Sunday, 28 May 2023

কর্নাটক নির্বাচনের ইঙ্গিত

নির্বাচনী সংস্কার কি জরুরি?

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত



রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন যে বর্তমানে আদৌ নিরপেক্ষ নয়, তা সকলেই জানেন ও বোঝেন। তা কোনও কালে ছিল কী? মানুষ বোঝে, যখন যে ক্ষমতায় থাকে/ থাকবে সে চাইবে তেমন একটি কমিশন, যে উঠতে বসতে তার কথা মেনে চলবে। মোদী আমলে সরকারের এই কুঅভ্যাসটা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে এই যা, এবং তারা যেন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

তার মানে এই নয় যে অন্য প্রধানমন্ত্রীদের/ মুখ্যমন্ত্রীদের (রাজ্যে রাজ্যে) আমলে সরকারি প্রভাবমুক্ত ছিল নির্বাচন কমিশন। (এই মন্তব্য থেকে বাদ দিচ্ছি দুই ইলেকশন কমিশনার  ও তাদের সময়ের কমিশনকে- একজন সুকুমার সেন ( প্রথম চিফ ইলেকশন কমিশনার) অন্যজন টি এন শেষণ। প্রতিটি সচেতন নাগরিক অন্তত এই নাম দুটি 'জীবনে ভুলবেন না'।)

আজ পরিস্থিতি এমন হয়েছে, আমরা মানতে বাধ্য যে নির্বাচন (যে কোনও স্তর বা পর্যায়ে) কার্যত হয়ে উঠেছে এক প্রহসন। মানুষ যতই গণতন্ত্রকে কাছে টানতে চায়, দল ও তার পরিচালকরা তাকে ততই দূরে ঠেলে দেয়। যত দিন যাচ্ছে ততই সংক্রামক রোগের মতো সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে এই ব্যাধি। দলগুলি ও তার নেতারা আস্থা হারাচ্ছে গণতন্ত্রেই। অথচ, আমরা সাধারণ মানুষ চাই গণতন্ত্র। উপায় খুঁজতে বেরিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা সকলে চাইছেন নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। 

কেমন সংস্কার? অনেক প্রস্তাব আমাদের সামনে। কেউ চাইছেন ইভিএম সরুক, ফিরুক পূর্ব ব্যবস্থা, তাঁরা আস্থা হারিয়েছেন যন্ত্রে। এ কথা সত্য যে  চাইলে যন্ত্রে কারচুপি সম্ভব। তবে সেই পুরনো ব্যবস্থাও পারে না মূল সমস্যাগুলির সমাধান দিতে। অতএব, তাকাতেই হবে মূল সমস্যার দিকে। এ দেশে (বা বলা ভালো, যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশেরই) মূল সমস্যা (সংক্ষেপে): 

১। ভোটে টাকার খেলা

২। ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোট। 

টাকার খেলা

ভুলতে পারি না যে এই দেশটা গরিব। তবে বড়লোকের দেশেও টাকার খেলা যে নেই তা হলফ করে বলতে পারি না। টাকার খেলা না যদি থাকে তো তার জায়গা নেয় অন্য খেলা। অর্থাৎ, বলতে চাই, যদি লোভ থাকে মানুষের স্বভাবে তো কেমন করে একটা নির্বাচনের সময় তা থেকে মুক্ত হবে মানুষ। অর্থলোভ জয় যদি কেউ করেও তো তাকে লোভ দেখায় অন্য কিছু; যথা, চাকরি, নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যৎ, ভালো-মন্দ ইত্যাদি। 

ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোট

এও এমন এক অসুখ যা সব দেশেই আছে কম-বেশি।  আমাদের দেশেও চিরদিন তার প্রভাব দেখা গেছে বেশ কিছুটা। সম্প্রতি তার প্রভাব যেন বেশ বেড়েছে। 

এই সমস্যাগুলি থেকে বেরব কোন পথে! পথ তো অনেক। যেমন,

কেউ কেউ চাইছেন সরকারি অর্থে নির্বাচন। সরকার ইচ্ছে করলে কত কী উপায়ে অর্থ জোটাতে পারে তা দেখিয়েছেন মোদিজী। আবারও বলি, এরকম খেলা তিনি প্রথম খেলছেন এমন নয়। তবে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের বদলে তিনি হিসেব দিতে হয় না এমন এক ফান্ড চালু করেছেন যা অবশ্যই অভিনব (PM Care Fund)। বলতে ইচ্ছে করে, দুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না। দুর্বৃত্ত কে সে কথা নিশ্চয় সকলে বোঝেন। এই মানুষটিকে কেউ মহামানবও বলতে পারেন। তবে, এমন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হাতে কোনওভাবে কোনও খরচের সুযোগ থাকলেই বিপদ! সরকারি অর্থে নির্বাচন আরও অনেক জটিলতার জন্ম দিতে পারে, যেমন কেউ বলতেই পারেন আমার ট্যাক্সের টাকা...। টাকার ভাগ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যতদিন দেশে শিল্পপতিরা থাকবেন ততদিন খরচের অভিন্নতা কার্যত অসম্ভব। আরও পথ আছে।

যেমন, দলহীন গণতন্ত্র। সেই কবে এক মহামানব যেন আমাদের এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমরা শুনিনি, মানিনি। চেষ্টা অবশ্য করেছি যাতে অন্তত পঞ্চায়েত দলহীন হয়। আমরা তাও পারিনি। ফল কী সাংঘাতিক হতে পারে তার নমুনা দেখছি রোজ এই পশ্চিমবঙ্গে। তা বলে, দলহীন গণতন্ত্র মানা সহজ সে কথাও ভাবা যায় না। 

তাহলে পথ কি নেই? নিশ্চয় আছে। আমরা কেবল সম্ভাব্য পথ নিয়ে কথা বলতে পারি, অন্য কিছু নয়। সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রধান সমস্যা এই যে, সেখানে উঁকি  দেয় সংখ্যাতত্ত্বও। আর কে না জানে, সংখ্যাতত্ত্বে অনেক কেরামতি দেখানো সম্ভব।

কর্নাটক নির্বাচনের পর বহু দল ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে সাহস ও আশা বেড়েছে। মানুষ বুঝেছে মোদি অপরাজেয় নয়। অনেকের মনে হচ্ছে যেন, কেন্দ্রে তাদের দল বুঝি ক্ষমতায় এল বলে। এমনটাই মানুষ ভাবত ১৯৬৭-র আগে, ভাবত বুঝি কংগ্রেস গেল বলে। তা তেমন না ভাবলে বা তেমন না ভাবাতে পারলে আর পৃথক দল করা কেন? তেমন ভাবতেই হয়। এবং ভাবাতেই হয়। তাতে দোষ নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ তার সাধ্যের সীমা কী তা ভাববে না। 

সাধ্যের সীমা ভাবছে যারা তারাও এবার কর্নাটক নির্বাচনের ফল দেখে উৎসাহিত। এমন নয় যে কর্নাটক নির্বাচনের ফল অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত। তবে সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে তো এমন ফল নিয়ে আশা জাগে। তাই হয়েছে। উৎসাহ বেড়েছে বা জেগেছে কেবল কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে, তা নয়। সব বিরোধী দলের কর্মী ও সমর্থকই প্রবল উৎসাহিত। তবু  চিন্তা বা ভয় যায় না। অনেক নিশ্চিত দেখায় বিজেপিকে। কেন? কারণ, তারা এও জানে যে বিরোধী শক্তি একজোট হতে পারবে না। তাই ৩০ শতাংশ সমর্থন এলেও তারা ক্ষমতায় থাকবে, যেমন আগে ছিল। হিসেবটা ভুল বলা যায় না। এই সত্য বদলের জন্য বিরোধী দলগুলির ঐক্য জরুরি। তবে যতই জরুরি হোক তা হবার নয়। বলে না, সাত মণ তেলও পুড়লেও রাধাও নাচবে না। তবে উপায়? 

আমরা যারা গণতন্ত্র চাই যে কোনও মূল্যে, তারা বলব, নজর দিন নির্বাচনী সংস্কারে। কেমন সংস্কার হলে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন হতে পারে? ওপরে কিছু বলেছি এবং তার সমস্যাও বলেছি। তাই সেগুলি বাদ দিতেই হয়। আর রইল একমাত্র সমাধান। তা হল, সংখ্যা অনুপাতে ক্ষমতার ভাগ। এমন অঙ্ক চালু আছে কিছু দেশে। আমাদের দেশেও চালু হোক না, ক্ষতি কী? সমস্যা এতেও আছে, তবে তার সমাধান পাওয়া অসম্ভব নয়।


Thursday, 25 May 2023

মেধার নিপীড়ন

দক্ষিণপন্থার এত জনপ্রিয়তা কেন!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত এক দশকে প্রায় গোটা বিশ্ব জুড়েই চরমতম দক্ষিণপন্থার শুধুমাত্র উদয় হয়নি, দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ ও তাদের একমেবোদ্বিতীয়ম নেতাদেরও তুমুল জনপ্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। আর সে প্রবণতা যে অচিরেই পুরোপুরি বিদায় নেওয়ার নয়, তাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। ব্রাজিলে সদ্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী নেতা বোলসোনারো পরাজিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী লুলা’র ভোট প্রাপ্তির ফারাক ছিল ১ শতাংশেরও কম। গত বছর (অক্টোবর ২০২২) ইতালিতে ফ্যাসিস্টপন্থী দল ‘ব্রাদার্স অফ ইতালি’র নেত্রী জিওর্জিয়া মেলোনি প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে আসীন হয়েছেন। হাঙ্গেরি, সুইডেন, ফ্রান্স, তুরস্ক, রাশিয়া সহ বহু দেশ ও আমাদের উপমহাদেশেও দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয় রাজনীতির এখন রমরমা। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ‘বিদেশি’ শনাক্তকরণ, ধর্ম-বর্ণ-জাতি ভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতির সহজ গাণিতিক সমীকরণে এর উত্থান। কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে উগ্র দক্ষিণপন্থা ধাক্কা খেলেও তার বিপদ যে কেটে গেছে, অথবা, আগামী কোনও নির্বাচনে তারা যে আবার সাফল্য পাবে না, তা বলার অবকাশ এখনও তৈরি হয়নি।

