Wednesday 10 May 2023

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জুজু?

রথী-মহারথীরা কি ভয় পাচ্ছেন?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘গডফাদার’ বলে কথিত জেফ্রি হিন্টন গুগল থেকে পদত্যাগ করেই এক বিপদঘন্টা বাজিয়েছেন। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও প্রয়োগ যেদিক পানে এগোচ্ছে তাতে মানবজাতির মহাবিপদ আসন্ন। অনেকে ভেবেছেন, তিনি বলতে চেয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বগ্রাসী দখলদারি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছে, যেখানে এই ভুবনের ওপর মানুষের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না; অচিরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মেশিন সমূহ সমস্ত কিছুর দখল নিয়ে নেবে। অনেকটা হলিউডি ছবির আদলে।

প্রথমেই এটা স্পষ্টত বুঝে নেওয়া দরকার যে, হিন্টন এমন ধরনের কোনও কথা বলেননি। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত ক্ষমতার কথা উদ্ভাসিত করেছেন, তার অসাধ্য সাধনের কীর্তিরও উল্লেখ করেছেন এবং আচম্বিত অদ্ভুতুড়ে আচরণের গল্প কবুল করেছেন। কিন্তু তিনি এমন কথা কখনও বলেননি যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত যন্ত্রেরা মানুষের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির চালকের আসনে বসে যাবে। হিন্টন বরং আমাদের সতর্ক করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও প্রয়োগ যদি মন্দ লোকের হাতে পড়ে, তাহলে এর ব্যবহার এমন ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক পরিসরে পৌঁছতে পারে যে, সে ক্ষেত্রে তেমন পরিস্থিতিতে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা এবং তার থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব এক ব্যাপার হয়ে উঠবে। তাই, তাঁর অভিমত, অবিলম্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গবেষণা আমাদের স্থগিত রাখা উচিত। কিছুদিন আগে কয়েকজন গবেষকও এমনতর নিদান দিয়েছিলেন, যেখানে তাঁদের আবেদন ছিল, এ সংক্রান্ত গবেষণা যেন অন্তত ছ’ মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয়।

বিশেষজ্ঞরা যখন এমনতর আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তখন অন্তত এটুকু অস্বীকার করার আর কোনও উপায় নেই যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ সমাজব্যবস্থা পরিচালনায় এক কেন্দ্রীয় অভিমুখ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং রাজনীতি-অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। যদিচ, এমন কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি বা তার সম্ভাবনাও দেখা দেয়নি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার স্রষ্টা মানুষটিকে ছাপিয়ে কোনও কিছু করে ফেলতে সক্ষম। চ্যাটজিপিট৪ আসার পরে অনেকেই এর অন্তর্জাত ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে এইসব যন্ত্রানুষঙ্গের কিছু ‘অদ্ভুতুড়ে’ আচরণে চমকিত ও আশঙ্কিত হয়েছেন, কিন্তু এই কথাটা নির্দ্বিধায় বলাই যায় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত কোনও যন্ত্রই এখনও ‘অনুকূল’ (সত্যজিতের গল্প) হয়ে ওঠার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। আদৌ পারবে কিনা, সে প্রশ্নটিও অতএব থেকে যাবে রহস্য-রোমাঞ্চের আবেশ নিয়ে।

কিন্তু কথা হল, তাহলে বহু গবেষক ও রথী-মহারথীরা এমন আশঙ্কার কথা বারবার শোনাচ্ছেন কেন? ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, তথ্য প্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল জগতে হাজারে হাজারে কর্মী ছাঁটাই হয়ে চলেছে। কগনিজেন্ট’এর মতো সংস্থা প্রায় দেউলিয়া ঘোষণার পথে। মাইক্রোসফট, গুগল’এর মতো দৈত্যাকার কোম্পানিগুলিতে পর্যন্ত কর্মী সংকোচনের হিড়িক পড়ে গেছে। 

