মন্দার আবর্তে বাংলাদেশ!
রাজীব ভট্টাচার্য
করোনা পরবর্তীকালে এশিয়ার একের পর
এক দেশ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের পরে এবার কি
বাংলাদেশের পালা? কোভিড সংকট মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ঋণের বোঝা, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রা
ভাণ্ডারে টান, রফতানির দ্রুত হ্রাস ইত্যাদি সমস্যায় হঠাৎ বাংলাদেশ তীব্র সংকটে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার (আইএমএফ)'এর ফেব্রুয়ারি ২০২৩'এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১-২২'এ অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল
দেশের তকমা পাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি
৭.১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালে ৫.২ শতাংশে পৌঁছনোর আশঙ্কা। সেই কারণেই
বাংলাদেশ আজ ঋণের জন্য আইএমএফ'এর দ্বারস্থ।
এই আর্জির কথা মাথায় রেখে আইএমএফ ২.৫ বিলিয়ন SDR অর্থাৎ ৩.৩ বিলিয়ন ডলার মঞ্জুর করেছে এবং এটি মূলত দুটি খাতে প্রদান করা হয়েছে- সম্প্রসারিত ঋণ সুবিধা (ECF) এবং সম্প্রসারিত তহবিল সুবিধা (EFF) খাতে।
মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের দ্রুতগতিতে হ্রাসকে সাধারণত বিশ্ব মন্দার প্রাথমিক সূচক (কোস ও টেরনস, ২০১৫) বলে ধরা হয়। এই জাতীয় উৎপাদনের দ্রুতগতিতে হ্রাসের সাথে যুক্ত হয় মন্থর গতিতে শিল্প বৃদ্ধি, বাণিজ্য শ্লথতা, আন্তর্জাতিক মূলধন চলাচলে নিম্নগতি ও সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে বেকারত্ব বৃদ্ধি। ১৯৭০ সালের পর থেকে বিশ্বে পাঁচটি মন্দা দেখা দেয়- ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১, ২০০৯ ও সর্বশেষ ২০২০। যদিও প্রতিটি মন্দার প্রকৃতি ও ধরনই একে অন্যের চেয়ে পৃথক, তবে তাদের মধ্যে মূলগত সাদৃশ্য আছে।
করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়েছে
মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে। জ্বালানি, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ
দ্রুত কমে আসায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জ্বালানির দাম উর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়েছে, ফলে
মুদ্রাস্ফীতিও আকাশছোঁয়া। তাছাড়া বিশ্ব বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, জোগান বা
সরবরাহে ছেদ এবং আন্তর্জাতিক চাহিদার ক্রমাবনতি বাংলাদেশের চলতি হিসাবখাতের ঘাটতিকে প্রশস্ত
করেছে, টাকার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে এবং চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ফলে দারিদ্রের উপর
মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া, বিশ্ব
বাজারেও একটা অর্থনৈতিক মন্দা ও
অনিশ্চয়তার পরিবেশ বাংলাদেশের লেনদেনের হিসাবখাতকে বেশ চাপে রেখেছে।
সাম্প্রতিককালে কিছু তথ্যকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মন্দার
সূচক রূপে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, স্থূল জাতীয় উৎপাদনের গতির শ্লথতা (৭.২ শতাংশ থেকে
৫.২ শতাংশে অবনমন), রফতানি এক লাফে ২৩.২ শতাংশ (২০২২) থেকে হ্রাস পেয়ে (-)৭.২ শতাংশ (২০২৩) নেমে আসা, ভোক্তার
মূল্য সূচক (CPI) ৬ শতাংশ (২০২২) থেকে বেড়ে ৮.৯ শতাংশে (২০২৩) পৌঁছে যাওয়া। সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি আনুমানিক ৯.৫ শতাংশ (বছর থেকে বছর)- যা এই দশকে সর্বোচ্চ। চলতি খাতে
ঘাটতি স্থূল জাতীয় উৎপাদনের ১.১ শতাংশ (২০২১) থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.১ শতাংশে (২০২৩)। মুদ্রা
তহবিলের সঞ্চয় মার্কিন ডলারে ৪০.৭ বিলিয়ন (২০২১) থেকে কমে ২৫.৭ বিলিয়ন (২০২৩) হয়েছে। মধ্য ও দীর্ঘকালীন ঋণের বোঝা ৬.৯ বিলিয়ন (২০২১) থেকে বেড়ে আনুমানিক
১১.৭ বিলিয়নে (২০২৩) পৌঁছবে। মোট কেন্দ্রীয় সরকারি ঋণ স্থূল জাতীয় উৎপাদনের ৩৫.৬ শতাংশ
থেকে বেড়ে ৪২.২ শতাংশে পৌঁছনোর আশঙ্কা।
অতীতে দারিদ্র দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও
বাংলাদেশ আজ যে চ্যালেঞ্জগুলির সম্মুখীন তার অন্যতম ক্ষেত্রগুলি হল মানবসম্পদের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ও ঝুঁকি হ্রাস। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের
ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বারংবার ধাক্কা খেয়েছে এবং তার জেরে বিদেশি
মুদ্রা তহবিল ক্রমশ খালি হয়েছে আর তা দরিদ্র সম্প্রদায়ের চাহিদার উপর ঋণাত্মক