প্রশ্ন হল, এই উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এমনতর আপাত বিপুল সাফল্যের কারণ কী? এ নিয়ে একটি পুস্তক-বোমা ফাটিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক দর্শনের অধ্যাপক মাইকেল জে স্যান্ডেল। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘The Tyranny of Merit’ নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। যদিও তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মূলত ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক জগৎ, কিন্তু যে কথাগুলি তিনি পেড়েছেন তার প্রাসঙ্গিকতা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেও সমভাবে প্রযোজ্য।

বলা যেতে পারে, তিনি ‘মেধাতন্ত্রের নিপীড়নের’ বিরুদ্ধে একপ্রকার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বিশেষ করে, গত শতকের ৮০-৯০’এর দশক থেকে বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির হাত ধরে যে মেধাতন্ত্রের উত্থান তা পিছিয়ে-পড়া, তথাকথিত অল্প-শিক্ষিত, দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষদের দক্ষিণপন্থার পিছনে সমবেত করেছে। কারণ, বিশ্বায়নের প্রবক্তারা মনে করেছিলেন, উদারনৈতিক অর্থনীতির ফলে যে কোনও ব্যক্তি, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেধার মাধ্যমে নিজ যোগ্যতায় সাফল্য অর্জন করে নিজেকে এবং দেশ ও দশ’কে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। শুনতে ও ভাবতে কথাখানি বেশ। কিন্তু তা যে এক নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, সে ভাবনা হয়তো তখনও মাথায় আসেনি। দেখা গেল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন এমন এক মহিমান্বিত স্তরে স্ফীত হয়ে উঠল যে, নামীদামী প্রতিষ্ঠানের একটি উচ্চ ডিগ্রি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি হল না, তা আত্মগর্ব, সামাজিক সম্মান ও অর্থ কৌলিন্যেরও এক কঠিন আবহ ও বিভাজন তৈরি করল; যে আবহে তথাকথিত অল্প-শিক্ষিত ও অসাফল্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা করা এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়াল। মাইকেল স্যান্ডেল তথ্য দিয়ে দেখাচ্ছেন, বিশ শতক জুড়ে আমেরিকায় মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তা ক্রমেই কমে গেছে। এর কারণ, আত্মহত্যা, মাদক দ্রব্যের অতিরিক্ত ব্যবহার ও মদ জনিত যকৃতের রোগ। এই প্রবণতাকে কোনও কোনও সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন ‘হতাশাপ্রসূত মৃত্যু’। অর্থাৎ, মেধাতন্ত্রের আগ্রাসনের ফলে এমন এক তীব্র বিভাজিত সমাজের জন্ম হয়েছে যেখানে অসফল বা ‘অল্প-শিক্ষিতরা’ বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মবিনাশ বা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।

মোদ্দা কথায়, প্রাতিষ্ঠানিক ‘শিক্ষা’ হয়ে দাঁড়াল এমন এক অত্যাবশ্যকীয় অর্জন যা সমাজে যে কোনও ব্যক্তির সাফল্য বা অসাফল্যকে প্রায় একক ভাবে সূত্রায়িত করার যন্ত্র হয়ে উঠল। ভাবখানা এই, নিজ মেধা গুণে অর্জিত শিক্ষার জোরে যে সাফল্য-চূড়োয় পৌঁছনো গেল, তার আত্মগর্বী অধিষ্ঠানে বাকী জনসমাজ (বিশেষত অসফলেরা) আসলে খুড়কুটো। এইভাবে নির্মিত হল এক নতুন বিভাজনের আখ্যান। ইংল্যান্ডে ব্রেক্সিটের ভোট ও আমেরিকায় ট্রাম্প’এর জয় ছিল এই বিভাজনের বিরুদ্ধে নিচুতলার বিপন্ন মানুষের সটান জবাব। সে সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ কতটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়তে পারেন, তা নিয়ে যখন অর্থনীতিবিদরা দেশবাসীকে সাবধান করছেন, তখন ব্রেক্সিটপন্থী এক নেতা বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশ বিশেষজ্ঞদের ভারে যথেষ্ট ক্লান্ত।’

লেখক বলছেন, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী দেখাচ্ছে, রাজনৈতিক সুবিচারের সক্ষমতার মধ্যে যে অন্তর্দৃষ্টি নিহিত থাকে তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। উদাহরণ দিচ্ছেন, আমেরিকার দুই প্রবাদপ্রতিম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিঙ্কনের কলেজ-ডিগ্রি পর্যন্ত ছিল না। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টিকে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মোড়কে আবদ্ধ রাখা যায় না। তাঁর মতে, বিশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলগুলি সংসদের গঠনকে বহুল পরিমাণে গণতান্ত্রিক করে তুলেছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক সাংসদের কোনও কলেজ-ডিগ্রি ছিল না। অথচ, ২০০০ সালে এসে দেখা গেল, সংসদগুলিতে কলেজ-ডিগ্রিহীন সাংসদ একেবারেই আর নেই। যেন, পুরনোকালের অভিজাত ও সামন্তপ্রভুদের দিন আবার ফিরে এল। ডিগ্রিধারীদের এক নতুন শ্রেণি এবার দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল। এই বার্তা ক্রমে গেল রটি, তোমার যথাযথ ডিগ্রি থাকলে তোমার আরও আরও অর্জন-ক্ষমতা আছে, নচেৎ তুমি ব্রাত্য।

তাহলে কি শংসাপত্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দড় বাড়িয়ে এক নতুন ধরনের বৈষম্যধারী সমাজ তৈরি করা হল? চিত্রটা দাঁড়াল, লেখকের ভাষায়, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার sorting যন্ত্রকে অবলম্বন করে যারা উপরে উঠে গেল, তারা নিজেদের ভঙ্গুর আত্ম-অহমিকাকে বজায় রাখতে ক্রমেই নানাবিধ শঙ্কা, ঠিকঠাক থাকার দুর্বিষহ কসরত ও মেধাকেন্দ্রিক অহংকারে নিমজ্জিত হল। যাদের পিছনে ফেলে তারা উঠল, তাদের ওপর চাপিয়ে দিল ভয়ঙ্কর অনৈতিক, এমনকি লজ্জাজনক ব্যর্থতার এক অসহনীয় বোঝা।’

খেয়াল করলে মালুম হবে, ৬০-৭০ দশকের শ্রমজীবী মানুষের উত্তাল বাম আন্দোলন ৮০-৯০’এর দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিন্তার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে ক্রমেই শক্তিক্ষয়ের পথে এগিয়েছে। বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির ধারণাও তখন পাকতে শুরু করেছে। ৯০-এর দশকে তা এক নির্দিষ্ট গতিপথে এগোতে থেকেছে। নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির বীজ তখন অঙ্কুরিত হচ্ছে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। তথ্য প্রযুক্তির জোয়ার এসেছে। এই নতুন উত্থানকে পুষ্ট করতে বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অসীম গুরুত্ব। উদার অর্থনীতির প্রবক্তারা এক নতুন মতাদর্শ নিয়ে আসছেন, যেখানে অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে কোনও মানুষ নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থ কৌলিন্য গড়ে নিতে পারে। সেই দৌড়ে যারা সফল হচ্ছে, তাদের হাতে এসে পড়ছে দুনিয়ার প্রাচুর্য ও অত্যাশ্চর্য বৈভব। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ধরনের এক তীব্র বৈষম্যমূলক সমাজ।

বাম আন্দোলনে যেহেতু তাত্ত্বিক চর্চা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসর, ফলে, বাম মতাদর্শও ঢুকে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মেধাতন্ত্রের জোয়ালে- বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে তা আলোচিত হচ্ছে, গবেষণাপত্র লেখা হচ্ছে, গবেষক, অধ্যাপকেরা সেই সব বিষয়ে অর্জন করছেন খ্যাতি, অর্থ ও পুরস্কার। বামেদের দৃষ্টি নিজভূম শ্রমজীবীদের জীবন-জীবিকা-আন্দোলন থেকে সরে যাচ্ছে পরবাসে মেধাতন্ত্রের সেমিনার কক্ষ ও গবেষণাপত্রে। শ্রমজীবী মানুষটি কী ভাবছেন, তার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে মেধাতান্ত্রিক গবেষণার ফলাফল। পিকেটি বলছেন, বাম দলগুলি ক্রমেই শ্রমজীবীদের দল থেকে বুদ্ধিজীবী ও পেশাদার এলিটদের দলে রূপান্তরিত হওয়ার কারণেই সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বাড়তে থাকা বৈষম্যকে তারা মোকাবিলা করতে পারেনি। বামেদের এই ক্রম-বিচ্ছিন্নতা ধীরে ধীরে এমন এক জমিন বুনেছে যেখানে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই যখন মোদি বলেন, ‘হার্ভার্ড নয়, হার্ড ওয়ার্ক চাই’, অথবা, ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘আমেরিকা হল আমেরিকাবাসীদের জন্য’- তাঁদের জনপ্রিয়তার কারণগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, মেধাতন্ত্রের সাফল্য-ক্ষমতা সরাসরি দাঁড়িয়ে পড়েছে আমজনতার বিপক্ষে। কারণ, মাইকেল স্যান্ডেল’এর মতে, যদিও মেধাতান্ত্রিক সমাজ পারিবারিক উত্তরাধিকারের অধিকারকে নাকচ করে, কিন্তু তা কখনই বৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়, বরং বৈষম্যকে বৈধতা দেয়; উপরন্তু, মেধাকে সর্বোচ্চ প্রাপ্য দেওয়ার উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে মেধাতন্ত্র বাকী ‘অমেধাবী’দের জঞ্জাল হিসেবে গণ্য করে। শুধু আর্থিক বৈষম্যই নয়, গত চার দশকে মেধাতন্ত্র মেধাবী ধনী ও সাধারণজীবীদের মধ্যে এতটাই দূরত্ব নির্মাণ করেছে যে তারা পরস্পরের ধারেকাছেও আর থাকে না- তাদের উভয়ের বাসস্থান, কাজের এলাকা, দোকানপাট, বিনোদন-স্থান সব আলাদা, এমনকি বাচ্চাদের স্কুলগুলি পর্যন্ত। অথচ, বাজারে যে কোনও কাজের আর্থিক উচ্চমূল্য কিন্তু সর্বজন হিতায়ে উদ্দিষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও মেধাতন্ত্র প্রচার করে- বাজার যাকে আর্থিক উচ্চমূল্য দিচ্ছে তার সামাজিক অবদানও অতএব অধিক। লেখকের মতে, তাহলে তো বলতে হয়, অল্প বেতনের স্কুল শিক্ষকদের থেকে অধিক মুনাফা অর্জনকারী ড্রাগ-ডিলাররা অনেক বেশি সামাজিক হিতে অবদান রাখেন।