এর অন্যতম কারণ দুটি: এক) কোভিডের সময়ে ডিজিটাল দুনিয়ার অতি প্রসারের ফলে বহু অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সেই মেদ এখন ঝরানোর সময়;  দুই) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও অগ্রগতির ফলে বহু কাজে মনুষ্যশ্রমের আর দরকার পড়ছে না এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে থাকবে। এমতাবস্থায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও অগ্রগতিতে খুব স্বাভাবিক যে কাজের জগতে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। তা শুধু সাবেক সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এর দৌড় আরও বহু দূরে প্রসারিত ও পরিব্যাপ্ত। এখানেই সম্ভবত আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে উঠছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিব্যাপ্তি কত দূর অবধি বিস্তৃত, তার হদিশ পেতে ইতিমধ্যেই বড় বড় প্রযুক্তিবিদদের কালঘাম ছুটেছে। তার ওপর বহু দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের হাতে পড়ে ডার্ক ওয়েব এখন এক বৃহৎ শিল্পে পরিণত হয়েছে। হ্যাকাররা আরও উন্নত সজ্জায় সজ্জিত। প্রতারকেরা নিত্য নতুন ফাঁদ পেতে লুঠতরাজের এমন এক দুনিয়া গড়ে তুলেছে যে বড় বড় কর্পোরেট ও রাষ্ট্রসমূহও তাদের দাপটে আজকাল রীতিমতো শঙ্কিত। কিছুদিন আগে এইসব বিষয় নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে একটি উচ্চপর্যায়ের মিটিং ডেকেছিলেন। সেখানে কী আলোচনা বা ফয়সালা হল তা অবশ্য আর কিছু জানা যায়নি। 

মোদ্দা কথায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে মনুষ্য জ্ঞান, দক্ষতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা এতটাই হস্তান্তরিত হয়েছে যে, সেইসবকে ব্যবহার অথবা খানিক উন্নত করে ও ঘটের কিছু বুদ্ধি খরচ করে দিব্যি বহু অসাধ্য সাধন করে ফেলা অসম্ভব কিছু নয় আর। যেমন, চ্যাটজিপিটি৪ থেকে নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে অথবা তার সহযোগিতায় ভাল-মন্দ নানাবিধ ‘কাজের কাজ’ সেরে ফেলা সম্ভব। আর এই বিন্দুতেই শুরু হয়েছে সোরগোল। দুনিয়ার অন্যতম বাণিজ্য অধিপতি ওয়ারেন বাফেট সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পারমাণবিক বোমার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এলন মাস্ক’এর কথা সবসময়ে ততটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে আসছেন। এঁদের অন্যতম একটি আশঙ্কা হল, AI (Artificial Intelligence) হয়তো পরিণতি পেতে পারে ASI (Artificial Super Intelligence)’তে, অর্থাৎ, সে প্রকারান্তরে মনুষ্য বুদ্ধিমত্তার প্রায় সবটাই আয়ত্ব করে ফেলে এক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনে রূপান্তরিত হবে। কতকটা কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনালেও এই আশঙ্কাতেই এখন বড় বড় কর্পোরেটপতিরা দিনাতিপাত করছেন।

তবে এরই মাঝে আমাদের ঘরের মানুষ নারায়ণমূর্তি কিন্তু গত মার্চে ন্যাসকম’এর একটি সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতশত কিছু করার ক্ষমতা নেই। কারণ, মানুষের মন হল সব থেকে অধিক নমনীয় এমন একটি সত্তা, যা প্রযুক্তির অগ্রগতির থেকে আরও বেশি এগিয়ে থাকতে ও সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারদর্শী। তাঁর মতে, ১৯৭৭-৭৮ সালেও এমন কিছু programme generators এসেছিল যা দেখে অনেকেই প্রভূত কর্মচ্যুতির সম্ভাবনা ভেবেছিলেন। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। বরং তিনি চ্যাটজিপিটি’র ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন যে এটিকে ভিত হিসেবে গণ্য করে আমাদের আরও বেশি সৃজনশীলতা দেখানো ও আরও বড় সমস্যা সমাধানের পথে এগোনো উচিত; চ্যাটজিপিটি হোক কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মানুষকে সর্বতোভাবে প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা এদের কারওরই নেই। কতকটা দার্শনিক অবস্থান থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে এমনতর কথা পদার্থবিদ রজার পেনরোজ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Emperor’s New Mind’এ (১৯৮৯) বলেছিলেন। তাঁর স্পষ্ট মত ছিল, মানুষের যে বিচিত্র বিচার ক্ষমতা (Judgemental Ability) তা অর্জন বা ধারণ করার সামর্থ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কখনও হবে না। কারণ, এই ক্ষমতার অন্তর্নিহিত চেতনা এমন একটি অস্তিত্ব বা সত্তা যা শুধুমাত্র মনুষ্য-অর্জন সাপেক্ষ। অবশ্য এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আজও চলেছে।