প্রভাব ফেলেছে।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থায়নের ফাঁক
(Financing Gap) প্রায় ২২১৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক
মুদ্রা ভাণ্ডার থেকে মিলবে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্কের থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন
ডলার ও বাকি ১০১৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক ঋণের
মাধ্যমে আসবে। এখন প্রশ্ন হল, এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশের
অর্থনীতি কি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
একদা কৃষি-নির্ভর নদী-মাত্রিক এই বাংলাদেশ দারিদ্র, খরা ও
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শিশু মৃত্যুর হারের
পতন, নারী শিক্ষার প্রসার (৭৩ শতাংশ) ও বেতনভুক নারীর কর্মক্ষেত্রে যোগদানের মাত্রা ৪ শতাংশ
থেকে বেড়ে আনুমানিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছছে। এর মূল কারণ অবশ্যই বস্ত্র শিল্পের
অভাবনীয় সাফল্য। তাই অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন যে বাংলাদেশের এই শ্লথতা
একটি স্বল্পকালীন পরিস্থিতি যার মূল কারণ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রা তহবিলে টান ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ত্রুটি। তবে
তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ শীঘ্রই এই শ্লথতা কাটিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে।
বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড: সেলিম রেহানের মতে, বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কর কাঠামো, বৈদেশিক
বাণিজ্য নীতি, মূলধনের বাজার ও মুদ্রা
বিনিময় হারের দ্রুত সংস্কার প্রায়োজন, যা বহু দিন যাবৎ অসম্পূর্ণ। এইগুলির সাথে দরকার খরচ
কার্যকর প্রকল্পগুলির দ্রুত সমাপ্তি। মূলধনের তহবিল ২০২২'এর প্রথম দিকে ছ' মাস
আমদানির খরচের সমতুল্য হলেও তা এখন হ্রাস পেয়ে প্রায় তিন মাসের আমদানির সমান।
বাংলাদেশের রফতানির দুটি প্রধান জায়গা হল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। তাই, রফতানির
দ্রুত সংস্কার করতে গেলে সার্ক গোষ্ঠীর দেশগুলির সাথে সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্যে ও ASEAN (দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার দেশগুলি)'এর উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি আর একটি বড় চিন্তার কারণ। কিন্তু
তেলের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাড়লেও আশা করা যাচ্ছে যে বিশ্ব বাজারে
মন্দার ফলে অদূর ভবিষ্যতে তেলের দাম কিছুটা হ্রাস পাবে। তাই মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা
আয়ত্তের মধ্যে চলে আসবে। মূলধনের বিনিয়োগ যা করোনা কালে দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল,
তা পুনরুদ্ধারের পথে কিছুটা এগিয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় ২৫৯১ মার্কিন ডলার থেকে
বেড়ে ২৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছনোর পথে। তাছাড়া, বাংলাদেশের ঋণ বৃদ্ধির হার প্রায়
১২ শতাংশের কাছে যা দ্রুত শিল্প অগ্রগতির সহায়ক হয়ে উঠবে বলে অনেকেই আশাবাদী।
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান দুই দেশই চিনের অর্থনৈতিক ঋণের
জালে জড়িয়ে ক্ষতির সম্মুখীন। বাংলাদেশও কোভিড পরিস্থিতি থেকে বেরনোর জন্য চিন, আমেরিকা ও বিশ্ব
ব্যাঙ্কের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার সুদের বোঝা বিশাল আকার ধারণা করেছে।
বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্য আজ বিপদের সম্মুখীন। ব্যাঙ্ক প্রতারণা, রাজনৈতিক
অস্থিরতা ও বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার সাথে চুক্তির ভিত্তিতে পরিকাঠামোগত সংস্কার এবং
বহু উন্নয়নমূলক প্রকল্পে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি (যা বহু প্রকল্পের খরচ প্রচুর
বাড়িয়ে দিয়েছে)- এই সব কারণে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশকে ঋণ
দেওয়ার সুবাদে চিন ও আমেরিকা তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বদ্ধপরিকর। ভারতের
ভূমিকা নীরব দর্শকের মতো হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই ভারত অবশ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পরপর
অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হওয়া কি ঈষান কোণে কোনও অশনি সংকেতের বার্তা বয়ে আনছে? এখন এটাই দেখার।
No comments:
Post a Comment