আমাদের চারপাশে তাকালেও মেধাতন্ত্রের তুমুল দাপট। এদের কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, তাদের দেওয়া করের টাকায় কেন সাধারণজনকে ‘খয়রাতি’ দেওয়া হবে! যেন, সাধারণজনেরা কেউ কর দেন না। তাঁরা জানেন না, আমাদের দেশের মোট কর আদায়ের ৫০ শতাংশই হল অপ্রত্যক্ষ কর, যা প্রতিটি নাগরিকের পকেট থেকে আদায় হয়। পথের ধারে চপ-তেলেভাজার দোকান দিলে মালিকের সামাজিক সম্মান থাকে না, কিন্তু সম্মান হননকারী ব্যক্তিটি যখন ব্র্যান্ডেড চপ-সিঙ্গাড়ার দোকানে চাকরির অফার পান, হ্যাট-কোট পরে সটান কাজে লেগে যান। বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক এক সাধারণজনের ইউটিউব ভিডিও’র ভাষ্য হুবুহু টুকে উত্তর-সম্পাদকীয় লেখে, প্রতিবাদ-পত্র পাঠালেও রা’ কাড়ে না, বিদ্বজ্জনেরাও জেনেবুঝে চুপ মেরে যান। কারণ, মেধাতন্ত্র বরাবর দুর্বল সাধারণের ভাবনা-চিন্তাকে হরণ করে এমন কত যে চৌর্যবৃত্তি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আশার কথা, আমাদের দেশে বহু রাজ্যে ‘খয়রাতির রাজনীতি’ (অন্য অর্থে, জনকল্যাণমুখি রাজনীতি) জনপ্রিয়তা পেয়েছে, দুর্বলের ঘরে বেঁচে থাকার সংস্থান পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আগামী দিনে মেধাতন্ত্র দুর্বলের ওপর এমনতর জিঘাংসা নিয়ে কতদিন সবলে টিকে থাকবে, তা দেখার।   

মাইকেল জে স্যান্ডেল তাঁর গ্রন্থের শেষের দিকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে উদ্ধৃত করেছেন: ‘আমাদের সমাজকে যদি বেঁচেবর্তে থাকতে হয়, তাহলে জমাদারদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা জানাতে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এই জমাদাররা আমাদের জঞ্জালগুলি পরিষ্কার করে ডাক্তারদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তাঁরা যদি জঞ্জাল পরিষ্কার না করতেন তাহলে আমাদের রোগভোগ আরও বাড়ত। সমস্ত শ্রমই মর্যাদাপূর্ণ।’       

     

Friday, 19 May 2023

শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ?

মন্দার আবর্তে বাংলাদেশ!

রাজীব ভট্টাচার্য



রোনা পরবর্তীকালে এশিয়ার একের পর এক দেশ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের পরে এবার কি বাংলাদেশের পালা? কোভিড সংকট মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ঋণের বোঝা, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডারে টান, রফতানির দ্রুত হ্রাস ইত্যাদি সমস্যায় হঠাৎ বাংলাদেশ তীব্র সংকটে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার (আইএমএফ)'এর ফেব্রুয়ারি ২০২৩'এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১-২২'এ অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের তকমা পাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি ৭.১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালে ৫.২ শতাংশে পৌঁছনোর আশঙ্কা। সেই কারণেই বাংলাদেশ আজ ঋণের জন্য আইএমএফ'এর দ্বারস্থ। এই আর্জির কথা মাথায় রেখে আইএমএফ ২.৫ বিলিয়ন SDR অর্থাৎ ৩.৩ বিলিয়ন ডলার মঞ্জুর করেছে এবং এটি মূলত দুটি খাতে প্রদান করা হয়েছে- সম্প্রসারিত ঋণ সুবিধা (ECF) এবং সম্প্রসারিত তহবিল সুবিধা (EFF) খাতে।

মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের দ্রুতগতিতে হ্রাসকে সাধারণত বিশ্ব মন্দার প্রাথমিক সূচক (কোস ও টেরনস, ২০১৫) বলে ধরা হয়। এই জাতীয় উৎপাদনের দ্রুতগতিতে হ্রাসের সাথে যুক্ত হয় মন্থর গতিতে শিল্প বৃদ্ধি, বাণিজ্য শ্লথতা, আন্তর্জাতিক মূলধন চলাচলে নিম্নগতি ও সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে বেকারত্ব বৃদ্ধি। ১৯৭০ সালের পর থেকে বিশ্বে পাঁচটি মন্দা দেখা দেয়- ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১, ২০০৯ ও সর্বশেষ ২০২০। যদিও প্রতিটি মন্দার প্রকৃতি ও ধরনই একে অন্যের চেয়ে পৃথক, তবে তাদের মধ্যে মূলগত সাদৃশ্য আছে।

করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়েছে মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে। জ্বালানি, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ দ্রুত কমে আসায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জ্বালানির দাম উর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়েছে, ফলে মুদ্রাস্ফীতিও আকাশছোঁয়া। তাছাড়া বিশ্ব বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, জোগান বা সরবরাহে ছেদ এবং আন্তর্জাতিক চাহিদার ক্রমাবনতি বাংলাদেশের চলতি হিসাবখাতের ঘাটতিকে প্রশস্ত করেছে, টাকার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে এবং চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ফলে দারিদ্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া, বিশ্ব বাজারেও একটা অর্থনৈতিক মন্দা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ বাংলাদেশের লেনদেনের হিসাবখাতকে বেশ চাপে রেখেছে।

সাম্প্রতিককালে কিছু তথ্যকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মন্দার সূচক রূপে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, স্থূল জাতীয় উৎপাদনের গতির শ্লথতা (৭.২ শতাংশ থেকে ৫.২ শতাংশে অবনমন), রফতানি এক লাফে ২৩.২ শতাংশ (২০২২) থেকে হ্রাস পেয়ে (-)৭.২ শতাংশ (২০২৩) নেমে আসা, ভোক্তার মূল্য সূচক (CPI) ৬ শতাংশ (২০২২) থেকে বেড়ে ৮.৯ শতাংশে (২০২৩) পৌঁছে যাওয়া। সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি আনুমানিক ৯.৫ শতাংশ (বছর থেকে বছর)- যা এই দশকে সর্বোচ্চ। চলতি খাতে ঘাটতি স্থূল জাতীয় উৎপাদনের ১.১ শতাংশ (২০২১) থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.১ শতাংশে (২০২৩)। মুদ্রা তহবিলের সঞ্চয় মার্কিন ডলারে ৪০.৭ বিলিয়ন (২০২১) থেকে কমে ২৫.৭ বিলিয়ন (২০২৩) হয়েছে। মধ্য ও দীর্ঘকালীন ঋণের বোঝা ৬.৯ বিলিয়ন (২০২১) থেকে বেড়ে আনুমানিক ১১.৭ বিলিয়নে (২০২৩) পৌঁছবে। মোট কেন্দ্রীয় সরকারি ঋণ স্থূল জাতীয় উৎপাদনের ৩৫.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২.২ শতাংশে পৌঁছনোর আশঙ্কা।

অতীতে দারিদ্র দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশ আজ যে চ্যালেঞ্জগুলির সম্মুখীন তার অন্যতম ক্ষেত্রগুলি হল মানবসম্পদের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ও ঝুঁকি হ্রাস। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বারংবার ধাক্কা খেয়েছে এবং তার জেরে বিদেশি মুদ্রা তহবিল ক্রমশ খালি হয়েছে আর তা দরিদ্র সম্প্রদায়ের চাহিদার উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থায়নের ফাঁক (Financing Gap) প্রায় ২২১৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার থেকে মিলবে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্কের থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও বাকি ১০১৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক ঋণের মাধ্যমে আসবে। এখন প্রশ্ন হল, এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি কি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

একদা কৃষি-নির্ভর নদী-মাত্রিক এই বাংলাদেশ দারিদ্র, খরা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শিশু মৃত্যুর হারের পতন, নারী শিক্ষার প্রসার (৭৩ শতাংশ) ও বেতনভুক নারীর কর্মক্ষেত্রে যোগদানের মাত্রা ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে আনুমানিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছছে। এর মূল কারণ অবশ্যই বস্ত্র শিল্পের অভাবনীয় সাফল্য। তাই অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন যে বাংলাদেশের এই শ্লথতা একটি স্বল্পকালীন পরিস্থিতি যার মূল কারণ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রা তহবিলে টান ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ত্রুটি।‌ তবে তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ শীঘ্রই এই শ্লথতা কাটিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে।

বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড: সেলিম রেহানের মতে, বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কর কাঠামো, বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি, মূলধনের বাজার ও মুদ্রা বিনিময় হারের দ্রুত সংস্কার প্রায়োজন, যা বহু দিন যাবৎ অসম্পূর্ণ। এইগুলির সাথে দরকার খরচ কার্যকর প্রকল্পগুলির দ্রুত সমাপ্তি। মূলধনের তহবিল ২০২২'এর প্রথম দিকে ছ' মাস আমদানির খরচের সমতুল্য হলেও তা এখন হ্রাস পেয়ে প্রায় তিন মাসের আমদানির সমান। বাংলাদেশের রফতানির দুটি প্রধান জায়গা হল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। তাই, রফতানির দ্রুত সংস্কার করতে গেলে সার্ক গোষ্ঠীর দেশগুলির সাথে সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্যে ও ASEAN (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি)'এর উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি আর একটি বড় চিন্তার কারণ। কিন্তু তেলের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাড়লেও আশা করা যাচ্ছে যে বিশ্ব বাজারে মন্দার ফলে অদূর ভবিষ্যতে তেলের দাম কিছুটা হ্রাস পাবে।‌ তাই মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে চলে আসবে। মূলধনের বিনিয়োগ যা করোনা কালে দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল, তা পুনরুদ্ধারের পথে কিছুটা এগিয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় ২৫৯১ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছনোর পথে। তাছাড়া, বাংলাদেশের ঋণ বৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশের কাছে যা দ্রুত শিল্প অগ্রগতির সহায়ক হয়ে উঠবে বলে অনেকেই আশাবাদী।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান দুই দেশই চিনের অর্থনৈতিক ঋণের জালে জড়িয়ে ক্ষতির সম্মুখীন। বাংলাদেশও কোভিড পরিস্থিতি থেকে বেরনোর জন্য চিন, আমেরিকা ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার সুদের বোঝা বিশাল আকার ধারণা করেছে। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্য আজ বিপদের সম্মুখীন। ব্যাঙ্ক প্রতারণা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার সাথে চুক্তির ভিত্তিতে পরিকাঠামোগত সংস্কার এবং বহু উন্নয়নমূলক প্রকল্পে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি (যা বহু প্রকল্পের খরচ প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে)- এই সব কারণে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার সুবাদে চিন ও আমেরিকা তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বদ্ধপরিকর। ভারতের ভূমিকা নীরব দর্শকের মতো হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই ভারত অবশ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পরপর অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হওয়া কি ঈষান কোণে কোনও অশনি সংকেতের বার্তা বয়ে আনছে? এখন এটাই দেখার।


Saturday, 13 May 2023

দ্য কর্নাটক স্টোরি

কুলোর বাতাস দিয়ে বিজেপি-বিদায় 

সুব্রত বসু



দক্ষিণের এই ৮৪ শতাংশ হিন্দু-রাজ্যে বিজেপি-র এবারের প্রচার বাঁধা ছিল শুধু বিদ্বেষ ও ঘৃণার তারে। কিন্তু আশার কথা, এ সব ছাপিয়ে কর্নাটকের সঙ্গীত বেজেছে ভালবাসার ধ্রপদী সুরেই। কর্নাটক বিদায় জানিয়েছে মোদী-শাহের বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতিকে।    

মোট আসন- ২২৪ (ম্যাজিক সংখ্যা- ১১৩) 

কংগ্রেস- ১৩৬ (+৫৬), বিজেপি- ৬৫ (-৩৯), জেডিএস- ১৯ (-১৮) 

দশাননের দশটা মাথা থাকলেও দশ মুখ দিয়ে একই সঙ্গে পরস্পর বিরোধী দশরকম বাণী নির্গত হত—এমন কথা মহাকবির রচনার কোথাও পাওয়া যায়নি। রামায়ণে যা হয়নি, কলিকালে ভূ-ভারতে বিজেপি নেতারা তার অনেকটাই করে দেখিয়েছেন। কর্নাটকের নির্বাচনের আগে  বিজেপির নেতাদের কথাবার্তা শুনে আমজনতার ঠিক তাই মনে হয়েছিল। 

এতদিন দলের ‘মুখিয়া’ নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে অমিত শাহ, জে পি নড্ডা-সহ তাবড় নেতার কথা শুনে মানুষের বারবারই মনে হয়েছে, এই দলটি ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না! দলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সব নেতার শয়নে-স্বপনে দেশের মানুষের উন্নয়ন ছাড়া আর কোনও ভাবনাই নেই! নোটবন্দি, জিএসটি, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ানো ইত্যাদি নানা বিচিত্র পদ্ধতিতে তাঁরা বিকাশের রথকে বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটিয়ে দেশকে রাতারাতি উন্নত অর্থনীতির তালিকায় ঢোকাতে বদ্ধপরিকর। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তো রাতের ঘুমই কার্যত ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে ভক্তরা রটিয়ে থাকেন! চারিদিকে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের উন্নয়নের ঠেলায় ৫৬ ইঞ্চির ছাতির প্রধানমন্ত্রী এখন ‘বিশ্বগুরু-বিকাশপুরুষ’। 

এ পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল! কিন্তু তাল কাটল কর্নাটকের নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেতাদের কথায়। সেখানে কর্মিসভায় সাংসদ এবং রাজ্য বিজেপির প্রধান নলিন কতীল ফস করে বলেই দিলেন, বিকাশ-টিকাশের কথা ছেড়ে দাও। জনগণকে ওসব কথা আর বলতে হবে না। তোমরা বরং ওদের কাছে গিয়ে লাভ-জেহাদের বিপদ নিয়ে বোঝাও। তাঁর কথায়, 'আমি তোমাদের বলছি, রাস্তা, নিকাশি ইত্যাদি ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে না। তোমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকে, এবং তোমরা যদি লাভ জেহাদ বন্ধ করতে চাও, তবে বিজেপি-কেই সরকারে আনতে হবে।'

শুধু লাভ জেহাদই নয়, কখনও হিজাব কখনও হালাল- দক্ষিণের এই ৮৪ শতাংশ হিন্দুর রাজ্যে বিজেপি-র এবারের প্রচার বাঁধা ছিল শুধু বিদ্বেষ ও ঘৃণার তারে। কিন্তু আশার কথা, এ সব ছাপিয়ে কর্নাটকের সঙ্গীত বেজেছে ভালবাসার ধ্রপদী সুরে। দক্ষিণের এই রাজ্য বিদায় জানিয়েছে মোদী-শাহের বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতিকে। কার্যত কুলোর বাতাস দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে এই দলটিকে। বিজেপির খুব পছন্দের স্লোগান 'কংগ্রেস মুক্ত ভারত'কে একটু পাল্টে এখন বলা যেতেই পারে, দক্ষিণ ভারত এখন বিজেপি-মুক্ত।

কিন্তু কেন বিজেপির এমন শোচনীয় পরাজয় হল কর্নাটকে? ধর্মীয় মেরুকরণের কোনও চেষ্টাই তো বাকি রাখেননি মোদী-শাহ জুটি। কখনও তা হিজাব নিয়ে, কখনও হালাল-ঝটকা মাংস নিয়ে, কখনও বা মাইক বাজিয়ে নমাজ পড়া নিয়ে। বিধানসভায় বিল পাশ করা হয়েছে জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করার বিরুদ্ধে। কার্যত একতরফা সাম্প্রদায়িক গোলমালে বারবারই তেতে উঠেছে দক্ষিণের একমাত্র বিজেপি শাসিত রাজ্যটি। এ বার লাভ-জেহাদের আতঙ্ক সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বজরং দল এবং শ্রীরাম সেনে নামের উগ্র মৌলবাদী সংগঠনকে হিংসা ছড়ানোর খোলা ছাড়পত্রও দেওয়া হয়েছে। উপকূলবর্তী কর্নাটক (ম্যাঙ্গালোর সহ নেত্রাবতী নদীর সংলগ্ন এলাকা) এবং মহারাষ্ট্র-লাগোয়া (মুম্বই-কর্নাটকে) এলাকায় সংখ্যালঘুদের হত্যাও করা হয়েছে নানা ছোটখাটো অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু ভোটের ফলাফল বের হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, বিজেপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই দুটি এলাকাতেও এই রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাঘের হাঁ-য়ের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে উপকূলবর্তী কর্নাটকের ১৯টি আসনের ৬টি ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। আর এই দুটি এলাকায় খারাপ ফলের জন্যই বিজেপি-র কোমর এতটাই ভেঙেছে যে তাদের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।

গত বিধানসভা নির্বাচনে আনন্দবাজারের প্রতিনিধি হিসেবে ওই রাজ্য ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কর্নাটকে আমজনতা মূলত অসম্প্রদায়িক। কর্নাটকের বিজেপি-র কাণ্ডারী বলে যাঁকে ধরা হয়, সেই ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ থাকলেও, উগ্র মৌলবাদীদের সমর্থন করতে কখনও তেমন ভাবে দেখা যায়নি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তাঁকে সরিয়ে সমনে রাখা হয়েছে শুধু মৌলবাদী প্রচারকদেরই। কর্নাটকের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় লিঙ্গায়েতরা এই বিষয়টিকে ভাল ভাবে নেননি। আর তার ফয়দা পেয়েছে কংগ্রেস (৩৩ কং, ১৬ বিজেপি)। লিঙ্গায়েতদের গড় বলে পরিচিত মুম্বই কর্নাটকে তাই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপি-র।

অনেকটাই একই রকম ভরাডুবি হয়েছে এই রাজ্যের আর এক বড় সম্প্রদায় ভোক্কালিগাদের ঘাঁটি মহীশূর-কর্নাটকে। এই এলাকা অন্য কর্নাটকের চেয়ে শিক্ষা ও সেচ ব্যবস্থায় সেই রাজতন্ত্রের আমল থেকেই রাজ্যের অন্য অংশের থেকে উন্নত। এই এলাকার প্রধান শক্তি এইচ ডি দেবগৌড়া ও কুমারস্বামীর জনতা দল (সেকুলার)। কিন্তু এখানেও কংগ্রেস তাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। মনে হতেই পারে, ভোটাররা ভেবেছেন, ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সুবিধা পেতে পারে বিজেপি। তাই তাদের একটা বড় অংশই ভোট দিয়েছেন কংগ্রেসকে, স্থায়ী এবং মজবুত বিজেপি বিরোধী সরকার তৈরির জন্য। সারা রাজ্যে জেডি(এস)-এর ১৭টি আসন কমাটাকে এই মানসিকতার প্রতিফলন বলেই মনে করা যেতে পারে। 