কিন্তু আমূল এক রূপান্তর যে চোখের সামনে ঘটে চলেছে তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। নিঃসন্দেহে সে রূপান্তর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এখনও পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় এমন কোনও মনুষ্য-চেতনা সম্বলিত ক্ষমতাধারী করেনি যা ওয়ারেন বাফেট বা এলন মাস্ক’এর শঙ্কাকে বাস্তবায়িত করে তুলতে পারে। তা এই মুহূর্তে মানুষের একটি ব্যবহারযোগ্য যন্ত্র হিসেবে, অবশ্য দানব হয়ে ওঠার বাস্তবতাকে সঙ্গে করেই, বিরাজমান। এ পর্যন্ত অনুমান, সেই দানব কখনই মনুষ্য-নাগালের বাইরে গিয়ে স্বয়ম্ভু হতে পারবে না।

উল্লেখ্য, ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ প্রকাশিত ‘দ্য ফিউচার অফ জব রিপোর্টস’ (‘ভবিষ্যতের কাজের হদিশ’) বলছে, সমীক্ষালব্ধ ৭৫ শতাংশ শিল্প বা বাণিজ্য সংস্থা আগামী দিনে মূলত বিগ ডাটা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেই প্রযুক্তি হিসেবে গ্রহণ করার পথে এগোচ্ছে। কিন্তু এইসব প্রযুক্তির অবলম্বন কর্মসংকোচনের পরিবর্তে সামগ্রিক ভাবে কর্ম-প্রসারের পরিমাণকে আখেরে net positive করে তুলবে বলে তাদের অনুমান। অস্যার্থ, নতুন নতুন প্রযুক্তির আবাহনে বহু লোকের কাজ চলে যাবে বটে, কিন্তু নতুন কাজের সৃষ্টি হবে আরও অধিক পরিমাণে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ফোরামের মতে, দুটি প্রযুক্তি আগামী পাঁচ বছরে আদতে নতুন কাজ সৃষ্টি করবে: মনুষ্যরূপী রোবট এবং অ-মনুষ্যরূপী রোবট

কিন্তু তবুও রথী-মহারথীদের শঙ্কা একটা থাকছেই। তা হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বজনীনতা অর্জনের যে পথ তৈরি হয়েছে সেখানে যে কেউ চাইলেই তার সহায়তা বা উপযোগিতা সহযোগে (চ্যাটজিপিটি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত) নানারকম অঘটনও ঘটিয়ে দিতে পারে। ব্যবসার জগতেও ওলটপালট ঘটে যাওয়াটা কোনও অসম্ভব ব্যাপার নয় আর। আজ যে বিলিয়নপতি, কাল সে দেউলিয়া হয়ে পথের ধারে বসে পড়তে পারে। কোনও এক অজানা প্রান্তর থেকে পথের মানুষটি উঠে যেতে পারে বিলিয়নপতিদের দঙ্গলে। এই ‘অদ্ভুতুড়ে’ ওঠানামার খেল দেখানোর ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আছে, তবে তা মনুষ্য-বুদ্ধির সাহচর্যেই। কোন মানুষটি কোথায় বসে কী ছক কষছে, তা জানারও যেমন উপায় আছে, আবার তা লুকিয়ে রেখে এগোনোর কলকব্জাও সমান তালে সচল। এখানেই এর আমূল রূপান্তরের সক্ষমতা আর ওয়ারেন বাফেট, এলন মাস্ক’দের সত্যিকারের শঙ্কা।

  

3 comments:

  1. পড়ে বেশ লাগলো। নতুন প্রযুক্তি প্রায়শই আশা আর আশঙ্কা দুয়েরই জন্ম দেয়। আমরা ব‍্যবহারের শুভবুদ্ধিতে ভরসা রাখি।

    ReplyDelete
  2. উত্তম ভট্টাচার্য10 May 2023 at 22:08

    আগামী দিনের প্রযুক্তি নিয়ে চর্চা খুব প্রয়োজনীয় । লেখক অনেক আগে হতে ই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বিষয়ে ,তার আতংক জনক দিক নিয়ে আমাদের অবগত করে চলেছেন এবং গভীরভাবে দেখা জন্য সজাগ করে চলেছেন। আমরা তাঁর আলোচনা হতে প্রভুত ভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছি। পাঠক হিসাবে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। আরো প্রশ্নএর দিকে তাকিয়ে আছি।

    ReplyDelete
  3. Human excellence will reach the highest level

    ReplyDelete