেরস্ত'র মতো হাফ হিন্দু।
ReplyDelete