কিন্তু বিজেপির এই ভরাডুবির মুখ্য কারণ, সরকারের কাজকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ। গত কয়েক বছরে কর্নাটকের জনতা দেখেছে, উন্নয়ন কী ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাজ্যে। সাধারণ কৃষক এবং আখচাষিদের আত্মহত্যা বাড়ছে। খোদ বেঙ্গালুরুর মতো শহর বর্ষাকালে চলে যাচ্ছে জলের তলায়। সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতি ও সরকারি কাজে কাটমানি হজমের নানা অভিযোগ। টাকা ট্রান্সফারের একটি অ্যাপের নামের অনুকরণে রাজ্য জুড়ে ‘পে-সিএম’ পোস্টার পড়েছে। দলের মধ্যেও নানা ঝগড়া। ২০১৮ সালের  নির্বাচনে বিধানসভার ২২৪ আসনের মধ্যে বিজেপি ১০৪টি আসন পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে, কংগ্রেস ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েও আসন পায় ৮০টি। বিজেপির থেকে আসন সংখ্যা কম হলেও প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার কংগ্রেসের একটু বেশিই ছিল। পরে কংগ্রেস-জেডি(এস)-এর জোট সরকার ভাঙিয়ে জোড়াতালি দিয়ে নিজেদের সরকার তৈরি করতে হয়েছিল বিজেপিকে। কিন্তু রাজ্যকে সুশাসনের রাস্তা দেখাতে পারেনি বিজেপি সরকার। 

এবার তাই জনগণের কাছে গিয়ে বলার মতো কোনও বিষয়ই ছিল না বিজেপির হাতে। উন্নয়নের ‘জুমলা’ নিয়ে জনতার কাছে গেলে হিতে-বিপরীতও হতে পারে বলে মনে করেছেন বিজেপি নেতারা। এ রাজ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র সাফল্যও তাঁদের একটু বিপাকে ফেলে দেয়। তাই মেরুকরণকেই শেষ পর্যন্ত তুরুপের তাস হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁরা। উত্তরপ্রদেশ মডেলে এখানেও একটি রামমন্দির তৈরির কথা ঘোষণাও করে বিজেপি সরকার। বলা হয়, রামচন্দ্র বনবাসের সময়ে পাঁচ বছর ছিলেন বেঙ্গালুরুর কাছে রামনগরে। এখানে একটি ছোট রামমন্দিরও আছে। সেই রামমন্দিরের বদলে অযোধ্যার আদলে তৈরি করা হবে দক্ষিণের ‘শানদার’ রামমন্দির। এই মন্দিরের উদ্বোধনে আসবেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী। 

দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া মৌলবাদী নেতা ঈশ্বরাপ্পাকে ফোন করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ভোট-ময়দানে নামিয়ে মৌলবাদী প্রচারে আরও অক্সিজেন জোগান তিনি। প্রচারে তুলে আনেন 'দ্য কেরালা স্টোরি' নামে একটা গাঁজাখুরি সিনেমার কথাও। বজরং দল নিষিদ্ধ করার কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে স্বয়ং বজরংবলীর অপমান বলে উল্লেখ করে মেরুকরণের নিকৃষ্ট চেষ্টাও চালান।

গণদেবতা তো বটেই, স্বয়ং বজরংবলীও যে এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে বিশেষ প্রসন্ন হননি, বিজেপি-নেতারা ২০২৪ সালের ভোটের আগে তা বুঝতে পারলেই মঙ্গল।


Wednesday, 10 May 2023

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জুজু?

রথী-মহারথীরা কি ভয় পাচ্ছেন?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘গডফাদার’ বলে কথিত জেফ্রি হিন্টন গুগল থেকে পদত্যাগ করেই এক বিপদঘন্টা বাজিয়েছেন। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও প্রয়োগ যেদিক পানে এগোচ্ছে তাতে মানবজাতির মহাবিপদ আসন্ন। অনেকে ভেবেছেন, তিনি বলতে চেয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বগ্রাসী দখলদারি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছে, যেখানে এই ভুবনের ওপর মানুষের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না; অচিরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মেশিন সমূহ সমস্ত কিছুর দখল নিয়ে নেবে। অনেকটা হলিউডি ছবির আদলে।

প্রথমেই এটা স্পষ্টত বুঝে নেওয়া দরকার যে, হিন্টন এমন ধরনের কোনও কথা বলেননি। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত ক্ষমতার কথা উদ্ভাসিত করেছেন, তার অসাধ্য সাধনের কীর্তিরও উল্লেখ করেছেন এবং আচম্বিত অদ্ভুতুড়ে আচরণের গল্প কবুল করেছেন। কিন্তু তিনি এমন কথা কখনও বলেননি যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত যন্ত্রেরা মানুষের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির চালকের আসনে বসে যাবে। হিন্টন বরং আমাদের সতর্ক করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও প্রয়োগ যদি মন্দ লোকের হাতে পড়ে, তাহলে এর ব্যবহার এমন ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক পরিসরে পৌঁছতে পারে যে, সে ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতিতে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা এবং তার থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব এক ব্যাপার হয়ে উঠবে। তাই, তাঁর অভিমত, অবিলম্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গবেষণা আমাদের স্থগিত রাখা উচিত। কিছুদিন আগে কয়েকজন গবেষকও এমনতর নিদান দিয়েছিলেন, যেখানে তাঁদের আবেদন ছিল, এ সংক্রান্ত গবেষণা যেন অন্তত ছ’ মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়।

বিশেষজ্ঞরা যখন এমনতর আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তখন অন্তত এটুকু অস্বীকার করার আর কোনও উপায় নেই যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ সমাজব্যবস্থা পরিচালনায় এক কেন্দ্রীয় অভিমুখ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাজনীতি-অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। যদিচ, এমন কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি বা তার সম্ভাবনাও দেখা দেয়নি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার স্রষ্টা মানুষটিকে ছাপিয়ে কোনও কিছু করে ফেলতে সক্ষম। চ্যাটজিপিট৪ আসার পরে অনেকেই এর অন্তর্জাত ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে এইসব যন্ত্রানুষঙ্গের কিছু ‘অদ্ভুতুড়ে’ আচরণে চমকিত ও আশঙ্কিত হয়েছেন, কিন্তু এই কথাটা নির্দ্বিধায় বলাই যায় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত কোনও যন্ত্রই এখনও ‘অনুকূল’ (সত্যজিতের গল্প) হয়ে ওঠার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। আদৌ পারবে কিনা, সে প্রশ্নটিও অতএব থেকে যাবে রহস্য-রোমাঞ্চের আবেশ নিয়ে।

কিন্তু কথা হল, তাহলে বহু গবেষক ও রথী-মহারথীরা এমন আশঙ্কার কথা বারবার শোনাচ্ছেন কেন? ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, তথ্য প্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল জগতে হাজারে হাজারে কর্মী ছাঁটাই হয়ে চলেছে। কগনিজেন্ট’এর মতো সংস্থা প্রায় দেউলিয়া ঘোষণার পথে। মাইক্রোসফট, গুগল’এর মতো দৈত্যাকার কোম্পানিগুলিতে পর্যন্ত কর্মী সংকোচনের হিড়িক পড়ে গেছে। 

এর অন্যতম কারণ দুটি: এক) কোভিডের সময়ে ডিজিটাল দুনিয়ার অতি প্রসারের ফলে বহু অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সেই মেদ এখন ঝরানোর সময়;  দুই) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও অগ্রগতির ফলে বহু কাজে মনুষ্যশ্রমের আর দরকার পড়ছে না এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে থাকবে। এমতাবস্থায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও অগ্রগতিতে খুব স্বাভাবিক যে কাজের জগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। তা শুধু সাবেক সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এর দৌড় আরও বহু দূরে প্রসারিত ও পরিব্যাপ্ত। এখানেই সম্ভবত আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে উঠছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিব্যাপ্তি কত দূর অবধি বিস্তৃত, তার হদিশ পেতে ইতিমধ্যেই বড় বড় প্রযুক্তিবিদদের কালঘাম ছুটেছে। তার ওপর বহু দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের হাতে পড়ে ডার্ক ওয়েব এখন এক বৃহৎ শিল্পে পরিণত হয়েছে। হ্যাকাররা আরও উন্নত সজ্জায় সজ্জিত। প্রতারকেরা নিত্য নতুন ফাঁদ পেতে লুঠতরাজের এমন এক দুনিয়া গড়ে তুলেছে যে বড় বড় কর্পোরেট ও রাষ্ট্রসমূহও তাদের দাপটে আজকাল রীতিমতো শঙ্কিত। কিছুদিন আগে এইসব বিষয় নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে একটি উচ্চপর্যায়ের মিটিং ডেকেছিলেন। সেখানে কী আলোচনা বা ফয়সালা হল তা অবশ্য আর কিছু জানা যায়নি। 

মোদ্দা কথায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে মনুষ্য জ্ঞান, দক্ষতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা এতটাই হস্তান্তরিত হয়েছে যে, সেইসবকে ব্যবহার অথবা খানিক উন্নত করে ও ঘটের কিছু বুদ্ধি খরচ করে দিব্যি বহু অসাধ্য সাধন করে ফেলা অসম্ভব কিছু নয় আর। যেমন, চ্যাটজিপিটি৪ থেকে নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে অথবা তার সহযোগিতায় ভাল-মন্দ নানাবিধ ‘কাজের কাজ’ সেরে ফেলা সম্ভব। আর এই বিন্দুতেই শুরু হয়েছে সোরগোল। দুনিয়ার অন্যতম বাণিজ্য অধিপতি ওয়ারেন বাফেট সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পারমাণবিক বোমার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এলন মাস্ক’এর কথা সবসময়ে ততটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে আসছেন। এঁদের অন্যতম একটি আশঙ্কা হল, AI (Artificial Intelligence) হয়তো পরিণতি পেতে পারে ASI (Artificial Super Intelligence)’তে, অর্থাৎ, সে প্রকারান্তরে মনুষ্য বুদ্ধিমত্তার প্রায় সবটাই আয়ত্ব করে ফেলে এক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনে রূপান্তরিত হবে। কতকটা কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনালেও এই আশঙ্কাতেই এখন বড় বড় কর্পোরেটপতিরা দিনাতিপাত করছেন।

তবে এরই মাঝে আমাদের ঘরের মানুষ নারায়ণমূর্তি কিন্তু গত মার্চে ন্যাসকম’এর একটি সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতশত কিছু করার ক্ষমতা নেই। কারণ, মানুষের মন হল সব থেকে অধিক নমনীয় এমন একটি সত্তা, যা প্রযুক্তির অগ্রগতির থেকে আরও বেশি এগিয়ে থাকতে ও সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারদর্শী। তাঁর মতে, ১৯৭৭-৭৮ সালেও এমন কিছু programme generators এসেছিল যা দেখে অনেকেই প্রভূত কর্মচ্যুতির সম্ভাবনা ভেবেছিলেন। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। বরং তিনি চ্যাটজিপিটি’র ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন যে এটিকে ভিত হিসেবে গণ্য করে আমাদের আরও বেশি সৃজনশীলতা দেখানো ও আরও বড় সমস্যা সমাধানের পথে এগোনো উচিত; চ্যাটজিপিটি হোক কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মানুষকে সর্বতোভাবে প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা এদের কারওরই নেই। কতকটা দার্শনিক অবস্থান থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে এমনতর কথা পদার্থবিদ রজার পেনরোজ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Emperor’s New Mind’এ (১৯৮৯) বলেছিলেন। তাঁর স্পষ্ট মত ছিল, মানুষের যে বিচিত্র বিচার ক্ষমতা (Judgemental Ability) তা অর্জন বা ধারণ করার সামর্থ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কখনও হবে না। কারণ, এই ক্ষমতার অন্তর্নিহিত চেতনা এমন একটি অস্তিত্ব বা সত্তা যা শুধুমাত্র মনুষ্য-অর্জন সাপেক্ষ। অবশ্য এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আজও চলেছে।

কিন্তু আমূল এক রূপান্তর যে চোখের সামনে ঘটে চলেছে তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। নিঃসন্দেহে সে রূপান্তর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এখনও পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় এমন কোনও মনুষ্য-চেতনা সম্বলিত ক্ষমতাধারী করেনি যা ওয়ারেন বাফেট বা এলন মাস্ক’এর শঙ্কাকে বাস্তবায়িত করে তুলতে পারে। তা এই মুহূর্তে মানুষের একটি ব্যবহারযোগ্য যন্ত্র হিসেবে, অবশ্য দানব হয়ে ওঠার বাস্তবতাকে সঙ্গে করেই, বিরাজমান। এ পর্যন্ত অনুমান, সেই দানব কখনই মনুষ্য-নাগালের বাইরে গিয়ে স্বয়ম্ভু হতে পারবে না।

উল্লেখ্য, ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ প্রকাশিত ‘দ্য ফিউচার অফ জব রিপোর্টস’ (‘ভবিষ্যতের কাজের হদিশ’) বলছে, সমীক্ষালব্ধ ৭৫ শতাংশ শিল্প বা বাণিজ্য সংস্থা আগামী দিনে মূলত বিগ ডাটা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেই প্রযুক্তি হিসেবে গ্রহণ করার পথে এগোচ্ছে। কিন্তু এইসব প্রযুক্তির অবলম্বন কর্মসংকোচনের পরিবর্তে সামগ্রিক ভাবে কর্ম-প্রসারের পরিমাণকে আখেরে net positive করে তুলবে বলে তাদের অনুমান। অস্যার্থ, নতুন নতুন প্রযুক্তির আবাহনে বহু লোকের কাজ চলে যাবে বটে, কিন্তু নতুন কাজের সৃষ্টি হবে আরও অধিক পরিমাণে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ফোরামের মতে, দুটি প্রযুক্তি আগামী পাঁচ বছরে আদতে নতুন কাজ সৃষ্টি করবে: মনুষ্যরূপী রোবট এবং অ-মনুষ্যরূপী রোবট

কিন্তু তবুও রথী-মহারথীদের শঙ্কা একটা থাকছেই। তা হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বজনীনতা অর্জনের যে পথ তৈরি হয়েছে সেখানে যে কেউ চাইলেই তার সহায়তা বা উপযোগিতা সহযোগে (চ্যাটজিপিটি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত) নানারকম অঘটনও ঘটিয়ে দিতে পারে। ব্যবসার জগতেও ওলটপালট ঘটে যাওয়াটা কোনও অসম্ভব ব্যাপার নয় আর। আজ যে বিলিয়নপতি, কাল সে দেউলিয়া হয়ে পথের ধারে বসে পড়তে পারে। কোনও এক অজানা প্রান্তর থেকে পথের মানুষটি উঠে যেতে পারে বিলিয়নপতিদের দঙ্গলে। এই ‘অদ্ভুতুড়ে’ ওঠানামার খেল দেখানোর ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আছে, তবে তা মনুষ্য-বুদ্ধির সাহচর্যেই। কোন মানুষটি কোথায় বসে কী ছক কষছে, তা জানারও যেমন উপায় আছে, আবার তা লুকিয়ে রেখে এগোনোর কলকব্জাও সমান তালে সচল। এখানেই এর আমূল রূপান্তরের সক্ষমতা আর ওয়ারেন বাফেট, এলন মাস্ক’দের সত্যিকারের শঙ্কা।

  

Tuesday, 9 May 2023

নিষিদ্ধকরণ পথ নয়

'দ্য কেরালা স্টোরি'র মিথ্যাচার

শোভনলাল চক্রবর্তী



আলোচিত-সমালোচিত চলচ্চিত্র ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তি-সৌহার্দ্য বজায় রাখতেই নাকি পশ্চিমবঙ্গে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ছবিতে যে সব দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তা রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে তামিলনাড়ুতেও এই ছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে মধ্যপ্রদেশের রাজ্য সরকার আবার ছবিটিকে করমুক্ত ঘোষণা করেছে। শাবানা আজমি ট্যুইট করে জানিয়েছেন, 'যারা 'দ্য কেরালা স্টোরিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন, তাঁরা 'লাল সিং চাড্ডা'কে নিষিদ্ধ করার দাবি যারা তুলেছিলেন তাঁদের মতোই ভুল করছেন। সেন্সর বোর্ড কোনও ছবিকে যদি একবার পাস করে দেয় তাহলে কারও আর অতিরিক্ত সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ বনবার অধিকার থাকে না।'

সম্প্রতি কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র সমালোচনা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, 'রাজনৈতিক দলগুলো আগুন নিয়ে খেলছে। তারা জাত-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে ভেদাভেদ তৈরির চেষ্টা করছে। 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' কেন? একটি সম্প্রদায়কে হেনস্তা করার জন্য। 'দ্য কেরালা স্টোরি'? সে-ও এক অসত্য ও বিকৃত কাহিনি।’ এর আগে ছবিটি নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারই ভিজয়ন। তিনি বলেছেন, এটা ‘প্রচারণামূলক’ ছবি, কোনওভাবেই তাঁর রাজ্যের গল্প নয়। ছবিটির মুক্তি বাতিলের আবেদনও করা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট সে আবেদন খারিজ করে দেয়, যদিও ছবির টিজারে উল্লিখিত '৩২,০০০ মহিলা'র সন্ত্রাসবাদী দলে যোগ দেওয়ার অপ্রামাণ্য ও প্ররোচণামূলক তথ্যটি বাদ দিতে কড়া নির্দেশ জারী করে। নানা বিতর্কের মধ্যে অবশেষে ১০টি দৃশ্য ছেঁটে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় ‘দ্য কেরালা স্টোরি’। গত শুক্রবার ভারতের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি।

ছবিতে শালিনী উন্নিকৃষ্ণণ থেকে ফতিমায় রূপান্তরিত হতে হয় নায়িকা আদা খানকে। সন্ত্রাসীদের একজন ছাত্রী সেজে ঢুকে পড়ে নার্সিং কলেজে। তারপর সেই কৌশলে শালিনীকে যোগ দেওয়ায় নিজেদের দলে। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে বোরখায় মুখ ঢাকতে হয়। কেরলের ভিন ধর্মাবলম্বী, মূলত হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়েদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করে জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিস-এ যোগদান করানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ছবির কাহিনি লেখা হয়েছে। ধর্মান্তরিত নারীর অসহায় জীবন সংগ্রামই এই ছবির মুখ্য উপজীব্য। অর্থাৎ, ছবিতে হিন্দু মহিলাদের উপর ইসলাম আগ্রাসনের কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে তোলার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে করছেন অনেকে। যেমন, ছবিটি মুক্তির আগেই কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এই ছবি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, কেরলের পরিস্থিতিকে বিকৃত এবং অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। কেরলকে বলা হয়েছে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর। তাই এ ছবি মুক্তি পেলে অশান্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এবার সেই পথে হাঁটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যদিও পরিচালক সুদীপ্ত সেন দাবি করেছেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলতে চেয়েছেন, তিনি আদতে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী একটি ছবি তৈরি করেছেন যার নেপথ্যে রয়েছে অনেক গবেষণা, পরিশ্রম ও তথ্যের বিশ্লেষণ। গোটা কাহিনিই সত্য ঘটনা অবলম্বনে বলেও দাবি করেছেন তিনি। যদিও নেটফ্লিক্স-এর 'ক্যালিফেট-৩' ছবির সঙ্গে সুদীপ্ত'র ছবির হুবহু মিল দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে ছবিটি পুরোটাই টোকা। 

কেরালা সরকার ছবিটি ব্যান করেনি, বয়কট করতে বলেছে সাধারণ মানুষকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ছবিটি কিন্তু কেরালায় একেবারেই চলেনি। মাত্র ১১টি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি চলছে, তাও শো-এর সংখ্যা কমে এসেছে ৪ থেকে ১-এ। ছবিটিতে এত বেশি ধর্মীয় প্রচারমূলক বক্তব্য যে সংলাপ ও দৃশ্যায়ন অত্যন্ত দুর্বল। সিনেমা হিসেবে অন্তত কেরালায় মুখ থুবড়ে পড়েছে 'দ্য কেরালা স্টোরি'। 

সলমান রুশদি থেকে তসলিমা নাসরিন হয়ে মকবুল ফিদা হোসেন- ভারতে নিষিদ্ধের কাহিনি নেহাত ছোটগল্প নয়। বই, ছায়াছবি বা কোনও ব্যক্তিকে যখন রাষ্ট্রশক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন এটা বোঝা খুব সহজ যে ওই বই, ছবি বা ব্যক্তিকে আসলে রাষ্ট্র ভয় পেয়েছে। নিষিদ্ধকল্পের আর একটি মূল লক্ষণ বিবেচনা শক্তির লোপ। আজ যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে 'দ্য কেরালা স্টোরি' নিষিদ্ধ করলেন তাঁদের সঙ্গে সেই অসভ্য উত্তাল জনতার চিন্তার দীনতার কি কোনও তফাত রইল যাঁরা 'পদ্মাবতী'র সেটে ভাঙচুর করে শুটিং বানচাল করেছিলেন, ধার্য করেছিলেন ছবির অভিনেত্রীর মাথার দাম। কিংবা যাঁরা 'লাল সিং চাড্ডা' ছবি চলাকালীন সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে সিনেমা বন্ধ করে দিয়েছিলেন? উত্তর, না। তাই যদি হবে তবে কেন এই নিষিদ্ধের রাস্তা? বাস্তবতা হল, আজ এই ইন্টারনেটের যুগে কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে ছবিটি দেখানো হবে, নানা সাইট থেকে মানুষ ছবিটি দেখবেন। নিষিদ্ধ ছবি দেখার হিড়িক পড়ে যাবে। এই তো কয়েক দিন আগে বিবিসির তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ হল ভারতে। নিষিদ্ধ হওয়া মাত্র আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ তথ্যচিত্রটি দেখলেন এবং বুঝলেন যে আসলে মোদিজি এখন ভোল বদল করেছেন। তাই নতুন প্রজন্মের সামনে ওই সব গোধরার পুরনো কাসুন্দি না আনাই শ্রেয়। কিন্তু সফলতা এল কী? একেবারেই নয়, উল্টে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। 

কর্নাটক নির্বাচনের প্রচারে মোদি 'দ্য কেরালা স্টোরি'র উল্লেখ করেছেন। সবরকম সৌজন্য শিকেয় তুলে কর্নাটকের মাটিতে দাঁড়িয়ে পাশের রাজ্য কেরল সম্পর্কে বলেছেন জঙ্গি রাজ্য, মানুষকে সাবধান করেছেন ওই রাজ্য সম্পর্কে। কিন্তু এত করেও লাভ কিছু হয়নি। কর্নাটকের যুবক-যুবতীরা বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি জ্বলন্ত ইস্যু নিয়ে মোদির নীরবতাকে ধিক্কার জানাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল সরকারকে মরণ কামড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হতে পারে যে, প্রয়োজনে দাঙ্গা লাগিয়ে তারা স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টা করবে। হয়তো সেই কাজে সত্যিই 'দ্য কেরালা স্টোরি'র গল্পের গরু গাছে ওঠার মতো ৩২,০০০ হিন্দু মেয়ের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী কাজে লাগানো হত। কিন্তু, রাজ্য প্রশাসন কি এতটাই দুর্বল যে গুটি কয়েক দাঙ্গাবাজদের দাঙ্গা সামলানোর ক্ষমতা তাদের বিলুপ্ত? আর এ রাজ্যের মানুষও কি এতই অসচেতন যে একুশ শতকে কুড়িরও বেশি বছর কাটিয়ে তারা এখনও দাঙ্গা-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়তে চাইবেন? 

দাঙ্গা ঠেকাতে 'দ্য কেরালা স্টোরি' নিষিদ্ধ করতে হল- এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খুব ভালো বিজ্ঞাপন হল না কিন্তু। মানুষের উপর 'মানুষের সরকার' আর একটু ভরসা রাখতে পারতেন। হয়তো দেখা যেত, কেরালার মতোই এ ছবি দেখতে মানুষ মোটেই আগ্রহী নন, অথবা, তীক্ষ্ণ সমালোচনায় এ ছবির অকাল গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটত।



Friday, 5 May 2023

বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বদেশি বোধ

প্রতিবেশী নাগরিকেরা যখন আপনজন

অর্ণব



রোমের ট্রেভি ফাউন্টেইন- ইতালিয়ান ভাষায় ফন্টানা ডি ট্রেভি। দীর্ঘ তিরিশ বছর (১৭৩২-১৭৬২) ধরে নির্মিত। নিকোলা সালভি ছিলেন এর প্রধান নকশা নির্মাতা। ৮৬ ফুট উঁচু ও ১৩১ ফুট ব্যাস যুক্ত ঝর্ণাধারা। এটি ইতালির বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত। এখানে হাজার হাজার পর্যটক জড়ো হয়। একাধিক ফটোগ্রাফার কিছু ফুল সমেত ব্যস্ত পায়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। নব্য প্রেমিক যুগল থেকে শুরু করে বৃদ্ধ দম্পতি এখানে এসে ছবি তোলে, পরস্পর পুষ্প অর্পণের ছবি । ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে সুপ্রশস্ত ফন্টানা ডি ট্রেভি। 

ভদ্র পরিশীলিত মার্জিত লোকজনের ভিড়ে কোথাও বুঝি ছন্দ পতনের শব্দ। বয়স্ক এক দম্পতির অনুমতি ছাড়াই এক ফটোগ্রাফার তাদের হাতে ফুল ধরিয়ে ছবি তুলে এবার টাকা চাইছে। 

'আমি তো ছবি তুলতে বলিনি। তুমি কেন তুললে?' দম্পতির যুক্তি। 

'এখানে সবাই এই ছবি তুলে নিয়ে যায়। এটাই রেওয়াজ।' ফটোগ্রাফারের আত্মপক্ষ সমর্থন।

আসলে অতিরিক্ত সমস্যা হল ভাষা সমস্যা। কে বুঝবে কার কথা। বেগতিক বুঝে আমি দোভাষী হিসেবে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে গেলাম। এই সুযোগে বলে রাখি, আমি ইউরোপিয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে এসেছি। তদুপরি ফটোগ্রাফার-কাম-ফুল বিক্রেতাকে নির্ভেজাল বাঙাল বলেই বুঝতে পারলাম। আর ওই দম্পতি ডাচ। ডাচ ভাষায় আমি মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারি। হল্যান্ডে গ্রনিংগেন ইউনিভার্সিটিতে আমি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি। আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম, ডাচ ভাষায় ওই দম্পতিকে থামতে বলে আমি যেই বাঙাল উচ্চারণে ফটোগ্রাফারকে সম্বোধন করলাম, 'ভাইডি, ব্যবসা করতে আইছেন, মাথা খান ঠান্ডা রাখোন লাগব তো?' ব্যাস, ধাঁআআ। ফটোগ্রাফার পয়সা কড়ি না নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়ল। আমি আমার স্বজন কাঠবাঙাল পেয়ে কোথায় একটু মনের সুখে গল্প করে নেব, সেই সুযোগ হাতছাড়া। 

'ভাইডি, শোনেন শোনেন খাড়ান, আমি আপনের স্বজাতি, বাঙাল, দ্যাশ ফরিদপুর।' ভাইডি আর ত্রিসীমানায় নাই। এই ঘটনা কাঁটার মতো ফুটতে থাকল। প্রবাসে দৈবের বশে স্বভাষী মেলে। সে কেন আমাকে দেখে মুখ ফেরালো! বলা যায়, পালিয়ে বাঁচল। এই অপমান হজম করা সহজ নয়। 

বিদেশে থাকলে বন্ধু'র ধারণা পাল্টে যায়। 'বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা' কথাটার যথার্থ উপলব্ধি বিদেশেই সম্ভব। সেই সাথে দ্বিতীয় সত্য জানা 'বিনা স্বদেশী খানা মন ভরে না'। তবে স্বদেশি শব্দটি আর আক্ষরিক থাকে না। বাঙালির দেখা মিললে সর্বোত্তম। হিন্দি ভাষী, পাঞ্জাবী এমনকি পাকিস্তানিকেও মনে হয় স্বদেশি। ভাষায় ও খাদ্যে নিকটজন। বাংলাদেশ হলে তো কথাই নেই। গ্যাটিংগেনে পড়তে এসে আমার এমনই নিকটজন পাকিস্তানি স্বজন মোস্তাক আফ্রিদি। ওর সাথে আলাপ হবার আগে জাতি হিসেবে আফ্রিদি ইউসুফজাই নাম শুনেছি মাত্র। যোদ্ধা জাতি। ও হ্যাঁ, শাহিদ আফ্রিদির নামও শুনেছি ক্রিকেটার হিসেবে। 

মোস্তাককে দেখে যোদ্ধা জাতি হাসবে। সুন্দর লম্বা ছিপছিপে গড়ন। একটা পিঁপড়ে মারতেও কষ্ট পায়। বলে, আমি তো স্রষ্টা নই, আল্লাহ হলেন স্রষ্টা। তাহলে আমার কোনও অধিকার নেই কোনও সৃষ্টি বিনাশ করার। 'কিসিকো কোই হক নেহি এক ভি জানকো ছিন লেনে কা'- যোদ্ধা জাতি এ কথা শুনলে হাসবে না? 

'সব আফ্রিদি ক্রিকেট খেলবে, আফ্রিদি হলেই যুদ্ধ করবে এরকমই তোমরা ভাবো, তাই না?' মোস্তাক বলে আর হাসে। ওর কাছে শুনলাম কত কথা। আইয়ুব আফ্রিদি- মাদক সম্রাট ও আফগানিস্তান হেরোইন ব‍্যবসার প্রতিষ্ঠাতা আন্ডারওয়ার্ল্ড বস্। রিয়াজ আফ্রিদি- পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার; এছাড়াও উমর গুল, শাহিদ আফ্রিদির নাম সকলের জানা। এগুলোর সাথে আফ্রিদি মানানসই, তাই না? 

এরপর মোস্তাক শোনাল কবি খাতির আফ্রিদির নাম। অসংখ্য প্রেমের কবিতার স্রষ্টা। দশ বছর টিবি রোগে ভুগে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। পাশতুন কবি, পাশতুন ভাষায় গজলের স্রষ্টা।

'যে মানুষটা কথার ছলে

মান অভিমান জেনে নিত রোজ। 

তাকে কখনও যায় না ভোলা

হারিয়ে সাকিন আজ সে নিখোঁজ।'

আমি এই দুটি পঙক্তি শুনে অভিভূত। এ তো নিছক প্রেমের কাব্য নয়। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে উপেক্ষিত সেই চরিত্র, যার একমাত্র সমব্যথী বাল্যবিধবা ঠাকুমার মৃত্যু যন্ত্রণা। বুঝি বা ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর পর দুর্গার এমনই সকরুণ আর্তি। মন ছুঁয়ে গেল। শুনলাম এমনই প্রেমের কবিতা কিন্তু বিষাদময় আরও দুই পঙক্তি -

'ভেবে বলো দেখি, 

আমি এই দুনিয়ায়

যদি কোনওখানে না থাকি

কার কিবা আসে যায়?' 


সময় সুযোগ পেলেই মোস্তাক খাতির'এর কবিতা শোনাতো। খাতির একটি স্কুলে বাগানের মালির কাজ করতেন। কোনওদিন স্কুলে পড়াশোনা করেননি। প্রথম জীবনে কিছু অসাধারণ গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এরপরে তিনি 'পোয়েট্রি সোসাইটি'র সদস্য হয়ে হামজা শিনোয়ারি ও নাজির শিনোয়ারির সাহচর্যে আসেন। এরা দুজনেই পাশতুন কবিতার প্রাণপুরুষ। এরপর খাতির আফ্রিদি অসংখ্য স্মরণীয় গজল রচনা করেন। হামজা শিনোয়ারি তাঁর গজলের পরম ভক্ত ছিলেন। কবির একমাত্র সন্তান ও এক সম্পর্কিত ভাই তাঁর দুর্লভ সৃষ্টি একত্রিত করে সংকলিত করেন। 

মোস্তাকের সাথে বন্ধুত্বের শুরুটাও তো কম আকর্ষণীয় নয়। সেটা ছিল ২০১২ সাল। হঠাৎই মোস্তাক আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, 'আরে ইয়ার, ইঁয়হা তো জার্মানি মে কোই কিরকেট নেহি পহচানতা, কোই তো চাহিয়ে দিল কি বাত শেয়ার করনা। টুডে সিক্সটিনথ্ মার্চ ! ঢাকা মে এশিয়া কাপ কা বড়িয়া ধামাকা, আজ তেন্ডুলকর কা হান্ড্রেডথ সেঞ্চুরি করনে কা গ্রেট মওকা! বইঠ না ইয়ার ইধর, থোরি সি বাত কর না শেয়ার।' আমি বিস্ময়ে হতবাক। আমি মনেই রাখি না শচীন তেন্ডুলকর বা ভারতীয় ক্রিকেটের খবর। আর খোদ পাকিস্তানি সে খবর রাখে। এটাই ছিল হৃদ্যতার শুরুয়াৎ। এরপর মাঝে মাঝেই আমাদের বাটি চালাচালি চলত। আমার রান্না ওর কাছে স্বদেশি, ওর রান্নাও আমার কাছে ঘরোয়া। খাদ্যে, ভাষায়, ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতা বেড়ে চলল। 

ইউনিভার্সিটি প্রায় মাসখানেক ছুটি। অতএব, কোনও 'দ্বিধা' অথবা 'কিন্তু' কিংবা 'যদি' ঝেড়ে ফেলে আমি আমার X-Calibre 8 বাইসাইকেল নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লাম। মোস্তাক বলল, 'আরে দোস্ত, হামে ভি সাথ বুলা লে, হাম ভি হ্যায় আকেলে। দেশওয়ালী নেহি, পড়োশী তো হ্যায় জরুর।' সঙ্গী জুটে গেল। দুজনেই দুটি বাইসাইকেল চেপে ইউরোপ ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লাম। এই সুদীর্ঘ সময়ে কত না অন্তরঙ্গতা, ভাব-ভাবনার বিনিময়। 

প্যারিসে ৮.২ হেক্টর জমিতে বৃটিশ কায়দায় নির্মিত পার্ক মঁসিউ। ছোটদের খেলার সামগ্রী, তার সাথে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ব্রোঞ্জ ও মার্বেল পাথরের মূর্তি বিখ্যাত ভাস্কর নির্মিত, চিনা দূর্গের নকল, করিন্থিয়ান স্তম্ভের নকল, ডাচ উইন্ডমিলের নকল ইত্যাদি নানাবিধ সুদৃশ্য উপকরণে পার্কটি সুসজ্জিত। সেখানে অ্যামব্রোস থমাসের মূর্তির পাদদেশে শ্বেত শুভ্র জ্যোৎস্নালোকে মোস্তাক আর আমার বিনিদ্র রজনী আড্ডা। এই অ্যামব্রোস থমাস ছিলেন কনজারভেটরি ডি প্যারিস'এর মিউজিকের ছাত্র। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ মিউজিক পুরস্কার প্রিঁ ডি রোম লাভ করেন। ১৮৩৭ সালে তিনি তার প্রথম অপেরা কম্পোজ করেন La double échelle- এই স্মরণীয় মুহূর্তে আমরা পাশাপাশি শুয়ে দুই প্রতিবেশী শত্রু দেশের যুবক। মোস্তাক বলে, তোমার দেশের মানুষ ভাবে পাকিস্তানের মানুষ রাঁধে না, খায় না, ঘুমায় না। ভারতের দিকে বন্দুক তাক করে বসে থাকে। তারা হাসে না, কাঁদে না, ভালোবাসে না, কেবলই জেহাদি উল্লাস করে। আমাদের দেশেও ভারত সম্পর্কে এমনই কথা ভাবে। বলা ভালো, ভাবানো হয়। বিদেশে এসে আমাদের দুজনেরই পছন্দ বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। অথচ বাংলাদেশ হল পাকিস্তানের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। 

গোটা ছুটি চড়কি পাক খেয়েছিলাম ইউরোপের আনাচকানাচ, দিবারাত্রি নিদ্রাহীন। পরম বিস্ময় আর আনন্দ ফূর্তি অপার। তবু কী এক অভাববোধ হয়। কীসের অভাবে সব বিস্বাদ রসহীন মরুময়। দিন কয় পরে, ভাবনা চিন্তা না করেই ভুলক্রমে রোমে ঢুকে গিয়েছি- এরপর মিনেপলিস, মিনেসোটায় একটি রেস্তরাঁয়, নাম দেখে নয়, ঢুকেছি খিদের জ্বালায়। খাবারের স্বাদ, ওয়েটার ম্যানেজারের চেনা ভাষা যত্ন আহ্লাদ বুঝিয়ে দিল এতদিন কোথায় বিস্বাদ ছিল। মিনেপলিস বোধ হল ওয়েসিস। বেরিয়ে দেখি নাম লেখা- শেফ তৌসিফ মেহমুদ 'পাক ইন্ডিয়ান ফুড'। এরপর আর ভুলক্রমে নয়, খুঁজে নিতাম ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানি, একই দেশি ঘরানা।

সেই পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি ফটোগ্রাফারের কথা মনে থেকেই গিয়েছিল। পরে জেনেছি, ইতালিতে সাধারণ বাংলাদেশি মানে জীবিকা সন্ধানীরা সাধারণত লিবিয়া হয়ে ইতালি ঢুকে থাকে। আইনি ও বেআইনি অনুপ্রবেশ এ পথেই ঘটে। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া একটি দালাল চক্র সক্রিয়। বেকার বাংলাদেশি যুবক মোটা টাকা দিয়ে ভাগ্যের দরজা খুলতে চায়। প্রশ্ন হল, লিবিয়া কেন? লিবিয়া ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির উপনিবেশ ছিল। ভূখণ্ডটি আগে অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। ১৯১১'এর পরে ইতালো-তুর্কি যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে তুরস্ক ইতালিকে দুটি অঞ্চল ছেড়ে দেয়। ফলে, ইতালির দুটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল: ইতালিয় ত্রিপলিটানিয়া এবং ইতালিয় সেরেনাইকা। ১৯৩৪ সালে এই দুটি একটি উপনিবেশে একীভূত হয়েছিল: ইতালিয়ান লিবিয়া। ইতালি-লিবিয়া যাতায়াত অনেক পুরনো। 

যারা এখানে কাজ খুঁজে পায়- হোটেল-রেস্তোরাঁ, ট্যুরিস্ট স্পটে ব্যবসা, ফেরি করা, সেলুন পার্লারে, এরা যা উপার্জন করে তা ভারত বাংলাদেশের মুদ্রার সাপেক্ষে অনেক বেশি। এরা ইউরোপে কোনওমতে দিন গুজরান করে অধিকাংশ টাকা বাড়িতে পাঠায়। বাড়িতে বলে, ইউরোপে চাকরি বা ব্যবসা করে। বাড়িতে নিজের বাড়িতে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা জানায় না। এই ছেলেটি যখন কোনও স্বদেশি স্বভাষীকে দেখতে পায়, আতঙ্কিত ও আশঙ্কিত হয়। যদি চেনাজানা সূত্র প্রকাশ পায়। দেশের বাড়িতে ও অঞ্চলে মানুষ যদি তার সত্য জীবিকা জেনে ফেলে! একটা ভয়। 

গণতান্ত্রিক ইউরোপে কর্ম বা জীবিকা নির্বাহের কৌলীন্য বিচার হয় না। তাই কত সহজেই আইনজীবী পিতা সন্তানের মাছের দোকান দেখাতে পারে। কিন্তু ইউরোপের উপনিবেশে শাসক-প্রভুর বাহ্যিক আধুনিকতা সমাদৃত হয়েছে। প্রভুর আদব কায়দা, ঠাটবাট, চালচলন পূজিত হয়েছে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষকের আত্মপরিচয় এবং বিদেশের মাটিতে ফুটপাতের হকার, রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের 'আত্মপরিচয়ে অনেক ফারাক'। স্বভাষী বা স্বজাতি হলেও আমার পরিচয় তাই 'ভাইডি'র চোখে অন্য, অপর।

অনুলিখন: মালবিকা মিত্র।